৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে মনে হয়, ঢাকা কলেজে সবে ভর্তি হয়েছি। সে এক নুতন অভিজ্ঞতা, স্কুলের ক্ষুদ্র গন্ডির বাইরে দেশের আনাচ কানাচ থেকে আসা বহু ছেলের সাথে সহাবস্থান, সাইন্সের ৩ সেকশন, এক এক সেকশনে প্রায় ১৫০ করে ছেলে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছেলেরা এক এক কোনে নিজেদের মত ঘেটো বানিয়ে থাকে, গভঃ ল্যাব স্কুল থেকে আসা ছেলেদের গ্রুপ সবচেয়ে বড়, দাপটও ব্যাপক। বাকিদের গ্রুপ ছোট ছোট, বিশেষ করে মফস্বলের ছেলেদের অবস্থা সবচেয়ে করুন। উদয়ন স্কুল থেকে আসা ছেলেদেরও ছোটখাট গ্রুপ আছে। ধীরে ধীরে নুতন নুতন বন্ধু হচ্ছে। অনেকদিন ক্লাস করেও উদয়ন থেকে আসা ছেলেটার আসল নাম অনেকদিন জানতাম পারিনি, বন্ধু বান্ধব সবাই ডাকে গুল্লু বলে। অনেক পরে জানতে পারলাম তার আসল নাম অভিজিত রায়।
চোখে পড়ার মত টকটকে ফর্সা, সুদর্শন, একটু বড়সড় শরীর, কোঁকড়া ঘন চুল, ঘন গোঁফ, বয়সের তূলনায় বেশ ভারিক্কি স্বভাব, এক কাঁধে ঝোলা ব্যাগপ্যাক, পায়ে সব সময় স্যান্ডেল শু; অভিজিতের এই চেহারাই সব সময় চোখের সামনে ভাসে। এত বছরে সেই বেশ বদলেছে অনেক, তাও ওর সাথে ফোনে কথা বলার সময় মনে হত সেই গুল্লুর সাথেই কথা বলছি। গুল্লু নামের কারন সম্ভবত গোলগাল, ফর্সা, আদুরে আদুরে চেহারার কারনে। উদয়ন স্কুলের ছেলেপিলে শিশুকাল থেকেই ওকে আদর করে গুল্লু বলে। আমিও এই পর্যন্ত তাকে গুল্লু নামেই ডাকতাম, কোনদিন অভিজিত ডাকিনি।
অল্প দুয়েকজন ছাড়া অনেকেই হয়ত জানেন না যে অভিজিত আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু (ছিল বলতে কোথায় যেন বাঁধছে)। নেট এ ব্যাক্তিগত বিষয় তেমন আনতে চাইনা বলে প্রকাশ করি না, তাছাড়া এক শ্রেনীর সূস্থ মাথার উন্মাদ একে কেন্দ্র করে নানান কাহিনী বানাবে। ঢাকা কলেজের পর বুয়েটে ৫ বছর, যদিও ভিন্ন বিভাগে। তারপর পাশ করার পর জীবনেরে নিয়মে এক একজনা এক এক দেশে ছড়িয়ে পড়ি, সরাসরি যোগাযোগ ছিল না বহুদিন, জানতাম ও সিংগাপুর গেছে। আমেরিকা কবে এসেছিল শুনিনি। কলেজে তেমন টের পাইনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে ভাসা ভাসা শুনতাম সে নাকি বেশ আঁতেল হয়ে গেছে, কি কি জ্ঞানগর্ভ লেখা লেখে।
