সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড় ভাই। বঙ্কিমের মতো ইনিও বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন। শুধু ইনি না, তাঁদের আরেক ভাই পূর্ণচন্দ্রের অবদানও কম নয়। এই পূর্ণচন্দ্রের হাত দিয়েই বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের সূত্রপাত হয়। সঞ্জীবচন্দ্রের অবদান বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতিযোগ্য হলেও বঙ্কিমের মতো ওরকম জনপ্রিয়তা বা নামডাক অর্জন তিনি করতে পারেন নি। এটা তাঁর অযোগ্যতার কারণে হয় নি, হয়েছে নেহায়েতই দুর্ভাগ্যের কারণে। বঙ্কিম তাঁর বড় ভাই সম্পর্কে বলেছেন,
“প্রতিভাশালী ব্যক্তিদিগের মধ্যে অনেকেই জীবিতকালে আপন আপন কৃতকার্যের পুরস্কার প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। অনেকের ভাগ্যে তাহা ঘটে না। যাঁহাদের কার্য দেশ কালের উপযোগী নহে, বরং তাহার অগ্রগামী, তাঁহাদের ভাগ্যে ঘটে না। যাঁহারা লোকরঞ্জন অপেক্ষা লোকহিতকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন, তাঁহাদের ভাগ্যেও ঘটে না। যাঁহাদের প্রতিভার এক অংশ উজ্জ্বল, অপরাংশ ম্লান, কখন ভস্মাচ্ছন্ন কখন প্রদীপ্ত, তাঁহাদের ভাগ্যেও ঘটে না ; কেন না অন্ধকার কাটিয়া দীপ্তির প্রকাশ পাইতে দিন লাগে। ইহার মধ্যে কোন্ কারণে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়* তাঁহার জীবিতকালে, বাঙ্গালা সাহিত্যসভায় তাঁহার উপযুক্ত আসন প্রাপ্ত হয়েন নাই, তাহা এ জীবনী পাঠে পাঠক বুঝিতে পারেন। কিন্তু তিনি যে এ পর্যন্ত বাঙ্গালা সাহিত্যে আপনার উপযুক্ত আসন প্রাপ্ত হয়েন নাই, তাহা যিনিই তাঁহার গ্রন্থগুলি যত্নপূর্বক পাঠ করিবেন, তিনি স্বীকার করিবেন। কালে সে আসন প্রাপ্ত হইবেন।”
সঞ্জীবচন্দ্রের বাংলার সাহিত্য আকাশে এই ভাগ্যদোষ শুধু বঙ্কিমের নজরেই পড়ে নি। পড়েছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখেও। এতো প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কেনো তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তার একটা কাটাছেড়া রবীন্দ্রনাথ করেছেন তাঁর আধুনিক সাহিত্য প্রবন্ধে। সেখানে তিনি সঞ্জীবচন্দ্র সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন তা দেখলেই কিছুটা অনুমান করা যায় যে, কোন কারণে সঞ্জীবচন্দ্র তার যথাযথ আসন নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, সেই প্রতিভাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা না থাকলে এই বিড়ম্বিত অবস্থান শুধু সঞ্জীবচন্দ্রেরই নয়, যে কারোই হতে পারে।
“কোনো কোনো ক্ষমতাশালী লেখকের প্রতিভায় কী একটি গ্রহদোষে অসম্পূর্ণতার অভিশাপ থাকিয়া যায়; তাঁহারা অনেক লিখিলেও মনে হয় তাঁহাদের সব লেখা শেষ হয় নাই। তাঁহাদের প্রতিভাকে আমরা সুসংলগ্ন আকারবদ্ধভাবে পাই না; বুঝিতে পারি তাহার মধ্যে বৃহত্ত্বের মহত্ত্বের অনেক উপাদান ছিল, কেবল সেই সংযোজনা ছিল না যাহার প্রভাবে সে আপনাকে সর্বসাধারণের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে প্রকাশ ও প্রমাণ করিতে পারে।
সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভা পূর্বোক্ত শ্রেণীর। তাঁহার রচনা হইতে অনুভব করা যায় তাঁহার প্রতিভার অভাব ছিল না, কিন্তু সেই প্রতিভাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার হাতের কাজ দেখিলে মনে হয়, তিনি যতটা কাজে দেখাইয়াছেন তাঁহার সাধ্য তদপেক্ষা অনেক অধিক ছিল। তাঁহার মধ্যে যে পরিমাণে ক্ষমতা ছিল সে পরিমাণে উদ্যম ছিল না।
তাঁহার প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু গৃহিণীপনা ছিল না। ভালো গৃহিণীপনায় স্বল্পকেও যথেষ্ট করিয়া তুলিতে পারে; যতটুকু আছে তাহার যথাযোগ্য বিধান করিতে পারিলে তাহার দ্বারা প্রচুর ফল পাওয়া গিয়া থাকে। কিন্তু অনেক থাকিলেও উপযুক্ত গৃহিণীপনার অভাবে সে ঐশ্বর্য ব্যর্থ হইয়া যায়; সে-স্থলে অনেক জিনিস ফেলাছড়া যায় অথচ অল্প জিনিসই কাজে আসে। তাঁহার অপেক্ষা অল্প ক্ষমতা লইয়া অনেকে যে পরিমাণে সাহিত্যের অভাব মোচন করিয়াছেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা সত্ত্বেও তাহা পারেন নাই; তাহার কারণ সঞ্জীবের প্রতিভা ধনী, কিন্তু গৃহিনী নহে।“
সঞ্জীবচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৪ সালে, চব্বিশ পরগনা জেলার কাঁটালপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা যাদবচন্দ্র ছিলেন বর্দ্ধমানের ডেপুটি কালেক্টর। পরীক্ষাসংক্রান্ত নানা জটিলতার কারণে সঞ্জীবচন্দ্রের একাডেমিক পড়াশোনা খুব একটা হয় নি। পড়ালেখা যা করেছেন সবই নিজের চেষ্টায়। একাডেমিক পড়াশোনা তাঁর দ্বারা হবে না, এই বিবেচনা করে তাঁর পিতা তাঁকে বর্দ্ধমানে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। এখানেই সঞ্জীবচন্দ্র নিজের চেষ্টায় ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস এবং বিজ্ঞানে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন।
