রাজশাহীর পুঠিয়াতে বেড়াতে গিয়েছি রাজবাড়ি এবং এর সংলগ্ন মন্দিরগুলির ছবি তুলবো বলে। সাথে ট্রাইপড রয়েছে, ট্রাইপড নিয়ে ঊর্ধ্বগতিতে হেঁটে চলেছি এই মন্দির থেকে সেই মন্দির। সেটি দেখে এক পথচারী কৌতূহলী হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই এই তেপায়া জিনিষটির নাম কি?’ আমি বললাম, ‘এর নাম ট্রাইপড, এটির ওপর ক্যামেরা বসিয়ে ছবি তোলার কাজ চলে।’ ভদ্রলোক তার পরেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা আপনার ক্যাম্রাখানি কোথায়?’ আমি বললাম, ‘পকেটে।’ ভদ্রলোক আমার দিকে অবিশ্বাসের ভঙ্গি নিয়ে চেয়ে রইলেন, বললেন, ‘তেপায়া এই জিনিষটি তো দেখেছি আগেই, নাম জানতাম না। কিন্তু এর ওপর তো ভায়া বড় বড় ক্যামেরা রাখতে দেখেছি। আপনার এই লিলিপুট ক্যামেরা দিয়ে তার কি কাম।’ আমি তখন সহাস্যে তাঁর উৎসুক ভরা মুখের দিকে তাকালাম। আসলেই তো, লিলিপুট ক্যামেরার এই জগতে কি কাম??

পকেট ক্যামেরা, কমপ্যাক্ট ক্যামেরা কিংবা অনেকে এর নাম দিয়েছেন পয়েন্ট এন্ড শুট। মানে সাবজেক্টের দিকে চাও, সাটার প্রেস কর, ব্যাস, বাকি সব কাজ ক্যামেরার। মানে আমার কোন ঝামেলা নেই, শুধু কম্পোজিশনটা খানিক ঠিক করে নেয়া। তবে যে কাজ ক্যামেরাটি করবে তা আসলে কেমন? মানে ছবি ভাল উঠবে তো? এইসব পকেট ক্যামেরা দিয়ে কিই বা এমন ছবি ওঠে? ওইতো সেই ডাইন্যামিক রেঞ্জের ঘাটতি, ওভার এক্সপোজের সমস্যা, রঙের গভীরতা নেই, সাবজেক্ট কেমন ফ্যাকাসে টাইপ হয়ে থাকে, আর অন্ধকারে তোলা ছবি সেইতো চরম গ্রেইন, গ্রেইনের চোটে ছবিই স্পষ্ট হয়না। এগুলি হচ্ছে মোটা দাগে কমপ্যাক্ট ক্যামেরার প্রতি ছুঁড়ে দেয়া অভিযোগের বাণ।

এখন এইসব বাণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য ক্যামেরাগুলির কি করা দরকার? সোজা উত্তরে ক্যামেরার ইমেজ গুন বাড়ানো দরকার। ইমেজ গুন বাড়াতে গেলে কি করতে হবে? ক্যামেরার সেন্সরের আকার বাড়াতে হবে, লেন্সের অ্যাপারচার মূল্য বাড়াতে হবে, আই এস ও মূল্য বাড়াতে হবে, রঙের গভীরতা বাড়াতে হবে, আর একটা জরুরি কাজ করতে হবে, সেইটা হল, ক্যামেরার কন্ট্রোল বাড়াতে হবে, ম্যানুয়াল ছবি তোলার সুযোগ বাড়াতে হবে, ফটোগ্রাফার যেন ছবি তোলার সময় কেবল ক্যামেরা নির্ভর না হন এটা ভাবতে হবে! তবে এইসব করতে হবে কমপ্যাক্ট ক্যামেরার আকারকে ছোট রেখে। আবার চাহিদার এখানেই শেষ নয়। ক্যামেরার এল সি ডি-ই যেহেতু ভিউ ফাইন্ডারের কাজ করবে, কাজেই তার আকার বাড়াতে হবে, রেজোলিউশন বাড়াতে হবে, এছাড়া কানেক্টিভিটি এখন একটা ফ্যাক্ট। কাজেই ক্যামেরায় ওয়াই ফাই সহ জি পি এস সুবিধা নয়া থাকলে কেম্নে কি!

