রতনপুর টু ফোর্ট মায়ার্স
লুনা শীরিন
ছোট টয়োটা ক্যামরী গাড়িটা ছুটছে,বড়দিনের মায়াবী দুপুর, চারিদিকে শীতের নরম রোদ। ফ্লোরিডাতে বড়বোনের বাড়িতে এসেছি আজ ৮ দিন পার হচ্ছে, এই প্রথম আমরা পরিবারের সবাই ব্যক্তিগত কাজের বাইরে দিন কাটাবো বাইরে বলে বের হয়েছি। ফোর্টমায়ার্সের প্রশস্ত রাস্তাটা আজ অনেকটাই ফাঁকা ফাঁকা, চারিদিকটা একটু নিরিবিলি বলেই প্রকৃতিকে আরো অপরূপ লাগছে, গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা আমাদের সবচেয়ে ছোটবোনের বন্ধু বাবু, আজকের দিনের পুরো দায়িত্ব ওর ঘাড়েই, ওই ই আমাদেরকে আজ ট্রিট করবে বলে কথা হয়েছে। প্রায় ৮ বছর হলো দেশ ছেড়েছে বাবু, নানান পথ পেরিয়ে এখন আমেরিকার মাটিতে ওর শক্ত ঘাটি, কিছুক্ষন পর পরই বলছে, ‘আপা ইউ কান্ট বিলিভ, ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হাউ রিসোর্সফুল ইজ আমেরিকা, ডু ইউ নো হাউ মেনি এয়ারপোর্টস ইন আমেরিকা? ইউ পিপল ডোন্ট নো এনিথিং, এনিথিং, বলতে বলতে বাবু হারিয়ে যায় আমেরিকার মোহে, বৈভবে।
আমার দৃষ্টির সীমানার ভিতর তখন আমেরিকা, আমেরিকা, আমেরিকা। সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে যে দেশটির দিকে, সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নাগরিকের স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। আমি এমন বহু বহু মানুষকে (দেশী এবং বিদেশী) গত কয়েক বছরে কাছ থেকে দেখেছি যারা দেশে যাবার অপেক্ষা করে কাটিয়ে দিয়েছে কম করে হলেও ২০ বছর, নিজ দেশে যেসব মানুষদের এই প্রবাসীদের অপেক্ষাতে থাকার কথা ছিলো আজ তারাই এই মানুষগুলোর ডলারের ও বৈভবের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে, আর দেশ থেকে একবার আসা এই মানুষগুলোর জীবন থেকে কেটে গেছে দিন/মাস/ঘন্টা/যুগ। একবার আমেরিকাতে ঢুকেছে তো এখানেই জীবন বয়ে গেছে, কারো হযতো বাবুর মতো স্বপ্নের ঘোরে আবার কারো চরম অনিশ্চয়তার ভিতর দিয়ে। কিন্তু সবাই তাকিয়ে থেকেছে আমেরিকার রিসোর্স আর বিত্তের দিকে। যত দিন গেছে তাদের অপেক্ষা বেড়েছে, আজ না কাল, কাল না পরশু তারা স্বপ্ন দেখেছে এইদেশে একদিন সেটেল হবে, কিন্তু সেটেল হবার চেয়েও বেশী তারা থিতু হয়েছেন। এই গল্প শুরু করলে লেখা শেষ হবে না কোনদিন, তাই আমি পাশের জেনারেশনকে দেখি, বাংলাদেশের তরুন ছেলে ডাক্তারী শেষ করে আমেরিকা এসেছিলো, পথ ওর জন্য সহজ ছিলো না তবুও বাবু থামেনি। আমেরিকাতে নিজেকে গড়ে তুলবে বলে কাজ থেকে দেশে যাবার কথা বলে ছুটি নিয়েছে, তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়াশুনা করেছে মাসের পর মাস, ৭ ঘন্টা অড জব করে বাকী ৮ ঘন্টা টানা পড়াশুনা, অমানবিক পরিশ্রম করে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে ,আমি অবাক হয়ে বললাম, তুই তো এতো ভালো ছিলি না দেশে। সারাদিন তো আড্ডা মারতি, ও বলে, কিসের সাথে কি তুলনা আপা? দেশ আমারে কি দিছে? রাখেন আপনার দেশ, দ্যাখেন দ্যাখেন কি বিশাল রোড, এই রোড ধরে আপনি পৃথিবীর যে কোন দেশে যেতে পারবেন, বাবু কায়দা