ছেলে ঘরে বসে বসে খাচ্ছে, এটা সহ্য হয় নি বাবার। কাজেই তিনি সঞ্জীবচন্দ্রকে কমিশনার অফিসে একটা কেরানির কাজ জুটিয়ে দিলেন। ছোট চাকরি, কিন্তু এতে সঞ্জীবচন্দ্রের কোন আক্ষেপ ছিলো না। তিনি নির্বিকারভাবেই এই কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, এতে বাধ সাধে তাঁর ছোট ভাই বঙ্কিমচন্দ্র। বড় ভাই এমন একটা সামান্য কেরানিগিরির কাজ করবেন, এটা মেনে নিতে পারেন নি তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজ সেই সময়ে মাত্র চালু হয়েছে। এর ল ক্লাসে ভর্তি হয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি অগ্রজকে অনেকটা জোর জুলুম করেই কেরানিগিরি চাকরি ছেড়ে ল ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বঙ্কিম মাত্র দুই বছর পড়লেন, ল ডিগ্রি শেষ না করেই চাকরিতে চলে গেলেন। রয়ে গেলেন সঞ্জীবচন্দ্র। তবে, যথারীতি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন তিনি।
এতেও কোন বিকার ছিলো না তাঁর। তিনি এবার কাঁটালপাড়ায় গিয়ে ফুলের বাগান করার দিকে পুর্ণ মনোযোগ ঢেলে দিলেন। বরাবরই মনে যা চাইতো, সেটা করার দিকেই তীব্র ঝোঁক ছিলো তাঁর। তিনি ফুলের বাগান করে বড়ই আনন্দে ছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবা ঠাকুরের এই কাজ মোটেও পছন্দ হয় নি। সেই সময় উইলসন সাহেব নতুন ইনকাম ট্যাক্স বসিয়েছেন। সেটার জন্য জেলায় জেলায় আসেসর নিযুক্ত করা হচ্ছিলো। যাদবচন্দ্র বাবু পুত্রকে আড়াইশত টাকা বেতনের একটা আসেসরের কাজ জুটিয়ে দিলেন। সঞ্জীবচন্দ্রের পোস্টিং হলো হুগলি জেলায়।
কয়েক বছর এই চাকরি করলেন তিনি। একদিন তাঁর পদটা বিলুপ্ত হয়ে গেলো। সৌন্দর্যপিপাসু সঞ্জীবচন্দ্র আবার ফিরে এলেন কাঁটালপাড়ায়। শুরু হলো আবার পুষ্প উদ্যান তৈরি করা। কিন্তু, এইবার ঝামেলা তৈরি হয়ে গেলো। বঙ্কিমদের সবচেয়ে বড় ভাই শ্যামচরণ বাবাকে পটিয়ে পাটিয়ে সেই পুষ্প উদ্যান গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। পুষ্প উদ্যান ধ্বংস হয়ে যাবার দুঃখেই কিনা কে জানে, সঞ্জীব জ্বলে উঠলেন এবার। ইংরেজিতে লিখে ফেললেন এক বিস্ময়কর বই, Bengali Ryot. এই বই এক সময় হাইকোর্টের জজদেরও হাতে হাতে ফিরতো। এই বই লেখার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। প্রতিদিন কাঁটালপাড়া থেকে ট্রেনে করে কোলকাতা গিয়ে রাশি রাশি বই ঘেটেছেন তিনি। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন,
“এই পুস্তকখানি প্রণয়নে সঞ্জীবচন্দ্র বিস্ময়কর পরিশ্রম করিয়াছিলেন। প্রত্যহ কাঁটালপাড়া হইতে দশটার সময়ে ট্রেনে কলিকাতায় আসিয়া রাশি রাশি প্রাচীন পুস্তক ঘাঁটিয়া অভিলষিত তত্ত্ব সকল বাহির করিয়া সংগ্রহ করিয় লইয় সন্ধ্যাকালে বাড়ী যাইতেন। রাত্রে তাহা সাজাইয়া লিপিবদ্ধ করিয়া প্রাতে আবার কলিকাতায় আসিতেন। পুস্তকখানির বিষয়, (১) বঙ্গীয় প্রজাদিগের পূর্বতন অবস্থা, (২) ইংরেজের আমলে প্রজাদিগের সম্বন্ধে যে সকল আইন হইয়াছে, তাহার ইতিবৃত্ত ও ফলাফল বিচার, (৩) ১৮৫৯ সালের দশ আইনের বিচার, (৪) প্রজাদিগের উন্নতির জন্য যাহা কর্তব্য।“
বইটা প্রকাশ হবার পরে ইংরেজ মহলে হুলুস্থুল পড়ে গেলো। রেভিনিউ বোর্ডের সেক্রেটারি চ্যাপম্যান সাহেব কোলকাতা রিভিউতে এর একটা ইতিবাচক সমালোচনা লিখে ফেললেন। অনেক ইংরেজ এই বই পড়ে এমনই মুগ্ধ ছিলেন যে, তাঁরা এই রায় দিলেন যে, এরকম বই স্বয়ং কোনো ইংরেজের পক্ষেও লেখা সম্ভব হতো না। হাইকোর্টের জজেরা রায়ের জন্য এই বই পড়া শুরু করলেন। অনেক বিচারের মিমাংসা এই বইকে রেফারেন্স ধরেই হয়েছিলো। লেফটেন্যান্ট গভর্নর সাহেবেরও হাতে গিয়ে পড়েছিলো এই বই। তিনি এটা পরে এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, চাকরির কোনো পরীক্ষা ছাড়াই সঞ্জীবচন্দ্রকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ দিয়ে দিলেন। চাকরি পেয়েও বেচারা আনন্দের চেয়ে দুশ্চিন্তাতেই পড়েছিলেন বেশি। আদৌ চাকরিটা তিনি রাখতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি বঙ্কিমকে লেখেন।
“ইহাতে পরীক্ষা দিতে হয়; আমি কখন পরীক্ষা দিতে পারি না, সুতরাং এ চাকরি আমার থাকিবে না।“
