লিখেছেন: দেবাশিস ভট্টাচার্য
একটা সময় ছিল যখন ভাববাদী বা আদর্শবাদী হওয়াটাই স্টাইল ছিল। বিশেষ করে উনবিংশ শতকের পরের দিকে বা বিংশ শতকের গোড়ায়। আমাদের দেশ তখন ইংরেজের অধীনে, যার ভাল খারাপ দুই দিকই ছিল। ভাল বলতে একটা মাথার উপর রবীন্দ্রনাথের পিতার মডেলে বিশ্বপিতা, এরকম একটা বোধ। সাধারণ লোকের মনে ঐতিহ্য সংস্কারের প্রভাব ছিল গভীর। হ্যাঁ রামমোহন বিদ্যাসাগর বা অনেক বিলেতে পরিযায়ী ভারতীয় ছিল যারা বেড়া টপকে ওদিকে কি আছে দেখতে আগ্রহী। কিন্তু সংখ্যায় তারা নগণ্য। ভারতবাসী ও তাদের ঔপনিবেশিক প্রভুরা সাধারণভাবে রক্ষণশীল ছিল। বিশেষ করে ইংরিজি শিক্ষার আলোয় আলোকিত ভারতীয়। সেই কালে একটা নিশ্চিন্ত ভাব ছিল যা আমাদের শিক্ষিত বাঙ্গালী সাহিত্য ও সমাজ নেতাদের রচনায় চোখে পড়ে। মোগল যুগের শেষের দুর্বিষহ সমাজ প্রবর্তন যাতনা মুছে গিয়ে এক “ চির বন্ধু চির নির্ভর হে সখা” গোছের আবহ নির্মাণ হয়ে উঠছিল। রামমোহন বিদ্যাসাগর নিপীড়িত যা হবার হয়েছেন স্বদেশবাসীর কাছে। যে স্বদেশবাসী তখনো মোগল প্রাক ব্রিটিশ সিনড্রোমে ভোগে। ঢপ পাঁচালি হাফ আখড়াই নিয়ে দাঁতে মিশি কাঁধে উড়ুনি মুখে পাখি বুলি নিয়ে ভবানিপুর বাগবাজারের গাঁজার আড্ডা সরগরম করে। পালা পাব্বনে নৌকোবোঝাই ফরাসি ব্র্যান্ডি আর ইয়ারদের নিয়ে ফুর্তি করতে গঙ্গাবিহার করে, সঙ্গে দুচারটি আনন্দদায়িনী আলহাদিনি বারবিলাসিনীও যায়। কিন্তু শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষও ছিল, বাড়ছিল, যারা বিতর্ক করে ইংরিজিতে, পয়সা দিয়ে কিনে মনিষীদের বই পড়ে, প্রশ্ন করে পুরাতন প্রথার বিষয়ে, নিষিদ্ধ মাংস ভোজন করে, আবার ব্রাহ্ম হয়ে পৈতে ফেলে নিরাকারের উপাসনায় মত্ত হয়। শিবনাথ শাস্ত্রী সতের আঠারো বছর বয়সে ব্রাহ্ম হয়ে যখন তাঁর গ্রামে এলেন তাঁকে দেখতে যারা ভিড় করত তারা তাঁর সমকালীন হয়েও আসলে অনেককাল আগের বাঙ্গালী। মন্দ দিক বলতে ছিল কাপ্তানি, পল্লবগ্রাহিতা, অর্থনৈতিক শোষণ।
সেই যুগের রচনাবলী পড়লে মনে হয় মুক্তমনা মানে প্রাচীন ধর্মের বিরোধ করা। আরেকটা জিনিশ মনে হয়, যে কথা দিয়ে নিবন্ধ শুরু করেছিলাম, আমাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তখন এক ভাবরাজ্যে বিচরণ করতেন, ভাব আদর্শ বিভিন্ন দর্শনশাস্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মিলন বিচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের মনোযোগ যতটা ছিল সমাজের বৃহত্তর দিকে প্রয়োগের দিকে ততটা ছিল না। এইকথাই নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, আগের ঐতিহাসিকরা লিখেছেন রাজন্যবর্গের ইতিহাস উচ্চ জাতপাতের মানুষের ইতিহাস বৃহত্তর বাঙ্গালী জাতির তৃণমূল ইতিহাস কেউ লিখে যান নি। এই কারণেই হিন্দু মুসলমানের সাহিত্য সমাজ বৌদ্ধিক জীবনে এত দুস্তর প্রভেদ। যেটা ঐতিহাসিক। কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম পেঁচা