তরুণ – জোরাভস্কি পরিবারের বড় ছেলে কাজিমির – ওয়ার্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের ছাত্র। জোরাভস্কিদের তিন ছেলের মধ্যে দু’জন ওয়ার্শ ইউনিভার্সিটিতে অন্যজন বোর্ডিং স্কুলে। ছুটিতে বাড়িতে এসে মারিয়ার সাথে পরিচয় হলো কাজিমিরের।
কয়েক দিনের মধ্যেই মারিয়াকে ভালো লেগে গেলো কাজিমিরের। মারিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে, ঘোড়ায় চড়তে চড়তে, সাইকেল চালাতে চালাতে, পারিবারিক বলড্যান্সে নাচতে নাচতে মারিয়ার প্রেমে পড়ে যায় কাজিমির। আর অষ্টাদশী মারিয়ার হৃদয়েও কাজিমিরের জন্য ঝড় উঠেছে। কাজিমিরের প্রেমে সাড়া দিলো মারিয়া। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো মারিয়া – জোরাভস্কি পরিবারের একজন হয়ে উঠবে সে অচিরেই।
জোরাভস্কি পরিবারের সবার সাথে মারিয়ার সম্পর্ক আরো আন্তরিক হয়ে উঠলো। অনেক চেষ্টা করে কাজিমিরের মায়ের মনও জয় করে ফেললো সে। ঘরের কাজ শেষ করে অবসর সময়ে চিনির কলের শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে শুরু করলো মারিয়া। পোল্যান্ডে এ ধরনের স্কুল চালানো নিষেধ। রাশিয়ান জার সরকার জানতে পারলে অনেক ক্ষতি হবে জেনেও মিস্টার ও মিসেস জোরাভস্কি বাধা দেননি মারিয়াকে। এই বাড়িতে মারিয়াকে দেখতে এসেছিলেন তার বাবা ও হেলা। মিস্টার ও মিসেস জোরোভস্কি খুবই সমাদর করলেন মিস্টার স্ক্লোদভস্কি ও হেলাকে। মারিয়া ভাবলো কাজিমিরের সাথে তার সম্পর্কে আর কোন বাধা নেই।
কিন্তু এক বছর প্রেমের পর কাজিমির যখন তার মা-বাবাকে বললো মারিয়ার সঙ্গে তার বিয়ের পরিকল্পনার কথা, যেন ভূমিকম্প হয়ে গেলো জোরাভস্কি পরিবারে। রেগে আগুন হয়ে গেলেন মিস্টার ও মিসেস জোরাভস্কি। গরীব গভর্নেসের প্রতি ভাল ব্যবহার করা এক কথা, আর তার সাথে ছেলের বিয়ে দেয়া অন্য কথা। ছেলেকে ডেকে মারিয়ার সামনেই পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন জোরাভস্কি – এ বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না।
বাধ্য ছেলের মত ওয়ার্শ ফিরে গেলো কাজিমির। মা-বাবার কথার সামান্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করলো না। যাবার আগে মারিয়াকে জানিয়ে দিলো – বাবা-মা’র অবাধ্য সে হতে পারবে না।
লজ্জায় অপমানে এতটুকু হয়ে গেলো মারিয়া। ভাবলো চাকরি ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু ব্রোনিয়াকে সে কথা দিয়েছে নিয়মিত টাকা পাঠাবে। ব্রোনিয়ার পড়াশোনা শেষ হতে আরো তিন বছর বাকি। নিজেও যে প্যারিসে গিয়ে পড়াশোনা করবে ভেবেছিলো তা প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল মারিয়া কাজিমিরের সাথে ঘরবাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
ঘরবাঁধার স্বপ্ন ভেঙে যাবার পর প্যারিসের স্বপ্ন আবার ফিরে এসেছে। যন্ত্রের মত কাজ করে চললো মারিয়া জোরাভস্কিদের বাড়িতে। একটা ক্ষীণ আশা হয়তো তখনো ছিল – কাজিমির হয়তো মা-বাবার অমতেই তাকে বিয়ে করতে চাইবে। কিন্তু কাজিমির সেরকম কিছুই করলো না। অবশেষে ১৮৯০ সালে জোরাভস্কিদের চাকরি ছাড়লো মারিয়া।
ইতোমধ্যে প্যারিসে ব্রোনিয়ার মেডিকেলের পড়াশোনা প্রায় শেষের পথে। ব্রোনিয়া প্রেমে পড়েছেন তার চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড় সহপাঠী এক পোলিশ যুবক কাজিমির ডিলুস্কির। পড়াশোনা শেষ হলেই তারা বিয়ে করবেন ঠিক করেছেন। ব্রোনিয়া লিখেছেন – মারিয়া যদি সরবোনের টিউশন ফি জোগাড় করতে পারে – তাহলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তাদের সাথেই হয়ে যাবে।
মারিয়া বুঝতে পারছে না কী করবে। বাবাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না – আবার নিজের পড়াশোনার স্বপ্নকে এভাবে বিনাচেষ্টায় ছেড়ে দিতেও ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া কাজিমিরকে সে এখনো ভুলতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে – যদি কাজিমির তার মা-বাবার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে। পরবর্তী এক বছর ধরে দোটানায় ভুগেছে মারিয়া।
১৮৯১ সালে ব্রোনিয়া ও কাজিমির ডিলুস্কির বিয়ে হলো। প্যারিসে নতুন সংসার শুরু করেছে তারা। কাজিমির জোরাভস্কির জন্য মারিয়ার অস্থিরতা টের পান মারিয়ার বাবা। তাঁরও মনে হয় ব্রোনিয়ার মত মারিয়াও যদি তার কাজিমিরকে পেতো – কতই সুখি হতো মেয়েটা। কিন্তু তা তো হবার নয়। কাজিমিরের সাথে দেখা করার শেষ চেষ্টা করেছে মারিয়া। কিন্তু কাজিমির দেখা করেনি মারিয়ার সাথে। মারিয়া সব ভুলে প্যারিসে যাবার জন্য তৈরি হয়।