সঞ্জীবচন্দ্রের ভবিষ্যতবাণীই সঠিক হয়েছিলো। পরীক্ষা ফেলের কারণেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিটা চলে গিয়েছিলো তাঁর। তবে, কতোটুকু তাঁর নিজের দোষে তিনি ফেল করেছিলেন, নাকি তাঁকে শত্রুতা করে ফেল করানো হয়েছিলো, সে বিষয়টা নিশ্চিত নয়। এ বিষয়ে বঙ্কিম বলেছেন,
“ডিপুটিগিরিতে দুইটা পরীক্ষা দিতে হয়। হয় পরীক্ষা বিষয়ে তাঁহার যে অদৃষ্ট তাহা বলিয়াছি। কিন্তু এবার প্রথম পরীক্ষায় তিনি কোনরূপে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। দ্বিতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন নয়। কর্ম গেল। তাঁহার নিজ মুখে শুনিয়াছি, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার মার্ক তাঁহার হইয়াছিলো। কিন্তু বেঙ্গল আপিসের কোন কর্মচারী ঠিক ভুল করিয়া ইচ্ছাপূর্বক তাঁহার অনিষ্ট করিয়াছিল। বড় সাহেবদিগকে একথা জানাইতে আমি পরামর্শ দিয়াছিলাম। জানানও হইয়াছিল, কিন্তু কোন ফলোদয় হয় নাই।“
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র এবং বঙ্কিমচন্দ্র দুজনেরই প্রতিবেশী। দুই ভাইয়ের বিশেষ স্নেহধন্যও ছিলেন তিনি। সঞ্জীবচন্দ্রের চাকুরি যাওয়ার বিষয়ে তিনিও একটা কাহিনি লিখে গেছেন। সঞ্জীবের অসাধারন রসবোধ এবং সবকিছু নিয়ে রসিকতা করার প্রবনতাই তাঁর চাকরি হারানোর পিছনে দায়ি বলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বয়ান করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই ঘটনাটি বিবৃত করেছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র মারা যাবারও প্রায় তিরিশ বছর পরে। সে কারণে এই কাহিনির মধ্যে কিছু তথ্যের বিভ্রাট রয়েছে। গোপালচন্দ্র রায় তাঁর সঞ্জীবচন্দ্র অ কিছু অজ্ঞাত তথ্য বইতে উল্লেখ করেছেন। তবে, সেই সব তথ্য বিভ্রাটকে বাদ দিলে, এই কাহিনিকেই তাঁর চাকরি হারানোর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা বলে মনে হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সেই কাহিনিটি এরকম।
“সঞ্জীবচন্দ্র খুব রসিক লোক ছিলেন। একদিন একজন বড় সাহেবের সহিত রসিকতা করিতে গিয়া তাঁহার ডেপুটিগিরিটি যায়। সঞ্জীববাবু তখন প্রোবেশনারী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কয়েকটি পরীক্ষায় পাস হইলেই তিনি পাকা হইতে পারেন। ১৮৮৪ সালে ডিস্ট্রিক্ট টাউন্স একট পাস হইল। ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ারম্যান এবং জজ সাহেব ও অন্যান্য ইংরাজ ও বাঙ্গালী হাকিমেরা কমিশনার হইলেন। একদিন কমিটিতে কথা উঠিল – রাস্তার নাম দিতে হইবে। টিনের উপর নাম লিখিয়া রাস্তায় রাস্তায় দিতে হইবে। সঙ্কল্প হইল ৩০০ টাকা মঞ্জুর করিতে হইবে। জজ সাহেব বলিলেন – ‘আরও ৭৫ টাকা চাই, কারণ বাঙ্গলা নামগুলা কে বুঝিবে? ও গুলা ইংরাজীতে তর্জমা করিয়া দিতে হইবে। ‘বৌমার গলি’ বলিলে কেহই চিনিবে না, Daughter-in-Laws Lane বলিতে হইবে।‘ জজ সাহেবের কথায় কেহই আস্থা করিতেছেন না, অথচ তিনি বার বার সেই কথাই বলিতেছেন। তখন সজীবাবু বলিয়া উঠিলেন – ’৭৫ টাকায় হইবে না, আমি প্রস্তাব করি আরও ৩০০ টাকা দেওয়া দরকার।‘ জজ সাহেব উৎফুল্ল হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন – ‘কেন? কেন?’ সঞ্জীববাবু বলিলেন –‘আদালতের সম্পর্কে যত লোক আছে, সকলের নামই ইংরাজীতে তর্জমা করিতে হইবে। মনে করুন, কালীপদ মিত্র বলিয়া একজন হাকিম আছেন। কালীপদ মিত্র বলিলে কে বুঝিবে? উহাকে Black-footed friend বলিয়া তর্জমা করিতে হইবে।‘ সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। জজ সাহেবের মুখ লাল হইয়া উঠিল। তিনি টুপি লইয়া কমিটি হইতে উঠিয়া গেলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলিলেন – সঞ্জীব ভাল কাজ করিলে না। বাড়ি গিয়া উঁহাকে ঠাণ্ডা করিয়া আইস। সঞ্জীববাবু তিন দিন গেলেন, জজ সাহেবের কাছে কার্ড পাঠাইলেন। সাহেব দেখা করিলেন না।
সপ্তাহ খানেক পরে খবর আসিল জজ সাহেব সেক্রেটারী হইয়া গেলেন। সঞ্জীববাবু তিন চারবার পরীক্ষা দিলেন কিছুতেই পাস করিতে পারিলেন না। তাঁহার নাম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের তালিকা হইতে কাটিয়া দেওয়া হইল। জজ সাহেবের সেক্রেটারী হওয়ার সঙ্গে সঞ্জীববাবুর পাস করিতে না পারিবার কার্য কারণ ভাব সম্বন্ধ আছে কি না জানি না, কিন্তু সঞ্জীববাবু মনে করিতেন আছে।“
চাকরি ফেরত পাবার জন্য নানা দেন দরবার করেছিলেন তিনি। কিন্তু, সেই ডেপুটিগিরির চাকরি আর তিনি ফেরত পেলেন না। তার বদলে সরকার সম বেতনের অন্য একটি চাকরিতে তাঁকে নিয়োগ দিলো। বারাসতে তখন একজন স্পেশাল সাব রেজিস্ট্রার থাকতো। সরকার এই পদে সঞ্জীবচন্দ্রকে নিযুক্ত করলো। তিনি যখন বারসাতে তখন প্রথম আদমশুমারী হয়। এর জন্য হাজার হাজার কেরানি নিয়োগ করা হয়। এদের সকলের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিলো সঞ্জীবচন্দ্রের।
