কাকতাল বলতে কী বোঝায় আর কাকতালে কেনই বা আমরা বিস্ময়াভীভূত হই? অভিধান ঘেঁটে কাকতাল অর্থ পাওয়া গেল এমন: “কার্যকারণ সম্বন্ধ নাই অথচ একসঙ্গে সঙ্ঘটিত দেখিয়া মনে হয় পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত”। এবার বিষয়টি একটু ব্যখ্যা করা যাক। ধরা যাক আপনার সাথে আপনার অফিসের বসের বেশ রাগারাগি হলো। আপনি তাঁর প্রতি বেশ অসন্তুষ্ট হওয়ায় বাসায় ফিরে ঠান্ডামাথায় সেটি নিয়ে ভাবলেন এবং পুরো বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার বসের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর মৃত্যু কামনা করে বসলেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আপনার বসের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলেন!
এই ঘটনাকে আপনি কীভাবে ব্যখ্যা করবেন? আপনি হয়তো মনে করতে পারেন আপনার নিশ্চয়ই কোনো আধ্যাত্মিক মারণাত্মক ক্ষমতা আছে যার ফলে আপনি ইচ্ছে করলে যে কারো মৃত্যু কামনার মাধ্যমে তাকে মেরে ফেলতে পারেন! এই ভেবে হয়তো আপনার শত্রুদের তালিকা করে ‘টেলিপ্যাথির’ মাধ্যমে তাদের হত্যা করতে উদ্যত হলেন কিন্তু আপনার বস ব্যাতীত বাকী সবার ক্ষেত্রেই আপনাকে নিরাশ হতে হলো! আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার সমস্যাটি কোথায়? প্রাণঘাতী ক্ষমতাটি কেন শুধু বসের ক্ষেত্রেই কাজ করল আর কারো ক্ষেত্রেই কাজ করল না? এসব ভেবে আপনার বেশ মন খারাপ হতে লাগল।
কিন্তু আপনি যদি বিষয়টিকে আরেকটু যৌক্তিক ভাবে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করতেন তাহলে আপনাকে শেষ পর্যন্ত মন খারাপ করতে হতো না। প্রথমত খোঁজ নিলে জানতে পাবেন প্রতিদিন আপনার মতোই হাজারো মানুষ তার বসের মৃত্যু কামনা করছেন এবং তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে দু’চারজন করে মারা যাচ্ছেন। শুধু তাই নয় আপনি নিজেও এর আগে বিভিন্ন সময়ে বসের সাথে রাগারাগির পর তাঁর মৃত্যু কামনা করেছেন কিন্তু ‘সফল’ হয়েছেন শুধু এবারই। তাহলে বিষয়টিকে ব্যখ্যা করা যায় কীভাবে? আসুন একটু যৌক্তিকভাবে চিন্তা করি। সম্ভাব্যতার আলো বিষয়টি দেখা যাক। প্রথমতঃ যেহেতু তিনি আপনার বস কাজেই ধরে নেওয়া যায় তাঁর বয়সও অনেক বেশি, এবং বার্ধক্য জনিত শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনাও আছে যথেষ্ট। এসব জটিলতার যে কোনো একটির মাধ্যমে তাঁর মৃত্যু ঘটতে পারে বেশ সহজে। আর যেহেতু আপনার মতোই আরো হাজার হাজার মানুষ তাঁদের বসের মৃত্যু কামনা করেছেন এবং তাদের মধ্যে দু’চার জনের মৃত্য ঘটাই বরং বেশ স্বাভাবিক।
আপনি কেন? অর্থাৎ আপনার ক্ষেত্রেই কেন বিষয়টি ঘটল? এটি লটারীতে প্রথম পুরষ্কার পাওয়ার মতোই বিষয়। একটি লটারীর জন্য হয়তো এক লাখ মানুষ টিকিট কেটেছেন যাঁদের মধ্যে কেবল একজনই প্রথম পুরষ্কারটি পাবেন। যিনি পাবেন তিনি হয়তো ভাবতে পারেন বিষয়টি খুবই অদ্ভুত। তিনি নিশ্চয় বিশেষ কেউ যাঁকে লটারীর টিকেটের জন্য মনোনীত (!) করা হয়েছে। কিন্তু বাকী নিরানব্বই হাজার নয়শ’ নিরানব্বই জন যাঁরা টিকেট কেটেছেন তাঁদের কাছে বিষয়টি বেশ স্বাভাবিকই মনে হবে। কারণ কাউকে না কাউকে তো প্রথম পুরষ্কারটি পেতেই হবে। যদি কেউই পুরষ্কারটি না পেত তাহলেই বরং বিষয়টি হতো অস্বাভাবিক এবং অগ্রহণযোগ্য। সেই ক্ষেত্রে লটারীর উদ্যোক্তাকে এর জন্য দায়ী করা হতো। অর্থাৎ একটি ঘটনা যখন ঘটার সম্ভাবনা থাকে লাখে একবার এবং তা নিজের উপরই ঘটে তখনই মানুষ কেবল ঘটনাটিকে অদ্ভুত মনে করে সেখানে অলৌকিত্ব খুঁজে পায়।
