লোকটা এলেই রীনাতের কেমন ভয় করতে থাকে। হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। নিজের রুম থেকে বের হতে চায় না। কিন্তু এ কথাটা সে কাউকে বলতে পারে না। এমন কি মাকেও না। আর লোকটা এলেই মা কেবল ডাকবে, “ও রীনাত তোমার রবিন মামা এসেছে। এসো দেখা করে যাও।” মায়ের এ ডাক টেবিলে বসা রীনাতকে আরো অসাড় করে। সে যায় না। যেতে পারে না। কিন্তু লোকটা আসে। সরাসরি তার রুমে ঢুকে বিছানায় বসে কখনও কখনও পড়ার টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে জানতে চায়, “কেমন আছ?” রীনাত চেয়ারের সঙ্গে আটকে বসে থাকে, নড়াচড়া করতে পারে না। তবে কেবলই ভয় হয় এই বুঝি লোকটা…..।

হুঁহ্‌! মামা! লোকটাকে মামা বলে ডাকতেও ঘৃণা হয়। কিন্তু লজ্জায় ঘৃণায় বাকহারা রীনাত কুঁকড়ে গিয়ে নিজেকেই অপরাধী ভাবে। মনে হয় সেদিন কেন লোকটাকে বাধা দিতে পারেনি। যেদিন লোকটা তার কিশোরী শরীরটাতে আচমকা হাত দিয়েছিল। সেদিন সারাদিন তার বমি পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অনেকবার গা ধুলেও তার শরীর থেকে ঐ লোকটার স্পর্শ মুছে যাবে না। ভীষণ ভয় পেয়েছিল। ছোট খালার পাশে শুয়ে সেই রাতে অস্বস্তিতে বার বার কেঁপে উঠেছিল। খালা কয়েকবার জানতে চেয়েছে- কী হয়েছে। কিন্তু রীনাত বলতে পারেনি। বলতে পারেনি ঐ যে রবিন মামা আসে ওটা একটা দুশ্চরিত্র। আর কী আশ্চর্য এত বছরেও লোকটার আসা-যাওয়া কমেনি। ঘরে ঢুকেই কী স্বাভাবিক স্বরে মাকে ডাকে। বলে -“তোমাদের দেখতে এলাম নাহার। তোমরা তো যাও-টাও না”। মাঝে মাঝে স্ত্রী-পুত্র সবাইকে নিয়ে আসে। ওর ছেলে যে কিনা ছেলেবেলায় তার খেলার সাথী ছিল, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাকে দেখলেও ভয় পায় রীনাত। কেবলই মনে হয় নিরিবিলি পেলে সেও কি তার বাবার মত হাত বাড়াবে?

আজও লোকটা এসেছে। আসবে না কেন? মায়ের আপন খালার ছেলে। এক শহরে থাকে। বিশেষ করে রীনাতের বাবার মৃত্যুর পর থেকে আরো বেশি আসে। আর সেই আসার সুযোগে -।

বাবার আকস্মিক মৃত্যু রীনাতদের বিহ্বল করে তুলেছিল। তেরো বছরের রীনাত কিছুতেই বুঝতে পারছিল না বাবার মত এত প্রাণবন্ত মানুষ কীভাবে এত তাড়াতাড়ি মারা যায়। মা এত বেশি ভেঙে পড়েছিল যে শেষ পর্যন্ত মাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। আত্মীয়-স্বজন ছুটে এসেছিল। সেই সময় সবার আসা-যাওয়াটা বেড়ে গিয়েছিল। নিকট আত্মীয়রা যে যখন পারে এসে দেখে যায়। ছোটখালা নিজের ঘরসংসার ফেলে ওদের সঙ্গে কয়েকদিন থেকে গিয়েছিল। এই লোকটাও সেই সময় থেকে আসা-যাওয়া বাড়িয়ে দেয়।

তার বেশ অনেকদিন পর একদিন সন্ধ্যায় লোকটা এসেছিল। মা তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। বাসায় ঢুকেই লোকটা বলেছিল – “অফিস থেকে এলাম। বাসায় গেলে দেরি হয়ে যাবে। নাহার কোথায়? এখনও ফেরেনি বুঝি?” বলতে বলতে রীনাতের পাশে বসেছিল। ডাবল সোফাটায় বসতে বসতে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছিল। ছোটখালা তাড়াতাড়ি চা করতে গিয়েছিল। আর এই সুযোগে লোকটা হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরে রীনাতের জামার ভেতর হাত দিয়েছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় সেদিন যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল রীনাত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোটখালার আসার সাড়া পেয়ে লোকটা চট করে সরে গিয়ে নিজের জায়গায় বসেছিল। রীনাত কান্না চাপতে চাপতে ছুটে গিয়েছিল বাথরুমে। অনেকক্ষণ চোখেমুখে পানি দিয়ে যখন বাথরুম থেকে বেরিয়েছিল ততক্ষণে লোকটা চলে গিয়েছিল। ছোটখালা পড়তে বসেছিল। সেদিন রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল সে। মা ফিরে এসে ডাকতে এলে বলেছিল – “খুব মাথা ব্যথা করছে, আজ রাতে খেতে পারব না”। তারপর সারা রাত ছটফট করে কেটেছে। পরদিন সকাল থেকে কতবার মুখের ভিতর নাড়াচাড়া করেছে, কিন্তু মা বা ছোটখালাকে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। তারপর থেকে গত চার বছরে যখনই লোকটা আসে রীনাতের শরীরটা পাথরের মত হয়ে যায়। যেখানে বসে থাকে সেখানেই একঠাঁই বসে থাকে।