২০০৮ সালে শেষ দিক থেকে মুক্তমনায় মাঝে মাঝে যেতাম, মাঝে মাঝে টুকটাক কথাবার্তা হত অভিজিত রায়ের সাথে, দেখতাম কি অসীম ধৈর্য্য এবং ঠান্ডা মাথায় বিতর্ক করে। বহুদিন টেরই পাইনি যে এইই সেই পুরনো বন্ধু অভিজিত। কোন এক কমেন্টে যেন উদয়ন স্কুল আর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং মিলিয়ে সন্দেহ হল, মেইল করলাম, কনফার্ম করল আমিই সেই। বছরে দুয়েকবার ফোনে কথা হত, অসাধারন জ্ঞানের সাথে সাথে রসবোধও চমতকার। কথা প্রসংগে লেখালেখি থেকে আগেকার নানান স্মৃতি, পুরনো বন্ধু বান্ধবদের কথাই হত বেশী। আমি প্রথম প্রথম নেহায়ত কমেন্টার পাঠক ছিলাম, সেইই উতসাহ দিত লিখে যেতে। প্রতিবারই বলতো একবার আটলান্টা বেরিড়ে যেতে, ফাজলামি করে বলতাম তোর সাথে সাথে আমার কল্লাও হারাতে চাই না। কেন যেন এতে সে সব সময় খুব মজা পেত। এ ছাড়া কাফের, নাছারা, ইয়াহুদীদের পয়সা খেয়ে আমরা লেখালেখি করি এই তত্ত্ব নিয়েও দারুন মজা করতাম।
ব্লগার অভিজিতের বাইরে ব্যাক্তি অভিজিত কেমন মানুষ ছিল? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি থেকে বলতে পারি আদর্শ ভাল ছেলে বলতে যা বোঝায় গুল্লু ছিল তাই (কারো অবিশ্বাস হলে উদয়ন ’৮৮ এসএসসি, বুয়েট ’৯০ ব্যাচের ছেলেপিলের কাছে খবর নিতে পারেন)। নেট জগতে কিছু ম্যানিয়াক তাকে যেভাবে দানবীয় চরিত্র হিসেবে ফুটাতে চাইতো দেখে মাঝে মাঝে পেট ফাটা হাসি পেত। বাস্তবের গুল্লু কারো কোন সাতে নেই পাঁচে নেই, কথা বলে একেবারেই কম কিন্তু গম্ভীর নয়, আড্ডা খুব পছন্দ করে। আঁতেল, গুরু গম্ভীর চরিত্ররা সাধারনত আড্ডায় খুব বোরিং হয়, ও ছিল একেবারেই উলটো। রসবোধ ছিল অসাধারন। কারো সাথে সে ঝগড়া মারামারি দূরে থাক গলা উঁচিয়ে কথা বলেছে তাও মনে হয় না কেউ বলতে পারবে বলে। বিনয় এবং নম্র ব্যাবহার ছিল একেবারে জন্মগত। তার বিনয় কেমন হতে পারে তার উদাহরন আরেকজন ব্লগার এবং লেখিকা বন্দনা কবিরের ভাষ্য থেকেঃ
এই মেলায় তার আরো তিনটি বই কিনেছি। সুদ্ধস্বর থেকে যখন তার সর্বশেষ বইটা কিনছিলাম তখন তিনি আমার পাশেই দাঁড়ানো। সেলস বয়টাকে যখন ‘অভিজিৎ রায়ের লেটেস্ট বইটা দিন’ বললাম তখন তিনি ইশারায় আমার পাশে দাড়ানো অভিজিৎ রায়কে দেখিয়ে দিলেন। উনি দেশে?! বিস্ময়ের সাথে তার দিকে ফিরতেই তিনি লজ্জিত হাসি দিলেন। জাগৃতি থেকে কেনা আর শুদ্ধস্বর থেকে কেনা তিনটি বইই এগিয়ে দিলাম অটগ্রাফের জন্য। তিনি লজ্জা নিয়ে বললেন,’বন্দনা কবীরকে অটগ্রাফ দিতে লজ্জা করছে’ কী নিষ্পাপ সেই অমায়িক হাসি! একবার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো উনার সাথে উনার বই সহ একটা ছবি তুলি। কিন্তু কজন এসে তাকে প্রায় জোর করে অন্য এক ক্যামেরা সামনে নিয়ে গেলেন। উনার ব্যাস্ততায় আমার আর তার সাথে ছবি তোলা হলো না।