অনেক সময় একটি ঘটনা বাহ্যিক ভাবে আমাদের কাছে অনেকটাই অসম্ভব বলে মনে হতে পারে বা সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ মনে হতে পারে কিন্তু গাণিতিক ভাবে হয়তো সেই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশী। শুধুমাত্র গাণিতিক বিষয়টি আমাদের জানা না থাকায় সেটিকে আমাদের অনেক বেশী কাকতালীয় বলে মনে হয়। উদাহরণ হিসেবে জন্মদিনের সম্ভাব্যতার কথা বলা যায় যেটি নিয়ে আমি গণিতের সৌন্দর্য বইয়ের প্রথম অনুচ্ছেদে আলোচনা করেছিলাম। আমরা সেখানে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলাম কোথাও যদি ২৩ জন লোক উপস্থিত থাকে তাহলে তাদের মধ্যে দুজনের জন্মদিন একই হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি। কোথাও যদি ১০০ জন লোক থাকে তাহলে মোটামুটি নিশ্চিৎভাবেই সেখানে এমন একজোড়া পাওয়া যাবে যাদের জন্মদিন একই। গাণিতিক ভাবেই এই বিষয়টি প্রমাণীত। আপনার যদি বিষয়টি না জানা থাকে এবং একটি বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেনীতে যদি আপনাকে জন্মদিনের জরিপ করার জন্য পাঠানো হয় তাহলে সেসব শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে জন্মদিনের মিল দেখে বিস্ময়াভীভূত হওয়াই আপনার পক্ষে স্বাভাবিক।
এই ধরনের একটি মজার খেলা খেলা যেতে পারে যার মূলনীতি উপরোক্ত জন্মদিনের মতোই। নিয়মটি হচ্ছে এমন: ১০ জন মানুষকে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যা লিখতে দেওয়া হবে যেন প্রত্যেকে এমন একটি সংখ্যা লেখার চেষ্টা করেন যা অন্য কারো সংখ্যার সাথে মিলবে না। বিস্ময়কর হলেও গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দেওয়া যায় যে একতৃতীয়াংশের বেশী ক্ষেত্রেই ১০ জনের মধ্যে দুইজনের সংখ্যা মিলে যাবে! বাস্তবিক ক্ষেত্রে বিষয়টি হবে আরো অদ্ভুত। যেহেতু প্রতি মানুষেরই চিন্তা ধারায় খানিকটা মিল আছে তাই শেষপর্যন্ত খেলতে গিয়ে দেখা যাবে দু’বারের মধ্যেই একবার দুজনের সংখ্যার মধ্যে মিল পাওয়া যাচ্ছে। কেননা আপনাকে যখন বলা হবে এমন একটি সংখ্যা বাছাই করতে যার সাথে অন্য কারো সংখ্যার মিল থাকবে না তখন আপনি বিদঘুটে একটি সংখ্যা চিন্তা করে বের করতে চেষ্টা করবেন। অন্যরাও একইভাবেই চেষ্টা করবে। এবং তখন দেখা যাবে সবারই চিন্তা বিশেষ কিছু সংখ্যার প্রতি নিবিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যাটি লেখা হচ্ছে ৫০ এর চেয়ে বড়। আপনি নিজের ক্ষেত্রেই চিন্তা করে দেখুন না। শুরুতে যখন আপনাকে এই খেলাটির নিয়ম বর্ণনা করা হচ্ছিলো তখন আপনি ৫০ এর নীচে সংখ্যা চিন্তা করতে পেরেছিলেন কি? মাইন্ডগেমগুলো খেলার ক্ষেত্রে মানুষের মনের চিন্তাধারার এই প্যাটার্নটিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেক সময় মঞ্চে উপবিষ্ট জাদুকর এই পদ্ধতিতে হয়তো দর্শকের মন পড়ে ফেলতে পারেন। একটি শর্ত আরোপ না করে অনেক সময় এমন একাধিক শর্ত আরোপ করা হয় যাতে করে আপানার চিন্তাধারা একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে নিবিষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে কাকতালীয় বিষয়টি আর কাকতালীয় থাকে না।
