কয়েকিদিন ধরে উপরের নির্দেশে শহরে আমাদের অপারেশন বন্ধ। কারণ মিত্র ও মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম শহরের দিকে এগিয়ে আসছে দ্রুত। এ অবস্থায় শহরের অভ্যন্তরে গেরিলা অপারেশন করে জনগণের ভোগান্তি না বাড়ানোর চিন্তা থেকে এ নির্দেশ। ১৫ ডিসেম্বর, সকাল থেকে শহরের মানুষ দ্রিম দ্রিম গোলাগুলির শব্দ শুণতে পাচ্ছিল।
সন্ধ্যা রাতে ইয়াহীয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিচ্ছে। একটি বাসার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সংগোপনে আমি ভাষন শুনছিলাম। এক পর্যায়ে ইয়াহীয়া দম্ভ করে বলছে-যব তক মেরা বারো কোটি মোজাহিদো জিন্দে রেহেগা, তব তক মাইনে পাকিস্তানকো খুচবি হোনা নেহি দোওঙ্গা ইনশাল্লাহ-যতক্ষণ পর্যন্ত আমার বার কোটি মুজাহিদ জীবিত থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি পাকিস্তানের কিছু হতে দেব না। এ যেন মুমুর্ষ ব্যাঘ্রের নি:স্ফল আস্ফালন মাত্র। তার এ বক্তব্য শুনার সাথে সাথে ঐ বাসার ছেলে-মেয়রাও হু হু করে হেসে ওঠল। কারণ তাদের কাছে ইয়াহীয়া খানের এ দম্ভোক্তি অন্ত:সার শূণ্য মনে হচ্ছিল।
সারা রাত চরম উৎকণ্ঠায় নির্ঘুম কাটালাম । রাতের আধাঁর ক্রমে তরল হতে হতে ভোরের আলো ফুটতে লাগল। ইতোমধ্যে সংবাদ রটে গেল-পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমপর্ণ করবে।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, শুক্রবার । মোগলঠলী সেল্টার থেকে কদমতলীর প্রধান সড়কে বের হলাম। সেদিনের সকালের আকাশ, বাতাস, সবকিছুই যেন অন্যরকম লাগছে । সূর্যের আলোও যেন অধিকতর রক্তিমাভা ধারণ করেছে । আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে-বলে নাচতে ইচ্ছা করছে ।
কিছুক্ষণ পর পর সামরিক কনভয়গুলো পরাস্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে নেভাল বেইজের দিকে। রাস্তায়, রাস্তায় ও রাস্তার দু’পার্শ্বে বিভিন্ন ভবনের ছাদে মানুষের উদ্বাহু নৃত্য ও আনন্দ-উল্লাস, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু-শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত রাজপথ। কারো হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি । হাতে হাতে বাংলাদেশের মানচিত্র ও রক্তসুর্য়খচিত পতাকা । নয় মাস পাকিস্তানীদের তীব্র খানাতল্লাসিতে এ পতাকা ও মানচিত্র কিভাবে মানুষ সংরক্ষণ করেছিল জানি না।
পাকিস্তানী সেনাদের কনভয় দেখলে রাস্তার দু’পাশে সমবেত মানুষ শ্লোগান ফেটে পড়ে। দেওয়ানহাট মোড়ে এক কিশোর একটা সেনা কনভয় লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারলে তারা পাল্টা গুলি ছুড়ে। আহত হয় কয়েকজন। তাদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। বেঁচে গেছে কিনা জানি না।
এভাবে জনতার অপ্রতিরোধ্য ঢল দেখতে দেখতে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। । এত লোকের ভিড়ে আমাকে তেমন কেউ চিনতে পারছে বলে মনে হয় না । পরিচিত যাদের সাথে পথ চলতে দেখা, তাদের অনেকেই হয়ত জানেই না, আমি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে আসার প্রচণ্ড আকুলতা দ্রুত পদবিক্ষেপে কর্ণফুলীর তীরের রেল লাইন ধরে বাড়ির দিকে হেটে চলেছি-রাস্তায় কোন পরিবহন নেই। কেবল মানুষ আর মানুষ।
কখনো কখনো সে উল্লসিত জনতার মিছিলে মিশে যাচ্ছি। নৌ-ঘাটি (নেভাল বেইজ) থেকে কর্ণফুলীর পাড়ে পাড়ে ৯ নং গুপ্তখালের সেতু পর্যন্ত গিয়ে খালপাড়ের কৈল্লার হাটের রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পরিবেশ-পরিস্থিতির কী অদ্ভূত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম । মাত্র একদিন আগেও গুপ্তখালের মুখে পানিতে কাঁটাতারের বেড়া, রাস্তার মুখে পাকসেনাদের চেকপোস্ট, বার্মা ইস্টার্ন লিঃ (বর্তমান পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিঃ ) এর হাউজিং কলোনীর খেলার মাঠে ভূ-গর্ভস্থ জল্লাদখানা, সব মিলিয়ে এ এলাকা ছিল ভয়ঙ্কর আতঙ্কের জনপদ। অথচ একদিনের ব্যবধানে কেমন যেন পাল্টে গেছে সব। কোন ভয়ভীতি নেই আজ কারো মনে। পাকসেনাদের চেকপোস্ট, গার্ডরুম, অস্থায়ী ক্যাম্প সবই শূণ্য পড়ে আছে। পড়ে আছে তাদের কিছুক্ষণ পূর্বে ব্যবহৃত তৈজসপত্র, আধপোড়া সিগারেট, বিভিন্ন পানীয়ের বোতল । শুধু হাওয়া হয়ে গেছে পাকসেনারা। সবাই আশ্রয় নিয়েছে নিকটস্থ নেভেল বেইজে।