১৮৯১ সালের নভেম্বরের এক শীতের সকালে প্যারিসে পা রাখলেন চব্বিশ বছর বয়সী মারিয়া স্ক্লোদভস্কা। ফরাসি নিয়মে মারিয়া হয়ে গেলেন মেরি। ব্রোনিয়া ও তার স্বামী কাজিমিরের বাসায় উঠলেন মেরি।
সরবোনের ক্লাস শুরু হলো দু’দিন পরেই। ১৮৯১ সালের ৩রা নভেম্বর প্রথমদিন ক্লাস করতে এসে মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলেন- স্বপ্ন, নাকি সত্যি। ইউরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সরবোন – মেরির স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র তেইশ জন মেয়ে। মেরি সেই তেইশ জনের একজন। প্রতিদিন সকালে ঘোড়ায় টানা বাসে চড়ে ইউনিভার্সিটিতে আসেন মেরি। তারপর ক্লাসে অখন্ড মনযোগে লেকচার শোনেন। কিন্তু প্রথম দিনই বুঝে গেলেন তাঁর যে ফরাসি ভাষাজ্ঞান তাতে প্রফেসরদের লেকচার তিনি পুরোপুরি বুঝতে পারছেন না। তাছাড়া পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতে তার যে দখল তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পড়াশোনায় ভালো করতে হলে তাকে আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে।
ব্রোনিয়া ও কাজিমির ডাক্তারি প্র্যাকটিস শুরু করার জন্য একটা দোতলা বড় বাসা ভাড়া নিলেন। নিচের তলায় পাশাপাশি দুটো চেম্বার – ব্রোনিয়া ও কাজিমিরের। কিন্তু নতুন বাসাটি সরবোন থেকে অনেক দূরে। আসা যাওয়ায় অনেক সময় নষ্ট হয় মেরির। তিনি তাই ইউনিভার্সিটির কাছে ল্যাটিন কোয়ার্টারের ফ্ল্যাটার্স রোডে একটা সস্তা বাসা ভাড়া করলেন।
বাসা বলতে ছয়তলা পুরনো বিল্ডিং এর চিলেকোঠায় একটা রুম। বিল্ডিং-এর বাইরে একটা ঝরঝরে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করতে হয় তার রুমে। বাসা থেকে বিশ মিনিট পায়ে হেঁটে ইউনিভার্সিটিতে যান মেরি। সারাদিন ক্লাস করে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করেন যতক্ষণ লাইব্রেরি খোলা থাকে। তারপর আবার পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরা। সারাদিন তেমন কিছু খাওয়াও হয় না। অনেকদিন বাসায় ফিরেই শুয়ে পড়েন বিছানায়। রুমে একটা বিছানা ছাড়া আর কোন আসবাব নেই। রুমহিটিং-এর ব্যবস্থাও নেই। কয়লার খরচ কমানোর জন্য শীতকালে বরফের মত ঠান্ডা ঘরেই রাত কাটান মেরি।
একদিন মেরির খবর নিতে এসে কাজিমির দেখেন প্রচন্ড ঠান্ডায় মেরি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন ঘরে। রক্তচাপ মারাত্মক রকমের কম। তাড়াতাড়ি প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে নিজেদের বাসায় নিয়ে আসেন মেরিকে।
সপ্তাহখানেক পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে নিজের বাসায় ফিরে আবার কষ্ট, কষ্ট, আর কষ্ট। কিন্তু কষ্ট হলেও তাঁর তৃপ্তিও অনেক – জানার তৃপ্তি, কাজের তৃপ্তি, জ্ঞানের তৃপ্তি। প্রচন্ড ঠান্ডায় জ্বালানি কিনলে খাদ্য কেনার টাকা থাকতো না। সারাদিনে হয়তো এক টুকরো রুটি আর এক কাপ চায়ের বেশি কিছু জুটতো না। এ যেন অসাধ্য সাধন করার সাধনা।
শুরুতে কিছুদিন পোলিশ জাতীয়তাবাদী একটা স্টুডেন্ট গ্রুপের সাথে মিশেছিলেন মেরি। পরে সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেন। তিনি বুঝতে পারেন পোল্যান্ডের জন্য কিছু করতে হলে আগে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে যেন দেশের জন্য সত্যিকারের কিছু করা যায়। বিজ্ঞান বিভাগের অনেক ছেলেমেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলো মেরির। তাঁর ব্যক্তিত্ব সৌন্দর্য আর অসাধারণ সাধারণত্বে অনেক ছাত্রই আকৃষ্ট হয়েছেন মেরির প্রতি। মেরিই তখন সরবোনে একমাত্র ছাত্রী যার গায়ে একটুকরো গয়নাও নেই, যার পোশাকে একটুও চাকচিক্য নেই।
ল্যামোটি নামে এক ফরাসি ছাত্র মেরির প্রেমে পড়ে গেলেন। মেরিকে অনেকবার চিঠি লিখেও কোন উত্তর না পেয়ে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দেন ল্যামোটি। কাজিমিরের কাপুরুষতা মেরিকে অনেকটাই পুরুষবিদ্বেষী করে তুলেছে। কিন্তু তিনি সেটা প্রকাশ করতে চান না। ল্যামোটিকে বললেন, “আমি তো ফ্রান্সে থাকবো না। লেখাপড়া শেষ করেই পোল্যান্ডে ফিরে যাবো। সেখানে গিয়ে স্কুলে মাস্টারি করবো। আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। কিন্তু তুমি চাইলে আমরা বন্ধু হয়ে থাকতে পারি।”