ঘটনার মিল ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে কাকতাল কল্পনা করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ ২৯৯৭৯২৪৫৮ মিটার/সেকেন্ড। অপরদিকে মিশরের গিজায় অবস্থিত গ্রেট পিরামিডের পৃথিবীতে অবস্থান ২৯.৯৭৯২৪৫৮ ডিগ্রি অক্ষাংশ! এতে করে কী প্রমাণ হয় মিশরীয় সভ্যতায় আলোর গতিবেগ এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা সম্বন্ধে ভালো ধারনা ছিলো? এমনিতেই মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার আর গাল-গল্পের শেষ নেই। অনেকেই মনে করেন মিশরীয়দের অভিকর্ষ বল উপেক্ষা করার প্রযুক্তি ছিলো যার ফলে তারা ভারী ভারী পাথর শূন্যের ভাসিয়ে (!) পিরামিড তৈরি করেছে। আবার অনেকেই বলেন মিশরীয়রা বায়ুমন্ডল থেকে মুক্ত শক্তি নিষ্কাশন করে তা দিয়ে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালাতে পারত। কিংবা এমনও ধারনা আছে ভিনগ্রহ থেকে আগন্তুক এসে মিশরের পিরামিড আর তাদের সভ্যতা নির্মান করে দিয়ে গেছে। এধরনের সাংখ্যিক কাকতাল সেই আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু একটু যৌক্তিকভাবে চিন্তা করে দেখুন। আলোর বেগের এস আই এককের পরে যদি দশমিক বসানো হয় তাহলে পৃথিবীতে সেই মানের লক্ষ্যাধিক অক্ষাংশ কিংবা লক্ষ্যাধিক দ্রাঘিমাংশ কল্পনা করা যায় যেগুলো হয়তো একেক টুকরো জমি নির্দেশ করবে। এই হাজার হাজার খন্ড জমির মধ্যে যে কোন একখন্ড জমিতে তো কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অবস্থান করতেই পারে। যদি অবস্থান না করতো তাহলেই তা হতো অস্বাভাবিক! আর তাছাড়া আলোর গতি ছাড়াও জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুব সংখ্যা আছে আরো গোটা তিরিশেক। এই সবগুলো যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে সম্ভাব্যতার আলোকে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার স্থানাঙ্কের সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুবকের মান মিলিয়ে দেখা সম্ভব। এর বাইরেও কথা আছে। হয়তো ভাবছেন একটি সংখ্যার এতগুলো মান পুরোপুরি মিলে যাওয়া কাকতালীয় হতে পারে না। কিন্তু পিরামিডের অক্ষাংশ যে দশমিকের পর সাতঘর পর্যন্ত প্রকাশ করতে হবে তা কে বলেছে। বরং পিরামিডের কেন্দ্রবিন্দুর অক্ষাংশ দশমিকের পর চারঘর পর্যন্ত প্রকাশ করলেই চলে। চারঘরের পর আমাদের ইচ্ছেমত অংক বসালেও তা পিরামিডের অভ্যন্তরীন কোনো বিন্দু প্রকাশ করবে।
উপরে যদিও একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে কিন্তু সংখ্যাবাচক বা নিউমারলজিক্যাল কাকতালের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কেননা, নিউমারলজি অনুযায়ী কোনো কিছুর নাম বা অন্যান্য বিষয়গুলোকে বিভিন্ন সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় এবং তাদের মধ্যকার বিভিন্ন মিল বা প্যাটার্ন খুঁজে বের করা হয়। জ্যোতিষচর্চাকরীরা এই পদ্ধতিতে কাজ করেন। আমরা উদাহরণ হিসেবে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইনটাওয়ারের বিমান হামলার ঘটনাটি বিবেচনা করতে পারি। সেই ঘটনাগুলো ঘটনার পর অনেকেই এর সাথে বিভিন্ন অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপারের সম্পর্ক খুঁজে পেতে শুরু করেছিলেন। তথ্যগুলো বেশ চমকপ্রদ (আসলে কেন চমকপ্রদ নয় পাশে তা-ও উল্লেখ করা হলো):
- আক্রমনের দিনটি ছিলো ৯/১১ = ৯ + ১+ ১ = ১১ (সালটি বাদ গেলো কেন)
- প্রতিটি ভবন ১১০ তলা করে। (মেলানোর জন্য একটি অংক বাদ দিতে হলো।)
- সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ বছরের ২৫৪তম দিন: ২ + ৫ +৪ = ১১ (সাপ্তাহ বা বছর বা অন্যান্য ভাবে অন্যন্য যেকোন সংখ্যা বের করে আনা সম্ভব)
- ইরাক/ইরানের এরিয়া কোড ১১৯: ১+১+৯= ১১। যুক্তরাষ্টের এরিয়া কোড ৯১১ যা বিপরীতধর্মীতা তথা শত্রুতার ইঙ্গিত প্রকাশ করে। (এই হিসেবে আরো অনেকগুলো দেশের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা থাকার কথা।)
- পাশাপাশি স্থাপিত ভবন দুটিকে একসাথে ইংরেজিতে ১১ এর মতো দেখায়। (ভবনের কমোডগুলোর খোলা অংশগুলোকে ০ এর মতো দেখায়!)