চৌদ্দ বছর বয়সের এ আঘাতটা রীনাতকে কেমন যেন জড়োসড়ো করে দিয়েছে। একে তো বাবার আকস্মিক মৃত্যু জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল। তার পরপরই ঐ ঘটনাটা এত বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল যে কারো সঙ্গে সহজভাবে আজ অবধি মিশতে পারে না। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ওঠার পরও ক্লাসের ছেলে-মেয়ে কারো সাথেই তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। যতটুকু সময় প্রয়োজন তার বাইরে কখনও কোথাও থাকেনি। কলেজে যাওয়া আসার পথেও সব সময় একটা আতঙ্ক- এই বুঝি কেউ গায়ে হাত দিল। মা কত বলে মায়ের সঙ্গে একটু বাইরে যেতে – মেলায়, মার্কেটে বা আত্মীয়-স্বজনের বাসায়। ইচ্ছেও করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটা মনে পড়ে আর যেতে ইচ্ছে করে না। মা মাঝে মাঝে বকাবকি করে- “লেখাপড়া শিখে কী হবে এরকম একঘরে হয়ে বেঁচে থাকলে। এখনকার মেয়েরা কত স্মার্ট, তাছাড়া অফিস আদালতে চাকরি বাকরি করতে গেলে এরকম মুখচোরা হয়ে বসে থাকলে তুমি কখনো কিছুতে উন্নতি করতে পারবে না। এ যুগটাই হচ্ছে যোগাযোগের যুগ”। আরো বেশি রেগে গেলে অসামাজিক, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক বলে খোঁচা দিতেও ছাড়ে না।

মায়ের এরকম বাক্যবাণ শুনে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চিৎকার করে সব বলে দিতে। ইচ্ছে করে, কিন্তু বলতে গেলেই গলার কাছে কেমন একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে। আর কোন কথাই বলতে পারে না। রীনাত নিজেও ভেবেছে – মায়ের কথাটা মিথ্যে নয়। এবার এইচএসসি পাশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা বন্ধুত্ব এগুলোতো জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপার। পরের কাঁধে ভর করে আর কতদিন। কোথাও যেতে হলে মা ছোটখালাকে ফোন করে। ছোটখালা এসে তাকে নিয়ে যায়। ছোটখালা ব্যস্ত থাকলে বাসার কাজের বুয়াকে সাথে নিতে হয়। এমন করে কতদিন চলবে। বুয়া পর্যন্ত মাঝে মাঝে বলে – “আপা আপনে এত ভয় পান ক্যান? আইজকাইল মাইয়াগো কত সাহস। গার্মেন্সের মাইয়ারা কত দূরদ্যাশ থেকে আইসা শহরে চাকরি করতাছে, একলা একলা থাকতাছে”। সত্যি রীনাতও অনুভব করে মেয়েরা কত সচ্ছন্দে চলাফেরা করে। যখন স্কুলে পড়ত তখনও দেখত হুটহাট বান্ধবীর বাসায় চলে যাচ্ছে। কলেজে তো বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের কাজই ছিল আড্ডা দেওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কাল। মা যেতে পারবে না – অফিসে জরুরি মিটিং। ছোটখালাকে ফোন করল রীনাত। খালা জানালো বিভুর পরীক্ষা। তাহলে? বুয়া! ধুর – পরীক্ষা দিতে কি বুয়াকে নিয়ে যাওয়া যায়? লোকে হাসবে। আর এ কথা বললে মা রেগে কাঁই হবে। অথচ অপরিচিত জায়গায় একলা যাওয়ার কথা ভাবলে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তাহলে কী হবে? নাহ্‌ এবার নিজেকে দাঁড়াতে হবে। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ে নিজেকে তৈরি করে – পারব, আমি পারব, আমাকে পারতে হবে। বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিজেকে ধমকাল – ভীতু, ভীতুর ডিম। আবার সাহস দিল – পারব, পারব, পারব।