করে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয় । শোনেন আপা, আমি তো এই দেশে আইসাই বুঝতে পারছি, একবার যদি দাড়াইতে পারি —— উত্তেজনায় কথা শেষ করতে পারে না ও, ছোট গাড়িটা ইউএস ৪১ রোডে টার্ন করে, আমি বাবুর চেহারাতে শুধুই আগামী দেখি, ও আবার ফিরে আসে, এই যে রোডে উঠলাম এই রোড আপনাকে সোজা কানাডা নিয়ে যাবে, আপনি ভাবতেও পারবেন না আমেরিকা কি জিনিস, এইদেশটার কত টাকা আছে, আপনার কোন আইডিয়া নাই, কোনই আইডিয়া নাই, বাবুর কথা শুনে মনে হয় সারা আমিরেকার এজেন্ট ও আর আমরা ওর কাস্টমার। আমি আবার কিছুক্ষন বাইরে তাকাই, গাড়ি ছুটছে, পিছনের টয়োটা সিয়েনা তে আছে ৬ জন, বাবু আজ আমাদেরকে নিয়ে যাবে নেপলস ক্যানেল এর ভিউ দেখাতে। প্রায় দুঘন্টার ড্রাইভ, গাড়িতে আমার প্রিয় বাঙলা গান বাজছে, আমি সাধারনত রাস্তায় কথা বলতে চাই না, কিন্তু বাবু দমবার পাত্র নয়, কিছুতেই না, ‘আপা বলেন তো আমেরিকার ইয়াররি বাজেট কত? আপনি তো কানাডায় থাকেন, সবাই বলে আমেরিকার ইকোনমি পড়ে গেছে, হা হা হা, জানেন আপনি এইদেশটার কত টাকা আছে? কিছুই পড়ে নাই আপা, কিছুই না, আমি তো যত দেখতাছি তত অবাক হইতাছি, এই যে ডানদিকে তাকান, তাকান না আপা তাকান, এইটা হলো প্রাইভেট এয়ারপোর্ট, আপনি ভাবতেও পারবেন না শুধু ফ্লোরিডাতেই কত বড়লোক থাকে, আমি বাবুকে জিঞ্জেস করি, তুই রতনপুর যাসনি কোনদিন? বাংলাদেশের বি,বাড়িয়ার নবীনগর থানার রনতপুরে বাবুদের বাড়ি, আমি রতনপুরকে চিনি ও জানি, একটা ট্রেনিংএর আয়োজনে থেকেছিলাম ৬ দিন, ওই গ্রামের মাজেদা, সাহারা, নাছিমা, ফজলভাই, একরামভাই জন্মাবধি একঘেয়ে জীবনযাপন করে, ওদের জীবনে কোন উত্তেজনা নেই, চাওয়া পাওয়ার স্বপ্ন নেই, শুধু আছে জীবনকে বয়ে বেড়ানোর দায়। তাই ইউএস রোডে উঠে যেন রতনপুরকে বেশী বেশী দেখতে পাই আমি। বাবুর প্রতিটা উত্তেজনাকর ঘন্টার সাথে রতনপুরকে আমার আরো বেশী মনে পড়ে।
এবার শুরু হলো নেপলস ক্যানেলে বোট ক্রুজ, বাচ্চারা হুটোপুটি করে সাদা ঝকঝকে বোট এ উঠে পড়ে, কি ঝকঝকে দেশ, মনে হয় এইমাত্র সাজানো হলো দেশটাকে। দুপুরের সোনাঝরা রোদ, চারিদিকে ঝকঝকে মানুষ, কোথাও দারিদ্রতার কোন ছাপ নেই, মুখে কোন কষ্টের ছায়া নেই, এদেরকে দেখলে মনে হয় কেবল এনজয় করার জন্যই এদের জন্ম হয়েছে, তাই বুঝি বার বার বলে এনজয়, এনজয়, হ্যাভ ফান। বোটের ভিতর সবাই সবাইকে হ্যালো করে, আমি পানির দিকে তাকিয়ে চলে যাই রতনপুরের নদীতে, ট্রেনিং শেষে সেবার আমরা বেড়িয়েছিলাম নৌকায় করে বেড়াতে, হৈ হৈ করে কেটেছিলো আমাদের পুরো বিকেল থেকে রাত অব্দি, কেমন আছে রতনপুরের সেই মানুষগুলো? নদীর পানি আমাকে নস্টালজিয়া করে, সাদা ডেকের কোনায় দাড়িয়ে আছে সাধারন বাঙালী ছেলে বাবু, পরনে একটা দেশী টিশার্ট । বাবু অন্য সবাইকে বাড়ি দেখাচ্ছে, নেপলস খাল এর দুধার জুড়ে সুদৃশ্য বাড়ি, বাড়ি না বলে প্যালেস বলা ভালো, কি অবাক করা ধনকুবের এরা, বাবুর ধারাবিবরনীর শব্দগুলো ভেসে আসছে আমার কানে —- প্রতিটা বাড়ির দাম মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার, ওই যে দেখছেন বাড়ির