এখন ওপরের সব কথা চিন্তা করে কিছু বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে কিছু সংযোজন করে ক্যামেরা কোম্পানিগুলি পকেটে ঢোকানোর মতন করে ক্যামেরা উৎপাদনের চিন্তা করতে লাগলো। এ যাত্রায় প্রথম এলো প্যানাসনিক তাঁদের এল এক্স ৩ নিয়ে। ঈষৎ বর্ধিত সেন্সর আকার নিয়ে। সাধারণত কমপ্যাক্ট ক্যামেরায় যে সেন্সর থাকে অর্থাৎ ১/২।৩ ইঞ্চি তার জায়গায় এল ১/১.৬৩ ইঞ্চি সেন্সর। সেই সাথে র শুটিং, ম্যানুয়াল কনট্রোল সবকিছুর প্রাপ্যতা দিয়ে একটু অতি আগ্রহীদের ক্যামেরা। তবে তারা যেটি করতে পারলনা, সেটি হচ্ছে ক্যামেরার আকারকে প্যান্টের পকেটের ভেতর ঢোকাতে তারা ব্যার্থ হল। আর তার পরপরই ক্যানন নিয়ে এল ক্যানন এস ৯০।

ক্যানন এস ৯০ যে কারণে একটি অসাধারণ পথ প্রদর্শনকারী ক্যামেরা তা হল, এটিই সর্বপ্রথম আ্যাডভান্স লেভেলের ক্যামেরা যা প্যান্টের পকেটে অনায়াসে ঢোকানো যায়। মানে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতন। এক তো ক্যামেরাটি আমার প্যান্টে ঢোকানো যাচ্ছে, মানে ক্যামেরার চলনশীলতা বেড়ে গেল বহুগুন আবার সেইসাথে ক্যামেরার ইমেজগুন, ম্যানুয়াল কন্ট্রোল স্থিরচিত্রগ্রাহকদের হাতের মুঠোয় চলে এল। এতেই শেষ নয়, ক্যানন তাঁর সেন্সর আকার আরও বাড়িয়ে দিল, ১/১.৭ ছিল তখন বাজারের সর্বোচ্চ কমপ্যাক্ট সেন্সর সাইজ। যেইনা এই ক্যামেরা কমপ্যাক্ট জগতে ঝড় বইয়ে দিল, বাজারে একের পর এক আসতে থাকল আ্যাডভান্স লেভেলের কমপ্যাক্ট ক্যামেরা। একে একে এল অলিম্পাস, নিকন, তারপর এল সনি, ফুজিফিল্ম স্যামসাং এবং সর্বশেষে পেনট্যাক্স। তবে কয়েক বছর পর্যন্ত আকারে ক্যাননকে টেক্কা দিতে পারে এমন কোন ক্যামেরার সন্ধান দিতে পারেনি  কেউ শুধু একটি ক্যামেরা ছাড়া, সনি আর এক্স ১০০। এটি হঠাৎ এলো আর বাজারে এসেই মাত করে দিল। তারা কমপ্যাক্ট সেন্সরের আকার বাড়িয়ে একবারে ১ ইঞ্চি করে ফেলল। এটিও পকেটে ঢোকানো যায় কিন্তু এর দাম $ ৬৫০ , তাই অনেকের নাগালের বাইরেই রয়ে গেল।

পাঠকরা লক্ষ্য করুন, ক্যামেরার এই জগতে কত দ্রুত কত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ২০১০ সালে বাজারে আসে ক্যানন এস ৯০। সেই সময় এই লেন্সের সেন্সর আকার ছিল যুগান্তকারী, তার সাথে ম্যানুয়াল কনট্রোলের প্রাপ্যতা, লেন্সের অসাধারণ আলোক সংগ্রহ ক্ষমতা বাজারে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তার দুই বছর যেতে না যেতেই ১ ইঞ্চি সেন্সর সনির মাধ্যমে এসে হাজির। আর সেই সঙ্গে ক্যামেরার বডির সাথে জি পি এসের সংযুক্তি এই ছোট ক্যামেরাগুলিকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলল। আর বছর যেতে নয়া যেতেই রিকো সাহেব পুরো এ পি এস সি সেন্সর কমপ্যাক্ট ক্যামেরার ভেতর এনে দিল, নিকন ই বা পিছিয়ে থাকবে কেন। তারা কুল্পিক্স এ যা কিনা একেবারেই পকেটে ঢোকানোর মতন, সেটি সজোরে ঘোষণা দিয়ে উপস্থিত হয়ে গেল। যদিও দাম রাখল একেবারে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