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে রেজাল্ট বের হলে দেখা গেলো সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মত একজন মেয়ে কোন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। মেরি স্ক্লোদভস্কা পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
খুশির খবর নিয়ে পোল্যান্ডে বাবার কাছে ফিরলেন মেরি। বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ তৈরি হয়েছে মেরির। সরবোনে পড়াশোনা করতে করতে বুঝেছেন গণিতে শক্ত ভিত্তি ছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা সম্ভব নয়। গণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আবার পড়াশোনার খরচ আসবে কোত্থেকে? বাবা এতদিন অনেক করেছেন। প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়েছেন মেরি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ছয়শ’ রুবলের একটা স্কলারশিপ পেয়ে যান মেরি।
সরবোনে মেরির পোলিশ বান্ধবী ডায়ডিনস্কা আলেক্সান্ড্রোভিচ স্কলারশিপ কমিটিকে মেরি স্ক্লোদভস্কার ব্যাপারে দরখাস্ত করে স্কলারশিপটার ব্যবস্থা করেছেন। [চার বছর পর মেরি স্কলারশিপের টাকাটা কমিটির কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তাঁর মতো অন্য কোন শিক্ষার্থীর কাজে লাগবে।]
সেপ্টেম্বর মাসে আবার প্যারিসে ফিরে এলেন মেরি। বাসা নিলেন ইউনিভার্সিটির কাছে। এবারো ছয়তলায় একটা রুম। আবার নতুন করে সংগ্রাম। ১৮৯৪ সালে ফাইনাল পরীক্ষার আগে মেরি একটা খন্ডকালীন গবেষণার চাকরিও পেয়ে গেলেন।
সোসাইটি ফর দি এনকারেজমেন্ট অব ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজ ইস্পাতের চৌম্বকধর্ম পরীক্ষা করার জন্য মেরিকে নিয়োগপত্র দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো সরবোনের পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের গবেষণাগার খুবই ছোট আর যন্ত্রপাতি ধরতে গেলে কিছুই নেই। মেরি পরামর্শ চাইলেন সরবোনের প্রফেসর জোসেফ কাওয়ালস্কির কাছে। কাওয়ালস্কি মেরিকে বললেন, “কাল আমার বাসায় এসো। তোমার সমস্যার সমাধান যে করতে পারবে তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো।”
পরদিন সন্ধ্যাবেলা প্রফেসর কাওয়ালস্কির বাসায় গেলেন মেরি। ঘরে ঢুকতেই দেখলেন জানালার কাছে উদাস চোখে দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সী দাড়িওয়ালা এক যুবক। মেরি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। চোখাচোখি হলো দু’জনের। কাওয়ালস্কি এগিয়ে এসে বললেন, “এসো মেরি, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ইপিসিআই’র ফিজিক্স ল্যাবের ডিরেক্টর পিয়ের কুরি। আর পিয়ের, এ হলো মেরি স্ক্লোদভস্কা যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।”
“বুঁজো মাদ্মাজেল”- ভরাট কন্ঠস্বর পিয়েরের।
“বুঁজো মঁসিয়ে”- গলা কাঁপছে মেরির।
মেরি যখন কথা বললেন পিয়েরের সাথে দু’জনই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। একদিকে পিয়েরের মেধা, প্রজ্ঞা আর সাবলীলতা, অন্যদিকে মেরির জ্ঞানের গভীরতা, নম্রতা আর অনুসন্ধিৎসায় তাঁরা পরস্পর মোহিত হয়ে গেলেন। মেরির গবেষণার কথা শুনে পিয়ের খুশি হয়ে ইপিসিআই’র ল্যাবে গবেষণা করতে আহ্বান জানালেন মেরিকে। মেরির ল্যাব সংক্রান্ত সমস্যা মিটে গেলো।
পিয়েরকে দেখে এবং কথা বলে মেরির এত ভালো লাগলো – মনে হলো পিয়ের যেন কোন স্বপ্নলোক থেকে উঠে আসা এক উদাসীন বিজ্ঞানী যার লক্ষ্য স্থির অথচ প্রাত্যাহিক জীবনের ব্যক্তিগত সুখদুঃখের সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন। পিয়েরের সাথে যখন মেরির দেখা হয় তখন পিয়েরের বয়স ৩৫ – অথচ মেরির কাছে মনে হলো আরো কম।
পরদিন থেকেই ইপিসিআই-এ পিয়েরের ফিজিক্স ল্যাবে ইস্পাতের চৌম্বক ধর্ম সংক্রান্ত পরীক্ষা শুরু করলেন মেরি। চৌম্বক-ধর্ম সম্পর্কিত গবেষণায় ইতোমধ্যেই যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন পিয়ের। শুরু হলো মেরির সাথে গভীর বৈজ্ঞানিক আলোচনা।
পিয়ের তাঁর প্রায় পনেরো বছরের বৈজ্ঞানিক জীবনে কখনোই মেরির মত এমন দীপ্তিময়ী মহিলার সংস্পর্শে আসেন নি। পুরো ফ্রান্সে কোন মহিলা পদার্থবিজ্ঞানীর দেখা পাননি পিয়ের। মেরিকে যতই দেখছেন পিয়েরের মনে হচ্ছে মেরি যেন এক আশ্চর্যমানবী – কী অপরূপ তার রূপ, কত স্নিগ্ধ তার ব্যক্তিত্ব, কত গভীর তার পান্ডিত্য।