অবশ্য নাগরিক জীবনে ইতরজন সম্বন্ধে কয়েক পাতা লিখেছেন। নীল দর্পণকেও ভুলে যাচ্ছি না। অবশ্যই মনে পড়ছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে যিনি সবচেয়ে নিচের থাকের অর্থাৎ স্ত্রীলোকের বেদনা নিয়ে মধ্যরাতে অনেক তেল পুড়িয়েছেন, উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহের জুজু ডেকে এনে বিভীষিকার সৃষ্টি করেছিলেন। এই বিদ্যাসাগরই আবার ছাতুবাবুর দৌহিত্র শরতচন্দ্র ঘোষের প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল থিয়েটারের পরিচালক সমিতি ছেড়ে দেন সেখানে পতিতাদের দিয়ে অভিনয় করান হচ্ছিল বলে। মনে রাখা দরকার পতিতাদের নাট্যমঞ্চে নিয়ে আসার মূলে ছিলেন ধর্মান্তরিত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েদের ভূমিকায় মেয়েরাই অভিনয় করুক, তাঁর বিবেচনায় কে পতিত কে নয় ভেদ ছিল না, ইয়ে, পানাসক্ত মানুষ হলে যা হয় আর কি।
মধুসূদনের কথায় মনে পড়ে গেল যে তিনি ডিরোজিওর আদর্শ চ্যালাই ছিলেন বটে। অর্থাৎ মুক্তমনা। ভাববাদের রাজ্যে এক বিদ্রোহী। তা না হলে অমিত্রাক্ষর ছন্দ নির্মাণ করে রামের গুষ্টি নাশ করেন আর রাবণকে নায়কের সিংহাসন দেন? আজকের রামপন্থীরা তো তখনো ছিল, ছিল না? যাদের জীবনে রাম মন্দির আর বাবরি মসজিদ নিয়ে সমস্যাটাই মূল তাদের রাজত্ব তখন দেশে একচেটিয়া। তাদের সমঝে চলতে হয় স্বয়ং ব্রিটিশ সিংহকেও। সতীদাহ বিলোপ করতে রামমোহনকে কম বেগ পেতে হয়েছে? স্বয়ং রাধাকান্ত দেব বিরোধীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক প্রগতিবাদী চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন।
বিদ্যাসাগর সংশয়বাদী ছিলেন, ভাবা যায় না। যদিও ব্যক্তি জীবনে মায়ের শ্রাদ্ধ করেছেন। আবার একই সঙ্গে প্রকাশ্যে হিঁদুয়ানির ঘটাকে উপহাস করার শক্তিও তাঁর ছিল। একবার ছোকরা শিবনাথ শাস্ত্রীর সামনে এক বয়স্ক পাদ্রীকে যা হেনস্তা করেছিলেন। পাদ্রীটি তাঁকে চেনে না, দেখতে তো অনেকটা আমার মত মানে ও তো গয়া গোছের ঝটতি পড়তি চেহারা আর কি, তা পাদ্রী যখন হিন্দু ধর্মের উপর আক্রমণে প্রবৃত্ত তখন বিদ্যাসাগর তাঁকে বলেন ও মশাই এসব কথা ছেলে ছোকরাদের কেন বলেন, আমায় বলুন, বুড়ো মানুষ, সারাজীবন বিস্তর বদমায়েশি করে এখন মনে হয় একটু ধম্মকথা শুনি, পাদ্রী মহোৎসাহে তাঁকে জ্ঞান দিতে শুরু করতে একটু পরেই বিদ্যাসাগরের ঠাট্টা তামাসায় উত্যক্ত হয়ে বিষম চটে গেলেন। যা নয় তা বলে গাল দিয়ে চম্পট দিলেন। বিদ্যাসাগর হাসতে হাসতে মরেন। তাঁর রোগ ছিল হাসতে হাসতে চোখে জল এসে যাওয়া। তিনি প্রায়ই বলতেন, ধর মরার পর যমরাজা যদি আমায় পাপের জন্য দশ ঘা বেত শাস্তি দেয় তো পুরুত পাদ্রীদের দেবে একশো ঘা বুঝলি। কেন বল তো? কারণ আমি ঈশ্বর ধর্ম বুঝি না জানিয়ো না তাই ওসব নিয়ে বক্তিমেও মারাই না, আর এরা কিচ্ছু না বুঝে না জেনে সারা জীবন লেকচার দিয়ে যায়, তো এদের বেশি শাস্তি দেবে না বল?
