ধর্মের দোহাই দিয়ে, বাঙালী নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে শারীরিক ভাবে বিচ্ছিন্ন রাখার যে ষড়যন্ত্র বহুযুগ ধরে চলে আসছিল এর মুল উৎপাটনে পথে বেগম রোকেয়ার ভূমিকা অস্বীকার্য। ১৯০৪ সালে ২৪ বছর বয়সী রোকেয়া দৃঢ় ভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছিলেন। তার মত মেধাবী, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মননশীল,সাহসী নারী বাঙালী সমাজে আজও বিরল।
তার সাহিত্য যেমন কালজয়ী তেমন তার প্রখর চিন্তাশক্তি, যুক্তি-বোধ অনেক পুরাতন কুসংস্কার ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল।
তাকে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত করার হলেও এটা তার কাজের সামান্য একটা পরিচয় মাত্র ।
শুধু মুসলিম সমাজ নয়, তিনি সমগ্র বাঙালী সমাজে নারী কে মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন।ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি নারী কে তারস্ব-মহিমায় প্রজ্বলিত হবার শক্তি যুগিয়েছেন।
তিনি তার // আমাদের অবনতি // শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন ,
যখনি কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছে, তখনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমরা প্রথমত যাহা সহজে মানি নাই তাঁহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি।…আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশ জনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন , তিনি আপনাকে দেবতা কিংবা ঈশ্বর প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ।। ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি-বিবেচনা বৃদ্ধি হইয়াছে সেরূপ পয়গম্বর দিগকে(অর্থাৎ ঈশ্বর প্রেরিত মহোদয়া দিগকে) এবং দেবতা দিগকেও বুদ্ধিমান হইতে বুদ্ধিমত্তর দেখা যায় !!
তবেই দেখিতেছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।
কেহ বলিতে পারেন তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন? তদুত্তরে বলিতে হইবে, ‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন। তাই ধর্ম লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম”
( রোকেয়া, আব্দুল কাদির, ১৯৭৩, ১১-১৩)
রোকেয়া তার লেখায় সকল কথিত ঈশ্বর প্রদত্ত দূতদের ভণ্ড এবং চতুর হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ঈশ্বর এবং ধর্মগ্রন্থগুলো যে তাদের চতুরতার কৌশল মাত্র,রোকেয়া স্পষ্ট ভাষায় তার-ই ব্যাখ্যা করেছেন।যদিও সামাজিক চাপের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি প্রবন্ধ থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল কিন্তু এর গুরুত্ব আজও এই সমাজে প্রবলভাবেই বিদ্যমান।
ঐতিহাসিকগনের মতে, রোকেয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখা হচ্ছে জ্ঞানফল। গল্প আকারে রোকেয়া লিখেছেন,
ফল ভক্ষণ করিবা মাত্র হাভার জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হইল নিজের নগ্নতা সম্পর্কে উপলব্ধি হল। চুল দিয়ে শরীর ঢাকলেন। মানবিক আত্ম উপলব্ধি হতে থাকল। অজানা মর্ম বেদনায় তাঁহার হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত হইল
এরপর আদম নিজে পত্নীর উচ্ছিষ্ট জ্ঞানফল খেলেন। খাওয়ার পর তারও জ্ঞানোদয় হল- তখন তিনি নিজের দৈন্যদশা হৃদয়ের পরতে পরতে অনুভব করিতে লাগিলেন। এই কি সর্গ? প্রেমহীন, কর্মহীন, অলস জীবন- ইহাই স্বর্গসুখ ? আরও বুঝিলেন তিনি রাজ বন্ধী, এই ইডেন-কাননের সীমানার বাহিরে পদার্পণ করিবার ক্ষমতা তাঁহার নাই।… এখন অজ্ঞতারূপ স্বর্গ সুখের স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গেল, জ্ঞানের জাগ্রত অবস্থা স্পষ্ট হইতে লাগিল। সুতরাং মোহ ও শান্তির স্থলে চেতনা ও শান্তির দেখা দিল। মোহ, কর্মহীনতার অনন্তসুখ থেকে মুক্ত হয়ে মানবিক সৃষ্টিশীলতার যাতনা নিয়ে আদম হাওয়া যখন কোন এক অজ্ঞাত পরিবর্তন লাভের জন্য ব্যাকুল হইলেন তখন // পরমেশ্বর উদ্যান ভ্রমণে আসিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, তোরা স্বাধীনতা চাহিস? যা তবে দুর হ ! পৃথিবীতে গিয়ে দেখ স্বাধীনতার কত সুখ!