কিন্তু এথেকে আমরা কি দেখছি, আমরা ক্যামেরার এই বিশেষ অঙ্গনে এক ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য দেখতে পাচ্ছি। ক্যামেরার ডি এস এল আর যেখানে প্রযুক্তির বন্ধ্যাত্বের চরমে পৌঁছে গেছে, যেখানে আর নতুন কোন আবিষ্কার কিংবা উদ্ভাবন নেই কিংবা হবার সম্ভাবনাও নেই, বছর বছর শুধু মেগাপিক্সেল আর আই এস ওর পরিবর্ধনই যার একমাত্র গন্তব্য সেখানে আমরা ক্যামেরার নতুন সব উদ্ভাবনী জারিজুরি এখানেই দেখতে পাচ্ছি। আর একটু গভীরভাবে ভাব্লে বুঝতে অসুবিধে হয়না যে স্মার্ট ফোনের সাবলীল পদচারণে ক্যামেরা জগতে ঘটে যাচ্ছে অভাবনীয় সব পরিবর্তন। স্মার্ট ফোন এসে কমপ্যাক্ট ক্যামেরার নীচের দিকের বাজার একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন কমপ্যাক্ট ক্যামেরা যদি পকেটে পোরা না যায়, কমপ্যাক্ট ক্যামেরায় যদি কানেক্টিভিটি না থাকে, কমপ্যাক্ট ক্যামেরায় যদি এ পি এস সি সেন্সর যুক্ত করা না যায়, তাহলে এই মাধ্যমের আর ভবিষ্যৎ রইল কোথায়?

আসুন, আমরা এইবার এই ক্যামেরাগুলির একটু স্পেসিফিকেশন দেখে এদের ভেতরকার পার্থক্য গুলি বোঝার চেষ্টা করি।

 

ওপরের তালিকায় নির্দেশিত ক্যামেরাগুলির মধ্যে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী খুব বেশী পার্থক্য কিন্তু আমরা দেখিনা। বিশেষ করে কিছু বৈশিষ্টে তাঁদের অবস্থান উনিশ বিশ। সেন্সর আকৃতি, লেন্সের বৈশিষ্ট্য, আই এস ও মূল্য, এল সি ডি র মান, মেগাপিক্সেল এবং সাটার স্পিডে আমরা খুব বেশী পার্থক্য দেখিনা। তবে ক্যামেরার আকৃতি, ওজন এবং মুল্যে বেশ পার্থক্য দৃশ্যমান। এই ক্যামেরাগুলির মধ্যে শেষ তিনটি ক্যামেরা পকেটে ঢোকানো যাবেনা, হয়ত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকলেও ঢুকতে পারে। বাকি চারটি ক্যামেরাই পকেটে ঢুকবে। ওজনে জিতে গেছে কেবল ক্যানন এবং প্যানাসনিক ক্যামেরা দুটি। এই ক্যামেরা গুলি হালকা হলে কি হবে এদের প্রতিটিই কিন্তু ইস্পাত দিয়ে তৈরি, প্লাস্টিক নয়, অনেকগুলি জাপানেই নির্মিত, অবশ্যই স্যামসাং বাদ দিয়ে। মুল্যের দিক দিয়েও সব ক্যামেরার মিল রয়েছে। পার্থক্য মাত্র দুটো ক্যামেরায়, সনি এবং ফুজিফিল্মে। হয়ত সেন্সরের আকার বাড়ানোর কারণেই এমনটি হয়েছে।

সবশেষ কথা হচ্ছে, ক্যামেরার আকার দিন দিন ছোট হচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, ক্যামেরার ইতিহাস ব্যাবহারিক সুবিধের ইতিহাস। এই ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে স্মার্ট ফোনের আগমনে। এখন কানেক্টিভিটি একটি বাস্তবতা আর এর সাথে পকেটে ঢোকানো সম্ভব এমন ক্যামেরার গ্রহনযোগ্যতাকে আর অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই। এ পি এস সি সেন্সর কমপ্যাক্ট ক্যামেরায় প্রবেশ করিয়ে দাম যদি একেবারে কমিয়ে দেয়া যায় সময়ে সাথে তাহলে কি হবে ডি এস এল আর ব্যাবহারকারিদের ভবিষ্যৎ? কে জানে হয়ত এইসব কমপ্যাক্ট ক্যামেরা আর স্মার্ট ফোনের মাঝেই লুকিয়ে আছেন শৌখিন ক্যামেরা ব্যাবহারকারিদের ভবিষ্যৎ!

 

:line:

 

( এটিই মুক্তমনায় আমার প্রথম লেখা জমা দেয়া। প্রকাশ হবে কিনা জানিনা। এই ধরণের ক্যামেরা সংক্রান্ত লেখা প্রকাশ হয় কিনা, তাও জানিনা। ভেবেছিলাম কিছু ছবি যুক্ত করব, কিভাবে করা যায় তাও ছাই জানিনা। জিল্লুর ভাই, আমার রুমমেট মুক্তমনা-র একনিষ্ঠ পাঠক। তাঁর পিড়াপিড়িতেই লেখাটি প্রস্তুত করা গেল। )