গল্পটা চলতে থাকবে। মানুষের চিন্তা ভাবনার গহন জগতটি তো একটি খোলা পথ। মুক্তমনা কেউই সঠিকভাবে নয়। বার্ট্রান্ড রাসেল বা জ্যাঁ পল সাঁত্রে কেউই একশো ভাগ যুক্তিবাদী বোধহয় ছিলেন না। আমাদের গহন অন্তর্জগতে অবচেতনায় অনেক শতাব্দীর অনির্ণীত আবেগ প্রবৃত্তি রহস্যময় সংস্কার জমা হয়ে আছে। আন্দামান বা আফ্রিকার আদিম প্রজাতি আমাদের মধ্যে বাস করে, কিন্তু মুক্ত পথের মুক্ত চিন্তার পথিক এইসব অরণ্যের মধ্যে জোর করে পথ কেটে এগিয়ে যায়। প্রায়ই নিন্দিত হয় অপপ্রচারের শিকার হয়, প্রাণসংশয়ও হয়। কিন্তু মুক্ত চিন্তার স্রোতের টান হয়তো বা সেই অদ্ভুত ঈশ্বরেরই মত রহস্যময়; স্পিনোজা যে ঈশ্বরের কথা বলতেন, আইনস্টাইন যে রূপকটিকে ভালবেসে ফেলেছিলেন।
আলোচনা শুরু হয়েছিল আমাদের পিতামহ চিন্তা পথিকদের নিয়ে। তাঁদের আদর্শবাদ নিয়ে। বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ উভয়ের অনেক প্রভেদ, কিন্তু তাঁরা দুজনেই সনাতন আদর্শের অনুসারী, বঙ্কিম কৃষ্ণচরিত্র আর রবীন্দ্রনাথ জীবনদেবতার মধ্যে তাঁদের সব পেয়েছির দেশ আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা মহান মানুষ ও মহৎ সৃষ্টিকর্তা ছিলেন। নিজেদের জীবনে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করে নিজেদের পথ কেটে এগিয়ে গেছেন। অন্ধকার ভেদ করে। কতটা সফল হয়েছেন বিচার করতে গেলে মুস্কিলে পড়তে হবে। তাঁদের সমাজের ফসল হিসেবে তাঁদের কর্মের একরকম বিচার। আবার সমাজবিপ্লবী হিসেবে আরেকরকম। আমার মনে হয় এই উভয় ধারাকে নিয়ে স্বীকার করে তবেই হয়তো খানিকটা মূল্যায়ন করা সম্ভব।
এই আলোচনা শেষ করব মার্ক্সবাদী চিন্তাশীল নট নাট্যকার পরিচালক উৎপল দত্তের লেখা গিরীশ ঘোষের জীবনী গ্রন্থের উল্লেখ করে। উৎপল আমাদের এখনকার বিচারে নিঃসন্দেহে মুক্তমনা ছিলেন। আশ্চর্যজনক ভাবে রামকৃষ্ণভক্ত ভক্তিপরায়ণ গিরিশচন্দ্রকে তিনিই আবার যুক্তি ও সমাজ অনুসন্ধিৎসু হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। গিরীশও ছিলেন নট নাট্যকার কবি,পানাসক্ত। তাঁর নাটকগুলি মহাকবি রবীন্দ্রনাথের তুলনায় একেবারে অন্যজাতের। তাঁর দর্শক ছিলেন বাবু বাঙ্গালীর সঙ্গে সঙ্গে অগণিত নিম্ন শ্রেণির বাঙ্গালী। হিন্দু মুসলমান উভয় চরিত্র নিয়ে ছিল তাঁর কারবার। নাটক ও নাট্যমঞ্চ এই ছিল তাঁর প্যাশন। মুক্ত চিন্তার জন্য মুক্তি পথের পথিক হতে গেলে কতগুলো ভিতরের শিকল তো ভাঙতেই হয় তাই না? নাটকের নট নটী তো সেই সময়ের সামাজিক পতিত পতিতারই পুনর্নির্মাণ।