তারুণ্যে যাকে ঘিরে ভালোবেসে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন – বিশ বছর বয়সে তাঁর সেই প্রেমিকার মৃত্যুর পর প্রেম-ভালোবাসার জগৎ থেকে নিজেকে জোর করে সরিয়ে রেখেছিলেন পিয়ের। যে প্যারিসে মেয়েরা পতঙ্গের মত ছুটে খ্যাতিমানদের পেছনে – সেখানে পিয়ের নিজেকে একেবারেই সন্ন্যাসী বানিয়ে ফেলেছিলেন। ধর্মে বিশ্বাস থাকলে হয়তো এতদিনে চার্চের পাদ্রীই হয়ে যেতেন তিনি। মেরির জন্য তাঁর মনের সব দরজা খুলে যাচ্ছে একে একে। মেরির প্রেমে পড়ে গেলেন পিয়ের।
এদিকে প্রচন্ড ব্যস্ত মেরি। গণিতের পড়াশোনা, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। তারপর যখন সময় পান ইস্পাতের ধর্ম পরীক্ষা। পিয়েরের সাথে দেখা হয় ল্যাবে। পিয়েরের সবকিছুই ভালো লাগছে মেরির। অথচ নিজের মন থেকেও যেন পালিয়ে বেড়াতে চাচ্ছেন মেরি। কাজিমির জোরাভস্কির কাছ থেকে পাওয়া অপমান তিনি এখনো ভুলতে পারেননি। তাছাড়া তিনি মনে করছেন ফ্রান্সের পড়ালেখা শেষ করে নিজের দেশ পোল্যান্ডে ফিরে যাওয়া তাঁর নৈতিক দায়িত্ব।
একদিন পিয়ের জানতে চাইলেন, “মেরি, তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছো তুমি?”
পিয়েরের চোখের মুগ্ধতা বুঝতে না পারার মত অনভিজ্ঞ মেরি নন। আলোচনা কোন্ দিকে মোড় নিচ্ছে বুঝতে পারছেন তিনি। উত্তর দিলেন, “পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই আমি পোল্যান্ডে ফিরে যাবো। ওখানে গিয়ে স্কুলে পড়াবো।”
“ফ্রান্স ছেড়ে একেবারেই চলে যাবে?”
“যেতে তো হবেই। ফ্রান্স তো আমার দেশ নয়।”
“ফ্রান্সকে তোমার নিজের দেশ করে নিতে পারো না?”
“মানে?”
“আমি তোমার অনাদর করবো না মেরি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। কেন বুঝতে চাইছো না?”
মেরি কোন উত্তর দিলেন না। বাসায় ফিরতে হবে তাঁকে। ফিরে রাত জেগে পড়তে হবে পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষায় প্রথম হতে হতে অন্যরকম মানসিক চাপ পড়ে পরীক্ষার সময়। শুধু পাশ করলেই তো এখন আর হবে না, প্রথম হতে হবে।
মেরির তাড়া দেখে পিয়েরের হঠাৎ ভয় হলো – মেরি কি রাগ করেছে? আর যদি কখনো দেখা না হয়? করুণ মুখে বললেন, “আমি কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?”
প্যারিসের সমাজ তখনো অনেকটাই রক্ষণশীল। মেয়েদের বাসায় অনাত্মীয় ছেলেদের প্রবেশ সামাজিক গুজব তৈরি করে। কিন্তু মেরি বা পিয়ের কেউই ওসব সামাজিক নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। মেরির সাথে পিয়ের গেলেন মেরির বাসায়। নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন ছয়তলায়।
মেরির বাসায় বসার একটা নড়বড়ে চেয়ার আর একটা ক্যাম্প খাট ছাড়া আর কোন আসবাবই নেই। পিয়ের একটুও অবাক হলেন না। যেন এটাই স্বাভাবিক। মেরির ভালো লাগলো পিয়ের মেরির ঘর সম্পর্কে কোন মন্তব্য করলেন না দেখে।
পিয়ের মেরিকে আবারো বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “দেখো মেরি, তোমার যে বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা আছে – তা শেষ হয়ে যাবে যদি তুমি পোল্যান্ডে ফিরে গিয়ে স্কুল মাস্টারি শুরু করো।”
মেরি নিজেও জানেন তা। দোটানায় ভুগতে থাকেন মেরি। পিয়ের চলে গেলে মেরি মেইলবক্স চেক করে একটা চিঠি পেলেন। ল্যামোটির চিঠি। মেরির প্রেমে ল্যামোটি এখনো একতরফা মজে আছেন। অনেকদিন মেরির দেখা না পেয়ে ল্যামোটি চিঠি লিখেছেন মেরিকে। সামনের পরীক্ষার জন্য শুভকামনা ইত্যাদি জানাবার পর ল্যামোটি লিখছেন – “তুমি বলেছিলে তোমাকে কিছুদিন না দেখলেই আমি তোমাকে ভুলে যাবো। কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি জানি হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না। কিন্তু তুমি মনে রেখো – যদি কখনো কোনদিন আমাকে তোমার দরকার হয় – তুমি ডাকলেই আমাকে পাবে। তোমার জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি।”
পিয়েরের ব্যক্তিত্বের কাছে ল্যামোটি কিছুই নন। কিন্তু পিয়েরের ব্যাপারেও মনস্থির করে উঠতে পারেন না মেরি। বর হিসেবে পিয়ের নিঃসন্দেহে উপযুক্ত। কিন্তু পিয়ের যে বিদেশী।
মনে পড়ে মেরির – ১৮৮৮ সালে তার বেস্ট ফ্রেন্ড কাজিয়া যখন এক জার্মান ছেলেকে বিয়ে করলো – রেগে গিয়েছিলেন মেরি। অনেক জাতীয়তাবাদী কথা শুনিয়েছিলেন তিনি তখন। এখন নিজেই যদি একজন ফরাসিকে বিয়ে করে ফেলে – নিজের দেশের প্রতি কি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না?