তারপরই কনক দ্বীপে অর্থাৎ পৃথিবীতে তাঁহারা, অভাব, স্বাচ্ছন্দ, শোক-হর্ষ-রোগ্য-আরোগ্য, দুঃখ-সুখ প্রভৃতি বিবিধ আলো আধারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া প্রকৃত দাম্পত্য জীবন লাভ করিলেন।
ধর্মগ্রন্থে নারী কে বলা হয়েছে পাপাচারে প্রলুব্ধকারিণী, অথচ রোকেয়া স্পষ্ট দেখিয়েছেন নারী এখানে পুরুষ কে আত্মসচেতন করেছে।পুরুষের ভেতরের মানবিক গুণাবলী কে জাগ্রত করেছে।তাকে জ্ঞান চিন্তায় প্রজ্ঞায় সক্রিয় করেছে। নারী এখানে শক্তিমতী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
তিনি গল্পের ছলে আরও একটি চমৎকার সত্যি সকলের সামনে তুলে ধরেছিলেন ,
দুইশত বছর হইল এই দেশের অদূরদর্শী স্বার্থপর পণ্ডিত মূর্খেরা ললনাদিগকে জ্ঞান ফল ভক্ষণ করিতে নিষেধ করে , কালক্রমে ঐ নিষেধ সামাজিক বিধানরূপে পরিগণিত হইল এবং পুরুষেরা এ ফল নিজেদের জন্য একচেটিয়া করিয়া লইল। ফলে নারীর কোমল হস্তের সেবা যত্ন বঞ্চিত হওয়ায় জ্ঞানবৃক্ষ মরিয়া গিয়াছে। নারীর আনিত জ্ঞানফলে নারীর সম্পূর্ণ অধিকার আছে, এ কথা অবশ্য স্মরণ রাখিবে
( রোকেয়া, আব্দুল কাদির ১৯৭৩, ১৮০-১৮৮)
স্বামী শব্দ যে প্রভু ধারণারই প্রকাশ মাত্র বেগম রোকেয়া তা ঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি তার ‘স্ত্রীজাতীর অবনতি শীর্ষক’ প্রবন্ধে লিখেছেন,
স্বামী শাব্দের অর্থ কি? দানকর্তা কে দাতা বলিলে যেমন গৃহকর্তা কে গ্রহীতা বলিতেই হয়, সেইরূপ একজন কে স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর বলিলে অপর কে দাসী না বলিয়া রা কি বলিতে পারেন?
তার এধরনের সাহসী সৎ লেখার জন্য মৌলবাদীরা তার বিরুদ্ধে বারবার ষড়যন্ত্র করেছে, তাকে দমাতে চেয়েছে তাই তিনি লিখেছিলেন ,
আমি কারাসিয়াং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি,উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগর তীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনের পঁচিশ বছর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াছি
পর্দা প্রথা,কোরআন শিক্ষা নিয়ে রোকেয়ার বক্তব্য পড়ে অনেক ক্ষেত্রে মনে হতেই পারে সে একজন গোরা মুসলিম কিন্তু এক্ষেত্রে বোঝা জরুরী তার সামাজিক অবস্থান এবং পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব তার মধ্যে থাকা অস্বাভাবিক ছিলনা কিন্তু তার অবস্থান থেকে ধর্মীয়গুরুদের এবং ধর্মের রীতিনীতির বিরুদ্ধে তার কঠোর বক্তব্যগুলো তাকে কখনোই একজন ধর্মান্ধ হিসেবে উপস্থাপন করে না।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা জরুরী, রোকেয়া বিষয়ে আকিমুন রহমান তার বিবি থেকে বেগম গ্রন্থে, বেগম রোকেয়া কে স্বামীর অনুকরণকারি হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন । তার যুক্তি অনেক ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হলেও তখনকার রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে আজকের সমাজের নারীদের চেয়ে তার চিন্তা অনেকাংশে অগ্রসর ছিল।তিনি রীতি মেনেছেন সামাজিক কারণেই।তাকে সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় অনেক কৌশলী হতে হয়েছিল।
বেগম রোকেয়া কে নিয়ে এ বিষয়ে আনু মুহাম্মাদ এর চমৎকার একটি লেখা আছে।
এর দুটা লাইন এমন ,
রোকেয়ার অগ্রসর চিন্তা ধারণ করতে না পেরে সমাজ তার কম গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় কেই গ্রহণ করেছে- মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত। আর সেই কাজেও রোকেয়া সেই সময় সহযোগিতা পান নি।