এই কাজ শেষ হবার পরে হুগলির সাব রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন তিনি। বাড়ি থেকেই তিনি অফিসে যেতেন বলে বেশ সুখেই ছিলেন তিনি। কিন্তু, সুখ বেশিদিন কপালে সইলো না। এই পদের বেতন সরকার কমিয়ে দেবে জানার ফলে তিনি বর্দ্ধমানে বদলি হয়ে গেলেন। বর্দ্ধমানেও বেশ ভালোই দিন কাটছিলো তাঁর। তবে, তার চেয়েও বড়ো কথা হচ্ছে যে, এখানে এসেই বাংলা সাহিত্যের সাথে তাঁর সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে। বঙ্গদর্শন পত্রিকার সাথে আমরা শুধু বঙ্কিমচন্দ্রের সংশ্লিষ্টতা শুনেই অভ্যস্ত, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না যে, সঞ্জীবচন্দ্রও এই পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন, এক সময় এর সম্পাদক হিসাবেও কাজ করেছেন। বঙ্কিমের ভাষ্যেই শুনি সেই কথাঃ
“বর্ধমানে সঞ্জীবচন্দ্র খুব সুখে ছিলেন। এইখানে থাকিবার সময়েই বাঙ্গালা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁহার প্রকাশ্য সম্বন্ধ জন্মে। বাল্যকাল হইতে সঞ্জীবচন্দ্রের বাঙ্গালা রচনায় অনুরাগ ছিল। কিন্তু তাঁহার বাল্য রচনা কখন প্রকাশিত হয় নাই, এক্ষণেও বিদ্যমান নাই। কিশোর বয়সে শ্রীযুক্ত কালিদাস মৈত্র সম্পাদিত শশধর নামক পত্রে তিনি দুই একটা প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন, তাহা প্রশংসিতও হইয়াছিল। তাহার পর অনেক বৎসর বাঙ্গালা ভাষার সঙ্গে বড় সম্বন্ধ রাখেন নাই। ১২৭৯ সালের ১লা বৈশাখ আমি বঙ্গদর্শন সৃষ্টি করিলাম। ঐ বৎসর ভবানীপুরে উহা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইতে লাগিল। কিন্তু ইত্যবসরে সঞ্জীবচন্দ্র কাঁটালপাড়ার বাড়ীতে একটি ছাপাখানা স্থাপিত করিলেন। নাম দিলেন বঙ্গদর্শন প্রেস। তাঁহার অনুরোধে আমি বঙ্গদর্শন ভবানীপুর হইতে উঠাইয়া আনিলাম। বঙ্গদর্শন প্রেসে বঙ্গদর্শন ছাপা হইতে লাগিল। সঞ্জীবচন্দ্রও বঙ্গদর্শনের দুই একটা প্রবদ্ধ লিখিলেন। তখন আমি পরামর্শ স্থির করিলাম যে আর একখানা ক্ষুদ্রতর মাসিক পত্র বঙ্গদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হওয়া ভাল। যাহারা বঙ্গদর্শনের মূল্য দিতে পারে না, অথবা বঙ্গদর্শন যাঁহাদের পক্ষে কঠিন, তাঁহাদের উপযোগী একখানি মাসিক পত্র প্রচার বাঞ্ছনীয় বিবেচনায়, তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম যে, তাদৃশ কোন পত্রের স্বত্ব ও সম্পাদকতা তিনি গ্রহণ করেন। সেই পরামর্শানুসারে তিনি ভ্রমর নামে মাসিক পত্র প্রকাশিত করিতে লাগিলেন। পত্রখানি অতি উৎকৃষ্ট হইয়াছিল ; এবং তাহাতে বিলক্ষণ লাভও হইত। এখন আবার তাঁহার তেজস্বিনী প্রতিভা পুনরুদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। প্রায় তিনি একাই ভ্রমরের সমস্ত প্রবদ্ধ লিখিতেন ; আর কাহারও সাহায্য সচরাচর গ্রহণ করিতেন না। এই সংগ্রহে যে দুটি উপন্যাস দেওয়া গেল, তাহা ভ্রমরে প্রকাশিত হইয়াছিল।“
এক কাজে তিনি বেশিদিন মন স্থির করে রাখতে পারতেন না। ফলে ভ্রমরেরও অকাল মৃত্যু ঘটলো। ভ্রমরের বদলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে বঙ্গদর্শনেই চলে এলেন তিনি। ১৮৭৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন বন্ধ করে দিলেন। এক বছর বন্ধ ছিলো পত্রিকাটি। এ সময় এটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন সঞ্জীবচন্দ্র। বঙ্কিমের কাছ থেকে স্বত্ত্বাধিকার চেয়ে নেন তিনি। ১৮৭৭ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত বঙ্গদর্শনের সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন তিনি। এ সময়ই তাঁর ‘জাল প্রতাপচাঁদ’, ‘পালামৌ’, বৈজিকতত্ত্ব, এই সব লেখাগুলো বঙ্গদর্শনে ছাপা হয়।
সঞ্জীবচন্দ্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত বইয়ের নাম পালামৌ। এটি একটি ভ্রমণকাহিনি। কিন্তু এতো রসালোভাবে এই ভ্রমণকাহিনি তিনি লিখেছেন যে, এটি একবার হাতে নিলে পাঠকের পক্ষে শেষ না করে উঠে পড়া একরকম অসম্ভবই। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখক হিসাব তাঁর ভাষা দারুণ সতেজ, অসম্ভব সজীব, ঝর্নার মতো গতিময় এবং দুর্দান্ত রকমের আধুনিক।এই বইয়ে লেখক ছোট নাগপুরের প্রাকৃতিক পরিবেশ, অরণ্যবাসী মানুষ, জীবজন্ত্ গাছ-পালা এবং পাখপাখালির বর্ণনা অবিস্মরণীয়ভাবে তুলে ধরেছেন। এই বর্ণনা এতো নিখুঁত, এতো প্রাণবন্ত, এতো শক্তিশালী এতো নির্জলা যে পাঠককে তা এক মুহুর্তের মাঝেই ছোট নাগপুরের প্রত্যন্ত অরণ্যে নিয়ে যায়। বাংলা ভাষায় সাহিত্য পদবাচ্য ভ্রমণ কাহিনি হিসাবে পালামো প্রথম এবং স্বার্থক গ্রন্থ। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে, এই অমর বাক্যটি এই গ্রন্থ থেকেই এসেছে। চন্দ্রনাথ বসু সঞ্জীবনী সুধাতে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ‘সমালোচনা (পালামৌ, দামিনি ও রাজেশ্বরের অদৃষ্ট)’-তে পালামৌ সম্পর্কে লিখেছিলেন এই বলে যে,