মাত্র কদিন আগেই তিনি মুক্তমনায় লেখার জন্য অনুরোধ করছিলেন। আর তার অনুরোধ করার ভঙ্গিটা এতো বিনয়ী যে নিজেকে খুব একটা কেউকেটা মনে হচ্ছিল তার নিমন্ত্রন পেয়ে। আমাকে লেখার জন্য অনুরোধ করছেন ‘অভিজিৎ রায়?!’ এটার মধ্যেও যেন একটা বুক ফোলানো গর্ব বোধ আছে।
কাল থেকে চোখের পানি আটকাতে পারছিনা। রাগ ক্ষোভ কিছুই দমাতে পারছিনা। বার বার মনে হচ্ছে উনার সাথে দেখা না হলেই ভালো হতো। হয়তো আর দশজন অপরিচিতের মৃত্যু সংবাদে খানিক কষ্টই পেতাম। তারপর ভুলে যেতাম। সেটা হবেনা। সারাজীবন ঐ চার মিনিটের স্মৃতি মাথায় নিয়ে বাঁচতে হবে।
আমি জানি এ বিনয় সাত মহলা বাড়িতে ১৫ পদের ডিনার সাজিয়ে গরীবের বাড়িতে দুটো ডালভাত খান গোছের বিনয় নয়।
সব কিছুতেই সে আছে, এবং পড়ার নেশা সাঙ্ঘাতিক। নেটে যেমন মনে হয় তুখোড় তার্কিক, বাস্তবে দেখে বোঝার কোন উপায় ছিল না। ক্লাসেও মাঝে মাঝে নিজের মনে কি সব জ্ঞানগর্ভ বই খুলে বসতো যেগুলির নাম উচ্চারন করতেই আমাদের বাধতো। তাকে খেলার মাঠে দেখা যায় সমঝদারের মত উপভোগ করতে, সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কনসার্টের সামনের সারিতে সে সকলের আগে হাজির,, বিতর্কের হলে, এমনকি কলেজ জীবনের সবচেয়ে বড় বিনোদন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নিউ মার্কেটে টাংকি মারতে যাওয়া সেই দলেও সে জুটে যেত। মনে পড়ে কলেজে একবার তার ঘন গোঁফ এবং বড়সড় শরীরের জন্য বলেছিলাম, তোকে পাক আর্মির মত লাগে; খুব হেঁসেছিল।
লেখালেখির জগতে আবার সাক্ষাতের পর উদয়ন স্কুলের অন্য বন্ধুদের থেকে পরে শুনেছি সে ছেলেবেলা থেকেই ঘোর নাস্তিক এবং তাতে তার কোন গোপনীয়তা কোনকালেই ছিল না। সেই স্কুলের নীচের ক্লাস থেকেই বন্ধুদের সাথে ধর্ম বিষয়ক বিতর্ক করতো। তার এবং রিজওয়ানের বিতর্কের কথা এখনো লোকে স্মরন করে। ’৭৫ পরবর্তি সে সময়ে দেশে ধর্ম উন্মাদনার বীজ সফলভাবে রোপিত হলেও চারা মোটে উঠতে শুরু করেছে, ডালপালা মেলে ফল বিতরন সেভাবভে শুরু করতে পারেনি, তাই হয়ত গুল্লু আয়ু একটু বেশীই পেয়েছে।
একাডেমিক দিক বাদই থাক (ওর নামে আমেরিকায় পেটেন্টও আছে শুনেছি)। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতাম একজন মানুষের এমন বহুমূখী প্রতিভা কিভাবে সম্ভব? ধর্ম, রাজনীতি, বিজ্ঞানের ক্লাসিকাল মৌলিক বিষয়গুলি থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক নানান শাখা, সাহিত্য, দর্শন, আর্ট, কালচার, ইতিহাস, সংগীত, খেলাধূলা, সমাজ বিজ্ঞান যে কোন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ্রর সাথে অন্তত দীর্ঘক্ষন আলাপ করার মত জ্ঞান তার ছিল। বাংলা ব্লগেই এই সব বিষয়ের ওপর ওর লেখা আছে। আর কোন ব্লগারের এমন বহুমূখী লেখা আছে বলে জানি না। বাংলা কমিউনিটিতে সে প্রতিভা বোঝার মত ক্ষমতাও বেশী লোকের নেই, তাই তার মূল্যায়ন হয়েছে কেবল ধর্ম বিষয়ক লেখালেখি কেন্দ্র করে দুই পরস্পর বিরোধী গ্রুপের মাঝে।
