(অর্ফিউসকে কথা দিয়েছিরাম যে আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় নারী সিরিজটি শেষ করব। কিস্তু সাময়িক বন্ধের অনেক কারণ এবং কারণগুলো অনেকের কাছে অনর্থক অজুহাতের পর্যায়ে পড়বে বলে তা আর উল্লেখ করছি না। যাহোক, অর্ফিউসকে কথা দেয়ার যাতনায় আবার শুরু করলাম। @অর্ফিউস )
আরজ আলী মাতুব্বর “অনুমান’ গ্রন্থের শেষ নিবন্ধটির নাম সমাপ্তি। সমাপ্তি নিবন্ধের মূল কথাটি দিয়েই আমি আমার লেখার প্রথম পর্বটি শুরু করেছিলাম। স্বামীহারা, বিত্তহারা, গৃহহারা এক বিধবার চার বছর বয়সের ছেলে মৃত মায়ের ফটো তুলাতে মায়ের মৃত্যু পরবর্তী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান না করতে পেরে একদিন নাখোদাদের নামকরা নায়ক হয়েছেন। মাতৃ শোকের আবেগকে তেজে, শক্তিতে ও আশীর্বাদে পরিণত করেছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর।
বরিশাল প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন সাধারণ কৃষক থেকে আরজ আলী মাতুব্বর হয়ে উঠার মূলে, প্রেরণায়, উদ্ধুদ্ধকারী হিসেবে রয়েছেন এক নারী। তিনি নিজেই বলেছেন, “অগত্যা কতিপয় অমুছল্লি নিয়ে জানাজা ছাড়াই আমার মাকে সৃষ্টিকর্তার হাতে সোপর্দ করতে হয় কবরে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ছবি তোলা দুষণীয় হলে সে দোষে দোষী স্বয়ং আমিই, আমার মা নন। তথাপি যে আমার মায়ের অবমাননা করা হলো, তা ভেবে না পেয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে মার শিয়রে দাঁড়িয়ে তাঁর বিদেহী আত্মাকে উদ্দেশ্য করে এই বলে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মা! আজীবন ছিলে তুমি ধর্মের একনিষ্ঠ সাধিকা। আর আজ সেই ধর্মের নামেই হলে তুমি শিয়াল-কুকুরের ভক্ষ্য। সমাজে বিরাজ করছে এখন ধর্মের নামে অসংখ্য অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো –আমার জীবনের ব্রত হয় যেনো কুসস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ অভিযান। আর সে অভিযান সার্থক করে আমি যেনো তোমার কাছে আসতে পারি’’।
আবেগে আপ্লুত, দুঃখে মুহ্যমান, প্রতিজ্ঞায় শাণিত মন এ প্রসঙ্গে একটী কবিতার লাইনও যোগ করেছিলেন,
“তুমি আশীর্বাদ করো মোরে মা,
আমি যেনো বাজাতে পারি
সে অভিযানের দামামা”
এ দামামা ধর্মীয় রীতিনীতি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দুরীকরণে বাজাতে গিয়ে নারীর প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধেও বাজিয়েছেন।
“স্মরণিকা’ গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়টি হল ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরী’।এর প্রথম পাঠ লামচরি গ্রামের অবস্থান ও পরিবেশ। যেখানে একমাত্র লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার চেয়ে একাধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা অগ্রাধিকার পায়। যার বর্ণনায় আরজ আলী মাতুব্বর কবি নজরূল ইসলামের লেখা থেকে উদ্ধৃতি টেনেছেন,” বিশ্ব যাখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসে, বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকাহ-হাদিস চষে।’’ অর্থাৎ তিনিও নজরুলের মত বিংশ শতাব্দীতে এসে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে শিকেয় তুলে, সভ্যতার কথা ভুলে, নারীর মর্যাদা ও নারী অধিকারের প্রতি সম্মান না জানিয়ে, নারীর জীবিনবোধকে গুরুত্ব না দিয়ে নারীকে অবদমিত করতে, নারীর ভোগান্তি বাড়াতে এখনও যে ফেকাহ-হাদিস খুঁজে নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া চলছে — তা উপলদ্ধি করে মর্মাহত।
তিনি যেন দূরবীণ দিয়ে পরবর্তী কয়েক দশকে নারীর অবস্থানকে দেখেই নজরুলের উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলাম এর নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনাটিও মনে করিয়ে দেয়।
আরজ আলী মাতুব্বরের লামচরি গ্রামে কয়েক দশক আগে যেমন অবস্থা ছিল আজও বাংলাদেশের যে কোন গ্রাম তা ই রয়ে গেছে। একমাত্র লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার চেয়ে একাধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা অগ্রাধিকার পায়। সেখানে আরও বেড়ে যাচ্ছে অর্ধিশিক্ষিত অপশিক্ষিত মোল্লাদের দৌরাত্ম্য। আর এ দৌরাত্ম্যে নারীকে পেছনের দিকে ঠেলে পাঠানোর অপতৎপরতা বিরাজমান যা আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখে ও অন্যকে দেখানোর ব্যবস্থা করে গেছেন তাঁর লেখায়। (চলবে)
পাঠকের পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগের লেখার লিংকগুলো সংযোজিত হলো।
শুভ জন্মদিন, আরজ আলী মাতুব্বর।
এই বাক্যটা ঠিক সম্পূর্ণ মনে হচ্ছে না, দিদি।
অর্ফিউসের একদম দেখা নেই। তার সাথে যদি যোগাযোগ থাকে আবার নিয়মিত হতে বলবেন।
ঠিক ধরেছেন। কয়েকটা শব্দ কিভাবে যেন বাদ পড়ে গিয়েছিল। ঠিক করে দিয়েছি একনিষ্ঠ পাঠক। খুব ভালো লাগলো মনযোগ দিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য। আর অর্ফিউসের খবর আমিও জানি না। আগের লেখার মন্তব্য ধরে অনেক আগে এ লেখাটি সুরু করেছিলাম বলে অর্ফিউসের উল্লেখ।
আরজ আলী মাতুব্বর এক বিরাট প্রতিভাধারী, অত্যন্ত সাহসী মানুষ ছিলেন। শৈশবে পিতৃহীন এই ছেলেটি স্কুলে যেতে পারেনি। উনিশ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুতে সমাজের আঘাতেই তিনি জেগে উঠেছিলেন। তারপর তিনি স্বরে-অ, স্বরে-আ শিখতে শুরু করেন। তারপর তিনি যে মাপের তিন খানি বই লিখে গেছেন বাংলাভাষায় তা বিরল হয়ে থাকবে অনেক দিন।
গীতা দাস, আরজ আলী মাতুব্বর আমার আদর্শ। আপনি আপনি আরজ আলীকে নিয়ে লিখেছেন। আপনি আমার শ্রদ্ধা গ্রহন করুন।
কোন লেখা লিখে শ্রদ্ধা পাবার মতো বিশ্লেষণ হয়তো এটি নয়, তবে এতে আমার আরজ আলী পুনঃ পাঠ হচ্ছে। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।