“উপন্যাস না হইয়াও পালামৌ উৎকৃষ্ট উপন্যাসের ন্যায় মিষ্ট বোধ হয়। পালামৌর ন্যায় ভ্রমণকাহিনী বাঙ্গালা সাহিত্যে আর নাই। আমি জানি উহার সকল কথাই প্রকৃত, কোন কথাই কল্পিত নয়। কিন্তু মিষ্টতা মনোহারিত্বে উহা সুরচিত উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত ও সমতুল্য।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধে পালামৌ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তিনি পালামৌ সম্পর্কে বলেন,
‘পালামৌ’-ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে সৌন্দর্যের প্রতি সঞ্জীবচন্দ্রের যে-একটি অকৃত্রিম সজাগ অনুরাগ প্রকাশ পাইয়াছে এমন সচরাচর বাংলা লেখকদের মধ্যে দেখা যায় না। সাধারণত আমাদের জাতির মধ্যে একটি বিজ্ঞবার্ধক্যের লক্ষণ আছে–আমাদের চক্ষে সমস্ত জগৎ যেন জরাজীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সৌন্দর্যের মায়া-আবরণ যেন বিস্রস্ত হইয়াছে, এবং বিশ্বসংসারের অনাদি প্রাচীনতা পৃথিবীর মধ্যে কেবল আমাদের নিকটই ধরা পড়িয়াছে। সেইজন্য অশনবসন ছন্দভাষা আচারব্যবহার বাসস্থান সর্বত্রই সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের এমন সুগভীর অবহেলা। কিন্তু সঞ্জীবের অন্তরে সেই জরার রাজত্ব ছিল না। তিনি যেন একটি নূতনসৃষ্ট জগতের মধ্যে একজোড়া নূতন চক্ষু লইয়া ভ্রমণ করিতেছেন। ‘পালামৌ’তে সঞ্জীবচন্দ্র যে বিশেষ কোনো কৌতূহলজনক নতূন কিছু দেখিয়াছেন, অথবা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কিছু বর্ণনা করিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু সর্বত্রই ভালোবাসিবার ও ভালো লাগিবার একটা ক্ষমতা দেখাইয়াছেন। পালামৌ দেশটা সুসংলগ্ন সুস্পষ্ট জাজ্বল্যমান চিত্রের মতো প্রকাশ পায় নাই, কিন্তু যে সহৃদয়তা ও রসবোধ থাকিলে জগতের সর্বত্রই অক্ষয় সৌন্দর্যের সুধাভাণ্ডার উদ্ঘাটিত হইয়া যায় সেই দুর্লভ জিনিসটি তিনি রাখিয়া গিয়াছেন, এবং তাঁহার হৃদয়ের সেই অনুরাগপূর্ণ মমত্ববৃত্তির কল্যাণকিরণ যাহাকেই স্পর্শ করিয়াছে–কৃষ্ণবর্ণ কোলরমণীই হউক, বনসমাকীর্ণ পর্বতভূমিই হউক, জড় হউক চেতন হউক ছোটো হউক বড়ো হউক, সকলকেই একটি সুকোমল সৌন্দর্য এবং গৌরব অর্পণ করিয়াছে।“
পালামৌ বিহারের একটি অঞ্চল। ঘন অরন্যে ছাওয়া এক প্রত্যন্ত অঞ্চল। এখানে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। মূলত সরকারী কাজেই সেখানে গিয়েছিলেন তিনি, কোনো অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে নয়। বঙ্কিমের লেখা থেকে এ বিষয়ে বিশদ জানা যায়।
“গবর্ণমেন্টে তাহাকে কোন গুরুতর কার্য্যের ভার দিয়া পালামো পাঠাইলেন। পালামৌ, তখন ব্যাঘ্র ভল্লুকের আবাসভূমি, বন্য প্রদেশ মাত্র। সুহৃদপ্রিয় সঞ্জীবচন্দ্র সে বিজন বনে একা তিষ্ঠিতে পারিলেন না। শীঘ্রই বিদায় লইয়া আসিলেন। বিদায় ফুরাইলে আবার যাইতে হইল, কিন্তু যে দিন পালামৌ পৌঁছিলেন, সেই দিনই পালামৌর উপর রাগ করিয়া বিনা বিদায়ে চলিয়া আসিলেন। আজিকার দিনে, এবং সে কালেও এরূপ কাজ করিলে চাকরি থাকে না। কিন্তু তাহার চাকরি রহিয়া গেল, আবার বিদায় পাইলেন। আর পালামৌয়ে যে অল্প কাল অবস্থিতি করিয়াছিলেন, তাহার চিহ্ন বাঙ্গালা সাহিত্যে রহিয়া গেল। “পালামৌ” শীর্ষক যে কয়টী মধুর প্রবন্ধ এই সংগ্রহে সঙ্কলিত হইয়াছে, তাহা সেই পালামৌ যাত্রার ফল। প্রথমে ইহা বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়। প্রকাশকালে, তিনি নিজের রচনা বলিয়া ইহা প্রকাশ করেন নাই। “প্রমথনাথ বসু” ইতি কাল্পনিক নামের আদ্যক্ষর সহিত ঐ প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হইয়াছিল। আমার সম্মুখে বসিয়াই তিনি এগুলি লিখিয়াছিলেন, অতএব এ গুলি যে তাঁহার রচনা তদ্বিষয়ে পাঠকের সন্দেহ করিবার কোন প্রয়োজন নাই।“