কথা হলে মাঝে মাঝে বলতাম সাবধান হতে, অন্তত দেশে প্রকাশ্যে ঘোষনা দিয়ে ঘোরাফেরা না করতে। স্বভাবসূলভ হালকা ঠাট্টা করে হেঁসেই উড়িয়ে দিত। বিনা অপরাধে বেনামে দাগী আসামীর মত চলাফেরা ঘৃনা করত। এছাড়াও মনে হয় আমেরিকার নিরাপদ জীবনে বিপদের মাত্রা ভুলিয়ে দিত। এ নিয়ে শেষ কথা হয়েছিল বছর দুয়েক আগে যখন আমাদের ৪ জন ব্লগারকে আটক করা হয় তখন। বাংলা ব্লগ জগতে তখন চরম আতংক। অনবরত বেনামে জীবন নাশের হুমকি তো বহু বছরই ছিল, তখন আবার মোল্লা গ্রুপ বহু ব্লগারকে গ্রেফতার ফাঁসীর দাবী জানাচ্ছে, তার মাঝে অবধারিতভাবে ওর নামও আছে। অনেক সেলিব্রিটি ব্লগার তখন লো প্রোফাইলে চলে গেছেন, অনেকে প্রতিদিন উগ্র আস্তিক উগ্র নাস্তিক সকলকে ঘৃনা করি জাতীয় স্বঘোষিত চারিত্রিক সনদ জোগাড়ে ব্যাস্ত আছেন। তার মাঝেও অভিজিত ব্যাস্ত আছে ব্লগারদের মুক্তির দাবীতে জনমত তৈরীতে, বিদেশের নানান ওয়েবেও ইংরেজীতে লেখা দিচ্ছে। সে সময়ও বলছিল দেশে যাওয়া প্রয়োযন, মা অসূস্থ দীর্ঘদিন যাবত। বলছিলাম এ সময় যাস না, জানে বেঁচে গেলেও অন্তত এরেষ্ট হয়ে যাওয়া এমন কিছু বিষয় না। স্বভাবসূলভ ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিলেও সম্ভবত সেবার আর যায়নি। বই পাগল মানুষ, বইমেলার সময় হলেও অস্থির হয়ে যেত দেশে যেতে।
আন রিলেটেড এত বিষয়ের ওপর অগাধ জ্ঞান থাকার পরেও তার নিরহংকারী বিনয় ছিল বিরল। আমি এই, আমি সেই……অমূকের লেখা কোন লেখাই না এই জাতীয় কথা কোনদিন বলতে শুনিনি। নিছক শস্তা জনপ্রিয়তার জন্য লেখালেখির মাঝেও সে যেত না। বাংলা ব্লগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি জনপ্রিয়তা পাবার ভাল উপায়। মুক্তিযোদ্ধার বাবার ব্যাকগ্রাউন্ড কাজে লাগিয়ে তাকে কথা বলতে শুনিনি কোনদিন, একটি লেখায় মনে আছে সামান্য একটু বলেছিল। ব্যাক্তিগত আলাপেও কোনদিন কিছু বলতো না। অনেকেই হয়ত জানেন না ওর বাবা ডঃ অজয় রায় প্রথমে অস্ত্র হাতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন, এরপর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নির্দেশে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা কমিশনের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে ভারতের নানান অঞ্চলের শিক্ষিত সমাজের মাঝে জনমত তৈরীর দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ন পালন করেন। বৃদ্ধ বাবাকেও পুত্রশোকে কাতর অবস্থাতে শুনতে হয়েছে হুমকি; উনিও হুমকিদাতাদের সব যুক্তিবাদীর পক্ষ থেকে যথাযোগ্য জবাবই দিয়ে দিয়েছেন, “তোমরা আমার ছেলের আদর্শকে হত্যা করতে পারোনি”।
ব্লগার অভিজিতের পূর্ন মূল্যায়ন এ মুহুর্তে আমার পক্ষে সম্ভব না। সেও চুড়ান্তভাবে মানুষই ছিল, সীমাবদ্ধতা তারও নিশ্চয়ই ছিল। বিশেষ করে যখন একই বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন দুই গ্রুপের তর্কযুদ্ধ চলে তখন যুক্তিবাদী মানুষের মাঝেও অজান্তে হলেও চলে আসতে পারে এক ধরনের পক্ষপাত। অভিজিতের মধ্যেও কখনো সখনো তেমন দূর্বলতা দেখেছি।
বন্যার সাথে আমার সরাসরি কোনদিন কথা হয়নি। গুল্লুর সাথেও কোনদিন কথা হত না। জানি ও ব্যাতিক্রম ধরনের অসম সাহসী মানুষ। যে মানুষ ক্যান্সার অপারেশন করতে নিজে গাড়ি চালিয়ে যেতে পারে সে মানুষের জন্য আমাদের ফাঁকা সহানুভূতির তেমন দরকার পড়বে না। অভিজিত বন্যা দু;জনায়ই আমেরিকার নিশ্চিত পরিবেশে ড্রিম জব করত, বন্যা আমার জানামতে অভিজিতের চাইতেও গুরুত্বপূর্ন অবস্থানে ছিল। মোট কথা তাদের জীবন ইংরেজী ছবিতে দেখানো স্বপ্নময় আমেরিকান জীবনের মতই হতে পারতো। আমার ধারনায় বড় ধরনের ভুল না হলে বন্যা অভিজিতের স্বপ্ন এগিয়ে নিতে ব্যাতিক্রমী কিছু করবে।
সেই রক্তাক্ত মুহুর্তের ছবি যতবার দেখেছি তাতে তাকে একটুও আতংকগ্রস্থ মনে হয়নি। ক্যান্সারে জর্জরিত শরীর রক্তাক্ত, এক আংগুল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়, পাশে স্বামীর মগজের সাদা অংশ…..মাত্র ১০ হাত দূরে দাঁড়িয়ে অনেকে সে দৃশ্য উপভোগ করছে। সেই অবস্থায় একজন মহিলা স্বামীকে তুলে নিচ্ছে, তার দুচোখে আমি কোন রকম অসহায়ত্ব দেখিনি। বরং বলছে দেখো আমি এক বিন্দুও ভীত নই, তোমাদের দৌড় পেছন থেকে এসে চোরের মত আঘাত করা, তোমাদের ভয় মস্তিষ্কে, তাই সেখানেই তোমাদের আঘাত। তোমরা চাও মস্তিষ্ক শুণ্য মানুষ, কিন্তু তা হবার নয়। আশা করি এই দুই মহা ধর্মোপরাধীর রক্ত, শরীরের বিচ্ছিন্ন অংগ দেখে অনেক শান্তির পূজারীর অতৃপ্ত হৃদয়ে কিছুটা হলেও শান্তি এসেছে, কিছুদিনের জন্য অভিজিতোফোবিয়া থেকে ছুটি। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কিছুটা রক্তপাত তো হবেই। ফেসবুকে সেই রক্তাক্ত ছবিগুলির নীচের শান্তির সৈনিকদের নানান কমেন্ট পড়েও একবিন্দু অবাক হইনি। এমনই তো হবার কথা ছিল। শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার যারা একই কূপ থেকে পানি খাবার অপরাধে ভিন্ন মতাবলম্বী অসহায় মহিলাকে চুড়ান্তভাবে মৃত্যুদন্ড দিতে পারে, ধর্মানুভূতির মত বায়বীয় মামলায় নিস্কৃতি দিলে আদালতের বিচারককে নির্দ্বিধায় মেরে ফেলতে পারে, নিজের মেয়েকেও স্বহস্তে মেরে ফেলতে পারে এরা তো সেই একই ধারার প্রোডাক্ট।
শুধু বোঝেননি যে সে শান্তি তারা নিঃসন্দেহে এ পর্যায়ে বিনিময় করবেন নিজেদের ভাই ব্রাদারদের মাঝেই, নেহায়েত অন্ধ না হলে তার অজস্র আলামত তারা বিশ্বজুড়ে দেখতে পেতেন।
গুল্লু ওর একাডেমিক গবেষনায় মানব মস্তিষ্ক নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছিল। কোনদিন কি ভাবতে পেরেছিল ওর নিজের মস্তিষ্ক পড়ে থাকবে বাল্যকালের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে? যা দেখে উল্লাস করার মত লোক সে দেশে কম নেই যে দেশের সমাজ বদলানোর স্বপ্ন সে দেখতো? মস্তিষ্কের ওপরই যত রাগ। কেন কিছু বেয়াড়া ও বস্তুটু ব্যাবহারের চেষ্টা করে?
বর্তমান সময়ের ইসলা্মের উছিলায় সন্ত্রাস নিয়ে একটা লেখা শুরু করেও অনেকদিন থেমে গেছিলাম। কোনদিন ভাবতে পারিনি আমার বন্ধু অভিজিতকেও সে লেখার এক উদাহরন হিসেবে যোগ করতে হবে। বয়স অনেকে হলেও কোন এক কারনে আমার বন্ধুবান্ধব মৃত্যু বরন করেছে এখনো তেমন একটা হয়নি, আর এরকম হত্যাকান্ড অকল্পনীয়। ঘটনার পর মুক্তমনা ডাউন দেখে মনে কিছুটা স্বস্থিই পাচ্ছিলাম, অভিজিত বিহীন মুক্তমনা কিভাবে সম্ভব তা চিন্তা করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমরা যুক্তিবাদীরা কত অসহায়, আমরা ব্যাক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত হানার অপরাধে কারো গলায় নির্দ্বিধায় ছুরি চালাতে পারি না, ভিন্নমতাবলম্বীর বীভতস রক্তাক্ত ছবি দেখে উল্লাসে ফেটে পড়তে পারি না, এমনকি নির্লজ্জের মত নিজের কোলে ঝোল টানা যুক্তিও দিতে পারি না। সভ্য মানুষ হবার জ্বালা অনেক। মুক্তমনা কলম যেন কোনদিন থেমে না যায় অভিজিত নিঃসন্দেহে সেটাই চাইতো।
অভিজিতের মূল্যায়ন বাংলাদেশে হতে কতদিন লাগবে জানি না। যাদের পঁচা মাথায় ধর্ম ছাড়া আর কিছু ঢোকে না তাদের কাছে অভিজিতের আর কোন লেখার মূল্য নেই। যারা আজ বিকৃত আনন্দে মেতে উঠছেন তারা এখনো বুঝতে পারেননি যে দু’চার জন অভিজিত নিকেশ করে পাশবিক হিংসা চরিতার্থ কথা ছাড়া আর কিছুই লাভ হবে না। বরং একদিক থেকে হয়ত ভালই হয়েছে, এখন তারা হয়ত বুঝবেন যে চারদিকে কত অজস্র অভিজিত তৈরী হয়েই আছে। ডাইনী হত্যার