- প্রথম হামলাকারী বিমানটির ফ্লাইট নম্বর ১১। (বিমান উড্ডয়নের সাথে অনেকধরনের নম্বরই জড়িত থাকে)
- নিউইয়র্ক স্টেট হলো যুক্তরাষ্ট্রের ১১ তম স্টেট। (ওয়াশিংটন?)
- NEW YORK CITY তে ১১ টি বর্ণ রয়েছে। (যদি ১২ টি বর্ণের প্রয়োজন হতো তাহলে হয়তো অন্য কোনো কিছু যেমন: মহল্লা বা ডাকঘর বা বাসস্টপ এসবের সাথে মেলানো হতো।)
- AFGHANISTAN শব্দটিতে ১১ টি বর্ণ রয়েছে। (ইরাক, বা আলকায়েদা বা অন্যকিছুর সাথে মেলানো হয় নি কেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শহর ধরা হয়েছে আর এই ক্ষেত্রে দেশের নাম কেন।)
- THE PENTAGON এ ১১ টি বর্ণ রয়েছে। (নিউইয়র্কের আগে দি বসানো হয়নি কিন্তু পেন্টাগনের আগে দি বসানো হয়েছে। তাছাড়া পেন্টাগণ ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রথমটি শহর হলে এটি ভবনের নাম ধরা হবে কেন।)
- ১৯৯৩ সালে টুইন টাওয়ারে বোমা হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে দোষী সাব্যাস্ত RAMZI YOUSEF এর নামে ১১ টি বর্ণ রয়েছে। (অসাধারণ মিল বটে! ১৯৯৩ সালের কোথাকার কে তার সাথে মিল খুঁজে বের করা হযেছে। খুঁজলে এই লোকের শ্যালকের ভায়রা ভাইয়ের খালুর নামেও ১১ টি বর্ণ খুঁজে পাওয়া গেলে আশ্চর্ষ হবো না!)
- ফ্লাইট ১১ এর বিমানে ১১ জন বিমানক্রু ছিলো। (বাকী ফ্লাইটগুলোতে কতজন ছিলো?)