পালামৌ থেকে ফিরে এসেই তিনি সাথে সাথে সেই ভ্রমণকাহিনিটি লেখেন নি। এর জন্য দীর্ঘ সময় নিয়েছেন। ফিরে আসার পরে বন্ধুদের পৌনঃপুনিক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি এক লাইনও এই বিষয়ে লেখেন নি। অনেক পরে এসে কোনো এক বিচিত্র খেয়ালে লেখা শুরু করেন। যদিও পরিহাস করে তিনি বলেছেন যে, বুড়ো হয়ে গেছেন, তাই এখন গল্প করতে ভাল লাগে, তা সে কেউ শুনুক কিংবা না শুনুক। আমার অবশ্য ধারণা ভিন্ন। সেই সময়ে তিনি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। পত্রিকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ লেখার অভাবে, অনেক সময় সম্পাদকদের নিজেদেরই হাতে কলম তুলে নিতে হয় এর পৃষ্ঠা ভরার কাজের জন্য। তিনি নিজেও খুব সম্ভবত এ কারণেই তখন হাত খুলে লেখা শুরু করেন। তবে, যে কারণেই লিখুন না কেনো, শুধু এটুকুই বলবো যে, ভাগ্যিস লিখেছিলেন, নইলে এমন অপরূপ একটি সাহিত্যকর্ম হারিয়ে যেতো জরায়ূতেই, আলোর মুখ দেখার আগেই।
পালামৌর সবচেয়ে সেরা অংশ কী? এই প্রশ্ন যদি কেউ করে, তবে নিঃসন্দেহে তার উত্তর হবে এর বর্ণনা। শুধু যে প্রকৃতির বর্ণনা তিনি দিয়েছেন অতীব মনোহরভাবে, তা কিন্তু নয়। তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে মানুষ, সেই সাথে তাদের জীবনপ্রণালীও। সেই সময়ে পালামৌতে বসবাস ছিলো কোল জাতির। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তাঁর অসাধারণ বর্ণনাপটুতা দিয়ে তুলে ধরেছেন তাদের জীবনের নানা অংশ। কোলদের নাচের একটা বর্ণনা তিনি দিয়েছেন অনুপমভাবে, সেটা এখানে তুলে ধরছি উদাহরণ হিসাবে।
“যুবতী সকলে হাত ধরাধরি করিয়া অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি রেখা বিন্যাস করিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে বড় চমৎকার হইল। সকলগুলিই সম উচ্চ, সকলগুলিই পাথুরে কাল; সকলেরই অনাবৃত দেহ; সকলেরই সেই অনাবৃত বক্ষে আরসির ধুকধুকি চন্দ্রকিরণে এক একবার জ্বলিয়া উঠিতেছে। আবার সকলের মাথায় বনপুষ্প, কর্ণে বনপুষ্প, ওষ্ঠে হাসি। সকলেই আহ্লাদে পরিপূর্ণ, আহ্লাদে চঞ্চল, যেন তেজঃপুঞ্জ অশ্বের ন্যায় সকলেই দেহবেগ সংযম করিতেছে।
সম্মুখে যুবারা দাঁড়াইয়া, যুবাদের পশ্চাতে মৃন্ময়মঞ্চোপরি বৃদ্ধেরা এবং তৎসঙ্গে এই নরাধম। বৃদ্ধেরা ইঙ্গিত করিলে যুাদের দলে মাদল বাজিল, অমনি যুবতীদের দেহ যেন শিহরিয়া উঠিল। যদি দেহের কোলাহল থাকে, তবে যুবতীদের দেহে সেই কোলাহল পড়িয়া গেল, পরেই তাহারা নৃত্য আরম্ভ করিল। তাহাদের নৃত্য আমাদের চক্ষে নুতন; তাহারা তালে তালে পা ফেলিতেছে, অথচ কেহ চলে না; দোলে না, টলে না। যে যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, সে সেইখানেই দাঁড়াইয়া তালে তালে পা ফেলিতে লাগিল, তাহাদের মাথার ফুলগুলি নাচিতে লাগিল, বুকের ধুকধুকি দুলিতে লাগিল।“
এই বর্ণনায় অভিনবত্ব আছে, অসাধারণ ছন্দময় কাব্য আছে, আছে মাতাল এক আবেশ, সেই সাথে আছে অপূর্ব এক ধরনের সহজ সৌন্দর্য। চন্দ্রকান্ত বসু তাঁর সমালোচনা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, “সঞ্জীববাবুর সৌন্দর্যতত্ত্ব ভাল করিয়া না বুঝিলে তাঁহার লেখাও ভাল করিয়া বুঝা যায় না – ভাল করিয়া সম্ভোগ করা যায় না। কারণ তাঁহার সৌন্দর্যতত্ত্ব কেবলমাত্র তত্ত্ব নয়, তাহার সৌন্দর্য দেখিবার রীতি বা প্রণালীও বটে। এই জন্যই তিনি পালামৌর সেই বাইজীতে গেঙ্গেখালির মোহনার সেই পাখীটির রূপরাশি দেখিয়াছিলেন, এই জন্যই তিনি কোলকামিনীদিগের দেহে কোলাহল দেখিয়াছিলেন।“
কোলকামিনীদের দেহে কোলাহল পড়িয়া গেলো, এই বাক্যের মধ্যে সৌন্দর্য আবিষ্কারের জন্য চন্দ্রকান্ত বসু যে সৌন্দর্যতত্ত্বের কথা বলেছেন, সেই সৌন্দর্যতত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই বর্ণনার সৌন্দর্য উপভোগের জন্য গুঢ় সৌন্দর্যতত্ত্বকে টেনে আনার ঘোর বিরোধী তিনি। চন্দ্রনাথ বসুর সাথে তাই দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেছেন,
“এই বর্ণনাটি সুন্দর, ইহা ছাড়া আর কী বলিবার আছে? এবং ইহা অপেক্ষা প্রশংসার বিষয়ই বা কী হইতে পারে? নৃত্যের পূর্বে আহ্লাদে চঞ্চল যুবতীগণ তেজঃপুঞ্জ অশ্বের ন্যায় দেহবেগ সংযত করিয়া আছে, এ কথায় যে চিত্র আমাদের মনে উদয় হয় সে আমাদের কল্পনাশক্তিরপ্রভাবে হয়, কোনো বিশেষ তত্ত্বজ্ঞান-দ্বারা হয় না। ‘যুবতীদের দেহে কোলাহল পড়িয়া গেল’ এ কথা বলিলে ত্বরিত আমাদের মনে একটা ভাবের উদয় হয়; যে কথাটা সহজে বর্ণনা করা দুরূহ তাহা ঐ উপমা-দ্বারা এক পলকে আমাদের হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া যায়। নৃত্যের বাদ্য বাজিবামাত্র চিরাভ্যাসক্রমে কোল-রমণীদের সর্বাঙ্গে একটা উদ্দাম উৎসাহচাঞ্চল্য তরঙ্গিত হইয়া উঠিল, তৎক্ষণাৎ তাহাদের প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন একটা জানাজানি কানাকানি, একটা সচকিত উদ্যম, একটা উৎসবের আয়োজন পড়িয়া গেল–যদি আমাদের দিব্যকর্ণ থাকিত তবে যেন আমরা তাহাদের নৃত্যবেগে উল্লসিত দেহের কলকোলাহল শুনিতে পাইতাম। নৃত্যবাদ্যের প্রথম আঘাতমাত্রেই যৌবনসন্নদ্ধ কোলাঙ্গনাগণের অঙ্গে প্রত্যঙ্গে বিভঙ্গিত এই-যে একটা হিল্লোল ইহা এমন সূক্ষ্ম, ইহার এতটা কেবল আমাদের অনুমানবোধ্য এবং ভাবগম্য যে, তাহা বর্ণনায় পরিস্ফুট করিতে হইলে ‘কোলাহলে’র উপমা অবলম্বন করিতে হয়, এতদ্ব্যতীত ইহার মধ্যে আর-কোনো গূঢ়তত্ত্ব নাই। যদি এই উপমা-দ্বারা লেখকের মনোগত ভাব পরিস্ফুট না হইয়া থাকে, তবে ইহার অন্য কোনো সার্থকতা নাই, তবে ইহা প্রলাপোক্তি মাত্র।“