১৮৯৪ সালের জুলাইতে রেজাল্ট বের হলো মেরির। গণিতে প্রথম হলেন মেরি কুরি। সুখবর নিয়ে বাবার সাথে সময় কাটানোর জন্য পোল্যান্ডে চলে গেলেন তিনি।
পিয়ের ভাবলেন মেরির সাথে সম্ভবত আর কখনোই দেখা হবে না। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা আবারো খালি হয়ে গেল পিয়েরের। কিন্তু না, দশ দিন পরেই মেরির চিঠি পেলেন পিয়ের। তবে কি এখনো আশা আছে? পিয়ের চিঠি লিখলেন মেরিকে – “সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও আমরা তো পরস্পরের বন্ধু হয়ে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছি, তাই না? তুমি যদি তোমার মত না বদলাও আমরা তো বন্ধু হয়েই আমাদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারি – তোমার দেশপ্রেমের স্বপ্ন, আমাদের মানবতার স্বপ্ন, এবং আমাদের বৈজ্ঞানিক স্বপ্ন। আমার কাছে বিজ্ঞানিক স্বপ্নগুলোকে সফল করাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বৈজ্ঞানিক উন্নতির মাধ্যমেই আমরা সমাজের সব সমস্যার সমাধান করতে পারবো। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখলে এটাই ঠিক যে পোল্যান্ডের চেয়ে বর্তমানে ফ্রান্সেই বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্র অনেক বেশি উর্বর। এখানে আমরা যৌথভাবে যা কিছুই আবিষ্কার করি না কেন, যত ছোটই হোক, অর্জিত জ্ঞান হিসেবে থেকে যাবে তা। কিন্তু তুমি যদি ফ্রান্স থেকে দূরে থাকো – বছরখানেকের মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্ব বড় বেশি প্লেটোনিক হয়ে যাবে – কারণ আমাদের যে দেখাই হবে না আর। তুমি কিছুতেই কি আমার সাথে থাকতে পারো না? আমি জানি আমার এ প্রস্তাব তোমাকে আবারো রাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কী করবো বলো। আমার নিজেকে সবদিক থেকেই তোমার অনুপযুক্ত মনে হচ্ছে।”
মেরি পিয়েরের প্রস্তাবের কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর না দিয়ে জানালেন যে অক্টোবরে তিনি প্যারিসে ফিরছেন। নিজের একটা ছবিও পাঠালেন মেরি এবং পিয়েরকে আমন্ত্রণ জানালেন পোল্যান্ডে বেড়িয়ে যেতে।
পিয়ের বুঝলেন এখনো হয়তো আশা আছে। কিন্তু পোল্যান্ডে যাওয়াটা ঠিক হবে না মনে করে গেলেন না। বড়ভাই জাকোকে মেরির পাঠানো ছবিটা দেখালেন পিয়ের। জাকো খুব পছন্দ করলেন মেরিকে।
১৮৯৪ সালের অক্টোবরে প্যারিসে ফিরে এলেন মেরি। ব্রোনিয়াদের বাসার কাছে একটা এক রুমের বাসা ভাড়া করলেন। ইস্পাত পরীক্ষণের কাজটা শুরু করলেন আবার।
পিয়েরের সাথে দেখা হলো। কিন্তু পিয়েরকে বিয়ের ব্যাপারে পরিষ্কার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনটাই বলছেন না মেরি। অস্থির হয়ে উঠলেন পিয়ের। এরকম সিদ্ধান্তহীনতা ভালো লাগে না তাঁর। তিনি দুটো প্রস্তাব রাখলেন মেরির সামনে – “বিয়ে করার জন্য আমাকে যতটুকু ভালবাসা দরকার যদি ততটুকু ভালোবাসতে না পার, তাহলে এটুকু কি করা যায় – যদি আমি তোমার বাসার পাশেই একটা বাসা নিয়ে থাকি – তবে কি বিয়ে না করেও জাস্ট বন্ধুর মত থাকা যায়? যদি তাতেও তোমার আপত্তি থাকে – তুমি তো পোল্যান্ডে ফিরে যাবার জন্যই আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছো না তাই না? কারণ আমাকে বিয়ে করলে তোমাকে ফ্রান্সে থাকতে হবে। যদি সেটাই কারণ হয় – আমি তোমার সাথে পোল্যান্ডে গিয়ে থাকতে রাজী আছি। আমি সেখানের স্কুলে ফরাসি ভাষা শেখাতে পারবো। তাতে আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণা কিছুই হবে না। তাতে কিছু যায় আসে না। তোমাকে পেলে আমি তাও মেনে নিতে পারবো। তুমি কি দয়া করে ভেবে দেখবে একটু?”