সামনে পার্সোনাল বোট, প্রতিটা বোট এর দাম কমকরে হলেও ১০০ হাজার ডলার। জানেন আপা সবচেয়ে মজার বিযয় এরা কেউই এখানে থাকে না, এদের সবার জন্য এগুলো হচ্ছে অবকাশ যাপনের বাড়ি, কখনো ইচ্ছে হলে আসবে এখানে রাত কাটাতে। দ্যাখেন দ্যাখেন কি সুন্দর, এমন একটা বাড়ির দাম আপনাদের ধারনারও বাইরে, শুনবেন দাম? বাবু একবার দিগন্ত বিস্তৃত ক্যানেলটার দিকে তাকায়, ওর আকণ্ঠ মনোযোগ দেখে আবার আমার সামনে রতনপুরের পঁচা ডোবার মতো নদীটা ভেসে উঠে যার দুধারে অনেকটাই বস্তিবাসীদের বাস। আর ঠিক তখুনি বাবু আমাদেরকে বলে, একটা একটা বাড়ির দাম ২০ মিলিয়ন ডলারের উপরে, বলে ও নিজেই যেন প্রতিটা বাড়ির ভিতরে ঢুকে গিয়ে আমাদেরকে বোঝাবার জন্য আকুল হয়ে উঠে। আমি এগিয়ে যাই বোটের কোনার দিকে, সত্যিই তো, সারা পৃথিবীই আজ টাকার পুজাঁরী, আধুনিক মানুষ ভোগটাকে যে কোন দামেই কিনে নিতে চায়, তাইতো পুজিঁবাদের জয়জয়াকার, পুজিঁবাদের মাতন উঠেছে বিশ্বব্যাপী। লিংকন থেকে ওবামা কেউই এই জালের বাইরে যেতে পারবে না। খালের পানিতে ভুস ভুস করে ভেসে উঠছে ডলফিন, আমার মনের ভিতর থেকে অন্য এক মানুষ বলে উঠে ‘তুমিও তো বাবুরই অন্য এক সত্তা, শুধু কথা দিয়ে কি পার পাওয়া যায়? তুমিও তো ভাসিয়ে দিয়েছো নিজেকে এই বৈভবের দেশে, আড়াল করতে পারবে নিজেকে?’ আমি নিজের দিকে একরার তাকাই, এবারে বাবু আমাদের আসরের মধ্যমনি, হাসি আর ক্যামেরার ঝিলিকে দুলে দুলে উঠছে বোট, দূরে কোন কোন রাজপ্রসাদের বাড়িতে রোদ পোহাচ্ছে আধাশোয়া ন্যাংটো মানুষ, আর রতনপুরের ভ্রূন থেকে জন্ম নেয়া বাবু ততক্ষনে ফোর্ট মায়াস রোডে ক্যামরী থেকে পোরসে গাড়ির স্বপ্নের বিবরনীতে মুগ্ধ করছে অন্য একদল স্বপ্নবাজ মানুষকে। ডলফিনের ঝলকের মতোই আমার চোখে একবার রতনপুর আর একবার ফোর্ট মার্য়াস শহরের আলোকে সংগী করে সুদৃশ্য বোট এগিয়ে যায় আগামীর পথে।
লুনা শীরিন
ফ্লোরিডা, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮
আপু আপনার মনের আয়নায় ভেসে বেড়ানো রতনপুর এখন অনেক পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে।
চিরচেনা রতনপুরে কাঠ টিনের বদলে ইট সিমেন্ট এর তৈরি দালান কোঠার ছড়াছড়ি। বিদেশ বিভূইয়ে থেকে ও রতনপুরের মাটির সোঁদা গন্ধ আপনার কাছে কত পরিচিত ভাবতে ভাল লাগে।
আপনাদের নিয়ে আমরা গর্ব করি।
ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ আপনাকে ।
আহসান পাপ্পু
রতনপুর।
apnar bornona bhongi chomotkar. observation oshadharon. aktane pore fela jai…
@faisal arefin dipan,
Dipan–lekha porar jonno thanks.amake jodi amar lekhate pore fela jay tahole bola uchit ami lekhok hoea uthini, lekhok ke noybartik hote hoy bole jani.tobuo apni somoy dieasen–valo thakun.
luna
@luna shirin,
আমাদের বাংলা ব্লগে ইংরেজী হরফে বাংলা লেখাটা উৎসাহিত করা হয়না। একটু কষ্ট করে বাংলায় লিখুন। আপনার কম্পিউটারে যদি অভ্র ডাউনলোড না করা থাকে, তবে মন্তব্য করার নীচে ‘অভ্র’ নামে একটি বাটন আছে – সেটাতে চাপ দিয়েও টাইপ করতে পারেন।