সকালে ঘুম ভাঙতেই আবার সেই ভয়টা চেপে ধরল। এত ভীড়ের মধ্যে নিজের জায়গাটায় পৌঁছাতে পারবে তো। কিন্তু ভয় লাগছে বললে মা খুব মন খারাপ করবে। মা বার বার তাগিদ দিচ্ছেন দরকারি কাগজপত্র আর কলম পেন্সিল গুছিয়ে নিতে। তারপর বুয়াকে দিয়ে রিক্সা ডেকে আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে মুখে ফুঁ দিয়ে রিক্সায় তুলে দিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে রিক্সা থেকে নামার আগেই ফাইজা ডাক দিল – “এই রীনাত এদিকে আয়। তুই আমাদের হলে পড়েছিস।” এগিয়ে এসে রীনাতের হাত ধরে ফাইজা। ফাইজার এ আন্তরিকতা রীনাতের মনে একটা শক্তি আর আনন্দ এনে দেয়।

পরীক্ষাটা ভালই হয়েছে। ফাইজা, অর্পা, বিনু – বন্ধুরা সবাই কলকল করতে করতে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসে। রীনাতও চুপচাপ হাঁটতে থাকে। বিনু প্রস্তাব দেয় – “ভর্তি হতে পারি কি না পারি আজকে অন্তত চল ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখি। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে একটা বিশাল মিছিলের সামনে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি একপাশে সরে যায় ওরা। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিচ্ছে। পরীক্ষার্থী ছাত্রছাত্রীরা উৎসুক হয়ে জানতে চায়- কেন মিছিল? নানা রকমের কথা শোনা যায়। একজন স্যারের পদত্যাগ দাবি করে মিছিল। “কী করেছেন তিনি?” – কেউ কেউ জানতে চায়।

“আরে জানিস না – পরশুদিন টিউটরিয়াল দেবার জন্য স্যারের কাছে গিয়েছিল। স্যার একলা পেয়ে ওর গায়ে হাত দিয়ে উৎপীড়ন করেছেন। মেয়েটা স্যারের হাত কামড়ে নাকি ছুটে বেরিয়ে এসেছিল। তারপর অভিভাবককে নিয়ে সোজা ভিসির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।”

“কোন মেয়েটা? ওকি এখানে আছে?” – ভিড়ের মধ্যে প্রশ্ন উঠল। “ঐ যে মিছিলের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে কালো কামিজ পরা মেয়েটা।” ইস্‌ স্লোগান দিতে দিতে ওদের মুখগুলো এমন লাল হয়ে উঠেছে যেন এক্ষুণি রক্ত ফেটে বেরুবে। রীনাতের ভেতর পাহাড় ভাঙে, সমুদ্রের গর্জন শুরু হয়। এত সাহস! এত সাহস ঐ মেয়েটার। কই সে তো লজ্জায় ঘরের কোণে মুখ লুকায়নি। তবে রীনাত কেন ….? এতক্ষণ ফাইজার মুঠো করা হাতটা ছেড়ে দেয় রীনাত। মনে মনে টের পায় এই একটা ধাক্কায় এতদিনের খোলস ভাঙছে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আজ বাসায় ফিরে একটা অস্থিরতার মধ্যে আছে রীনাত। কেবলই সেই মেয়েটার মুখটা মনে পড়ছে। মনে পড়ে সেই সন্ধ্যার কথা। আহা! সেদিন যদি সেও মেয়েটার মত সাথে সাথে প্রতিবাদ করত তাহলে মনে মনে এত অপরাধবোধে ভুগতে হতো না। শয়তান, লম্পট একটা। কিন্তু এবার তাকে শিক্ষা দেবে।

কলিং বেলটা বেজে ওঠে। মা এসেছে ভেবে ছুটে যায় রীনাত। দরজা খুলতেই মাথাটা ধাঁই করে গরম হয়ে যায়। লোকটা হাসছে – “মা আসেনি? পরীক্ষা কেমন হল মামণি?” চোখ দুটো জ্বলে ওঠে রীনাতের – “আপনি কেন এসেছেন? মা নেই সুযোগ পেয়ে গায়ে হাত দেবেন? আর কক্ষণো যদি এ বাসায় আসেন আপনার মুখোশ খুলে দেব আমি। যান, এক্ষুণি চলে যান এখান থেকে। অভদ্র, ইতর – আবার বলে মামণি। লম্পট, শয়তান-” বলতে বলতে লোকটার মুখের ওপর দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আর সেই মুহূর্তে তার মনে হয় চার বছর ধরে বহন করা একটা পাষাণভার যেন বুক থেকে নেমে তাকে পাখির মত হালকা করে তুলেছে।