মেরির জন্য পিয়ের তাঁর সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ার পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত! এত ভালোবাসেন তাকে! মেরি আপ্লুত হয়ে গেলেন। ব্রোনিয়ার সাথে আলাপ করলেন। ব্রোনিয়া সব শুনে আনন্দে হতবাক হয়ে গেলেন। তার আদরের ছোটবোনকে কেউ এত ভালোবাসে অথচ মেরি এখনো ‘হ্যাঁ’ বলতে ইতস্তত করছে? ব্রোনিয়া মেরিকে বোঝাতে শুরু করলেন।
পিয়ের জানতে পারলেন যে মেরি ব্রোনিয়াকে বলেছেন তাঁর কথা। তিনি ব্রোনিয়ার সাথে দেখা করলেন। পিয়েরের সাথে কথা বলে ব্রোনিয়া এতই মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে নিজেই মেরিকে সাথে নিয়ে পিয়েরের সঙ্গে চলে গেলেন প্যারিস থেকে সাড়ে ছ’মাইল দূরে স্সো (Sceaux)-তে পিয়েরদের বাড়িতে।
পিয়েরদের বাড়িতে গিয়ে পিয়েরের মা-বাবার সাথে কথা বলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন মেরি। বিশেষ করে পিয়েরের বাবা ডাক্তার ইউজিন কুরির সাথে কথা বলে মেরির মনে হলো – এমন ঋষিতুল্য মানুষ তিনি আর একটাও দেখেন নি। কী সৌম্য স্নিগ্ধ মানবিক – অথচ কত গভীর জ্ঞানী মানুষ ইউজিন। মেরির মনে হলো এই মানুষটা মানুষের উপকারের জন্য নিজের প্রাণ দিতেও এক মুহূর্ত চিন্তা করবেন না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন মেরি – প্যারিসে ফিরেই পিয়েরকে ‘হ্যাঁ’ বলে দেবেন।
পিয়েরের মা-বাবারও খুব ভালো লেগেছে মেরিকে। পিয়েরের মা তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর সন্ন্যাসী ছেলে বিয়ে করতে রাজী হবে কখনো। মেরি যে তাঁর ছেলের মন ফেরাতে পেরেছেন তাতেই তিনি খুশি। তিনি ব্রোনিয়ার হাত ধরে অনুরোধ করলেন যেন মেরিকে রাজী করান।
প্যারিসে ফিরে এসে পিয়েরের সাথে খোলাখুলি কথা বললেন মেরি। পিয়ের মেরির জন্য নিজের ক্যারিয়ার পর্যন্ত উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। মেরি তা হতে দেবেন না।
পিয়েরের সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ার ইতোমধ্যেই অনেক প্রতিষ্ঠিত। পদার্থবিজ্ঞানে কত ভালো ভালো কাজ করেছেন পিয়ের। অথচ ফ্রান্সের বিজ্ঞানজগতে পিয়েরের কোন স্বীকৃতিই নেই। পিয়ের অনেক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন ঠিকই – কিন্তু নিজের ডক্টরেটটাই শেষ করেন নি। পিয়েরকে বললেন মেরি – “দেখো পিয়ের, আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমাকেই আমি বিয়ে করবো। কিন্তু তার আগে তোমাকে তোমার ডক্টরেট ডিগ্রি কমপ্লিট করতে হবে। আমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা আমাদের উভয়েরই বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারকে সামনে নিয়ে যাবে।”
নতুন উদ্যম ফিরে পেলেন পিয়ের। মেরির উৎসাহ আর সহযোগিতায় চৌম্বকক্ষেত্রের ওপর প্রকাশিত পেপারগুলো সমন্বয় করে ডক্টরাল থিসিস লিখলেন পিয়ের।
১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে ‘ম্যাগনেটিক প্রপার্টিজ অব বডিজ অ্যাট ডাইভার্স টেম্পারেচার’ শীর্ষক থিসিস জমা দিলেন সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। জুন মাসে কৃতিত্বের সাথে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে গেলেন পিয়ের। তার কয়েকদিন পরেই মেরি ও পিয়েরের এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো। তাঁদের এনগেজমেন্টের খবর জেনে গেলো প্যারিসের একাডেমিক জগৎ।
মেরির একতরফা ফরাসি প্রেমিক ল্যামোটি খবরটি জানার পর ভীষণ হতাশ হয়ে গেলেন। মেরির সাথে পিয়েরের সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। তিনি পরাজয় মেনে নিয়ে মেরিকে অভিনন্দন জানালেন। মেরি যখন বললেন যে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বটা এখনো থাকতে পারে – রেগে গেলেন ল্যামোটি – “এরকম ভন্ডামির কোন মানে হয় না। আমি মনে করি আজ থেকে তুমি আমার কাছে মৃত এবং তোমার কাছে আমিও মৃত। আমার কথা আর কোনদিন মনে করো না।”
১৮৯৫ সালের ২৬শে জুলাই পিয়েরের মা-বাবার বাড়ির কাছে স্সো টাউন হলে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হলো মেরি ও পিয়েরের। পোল্যান্ডের মারিয়া স্ক্লোদভস্কা হয়ে গেলেন ফ্রান্সের মেরি কুরি।
খুবই অনাড়ম্বর বিয়ের অনুষ্ঠান। ওয়েডিং ড্রেস কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন মেরির বাবা। কিন্তু প্রচলিত সাদা ড্রেসের বদলে মেরি একটা নেভি ব্লু রঙের মোটা কাপড়ের ড্রেস তৈরি করালেন যেটা তিনি পরে তাঁর ল্যাবোরেটরিতে অ্যাপ্রোন হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। বাকি টাকা দিয়ে দুটো বাই-সাইকেল কিনলেন দু’জনের জন্য।