একটু চেষ্টা করলেই ধরতে পারবেন শুধু ১১ নয় অন্য যেকোন সংখ্যা দিয়েও আমরা এই ধরনের একটি প্যাটার্ন বানিয়ে ফেলতে পারব। আপনার আসে-পাশে ঘটা কোনো ঘটনা দিয়ে পরীক্ষা করেই দেখুন না।
এতো গেলো সংখ্যার প্যাটার্ন। প্রকৃতির বিভিন্ন ছবি বা শব্দের সাথে বিভিন্ন পরিচিত অথচ সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুর মিল বেরিয়ে যাওয়া এবং সেসব মিল দেখে চমৎকৃত হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু এর অত্যন্ত সহজ ব্যখ্যা রয়েছে। মানুষের মস্তিষ্ক সবসময় তার দৃশ্যমান বিষয়কে পরিচিত বিষয়াবলীর সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। নীচের মৌখিক অভিব্যক্তিগুলো দেখুন:
এগুলো কি আদৌ কোনো মৌখিক অভিব্যক্তি? এসব তো কেবল কিছু রেখা, বিন্দু আর বৃত্তের সমন্বয়ে তৈরি চিত্র। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক এগুলোকে শুধু মানুষের মুখমন্ডল হিসেবেই চিহ্নিত করেনি বরং সেগুলোতে বিভিন্ন অভিব্যক্তিও বসিয়ে দিয়েছে। এই ভাবেই বিভিন্ন সময় এসব কাকতালীয় বিষয়গুলোকে সম্পর্কযুক্ত করে অলৌকিক্ত প্রচার করা হয়। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা প্রায়শঃই বিভিন্ন বস্তুতে ধর্মীয় বিভিন্ন নিদর্শন আবিষ্কার করে সেগুলোকে অলৌকিক হিসেবে দেখে তাঁদের ধর্মবিশ্বাস জোরদার করার চেষ্টা করেন।
এধরনের একটি মজার ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৫৪ সালে কানাডিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাণী এলিজাবেথের ছবি সংবলিত একটি পাঁচ ডলারের নোট প্রকাশ করে। কিন্তু নোটটি বাজারে আসার পর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অভিযোগ আসতে থাকে যে নোটটিতে রানীর চুলের একটা অংশে শয়তানের অবয়ব ফুটে আছে। আপত্তির মুখে এক পর্যায়ে ব্যাংকটি পাঁচ ডলারের বিলটির সবগুলো নোট নষ্ট করে ফেলে এবং নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে ছাড়ে।
কাকতালীয় ঘটনাগুলোর বা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলেই সেগুলো সহজে আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু অন্যান্য ঘটনাগুলোও কাকতালীয় ঘটনাগুলোর মতোই বিরল। যেমন: বিজ্ঞানী নিউটনের জন্মদিন ৪ জানুয়ারী, অপরদিকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্মদিন ১৪ মার্চ। দুজন মানুষের জন্মদিন একই সাথে ৪ জানুয়ারী এবং ১৪ মার্চ হওয়ার সম্ভাবনা ১/৩৬৫ X ১/৩৬৫ বা, ১/১৩৩২২৫ অর্থাৎ ১ লাখ ৩৩ হাজার ২২৫ বারের মধ্যে একবার। কিন্তু এই বিরল বিষয়টি যে নিউটন আর আইনস্টাইনের মধ্যে ঘটে গেছে সেই বিষয়ে আমরা কখনো আগ্রহ দেখাই না! অনেকেই বিবর্তনবাদ বর্জন করার জন্য এধরনের যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা বলে থাকেন বিবর্তনের মতো একটি বিষয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন আমাদের জগৎটি নানাবিধ ক্ষীণ সম্ভাবনার ঘটনা দিয়েই পরিপূর্ণ। উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। মনে করুন, আপনি চার সেট তাস থেকে একটি করে তাস দৈব ভাবে বেছে নিয়েছেন এবং তারপর আবিষ্কার করেছেন তাসের বিন্যাসটি হচ্ছে হরতনের বিবি, হরতনের ৭, রুইতনের গোলাম আর ইস্কাপনের ৩। এখন আপনি যে বিন্যাসটি পেয়েছেন তা পাওয়ার সম্ভাবনা হচ্ছে ১/৫২ X ১/৫২X ১/৫২ X ১/৫২ বা ১/৭৩,১১,৬১৬ অর্থাৎ প্রতি ৭৩ লক্ষ ১১ হাজার ৬১৬ বারের মধ্যে একবার। এবং আপনার পরে এই একই বিন্যাসের তাস কাছাকাছি সময়ে আর কারো তুলতে পারার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। আপনি কিন্তু এই বিরল কাজটি ঠিকই করে দেখিয়েছেন।
কাজেই কখনো যদি কাকতালীয় ঘটনা ঘটতে দেখেন তাহলে অলৌকিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করার আগে যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখুন। হয়তো আপনি যা কাকতালীয় ভাবছেন সেগুলোর মধ্যে আসলে কোনো সম্পর্ক রয়েছে যা আপনি উপেক্ষা করতেই স্বস্তি বোধ করছেন বেশি! কিংবা এটি হয়তো আসলেই একটি কাকতাল যা তার ঘটার সম্ভাবনা অনুযায়ীই ঘটেছে। মানুষের জীবনে প্রতিদিনই দু’একটি করে ছোট-খাটো কাকতালীয় ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। বছরে দুএকবার বেশ চমকে দেওয়ার মতো কাকতালীয় ঘটনা ঘটতেই পারে। আর সমগ্র জীবদ্দশায় দু’একবার একেবারে অবিশ্বাস্য ধরনের কাকতালও (মৃত্যুকামনার পরদিন আপনার বসের মৃত্যুঘটার মতো)নিশ্চয় ঘটবে ।
সংখ্যা নিয়ে ধস্তাধস্তি করে কিছু প্যাটার্ন খুঁজে বের করে তারপর সেটাকে কুদরত বলে দাবী যারা করে তাদের যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে না। উদাহরন তৈরী করে দেখাতে হবে। আমার খুব ইচ্ছা করে কোন বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, যেমন গীতাঞ্জলি, নিয়ে ওয়ার্ডসার্চ অপশন ব্যবহার করে এরকম সংখ্যাতাত্বিক ঝাঁকাঝাঁকি করে সেটাকে ‘অলৌকিক’ প্রমান করে দিই। নেহাত ধৈর্য নেই বলে বোধহয় পেরে উঠবো না। কিন্তু এরকম একটা কিছু মনে হয় করা দরকার।
গীতাঞ্জলি সহ অন্য যেকোনো বইয়েই এরকম প্যাটার্ন পাবেন। তবে আগে অভ্যেস না থাকলে একটু সময় লাগতে পারে আরকী। সেই ক্ষেত্রে একজন জোতিষীকে এই কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন!