আসলে পালামৌ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব ছিলো দ্ব্যার্থবোধক। চন্দ্রনাথ বসু যেখানে পালামৌ নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছেন, এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ সেই কাজটি করেন নি। এর সৌন্দর্যকে তিনি অকৃপণ আওয়াজে দৃশ্যমান করেছেন, এর গুরুত্বকে তিনি সামান্যতমও অস্বীকার করেন নি, আবার এর বাহুল্য জায়গাগুলোতে নিজের আপত্তি জানাতেও কুণ্ঠিত হন নি তিনি। নিঃসংকোচে তাঁর অপছন্দের জায়গাগুলোকে বলে ফেলেছেন তিনি। সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভা নিয়ে কোনো সংশয় তাঁর মনে ছিলো না, কিন্তু সেই প্রতিভাকে হেলাফেলা করেছেন বলেই তিনি বিশ্বাস করেছেন। পালামৌতেও তাঁর ধারণা যে সঞ্জীব ইচ্ছা করলেও অসাধারণ একটা কাজ করতে পারতেন, সেই সম্ভাবনাও ছিলো, সেই সৌন্দর্য উঠেও আসছিলো পালামৌতে। কিন্তু, অনাবশ্যক কিছু কিছু জিনিস নিয়ে আসায় সেই সৌন্দর্যে ঘাটতি হয়ে গিয়েছে। কিংবা বলা যায় যে, প্রকৃত সৌন্দর্যের কেন্দ্র বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে অপ্রয়োজনীয় সৌন্দর্যের আগমনে। কোন্টাকে রাখতে হবে, আর কোনটাকে ছাড়তে হবে, এই প্রজ্ঞা সঞ্জীবচন্দ্র পুরোপুরি দেখাতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যেইঃ
“পালামৌ’ সঞ্জীবের রচিত একটি রমণীয় ভ্রমণবৃত্তান্ত। ইহাতে সৌন্দর্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু পড়িতে পড়িতে প্রতিপদে মনে হয় লেখক যথোচিত যত্নসহকারে লেখেন নাই। ইহার রচনার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে আলস্য ও অবহেলা জড়িত আছে, এবং তাহা রচয়িতারও অগোচর ছিল না। বঙ্কিমবাবুর রচনায় যেখানেই দুর্বলতার লক্ষণ আছে সেইখানেই তিনি পাঠকগণকে চোখ রাঙাইয়া দাবাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছেন–সঞ্জীববাবু অনুরূপ স্থলে অপরাধ স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু সেটা কেবল পাঠকদের মুখ বন্ধ করিবার জন্য–তাহার মধ্যে অনুতাপ নাই এবং ভবিষ্যতে যে সতর্ক হইবেন কথার ভাবে তাহাও মনে হয় না। তিনি যেন পাঠকদিগকে বলিয়া রাখিয়াছেন, ‘দেখো বাপু, আমি আপন ইচ্ছায় যাহা দিতেছি তাহাই গ্রহণ করো, বেশি মাত্রায় কিছু প্রত্যাশা করিয়ো না।
পালামৌ’-ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি যে ছাঁদে লিখিয়াছেন, তাহাতে প্রসঙ্গক্রমে আশপাশের নানা কথা আসিতে পারে–কিন্তু তবু তাহার মধ্যেও নির্বাচন এবং পরিমাণসামঞ্জস্যের আবশ্যকতা আছে। যে-সকল কথা আসিবে তাহারা আপনি আসিয়া পড়িবে, অথচ কথার স্রোতকে বাধা দিবে না। ঝর্ণা যখন চলে তখন যে পাথরগুলোকে স্রোতের মুখে ঠেলিয়া লইতে পারে তাহাকেই বহন করিয়া লয়, যাহাকে অবাধে লঙ্ঘন করিতে পারে তাহাকে নিমগ্ন করিয়া চলে, আর যে পাথরটা বহন বা লঙ্ঘন -যোগ্য নহে’ তাহাকে অনায়াসে পাশ কাটাইয়া যায়। সঞ্জীববাবুর এই ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে এমন অনেক বক্তৃতা আসিয়া পড়িয়াছে যাহা পাশ কাটাইবার যোগ্য, যাহাতে রসের ব্যাঘাত করিয়াছে এবং লেখকও অবশেষে বলিয়াছেন, ‘এখন এ-সকল কচ্কচি যাক।’ কিন্তু এই-সকল কচ্কচিগুলিকে সযত্নে বর্জন করিবার উপযোগী সতর্ক উদ্যম তাঁহার স্বভাবতই ছিল না। যে কথা যেখানে আসিয়া পড়িয়াছে অনাবশ্যক হইলেও সে কথা সেইখানেই রহিয়া গিয়াছে।“
অনাবশ্যক কিংবা আবশ্যক, যে কারণেই হোক না কেনো, সঞ্জীবচন্দ্র যে বর্ণনা পালামৌর দিয়ে গিয়েছেন তা যে পাঠককে পালামৌর সৌন্দর্যে আপ্লুত করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। আর এই সৌন্দর্য বর্ণনা করাও হয়েছে রসে ভিজিয়ে ভিজিয়ে, উপাদেয় করে। সুতীক্ষ্ণ রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে সবকিছুকেই অত্যন্ত রসাত্মক ঢঙে পরিবেশন করেছেন তিনি। কোল জাতির একটা অংশের বিয়ের যে সরস বর্ণনা তিনি লিখেছেন, সেটি তুলে দিচ্ছি এখানে। এরকম বর্ণনা পুরো বিষয়টাকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসে ভীষণ রকমের জীবন্ত করে। পাঠক উৎসুক হয়ে, গভীরভাবে মগ্ন হয়ে নিমজ্জিত হয়ে যান লেখকের হাতের যাদুর ছোঁয়ায়।