কঠিন প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি লড়েছেন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। তিনি ধর্মের পশ্চাদপদ নিয়ম নীতি কে অস্বীকার করেছেন। রোকেয়ার অগ্রসর চিন্তা সমাজ মেনে নেয়নি বলে তাকে নিঃসঙ্গই থাকতে হয়েছে। তবুও তিনি তার চিন্তার প্রকাশ থেকে পিছু হটেননি। আজকের সমাজ তাকে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত খেতাব দিয়ে তাদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করলেও সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া একজন মুক্তমনা মানুষ।
আকিমুন রহমানের লেখাটির কিছু অংশ পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে -এ হলো একটি বিশেষ সময়, সমাজ ও বাস্তবতাকে অবস্থিত বাস্তবতার নীতি নৈতিকতা নিয়ে বিচার করার ফল। তবে ঐ সময়ের বিচারেও রোকেয়ার কিছুটা সীমাবদ্ধতা ও স্ববিরোধীতা ছিল-এটাও স্বীকার করতে হবে। রোকেয়ার সামাজিক সংস্কার আব্দোলন শুরুর আগেই কিন্তু মেরি ওলস্টোনক্রাফট সহ আরো নারীরা বই লিখে পুরুষতন্ত্রের পশ্চিমে গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রোয়েকা যখন লিখেন-
//যখনি কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছে, তখনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমরা প্রথমত যাহা সহজে মানি নাই তাঁহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি।// তখন তাকে স্যালুট।
আবার এই রোকেয়াই যখন সুগৃহিনী হবার উপায় বাতলে দিয়ে মেয়েদের ঘরকন্নার কাজগুলি নির্ধারন করে দেন এভাবেঃ
”(ক) গৃহ এবং গৃহসামগ্রী পরিস্কার ও সুন্দররূপে সাজাইয়া রাখা।
(খ) পরিমিত ব্যয়ে সুচারুরূপে গৃহস্থালী সম্পন্ন করা।
(গ) রন্ধন ও পরিবেশন।
(ঘ) সূচিকর্ম্ম।
(ঙ) পরিজনদিগকে যত্ন করা।
(চ) সন্তানপালন করা।”
অথবা বোরখা নিয়ে তার মন্তব্যঃ
‘‘রেলওয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাঁহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। … রেলওয়ে ভ্রমণকালে সাধারণের দৃষ্টি (public gaze) হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ঘোমটা কিম্বা বোরকার দরকার হয়।…আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না।’’
–তখন আমার মনে হয় সমাজের বাস্তবতায় রোকেয়াকে কিছুটা আপস করতেই হয়েছিল। তাতে কিন্তু রোকেয়ার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ কিছুমাত্র কমে না। যাই হোক,বেগম রোকেয়ার নির্মোহ সমালোচনা তখনই হবে যখন আমরা তাঁকে তাঁর দোষ গুন সীমাবদ্ধতাসহ আলোচনা করতে পারবো। তাতে রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা একটুও কমবে না, বরং তাঁকে দেবীর আসনে না বসিয়ে যথার্থ সম্মান দেখানো হবে বলে মনে করি।
মানুষকে বড় বোকা বানানোর সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হল ধর্ম!
একটু দ্বিমত আছে, তাই রেফারেন্সসহ লিখলে ভালো হতো।
দুটা বই এর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে পারি , বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কীর্তি (আবদুল কাদির, ১৯৭৩ ) , এবং আনু মুহাম্মাদ এর নারী , পুরুষ ও ধর্ম বই দুটি । প্রসঙ্গগত সাহিত্য মান নয় বরং চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে জ্ঞানফল রোকেয়ার শ্রেস্ট সৃষ্টি ।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজের যড়যন্ত্র অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বেগম রোকেয়া। এবং বুঝতে পেরেছিলেন এ যড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একমাত্র অস্ত্র হলো শিক্ষার মাধ্যমে নিজের আত্ন-পরিচয় তৈরী করা। আর তাই তিনি প্রতিকূলতাকে কৌশলে হয়তো আপন করে নিয়েছিলেন। আর তাইতো নারীবাদী হয়েও নামের পাশে স্বামীর নামটিও যুক্ত করে তৈরী হলো বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ধর্মটাকে হয়তো বিশ্বাস করতেন তবে মডারেটভাবে।
তবে সময়ের প্রেক্ষিতে যা প্রগতিশীলতা দেখিয়েছেন তা সম্মান না করে উপায় নেই।
ধন্যবাদ রইল। ভালো থাকবেন।
শুভেচ্ছা রইল 🙂