যুগে হয়ত সম্ভব ছিল, কিন্তু এই খোলা নেটের যূগে যা শুনতে চাই না তেমন রুঢ় সত্যের কবল থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোন উপায় নেই। আর যারা অভিজিতের হত্যাকান্ডের বিচার চাই কিন্তু তার ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার নিন্দা জানাই জাতীয় ষ্ট্যান্ডে থাকবেন তাদের বলতে চাই যে দানবীয় শক্তিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সব কূল রক্ষা করার নীতি খুব বেশীদিন লাজ করবে না। দেশ পাকিস্তান আফগানে পরিনত করতে না চাইলে দানবীয় শক্তির সাথে সঙ্ঘাত আজ হোক কাল হোক হবেই। আপনি ধর্মোদ্রোহী অভিজিতদের হত্যায় মৌন সমর্থন দিয়ে যদি মনে করেন আজীবন সিনেমা হলে সিনেমা উপভোগ করবেন, মেয়ে বন্ধু নিয়ে পহেলা বৈশাখ উপভোগ করবেন তবে জানুন আপনি বিরাট বিভ্রান্তির জগতে আছেন। আপনাদের না হোক পরবর্তি প্রজন্ম সে সঙ্ঘাত আর এড়াতে পারবে না।
প্রতিভা গড়তে হাজার বছর লাগে, ধ্বংস করতে এক মুহুর্তই যথেষ্ট। এটাই জগতের নিয়ম। এটাও নিয়ম যে জগত সভ্যতা সাইকো উন্মাদ এদের কারনে থেমে থাকে না, সভ্যতা নিজ গরজেই এক সময় এদের ছেঁটে ফেলে।
বাঙলাদেশ বড্ড অসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে । যার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে অভিজিৎ রায় কে । সত্যিই অসাধারন এক আহ্ববান আছে লেখাটাতে ।
অভিজিৎ রায়’দের হত্যা করে মেরে ফেলা যায় না । বরংচ হাজারো অভিজিৎ জন্ম নেয় রক্তের একেকটি ফোঁটা থেকে ।
আগে থেকে পরিচয় ছিল না। তার মৃত্যুই তার সাথে আমার পরিচয়ের যোগসূত্র হল এই কষ্ট টা আমাকে পোড়াচ্ছে ভিতরে ভিতরে। তবে এই লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে দাদা কে খুব কাছ থেকে চিনি। তার সেই লাজুক হাসি চোখে ভেসে উঠল। তার লেখক রূপ, প্রতিবাদী রূপ, যুক্তিবাদী রূপের সাথে পরিচিত হলেো তার ব্যক্তি জীবন অচেনাই ছিল। এই লেখাটা পড়ে মানুষ,বন্ধু, নিরহংকার অভিজিৎ দাদা কে এখন নিজের মধ্যে ধারন করতে পারব। আর তার চেতনাকে, মুক্ত চিন্তার ধারাকে অব্যাহত রাখার আপ্রান চেষ্টা করব।
সভ্যতা এগিয়ে যাবে । সভ্যতা গড়ে তুলতে কোটি কোটি মানুষের প্রয়োজন নেই, কয়েক জন অভিজিৎ রায়ই যথেষ্ট্য ! সভ্যতাকে প্রবাহিত হতে দিতে হবে ….
অসাধারণ মানুষের আচরণ ব্যতিক্রমী’ই হবার কথা। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজিৎ কে মেলে ধরবার জন্য ধন্যবাদ।
বাংলাদেশের ইতিহাস বুদ্ধিজীবি হত্যার ইতিহাস এই আমাদের গর্ব
অনেক অজানা ঘটনা জানালেন! ধন্যবাদ!