“তাহাদের সকল জাতির মধ্যে একরূপ বিবাহ নহে। এক জাতি কোল আছে, তাহারা উরাঙ কি, কী তাহা স্মরণ নাই, তাহাদের বিবাহপ্রথা অতি পুরাতন। তাহাদের প্রত্যেক গ্রামের প্রান্তে একখানি করিয়া বড় ঘর থাকে। সেই ঘরে সন্ধ্যার পর একে একে গ্রামের সমুদয় কুমারীরা আসিয়া উপস্থিত হয়, সেই ঘর তাহাদের ডিপো। বিবাহযোগ্য হইলে আর তাহারা পিতৃগৃহে রাত্রিযাপন করিতে পায় না। সকলে উপস্থিত হইয়া শয়ন করিলে গ্রামের অবিবাহিত যুবারা ক্রমে ক্রমে সকলে সেই ঘরের নিকটে আসিয়া রসিকতা আরম্ভ করে, কেহ গীত গায়, কেহ নৃত্য করে, কেহবা রহস্য করে। যে কুমারীর বিবাহের সময় হয় নাই, সে অবাধে নিদ্রা যায়। কিন্তু যাহাদের সময় উপস্থিত, তাহারা বসন্তকালের পক্ষিণীর ন্যায় অনিমেষলোচনে সেই নৃত্য দেখিতে থাকে, একাগ্রচিত্তে সেই গীত শুনিতে থাকে। হয়তো থাকিতে না-পারিয়া শেষে ঠাট্টার উত্তর দেয়, কেহবা গালি পর্যন্ত দেয়। গালি আর ঠাট্টা উভয়ে প্রভেদ অল্প, বিশেষ যুবতীর মুখবিনির্গত হইলে যুবার কর্ণে উভয়ই সুধাবর্ষণ করে। কুমারীরা গালি আরম্ভ করিলে কুমারেরা আনন্দে মাতিয়া উঠে।
এইরূপে প্রতিরাত্রে কুমার-কুমারীর বাকচাতুরী হইতে থাকে, শেষ তাহাদের মধ্যে প্রণয় উপস্থিত হয়। প্রণয় কথাটি ঠিক নহে। কোলেরা প্রেমপ্রীতের বড় সম্বন্ধ রাখে না। মনোনীত কথাটি ঠিক। নৃত্য হাস্য-উপহাস্যের পর পরস্পর মনোনীত হইলে সঙ্গী, সঙ্গিনীরা তাহা কানাকানি করিতে থাকে। ক্রমে গ্রামে রাষ্ট্র হইয়া পড়ে। রাষ্ট্র কথা শুনিয়া উভয় পক্ষের পিতৃকুল সাবধান হইতে থাকে। সাবধানতা অন্য বিষয়ে নহে, কুমারীর আত্মীয়-বন্ধুরা বড় বড় বাঁশ কাটে, তীর-ধনুক সংগ্রহ করে, অস্ত্রশস্ত্রে শান দেয়। আর অনবরত কুমারের আত্মীয়-বন্ধুকে গালি দিতে থাকে। চিৎকার আর আস্ফালনের সীমা থাকে না। আবার এদিকে উভয়পক্ষে গোপনে গোপনে বিবাহের আয়োজনও আরম্ভ করে।
শেষ একদিন অপরাহ্ণে কুমারী হাসি-হাসি মুখে বেশ বিন্যাস করিতে বসে। সকলে বুঝিয়া চারিপার্শ্বে দাঁড়ায়। হয়তো ছোট ভগিনী বন হইতে নূতন ফুল আনিয়া মাথায় পরাইয়া দেয়। বেশ বিন্যাস হইলে কুমারী উঠিয়া গাগরি লইয়া একা জল আনিতে যায়। অন্য দিনের মতো নহে, এ দিনে ধীরে ধীরে যায়, তবু মাথায় গাগরি টলে। বনের ধারে জল, যেন কতই দূর! কুমারী যাইতেছে আর অনিমেষলোচনে বনের দিকে চাহিতেছে। চাহিতে চাহিতে বনের দুই-একটি ডাল দুলিয়া উঠিল। তাহার পর এক নবযুবা, সখা সুবলের মতো লাফাইতে লাফাইতে সেই বন হইতে বহির্গত হইল, সঙ্গে সঙ্গে হয়তো দুটা-চারিটা ভ্রমরও ছুটিয়া আসিল। কোল কুমারীর মাথা হইতে গাগরি পড়িয়া গেল। কুমারীকে বুকে করিয়া যুবা অমনি ছুটিল। কুমারী সুতরাং এ অবস্থায় চিৎকার করিতে বাধ্য। চিৎকারও সে করিতে লাগিল, হাত–পাও আছড়াইল এবং চড়টা চাপড়টাও যুবাকে মারিল; নতুবা ভালো দেখায় না! কমারীর চিৎকারে তাহার আত্মীয়েরা ‘মার মার’ রবে আসিয়া পড়িল। যুবার আত্মীয়েরাও নিকটে এখানে-সেখানে লুকাইয়া ছিল, তাহারাও বাহির হইয়া পথ রোধ করিল। শেষে যুদ্ধ আরম্ভ হইল। যুদ্ধ রুক্মিণীহরণের যাত্রার মতো, সকলের তীর আকাশমুখী। কিন্তু শুনিয়াছি, দুই-একবার নাকি সত্যসত্যই মাথা ফাটাফাটিও হইয়া গিয়াছে। যাহাই হউক, শেষ যুদ্ধের পর আপোষ হইয়া যায় এবং তৎক্ষণাৎ উভয় পক্ষ একত্র আহার করিতে বসে।
এইরূপ কন্যা-হরণ করাই তাহাদের বিবাহ। আর স্বতন্ত্র কোনো মন্ত্রতন্ত্র নাই। আমাদের শাস্ত্রে এই বিবাহকে আসুরিক বিবাহ বলে।”
এখন থেকে একশো পয়ত্রিশ বছর আগ যে সহজ, সরল, সরস এবং মিষ্টি-মধুর ভাষার প্রয়োগে সঞ্জীবচন্দ্র পালামৌ লিখেছিলেন, তা পড়ে বিস্মিত হওয়া ছাড়া গতি থাকে না। সঞ্জীবচন্দ্রের আগেও কেউ কেউ ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছে বাংলা সাহিত্যে, কিন্তু সঞ্জীবের পালামৌর মতো এমন রমণীয়, কমনীয় তিলোত্তমা রূপে সেগুলো ধরা দেয় নি পাঠকের বাহুডোরে। শুধু সেই সময়ের পাঠকই নয়, আজকের পাঠকের কাছেও পালামৌ হৃতযৌবনা, রূপ-রস হারানো প্রাচীনা কেউ নয়, বরং তার রূপসুধা সৌন্দর্য এখনো সমভাবে প্রস্ফুটিত, এখনো সমান আকর্ষণীয়া সে।
দারুন লাগল
খুবই গভীর রাত, ঘুম নেই;পড়লাম আগ্রহ নিয়ে একটানে। তথ্যবহুল অথচ প্রাঞ্জল বর্ণনা; ফরিদীয় রচনা ব’লেই হয়ত। ধন্যবাদ।
মুগ্ধ হয়ে ছিলাম পালামৌ পড়ে। এই লেখাটা পড়তে পড়তে তার কিছু টুকরো স্মৃতি ফিরে আসলো মনে। এর পিছনের ঘটনাবলী, সঞ্জীবচন্দ্রের জীবন, তাঁর ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন এগুলো বেশি জানাছিলো না। সেই হিসাবে এই লেখাটা একট অনন্য সংযোগজন হয়ে রইলো।
প্রতিভা বনাম গৃহিনী পনার উপমাটাও ভাল লাগল। আসলেই সেলফটিসিপ্লিন ছাড়া বিকাশ সম্ভব নয়।