রোকেয়া ও নজরুল নিয়ে হুমায়ূন আজাদ তার নারী গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। বগলে খুনের সনদ (কিতাব) আর পকেটে ছুরি নিয়ে ধর্মান্ধরা সেই যুগেও যেমন ছিল আজও তারা তেমনি আছে। নজরুল-রোকেয়া থেকে হুমায়ূন আজাদ-অভিজিৎ পর্যন্ত এই সময়টুকুতে সমাজ সচেতনেতার বা সমাজের চিন্তা চেতনার দুয়ারে কে কতটুকু আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলেন ইতিহাস তা মূল্যায়ণ করবে।
হুমায়ূন আজাদ বলতেন-
বুঝা গেল ধর্মের সমালোচনাকারী হত্যায় কোন ব্লগারের উষ্কানীর অজুহাত লাগেনা, ব্লগার হওয়ার দরকার নাই। মিথ্যা প্রতারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত মানুষ রচিত ধর্মের ভন্ডামীর দিকে যে যখনই অঙ্গুলি তুলেছেন ধর্মবাদীরা তখনই ছুরি চাপাতি হাতে তার গলা কাটতে উদ্যত হয়েছে।
প্রযুক্তির সাথে সাথে হিংস্রতাও বহুমাত্রিক হয়েছে। ধর্মের সমালোচনা আর ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার কুট কৌশল হিসেবে ধর্ম কে ব্যবহার করা কে এক মাত্রার ফেলে দিলে হবে না। সত্য উন্মোচন যেমন আমার দায় তেমনি সত্য ধারনকারিদের রক্ষা করাও আমারই দায়। যুদ্ধে কৌশলী হতেই হবে, সময়টাই এমন।
সত্যি তাই। আমরা সবকিছুকে সংকীর্ণতার ক্লাসিফিকেশানে না ফেলা পর্যন্ত ঠিক তৃপ্তি পাইনা মানসিক ভাবে। এটা আমাদের মজ্জাগত সমস্যা। আমরা রবীন্দ্রনাথ কে হিন্দু কবি হিসেবে চিহ্নিত করে তার লেখা গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে না রাখার পক্ষেও চুপিসারে দাঁড়িয়ে যাই। শিল্প-সাহিত্য-আন্দোলন এগুলোকে আমরা ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে বিচার করি- এটা কার পক্ষে গেলো।
হিন্দু মানুষ, মুসলিম মানুষ বলে যেমন আলাদা কোন টার্ম হতে পারেনা ঠিক তেমনি মুসলিম নারী বলে আলাদা কোন টার্ম নেই। মহীয়সী রোকেয়া নারী শিক্ষায় অবদান রেখেছে, অবদান রেখেছেন সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে।
ওনাকে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বলার পেছনে সংকীর্ণ ক্লাসিফাইড দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী। এদের দৃষ্টিভঙ্গিটি খুব সম্ভবত এমন হতে পারে- ‘দেখো, এই মুসলিম নারীই কিন্তু সমাজের অগ্রযাত্রায় অবদান রেখেছেন, অন্য কোন ধর্মের লোক নয় কিন্তু!’
হ্যাঁ, মহীয়সী রোকেয়ার কিছু কথা পরে বাদ দেয়ায় সমালোচনার কারণে বা ধর্মীয় উগ্রতার চাপে পড়ে। এনিয়ে এখনো বেশ আছে, অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদও বলেছিলেন বাদ দেয়া অংশগুলোই ছিলো রোকেয়ার সবচেয়ে প্রগতিশীল ভাবনা। কিন্তু রোকেয়া তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন, অবদান রাখতে চেয়েছিলেন নারী শিক্ষায়, চেয়েছিলেন পিছিয়ে পড়া নারীকে খাঁচার বাইরে আনতে। সেটি করতে গিয়ে সেই সময়ের বাস্তবতায় ওনাকে কৌশলী হতে হয়েছে। সেটি না হলে আলটিমেইট যে অবদানটা উনি রেখেছেন সেটি বাধাগ্রস্থ হতো, মুখ থুবড়ে পড়তো। যে কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে লক্ষ্য ঠিক রেখে কৌশল পরিবর্তন হতেই পারে, সেটাই স্বাভাবিক।
ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। যদিও আরো বিস্তৃত করা যেতো।
কিছুটা অজুহাত দেই, আমি লেখার ক্ষেত্রে অলস তাই বিস্তৃত লেখা হয়ে ওঠে না। বুঝতে পারছি বদ অভ্যাসটা বিদায় করতে হবে। ধন্যবাদ , শুভেচ্ছা রইল 🙂
বেগম রোকেয়া সত্যিকার অর্থে মুক্তমনাদেরই অগ্রদূত। আর তার সময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করলে মনে হয় উনার আসলে ধর্ম সমন্ধে কৌশলী না হয়ে উপায় ছিলো না।
আমার ধারণা উনি আসলে ভাল করেই বুঝতেন ধর্মই নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা। কিন্তু তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তার আসলে ধর্মের সাথে আপস না করে উপায় ছিলো না।
শুভেচ্ছা রইল 🙂