বিয়েতে মেরির পরিবার থেকে উপস্থিত ছিলেন ব্রোনিয়া ও তাঁর স্বামী, পোল্যান্ড থেকে এসেছিলেন মেরির বাবা ও দিদি হেলা। আর পিয়েরের পরিবার থেকে পিয়েরের মা-বাবা, ভাই জাকো ও তার পরিবার। তাছাড়া পিয়ের ও মেরির কিছু ফরাসি বন্ধু-বান্ধব।
ধর্মে বিশ্বাস নেই কোন পরিবারেরই। তাই কোন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়নি বিয়েতে। কোন আংটিবদল হয়নি – এমনকি মেরি বা পিয়ের কারো জন্যই কোন আংটি কেনা হয়নি। কারণ তারা কেউই আংটি পরেন না এবং আংটির কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। বিয়ের পর টাউন হল থেকে কয়েক মিনিট হেঁটে পিয়েরের বাবার বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে অতিথিরা বিদায় নেন।
বিকেলে সাইকেলে চেপে হানিমুনে বের হলেন কুরি দম্পতি। নতুন বিয়ের চিহ্ন হিসেবে মেরির সাইকেলে একগোছা বুনোফুল বেঁধে দেন পিয়ের। বাগান মাঠ-ঘাট বন-বাদাড়ে কয়েক মাইল সাইকেলে ভ্রমণ করলেন মেরি ও পিয়ের। পিয়ের সাইকেল চালাতে চালাতে বলছিলেন তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। বলাবাহুল্য সব পরিকল্পনাই গবেষণা সংক্রান্ত। মেরিও গভীর মনযোগে বৈজ্ঞানিক আলোচনায় মেতে উঠলেন তাঁদের বিয়ের প্রথম দিনেই।
পথে এক জায়গায় সাইকেলদুটো রেখে বুনো পথে পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন নবদম্পতি। পিয়ের বিভিন্ন গাছের নাম বলছেন মেরিকে। ছোটবেলায় এরকম বুনো জঙ্গলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটতো তাঁর।
একসময় বুনোফুলে ভর্তি এক হ্রদের পাড়ে বসলেন দু’জনে। পিয়ের মেরিকে বললেন, “তোমার হাতটা একটু দেবে?”
মেরি ভাবলেন এতক্ষণে হুঁশ হলো তাঁর স্বামীর। বিয়ের পর এতক্ষণ একবারের জন্যও স্ত্রীর হাত ধরার কথা মনে হয়নি পিয়েরের। মেরি অনুরাগে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে দিলেন স্বামীর দিকে। একটু পরে হাতে ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মেরির। তাঁর হাতের তালুতে বসে আছে একটা ছোট্ট সোনালি ব্যাঙ। ঘেন্নায় আতঙ্কে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল মেরির। হাত ঝেড়ে ব্যাঙটাকে যে ফেলে দেবেন তাও পারছেন না তিনি।
“কী সুন্দর না? ব্যাঙটাকে একটু আদর করে দাও।”
এসব কী বলছেন পিয়ের! পিয়েরের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন মেরি – প্র্যাকটিক্যাল জোক্ করছেন, নাকি আসলেই? পিয়েরের চোখেমুখে কৌতুকের লেশমাত্র নেই। তিনি সিরিয়াস। প্রকৃতির সাথে সাথে প্রকৃতির প্রাণীদের প্রতিও মায়া-মমতা পিয়েরের।
শুনেছি দেবদাসের পাণ্ডুলীপি শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর অনেক বছর পর জঞ্জল স্তুুপের ভেতর থেকে বিদ্ধস্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, সেদিন যদি পাণ্ডুলীপিটি উদ্ধার না হত তাহলে বাংলা সাহিত্য এক মহান ট্রাজিক লেখনি হারাত। সেই বরাতে মন্তব্য, আর সেটা হলো যদি মারীয়া কুরী সম্পর্কে লেখক এত কিছু না লিখত, তাহলে কুরী সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত অনেক কিছু বাকী থেকে যেত, সত্যি অসাধারণ, অসাধারণ ট্রাজেডীর অবতরণা করেছেন। ধন্যবাদ লেখক।
আমি যশোরের লোক
মানুষের কিছু আকাশ কুসুম স্বপ্ন থাকে, আমার তেমন অসম্ভব প্রায় স্বপ্নের একটি মেরি কুরির মত কেউ হওয়া। প্রায় এক শতাব্দী আগে জন্ম নেয়া একজন নারী আমাকে আজ অব্দি এতোটা মুগ্ধ করে রেখেছে, আমি মেরির মত হবার কোন যোগ্যতাই রাখিনা জেনেও স্বপ্নটা দেখতে আমার ভালো লাগে। যে বিষয় নিয়ে আমি গবেষণা করতে চাই, অনেক চেষ্টা করেও সে বিষয়ে গবেষণার কোন সুযোগই পাচ্ছি না। এমন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, আমার অ্যাকাডেমিক যাত্রা হয়ত এখানেই শেষ হয়ে যাবে। তবুও মেরিকে মনে করে মুগ্ধতা কোনদিন কমবে না। মেরি কুরি আমার কাছে এমন একজন অনুপ্রেরণার নাম, যার সামনে আর কেউ দাঁড়াতে পারে না।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মেরি কুরিকে নিয়ে লেখার জন্য।
@নীল রোদ্দুর, আকশ কুসুম স্বপ্ন কেন বলছেন? মেরি কুরির যুগে তাঁদের যত কষ্ট করতে হয়েছিল এখন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কষ্টের ধরন অনেকটাই বদলে গেছে। এটাও সত্যি যে গবেষণার স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা মূলত অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল, কিন্তু দমে গেলে চলবে কীভাবে? আপনার স্বপ্ন অবশ্যই সফল হবে।
@প্রদীপ দেব, সেই অনেক কিছুর জন্যই মূলত আটকে আছি। অনুপ্রেরণার জন্য ধন্যবাদ। আমি চেষ্টা করব দমে না যেতে।
@নীল রোদ্দুর,
আমি এক সময় আপনার মতই ভাবতাম! কিন্তু দেখেছি লেগে থাকলে শেষ পর্যন্ত উপায় একটা হয়েই যায়। আপনার পছন্দের বিষয়টি কি?