খুব ভালো লেখা।
মানুষ অভিজিৎ কে তুলে আনার জন্য ধন্যবাদ। ওর মতো একটা অসাধারণ ভালো ছেলে ঢাকার রাস্তায় খুন হবে, এটা ভাবাই যায় না।
নিজেকে নিয়েও ওকে কোনোদিন গর্ব করতে শুনি নি, তার বিখ্যাত বাবাকে নিয়েও নয়। অজয় স্যার যেদিন একুশে পদক পেলেন, ওকে কল করে অভিনন্দন জানাতেই হেসে বলে যে, ‘আমারে অভিনন্দন জানান ক্যান? ওতো বাপে পাইছে।’ বললাম যে, ‘তুমিতো মিয়া ওই বাপেরই পোলা।’ শুনে সেকি অট্টহাসি তার।
মায়ামিতে আমার বাসায় এসেছে অভি। সকাল বেলায় আন্না ক্যামেরা নিয়ে আসছে। বলে যে, ‘এই অভি তোমার সাথে ছবি তুলবো। তুমি যখন নানা পদক পেয়ে বিখ্যাত হয়ে যাবা, তখন আমি এই ছবি সবাইকে দেখিয়ে বলবো যে, বিখ্যাত অভিজিৎ রায় আমার বাসায় এসে থেকে গেছে। তার সাথে ছবি আছে আমার।’ ‘কী যে বলেন আন্না আপা।’ বলে যা একখান লাজুক হাসি দিলো সে।
এই হচ্ছে মানুষ অভিজিৎ রায়।
অভিজিৎ দা’র এই অনুপস্থিতি অামাদের অনেক বড় ক্ষতি করে দিল।
সত্যের যে আলোর মশাল অভিজিৎ দা তাঁর জীবন দিয়ে জ্বালিয়ে গেছেন, তা জ্বেলে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।
অভিজিৎ দা’র হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার, বিচার ও শাস্তি দাবি করছি।
অত্যন্ত মর্মাহত। মুক্তমনা সৃষ্টি না করলে বহু লোক বোধ হয় বর্বর থেকে যেতে। অনেক জ্ঞ্যান হতে বঞ্চিত হত। জাতির অপরিসিম ক্ষতি হল।
বাধ্য কারাবেন?; বয়েই গেছে সরকারের আপনার আমার মত লোকের আনুভুতির………।।এইতো আর কইদিন তারপর সব শেষ…………।হারিয়ে যাবে সবকিছু ……… আমার মত সুবিধা বাঁদিরা আমেরিকা র নিশ্চিত জীবন ছেড়ে কোনদিন আর হয়ত যাবনা ওই দেশে।থাতস ইট , যার জাই সেই বোজে।
কত বড় ক্ষতি যে হয়ে গেল বাংলা সাহিত্যের, বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের বিজ্ঞানের ভবিষ্যতের সেটা আমরাও অনুমান করতে পারছি না এই মুহূর্তে। একজন নিরপরাধ আপাদমস্তক মানবতাবাদীকে এভাবে খুন করা হলো বাংলাদেশের রাস্তায়। আর কোনো আশা নেই এই দেশ নিয়ে। আমাদের প্রত্যয়, এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে বাধ্য করিয়ে ছাড়বো সরকারকে।
মুক্তমনার বাইরে তাকে চিনতাম না। কিন্তু সংবাদটা শুনে নিজ প্রতিক্রিয়ায় বুঝলাম, আমি তাকে নিজের মতো করে অনেক বেশি চিনতাম।
অভিজিৎ জন্ম নিতে থাকবে, বেড়ে উঠবে, তীব্র হবে আরো— ভীতির ভ্রুকূটি কখনো আলোকে রুখতে পারে না।
ভোটের রাজনীতির কাছে সবকিছু আসহায়………আসলে আমরা এখনো অনেক আন্ধকারে আছি , ঠিক যেন মধ্যযুগের ইউরোপ………রাষ্ট্রযন্ত্র কে আপোষ করতে হয় এদের কাছে। যে আলামত দেখতে পাচ্ছি তাতে দেশ টা ফাকিস্তান এর সঙ্গে তুলনা করতে পশ্চিমাদের আর বেশিদিন সময় লাগবে না।