ফেইস বুকে প্রায়ষঃই দেখি কোন ফলের বা সবজির ভেতরে আরবী হরফের প্যাটার্ণ নিয়ে লোকজন আল্লাহর কুদরত খোঁজেন। সম্ভবত আল্লাহ লেখা খোঁজেন।আমি এরকম প্যাটার্ণসহ বিভিন্ন ছবি প্রকৃতিতে দেখি। শ্যাওলা ধরা দেয়ালেও দেখি। শুকনা টেবিলে জল পড়লে জলের দাগেও বিভিন্ন ছবি হয়। বৃষ্টি পর প্যাঁক কাদায় ও হাঁটা চলার পরও বিভিন্ন প্যাটার্ণ তৈরি হয়। প্যাঁক কাদায় অবশ্য আরবী হরফের প্যাটার্ণ দেখি এ কথাটি বললে সমস্যা আছে। একবার ফেইস বুকে একটা ছবি দেখলাম দুটো গাছের বা একটা গাছের দুটো ডাল একটা আরেকটার উপরে এমনভাবে লেগেছে যে আরবী আল্লাহ লেখার প্যাটার্ণ হয়ে গেছে। এ নিয়ে সে কি আদিখেতা! এ সব নিয়ে কিছু বলা মুশকিল। একজনের পোস্টে একটা যৌক্তিক মন্তব্য করয়তে গিয়ে তো হাংগামাই বাঁধিয়ে দিয়েছি।তাদের কাছে কাকতালীয় বলে কিছু নেই। সবই আল্লাহর হুকুমে হয়। আল্লাহ যে সর্বত্র বিরাজমান তা ফল সবজির ভেতরেও হরফে প্রমাণ দেন। যাহোক, লেখাটি ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আপনি যেসবের কথা উল্লেখ করলেন শুধু সেসব নিয়েই মুক্তমনাতেই একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। এই বিষয়টির একটি নাম আছে: প্যারিডোলিয়া। আমার পোস্টে এগুলোই ব্যখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম তখন। আপনার আগ্রহ থাকলে দেখতে পারেন। https://blog.mukto-mona.com/2012/08/04/28062/
লিংককে গিয়ে পড়লাম। ভালো লেগেছে। আগে কী করে আমার পড়া হয়নি, ভাবছি।
ধন্যবাদ।
ভাল লেগেছে লেখাটি। প্রয়োজন ছিল এর।
মাঝে মাঝে কিছু কাকতালীয় ঘটনা বেশ ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়।
ধন্যবাদ। আপনিও একটি লেখা দিয়েছেন দেখলাম। সেটি এখনো যদিও পড়িনি তবে কিছু মন্তব্য করে দেয়া যায়। হেডলাইন দেখে শুরুতেই যা মাথায় এসেছে, আমরাতো সবকাজই করি প্রকৃতি বিরুদ্ধ। রোগ হলে হাসপাতালে যাই তাওতো প্রকৃতি বিরুদ্ধ। জন্মবিরতিকরণের কনসেপ্টটাওতো প্রকৃতি বিরুদ্ধ! রান্না করে খাবার খাই সেটি বা প্রাকৃতিক হয় কিকরে। ভালো থাকবেন। 🙂
মুক্তমনার ইমোটিকনগুলো কোথায়!