@মনজুর মুরশেদ,
কম্পিউটেশনাল নিউরোসায়েন্স (এক্সপেরিমেন্ট বেসড)। আরো পরিষ্কার করে বললে, নিউরাল পারসেপশন মেকানিজম, সিঙ্গেল নিউরন থেকে নিউরাল সিস্টেম লেভেলে ইনফরমেশন প্রসেসিং নিয়ে কাজ করা।
এই কাজের সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে মূল বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে আমার মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং- বি এস সি ডিগ্রী। আদ্যোপান্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া একজন, তাও আবার থার্মোডাইনামিক্স, অ্যাপলাইড মেকানিক্স পড়ে আসা কেউ কি করে নিউরোসায়েন্টিফিক সমস্যা নিয়ে কাজ করবে, সেটাই যারা সুযোগটা দিতে পারেন তাদের বিশ্বাস করানো কঠিন।
@নীল রোদ্দুর,
খুবই ইন্টারেস্টিং টপিক! শুধু বলার জন্যই বলছিনা, এক সময় এটা আমারো পছন্দের বিষয়গুলোর একটি ছিল; কাজ করার সুযোগও পেয়েছিলাম, কিন্তু বাস্তবতা বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যাইহোক আমার মূল বিষয় বরাবরই জীববিজ্ঞান, তাই আমার আর আপনার পরিস্থিতি ভিন্ন।
উত্তর আমেরিকায় বায়ো-মেডিক্যাল রিসার্চে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, আপনাকে নিদেন পক্ষে জীববিজ্ঞানের কোন একটা বিষয়ে মাস্টার্স করতে হবে। সরাসরি নিউরোসায়েন্স সম্পর্কিত হলে ভালো, তবে তা নাহলেও অসুবিধার কিছু নেই। এ পর্যায়ে আসল লক্ষ্য হচ্ছে মলিক্যুলার বায়োলজী, বায়োকেমিস্ট্রি, ফিজিওলজী-র মত বিষয়গুলো আয়ত্ব করা, বেসিক ল্যাবরেটরী টেকনিক শেখা এবং আধুনিক বায়োলজীর গবেষণা সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া। যদি মাস্টার্সে ভালো করতে পারেন তাহলে পিএইচডিতে সুযোগ পেতে অসুবিধা হবে না।
যদি এনিয়ে আরো আলোচনা করতে চান তাহলে ফোন অথবা ই-মেইলে যোগাযোগ হতে পারে।
@মনজুর মুরশেদ, লক্ষ্যে স্থির থাকার জন্য শুধু মনোবল নয়, আসলেই আমার কিছু বাস্তবিক পরামর্শ দরকার। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেইলে একটা মেইল দিয়েছি। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
ভাগ্যিস তারা সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে পোল্যান্ডে চলে যায়নি! শুধু এই একটা সিদ্ধান্তেই বিজ্ঞান পিছিয়ে যেতে পারতো অনেক বছর।
এবারের বইমেলায় আপনার বই অবশ্যই কিনবো। বেশি করে লিখতে থাকুন।
@রামগড়ুড়ের ছানা, অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের দেয়া উৎসাহ আমার লেখায় অনুপ্রেরণা।
ভাল লাগছে। পরের পর্বের অপেক্ষায়।
@গীতা দাস, অনেক ধন্যবাদ দিদি। রেডিয়াম ভালোবাসা বইমেলায় এসে গেছে।
অসাধারন লাগছে আপনার এই সিরিজটা।
@অরিন্দম, অনেক ধন্যবাদ। পুরো লেখাটা বই আকারে বেরিয়েছে এবারের বই মেলায়। “রেডিয়াম ভালোবাসা” পাওয়া যাচ্ছে মীরা প্রকাশনের স্টলে।
@অরিন্দম, অনেক ধন্যবাদ।
অসাধারণ!!! মুগ্ধের চেয়ে বেশি কিছু!! মানুষের জীবন কিভাবে সার্থক হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। :guru: :guru: :candle:
@অগ্নি, অনেক ধন্যবাদ আপনার উদার মন্তব্যের জন্য।