অবশ্যই , তবে ধর্মের সঙ্গে ঈশ্বর এক করে ফেলবেন না দয়া করে ।
ধর্ম না থাকলেও ঈশ্বর থাকবে ।
মন্দ পেলেন কোথায় ভায়া, এ সবই তো গৌরব করবার মত সময়ের কথা। ইয়াং বেঙ্গলের গৌরব গাঁথা। মুক্তমনাদের স্বর্নযুগ। এই সময়টা যদি ধরে রাখা যেত তা’হলে হয়তো আজকের মৌলবাদের শেকড় এতোটা গভীরে যেতে পারতো না। ব্রাহ্ম সমাজ’ও মুক্তমন ছেড়ে ধর্মাক্রান্ত হতো না। শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষরা বিতর্ক করে বেড়াতো, বই কিনতো, লাইব্রেরিতে যেত, প্রশ্ন করতো, প্রথাকে করতো চ্যালেঞ্জ, কিন্তু না; তা হলো না। ঠাকুরসম শক্তিও আপোষ করলো; ওই ব্রাহ্ম সমাজ হয়ে গেলো ব্রাহ্ম ধর্ম। হায় ডিরোজিও; ওরে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, মরবার আর সময় পেলি না?
ভাল বলেছেন কাজী। ডিরোজিও মারা গেল কিন্তু রেখে গেল এথেনিয়াম ক্লাবের স্মৃতি, রেখে গেল আগুনখোর একদল যুবা – দক্ষিণারঞ্জন মধুসূদন গৌর রামতনু লাহিড়ীদের, যারা ভবিষ্যতে বুড়ো হয়েও সেই তর্কের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে। আমার মনে হয় এই স্বর্ণযুগ ( ঠিকই বলেছেন, সাংস্কৃতিক স্বর্ণযুগ তো বটেই, বা স্বর্ণযুগের শাঁখে ফু ) শুধু পাঠ তর্ক স্বপ্ন বিনিময়ের নয়। এ পথের পরবর্তী পর্যায় হতে পারত মার্ক্সিয় প্লাটফর্ম, যেখান থেকে পরবর্তী গন্তব্যের ট্রেনটি ছাড়বে। আমাদের উপনিবেশ অপশাসনে ক্লিষ্ট শ্রেণী ধর্ম জাত পাতের তালি দেয়া ভারতবর্ষে তাই এল দুর্ভিক্ষ ( অন্নের এবং চিন্তার) এল মন্বন্তর এল দেশভাগ দাঙ্গার শোণিত উৎসব। বাম চিন্তা উপনিবেশিক ও পরবর্তী মিথ্যে গণতন্ত্রের লাল ফিতের ফাঁসে ফাঁসি গেল। অথচ কাজী বৃহত্তর সাম্যবাদী গণতন্ত্র না এলে চিন্তার মুক্তি কি করে সম্ভব?
যেমন ঘটনার ইতিহাস হয় বা দুর্ঘটনার তেমনি চিন্তার ইতিহাসও রচনা করা জরুরি। এই রচনাটি একটি পদক্ষেপ মাত্র। পড়ে ভাল মন্দ সহমত দ্বিমত জানালে চিন্তার সামান্য চর্চা হতে পারে। সেটাই লাভের।