কৈল্লার হাট অতিক্রম করে আমি যখন বার্মা অয়েল কোম্পানী সংলগ্ন সড়কে ওঠলাম, দেখতে পেলাম সামনে থেকে একটি মিছিল আসছে শ্লোগান দিতে দিতে। এরা আমার এলাকার লোক। আমি ভাবলাম অনেক পরিচিত মুখ এখানে দেখতে পাব। মিছিলটি যখন কাছে আসল, তখন ঠিকই দেখলাম মিছিলে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলেই আমার এলাকার অধিবাসী। সবচেয়ে পরিচিত লোকটি মিছিলে শ্লোগান দিচ্ছিল । আমার দূর সম্পর্কেরে আত্মীয়। জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় কর্মী ও সমর্থক-যার ভয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা প্রায় তটস্থ থাকত। আমি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে কিনা, সেটা জানার জন্য সে আমার বাবাকেও বহু জেরা করেছে, ভয় দেখিয়েছে। তার কণ্ঠেও বুলন্দ আওয়াজে- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান- কেমন যেন বিসদৃশ লাগছে। শশ্রুমণ্ডিত আঝানুলম্বা আলখাল্লা পরা লোকটিকে কেমন যেন ভাঁড়ের মত দেখাচ্ছিল। যত মিছিলের নিকটবর্তী হচ্ছিলাম, ঐ শ্লোগানদাতার হস্ত সঞ্চালনের সাথে সাথে তার কণ্ঠের আওয়াজ ও তত বুলন্দ হচ্ছিল। শ্লোগান দাতার চোখেমুখে অপরাধবোধের এক ভয়ার্ত অভিব্যক্তি আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। এক সময় নাতিবৃহৎ মিছিলটি আমাকে অতিক্রম করে চলে গেল।
বাড়ির খুব সন্নিকটে পৌছলে আনন্দ বেদনার এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বাড়ির ঘাটায় পৌঁছতেই কে যেন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠল-জানু এসেছে-রে। আমার ডাক নাম ছিল জানু । বাড়ির আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যেন এমন একটি মুহুর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। হৈ হৈ রৈ রৈ করে সবাই বাড়ির ঘাটায় এসে আমাকে ঘিরে ধরল। সর্বাগ্রে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠল আমার বড় বোন-আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে যে প্রায় কঙ্কালসাড় হয়ে গিয়েছিল । একে একে বাবা, মা, দাদী, ছোটবোন, ছোট ভাইসহ বাড়ির সবাই আমার সাথে কোলাকুলি করল।
ক্রমে এলাকার লোকজনও আমাকে দেখার জন্য বাড়িতে জড়ো হতে লাগল। আমি জানতে পারলাম, আমাকে ধরার জন্য বাড়ি ঘেরাও করে আমার যে চাচা এখলাছুর রহমানকে মীর কাশেম আলীর আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তিনি তখনো ফিরে আসে নি। তাই আনন্দ বেদনার এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া স্থানুর মত দাঁড়িয়ে কেবল অভ্যাগতদের সাথে কোলাকুলি করছিলাম।
স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি নৃতাত্ত্বিক জাতির পূনর্জন্ম-তার নিজস্ব একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, সদ্যজাত জাতিরাষ্ট্রকে ঘিরে বুকভরা একরাশ সোনালী স্বপ্ন কঁচি বুকে ধারণ করে আমি যেন জীবনের একটি প্রারম্ভিক অধ্যায়ের সফল পরিসমাপ্তি রচনা করলাম।
কৈশোর পেরিয়ে যৌবণের অনুভূতি যখন আমার তনু-মন-প্রাণে দোলা দেওয়া শুরু করেছে, তখন আমি সদ্য যুদ্ধবিজয়ী এক মুক্তিযোদ্ধা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে স্বপ্নে বিভোর হওয়ার সময় আমার। স্বপ্ন দেখেছি নিজেকে নিয়ে, নিজের সদ্য স্বাধীন দেশকে নিয়ে-যার স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলাম। একটি স্বাধীন স্বদেশভূমি, একটি গর্বিত জাতি, একটি উন্নত শোষণহীন সমাজ কাঠামো, ইত্যাকার স্বপ্নে বিভোর হলাম।
নিজ জাতির মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের এমন সুযোগ কত লোকেরই বা হয়? এ ভাবনা আমাকে ভীষণ গর্বিত করে বৈকি ।
পাদটীকাঃ (স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা নামক আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণ মূলক লেখাটি-যার ব্যাপ্তি সেই ১৯৬৫ ইং সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালীন সময় থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালীন সময় পর্যন্ত বিস্তৃত-দুই পর্বে বিভক্ত- এর থেকে সংকলিত)
ভালো লাগলো
স্মৃতির ধূসর পাতা নয়– ঝলমলে স্মৃতি চাই আমরা মুক্তিযদ্ধাদের কাছে।
ছোট্ট স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ গীতাদি। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতো অবশ্যই ঝলমলেে হওয়ারই কথা ছিল। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বৎসর পর যখন একজন মু্ক্তিযোদ্ধা দেখে-আজকের বাংলাদেশ তার সেই একাত্তুরের স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়-তখন সব স্মৃতি ধূসর-মলিন হয়ে যায়। আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এত বাগাড়ম্বরতা হচ্ছে, কিন্তু দেশ কি মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় এগুচ্ছে? ধর্মীয় জঙ্গীবাদ, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা,গণতন্ত্রহীনতা,ক্রমবর্ধমান সম্পদের বৈষম্য-এ সব বিষয়গুলোর প্রত্যেকটিই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী নয়? তাই মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিচারণ করতে যখন বলা হয়-তখন মনে জোর পাইনা, স্মৃতিগুলোও ধূসর মনে হয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়-স্বপ্ন দেখেনি তো? সত্যিই কি এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম?