মহাবিশ্বের শিকড়ের সন্ধানে (মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ)
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ
প্রকাশকঃ ছায়াবীথি
স্টল নংঃ ৪১৩
একুশে বইমেলা ২০১৩
বই পরিচিতিঃ
আজ থেকে প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগেকার কথা। একটি ভয়াল বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু আমাদের মহাবিশ্বের। সে থেকে আজ পর্যন্ত মহাবিশ্বে স্থান আর সময়ের একসাথে পথচলা। আর সেই সময়ের বাঁক ধরে প্রকৃতির এলোমেলো খেলার এক অনবদ্য রূপস্তত্বা আজ আমরা মানুষ। সৃষ্টি, মননে আর উৎকর্ষতায় সবার সেরা। নিজের উন্নত মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে আজ আমরা তাই বেরিয়েছি শিকড়ের সন্ধানে। মহাবিশ্বের শিকড়ের সন্ধানে। এই শিকড়ের খোঁজে বেরিয়েই একদিন আমাদের চোখে ধরা পড়ে গেলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে আদিম জগতের ছবি। মহাবিশ্বের শৈশবের ছবি। তারপর একে একে বেরিয়ে এলো রহস্যের সব ধুম্রজাল। সময়ের সাথে মহাবিশ্বের বিবর্তন নিয়ে মানুষের চিন্তার এই ইতিহাস উঠে এসেছে তিন বিজ্ঞানপ্রেমী ভাইবোনের প্রাত্যাহিক কথোপকোথনে।
বই থেকে…
১
“আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা”।
বাড়ির সামনের জ্যোৎস্নাস্নাত বিশাল উঠোনটায় শিতলপাটি বিছিয়ে মা তাঁর আদরের সোনামণিকে ঘুম পাড়াচ্ছেন। সময় বয়ে যায়। উঠোনের চাঁদ হেলে পড়ে পশ্চিমে। পার হয় অনেক বসন্ত। মায়ের সেই ছোট্ট সোনামণি একদিন অনেক বড় হয়। কোন এক কালবৈশাখীর কালো মেঘে শৈশবের সেই রূপালী চাঁদটা হঠাৎ হারিয়ে গেলে তার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা শৈশবের সেই দিনগুলোর কথা। ভাবে ঈশ মাকে যদি বোঝাতে পারতাম, মা তোমার সোনামণির কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে না গেলেও ঠিকই তোমার সোনামণিরা চাঁদের কপালে টিপ দিয়ে এসেছে। জানো মা তারা শুধু এ-করেই ক্ষান্ত হই নি। খুঁটে খুঁটে তাবৎ দুনিয়ার সৃষ্টি রহস্যও বের করে এনেছে। মা শুনে আর হাসে। বলে, তাই বুঝি !
হাল ছাড়ে না ছেলে। মাকে সে বুঝিয়ে ছাড়বেই। আসরে যোগ দেয় আরো দু’জন। দু’ছোটবোন। ছেলে শুরু করে। সে বহুদিন আগের কথা। কোন অস্তিত্বই ছিল না মানব জাতির। কোন গাছপালা কিংবা কোন পশুপাখিরও না। এমনকি পৃথিবী,চাঁদ,তারা,সূর্যও না। ছিল শুধু একবারে ঘন,ভয়ানকভাবে উত্তপ্ত এক ছোট্ট বিন্দু। একদিন সেই বিন্দুটা তার ভেতরের উত্তপ্ত বস্তুর ভয়াবহ চাপ সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ করেই ফুলে ফেঁপে উঠলো। যত সময় যেতে থাকলো এর আকৃতি তত বেড়েই চললো। কমতে শুরু করলো ভেতরের বস্তুর ঘনত্ব। ধীরে ধীরে তা শীতল হতে থাকলো। আর সেই মোটামুটি শীতল বিশ্বের কিছু বস্তু পরষ্পর মিলে মিশে তৈরি করলো আমাদের দেখা এই সুবিশাল বিশ্বজগৎ। তারপর সময়ের সাথে সাথে পালটে গেল এই বিশ্বজগৎ। তৈরি হল তারার জগৎ। তারার চারপাশে জন্ম নিল গ্রহ উপগ্রহ। আর এরকম কোটি কোটি গ্রহের একটিতে একদিন কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে জন্ম নিল প্রাণ। তারপর সেই প্রাণের ক্ষুদ্রকণা ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে আজকের তুমি,আমি আমরা সবাই।
তোকে এত কিছু কে বললো? একটু আগে না বললি তখন কেউই ছিল না। আমি বাবা তোদের এত শত বুঝি না। তুই তোর ছোটবোনদের বুঝা।
মা উঠে গেলে ছেলে হতাশ দৃষ্টিতে দু’ছোটবোনের দিকে তাকায়। এদের একজন এবার ইন্টারমিডিয়েটে। আরেকজন দশম শ্রেণিতে। ভাইয়া যখন মহাবিশ্বের গল্প বলে তখন মুগ্ধ হয়ে ওরা শুনে। কত বিশাল এই মহাবিশ্ব! কতই না তার রহস্য! আর কত কিছুই না বাকি আছে জানার! ভাইয়ার কাছ থেকে ওরা আগেই শুনেছে এরকম একটা মহাবিস্ফোরণ থেকে জন্ম নিয়েছে এই মহাবিশ্ব। জন্ম নিয়েছে স্থান এবং সময়। তারপর প্রায় সাড়ে তের বিলিয়ন বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে হয়ে মহাবিশ্ব নিয়েছে বর্তমান রূপ।
আচ্ছা ভাইয়া,তুমি একদিন বলছিলা মহাবিশ্বের মহাবিস্ফোরণের নাকি দুইটা চাক্ষুষ প্রমাণ আছে। একটা তো হল বেলুনের ফুটকির মত ছায়াপথগুলোর পরষ্পর থেকে দূরে সরে যাওয়া। যেটা আমরা ডপলার ক্রিয়া দেখে বুঝতে পারি। কিন্তু আরেকটা প্রমাণের কথা তো বল নাই’!বলছিল শান্তা,দু’বোনের মাঝে বড় জন।
ওহ,তাই নাকি। তবে আজকে এই গল্পই হয়ে যাক। আম্মুকে বল চা নাস্তা দিয়ে যেতে। আমি বুঝি না এসব বললে বেচারি উঠে দৌড় লাগায় কেন!
পুরান আমলের লোক তো! দেখো না এখনো ভূতের ভয়ে রাত্তিরে একলা বেরুনোর সাহস করে না! চায়ের কাপ আনতে আনতে টিপ্পনী কাটে ছোটবোন পলি।
আচ্ছা শোন। আসল কাহিনিতে আসি। তোরা তো জানিসই কোন বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এসে পড়লে তবেই সেই বস্তুটা আমরা দেখি। এই আলোটা আসলে একধরনের বিকিরণ তরঙ্গ। আলোর মত এরকম বিকিরণ আছে অসংখ্য। এতসব বিকিরণের ভিন্নতার পেছনে আসলে কাজ করছে এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য। বিকিরণের মূল কণা ফোটনের শক্তি কমে গেলে এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। ফলে দৃশ্যমান আলো পরিণত হয় অদৃশ্য অন্য বিকিরণে। আমাদের চোখের রড আর কোণ কোষ শুধু কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের প্রতি সাড়া দেয় বলে আমরা শুধু এই দৃশ্যমান আলোক বিকিরণ দিয়েই দেখি। একবার ভাবতো অন্যসব বিকিরণও যদি আমাদের দৃষ্টিগোচর হতো তাহলে কী অসাধারণই না হত! হ্যাঁ, এই ভাবাটাই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূর? নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে সে আজ আবিষ্কার করছে আরো নানারকম চোখের। এরকম এক চোখের নাম রেডিও। এ দিয়ে সে এখানে বসেই শুনে বিবিসির সংবাদ, শুনে, সুবীর নন্দির গান। আরেক চোখে টেলিভিশন দিয়ে সে কী অভাবনীয় কাজটাই না করলো! একদিন এমনি এক চোখ আকাশের দিকে তাক করে সে আবিষ্কার করে বসলো মহাবিশ্বের আদিমতম জগতের ছবি। আমাদের শিশু মহাবিশ্বের ছবি।
ব্যাপারটা একবারেই কাকাতলীয়। ১৯৬৪ সাল। এক রেডিও টেলিস্কোপ বানানোর ল্যাবে কাজ করছিলেন দুই সহকারি জ্যোতির্বিদ পেনজিয়াস আর উইলসন। একদিন তাদের ঘাড়ে দায়িত্ব পড়লো এমন একটা অ্যান্টেনা বানানো যা দিয়ে পৃথিবীতে দূরবর্তী দুটি স্থানের মধ্যে তথ্য আদান প্রদানের কাজ সারানো যাবে। অনেক খেটে খুটে কাজ করে বানিয়েও ফেললেন সেই অ্যান্টেনা। কিন্তু দূঃখের বিষয় হল তাঁদের এতো কষ্টের পরেও সেই অ্যান্টেনাকে কোনভাবেই গোলমাল মুক্ত করা যাচ্ছিল না। তাঁদের রিসিভার যন্ত্রে একবারে হালকা একটা খস খস শব্দ হচ্ছিল। তার মানে কোথাও না কোথাও একটা গোলমাল রয়েই গেল। সেটা দেখতে আবার অ্যান্টেনার ভেতর গেলেন দু’জন। দেখলেন আরে সেখানে পাশের বাড়ির কবুতরগুলো মল ছেড়ে বসে আছে। মল পরিষ্কার করে এদেরকে চিরতরে ঐ জায়গা থেকেই তাড়িয়ে দিলেন দু’বন্ধু। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। হতাশ হয়ে দিন গুনছিলেন তাঁরা। তাঁদের ব্যর্থতার বলিস কিংবা সফলতার যাই বলিস এই খবর কানে পৌছলো আরেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবার্ট ডিকের।
বেশ কয়েক বছর যাবৎ যিনি কাজ করছিলেন বিশ্ব সৃষ্টিতত্ব নিয়ে। তিনিও একই ধরনের একটা অ্যান্টেনা বানানোর চেষ্টা করছিলেন। পেনজিয়াস-উইলসনের আবিষ্কারই যে ১৯৪০ সালে আলফার – হারমেনের ভবিষ্যৎবাণী করা পটভূমি বিকিরণ তিনি তা ঠিকই বুঝতে পারেন। আর তাই পরীক্ষা করে দেখলেন আকাশের সব প্রান্ত থেকে এ বিকিরণ সমভাবে আসে কিনা। এটি যে সেই পটভূমি বিকিরণই তাতে সন্দেহ রইলো না যখন তাঁরা দেখলেন আকাশের সব প্রান্ত থেকেই সমহারে ছুটে আসছে এই মহাজাগতিক বিকিরণ। তাঁরা এই বিকিরণের নাম দিলেন মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ। সংক্ষেপে তোরা সিএমবিআর বলতে পারিস। আর এ থেকেই বোঝা গেল আমাদের মহাবিশ্ব সব দিক থেকেই প্রতিসম। মানে মহাবিশ্বের যেদিকেই তাকাস না কেন সব দিকেই মহাবিশ্বকে দেখতে একই মনে হবে। পলির বাম পাশের আকাশে যতগুলো তারকা- ছায়াপথ, ওর বাম পাশের আকাশে ঠিক ততগুলোই তারকা-ছায়াপথ।
তোরা ইচ্ছে করলে কিন্তু নিজেরাও খুব সহজেই এই সিএমবিআর দেখতে পারিস। টিভিটা অন কর। এমন একটা চ্যানেলে যা যেখানে কিছুই সম্প্রচার হচ্ছে না। প্রথম দেখায় শুধু একটা নীল পর্দা ভাসবে তোদের চোখের সামনে। তারপর আরেকটু ভালোভাবে দেখলে দেখবি সেই নীলের মাঝে সামান্য দু’একটা করে ফুটকি দেখা যাচ্ছে কিংবা হালকা একটা খচ খচ শব্দ। এটাই সিএমবিআর। এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে পেনজিয়াস ও উইলসন দু’জনকেই নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।
কথার ফাঁকে মা একবার তাঁর ছেলেমেয়েদের বিকেলের নাস্তা দিয়ে যান। দেয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে নিজেও কিছুক্ষণ কান পেতে থাকেন। কিন্তু কিছুরই অর্থোদ্ধার না করতে পেরে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেন। এর মধ্যে এতক্ষণ দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল পলি। সে-ই প্রথমে মুখ খুললো।
হুম। সবই বুঝলাম। কিন্তু ভাইয়া একটা জিনিস বুঝলাম না। এই সিএমবিআর কিভাবে মহাবিশ্বের আদি সেই মহাবিস্ফোরণকে সমর্থন করে?
আচ্ছা,কাহিনিটা তাহলে খুলেই বলি। বিগ ব্যাং এর প্রায় তিন লক্ষ আশি হাজার বছর পরের কথা। পুরো মহাবিশ্ব তখন ইলেক্ট্রন, প্রোটন আর বিকিরণ কণা ফোটনে পরিপূর্ণ স্যুপের মত। এই অবস্থায় ঋনাত্মক আধানের ইলেকট্রন আর ধনাত্মক আধানের প্রোটনের মাঝে ক্রিয়ারত কুলম্ব বল ঠিক ফল পাচ্ছিল না অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে। আর সেই আয়নের স্যুপে অতি শক্তিশালী ফোটনগুলো শুধু বারবার শোষিত আর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এক ইলেকট্রন থেকে অন্য ইলেকট্রনে। ফলে সেই সময়কার মহাবিশ্বটা ছিল একবারেই ঝাপসা, অস্বচ্ছ।
দিন গড়াতে থাকে। আকারে বাড়তে থেকে সেই শিশু মহাবিশ্ব। ক্রমাগত সম্প্রসারণ আর শীতল হওয়ার ফলে মহাবিশ্বের তখনকার তাপমাত্রা প্রায় নেমে এলো ৩০০০ ডিগ্রি কেলভিন-এ। এই তাপমাত্রায় আসার পর প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে কুলম্ব বল। প্রোটনের চারপাশে তড়িৎ বলে আবদ্ধ হয়ে অস্তিত্ব প্রকাশ করে প্রথম পরমাণু হাইড্রোজেন। আয়নের স্যুপ পরিণত হলো পরমাণুর স্যুপে। ফলে এখন আর ফোটনকে আটকে দেয়ার মত অবশিষ্ট কেউ রইলো না। একবারে স্বচ্ছ হয়ে পড়লো মহাবিশ্ব।
সেই যে মুক্ত হল ফোটন তা এতটা বছর ধরে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে পৌছলো আমাদের পৃথিবীতে। পথ পাড়ি দেয়ায় ফোটনের শক্তি গেল কমে। আর তাই তা গামা রশ্মি কিংবা আলোর ফোটনের মত এত শক্তিশালী না হয়ে আরো কম শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভ বা অণুতরঙ্গ ফোটনের মত হল।
পেনজিয়াস আর উইলসন এই অণুতরঙ্গ ফোটনকেই ধরেছিলেন তাঁদের অ্যান্টেনায়। সে থেকে শুরু। একের পর এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার পালটে দিল মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের ধারণা।
একটু আগেই বলছিলাম এই মহাজাগতিক বিকিরণ আকাশের সবদিক থেকে সুষমভাবে আসছে। কথাটা আসলে পুরোপুরি সত্য না। আমার ল্যাপটপটা নিয়ে আস,আমি কিছু ছবি দেখাচ্ছি তোদের।
এই ছবিটা পৃথিবীর। সেই অ্যান্টেনা যদি পৃথিবীর দিকে তাক করাই তবে আমরা এই ঝাপসা ছবিটা পাবো। এই ধরনের মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের ছবি তোলার কাজটা করে কিন্তু মহাকাশের কোব স্যাটেলাইট।
কী দেখলি? পৃথিবীর ছবির তুলনায় আকাশের ছবিটা অনেক বেশি সাদামেটে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন মহাবিশ্বের সব দিক থেকে সমান তালে ছুটে আসছে সিএমবিআর। একটা সুষম আদিম মহাবিশ্বের ছবি। মহাবিশ্বের শৈশবের ছবি। যেখানে বিরাজ করছে অগণিত আহিত কণার দল। একটা তরল স্যুপে। মহাকাশের এই ছবিটাকেই আরেকটু বড় করে দেখাচ্ছি তোদের।
কী দেখছিস? পৃথিবীর ২ মেরুর মত এই চিত্রেরও দুটা রঙ। এটা আসলে সিএমবিআর এর সাপেক্ষে আমাদের নড়াচড়ার জন্য দেখাচ্ছে। ডপলার ক্রিয়া আর কি। সিএমবিআর এর যে অংশ আমাদের কাছাকাছি তাকে নীল আর দূরের অংশকে লাল দেখাচ্ছে।
তাহলে দুই রঙের মাঝের ঐ গোলাপী রঙ্গা অংশটি কিসের? জানতে চাইলো শান্তা।
এটা আসলে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মাঝের ডিস্ক থেকে আসা কিছু মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের সাথে সিএমবিআর এর উপরিপাতনের ফল। দাড়া ছবিটা আরেকটু জুম করে দেখাই তোদের।
হে হে ! কী দেখছিস ! ঝামেলা আছে কিছু। আবারো বলছি মাঝের ঐ গোলাপী রঙ্গা অংশ কিন্তু আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কারণে এরকম দেখাচ্ছে। মজার ব্যাপার হল এই পর্যায়ে এসে আমরা আর সমতাপমাত্রায় বন্টিত বিশ্ব দেখি না। খুবই সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য ধরা পড়ে আমাদের সামনে। তাপমাত্রা বলছি কেন? কারণ সিএমবিআরকে তাপমাত্রার মাধ্যমেও উপস্থাপন করা যায়।
ধূর। এই ছবি দেখে তো কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। পুরো অস্পষ্ট। স্যুপ তো সমবন্টিত আর সুষম ছিল। তাহলে এসব কী দেখা যাচ্ছে। আর এটাতো পুরোটাই গোলমেলে লাগছে। ভালো কোনো ছবি নাই?
শান্তার অধৈর্য মুখ দেখে মাহমুদ লেপটপের আরেকটা ফোল্ডার খুলতে গেল। এই যা! চার্জ শেষ। কারেন্টও নাই। যা বাকিটা রাতে দেখাবো। এখন পড়তে বস। নইলে আম্মুর উত্তম মধ্যম খাইতে হবে কিন্তু!
২
রাতে খাওয়া দাওয়া সারার পর দু’বোন মিলে ধরলো আবার ভাইয়াকে। ব্যাটা তখন চার্জের দোহাই দিয়ে ভেগে গিয়েছিল। ওদের কেন জানি মনে হয় ভাইয়া ওদের বুজুম বাজুম গোজামিল দিয়ে এটা ঐটা বুঝিয়ে দেয়। আর অনেক জানে এমন একটা ভাব ধরে থাকে সবসময়। আর নাহ। অনেক হয়েছে। ওরাও কি ছোট নাকি!
কই দেখাও তোমার ছবি। তখন তো ঝাপসা ছবি দিয়ে বেশ ভালোই গোজামিল দেয়ার চেষ্টা করছিলে।
পলির কথা শুনে মাহমুদ মনে মনে হাসছে। আর যাই হোক ছোটবোনদের কাছে পাত্তা না পেলেও বিশ্বজগতের নানা রহস্যের প্রতি ওদের আগ্রহ দেখে মাহমুদ বেশ খুশিই হয়। এতো ছোট বয়সেও গৎবাঁধা পড়াশুনার ফাঁকে এই বিষয়গুলো ওদের ভাবায়। ওরা প্রশ্ন করে। উত্তর মনঃপুত না হলে জোরালো প্রতিবাদ জানায়। নিজেরাও উত্তর দিতে চেষ্টা করে। ব্যাপারটা ভালো লাগারই কথা।
হে হ। আমি গোজামিল দিচ্ছি নারে। দেখ দেখ। এই ছবিটা দেখ।
আগের ছবিগুলা থেকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে আঁকা হয়েছে এটা। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করেই বলি। আগের ছবিগুলোতে দেখেছিলাম আকাশের সবদিক থেকে সমানভাবে ছুটে আসছে সিএমবিআর। এখন সেই আকাশটাকে আমি আমার সুবিধার্থে একটা গোলকের মত চিন্তা করি্। ঠিক আদিম মানুষের আকাশগোলকের মত। তোরা তো আরো জানিস একটা গোলক তার কেন্দ্রে ফোর পাই স্টেরেডিয়ান ঘনকোণ উৎপন্ন করে। তো এত ঝামেলা না করে চল আমরা এই গোলকটাকে কেটে ফেলি। এমনভাবে কাটলাম যাতে এটিকে একটা টেবিলের উপর ভাঁজ করা ছাড়াই বিছিয়ে ফেলা যায়। তার মানে কী দাড়াল? আমাদের ত্রিমাত্রিক আকাশ গোলক এখন দ্বিমাত্রিক একটা পর্দার মত। এখন মনে কর তোরা আকাশের একটা ছোট্ট অংশের দিকে তাকাতে চাস। মানে দ্বিমাত্রিক বৃত্তের পরিধির একটা ছোট্ট অংশ। বৃত্তের পরিধি যেমন তার কেন্দ্রে ৩৬০ ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন করে। তেমনি আকাশের ছোট্ট একটা অংশ নিশ্চয়ই তোর চোখে আরো কম কোণ উৎপন্ন করবে। এভাবে আকাশের খুব ছোট্ট একটা অংশের দিকে তাকালেই দেখা যায় যে আসলে যে সিএমবিআরকে আমরা সমস্বত্ত আর সুষম বলে ভাবছিলাম তা আসলে মোটেই সুষম নয়। তাপমাত্রার খুব সামান্য পার্থক্য এখানে প্রতীয়মান হয়।
কত সামান্য?
প্রায় ১ কেলভিন তাপমাত্রার এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ। মানে তোরা যদি আকাশের দুটা খুব কাছাকাছি অংশের সিএমবিআর তাপমাত্রা মাপিস, তাহলে একটির তাপমাত্রা ২০ মাইক্রোকেলভিন হলে পাশেরটায় পাবি ২১ মাইক্রোকেলভিন।
ছবিটার দিকে তাকা। সিএমবিআর তাপমাত্রা গ্রাফ এটি। গ্রাফের y অক্ষে তাপমাত্রা আর x অক্ষে ডিগ্রির বিপরীত রাশি ব্যবহার করে আঁকা এই ছবিটা। ডিগ্রির বিপরীত এই রাশিকে এখানে L দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে আর কি! যেহেতু x অক্ষের ডানদিকে এই রাশির মান বাড়ে সেহেতু যতই বাম থেকে ডানে যাবি ততই ডিগ্রির মানও কমতে থাকবে অর্থাৎ তখন আকাশের খুব ছোট অংশের সিএমবিআর তাপমাত্রার ছবি পাওয়া যাবে।
এই মনে কর L এর মান যখন ১০০ তখন বুঝতে হবে তোরা ১ ডিগ্রি আকাশের ছবি দেখছিস। আবার L যখন ১০০০ তখন তোরা আসলে ০.১ ডিগ্রি আকাশের সিএমবিআর পাচ্ছিস। এরকম আরকি।
আচ্ছা আমরাতো গ্রাফ বুঝি নাকি! স্কুল পার করে কলেজ লাইফে আছি। এটা এতো ভেঙ্গে বলার কী হলো? সামনে আগান। আচ্ছা একটা কথা, আপনাদের সময় গ্রাফ-টাফ ইন্টারের পরে শিখাইতো বুঝি! অনেকটা ক্ষেপে গিয়ে মাহমুদকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিল শান্তা। কথার শেষে ফিক করে হেসে উঠার শব্দটাও কান এড়ালো না তার।
বরাবরের মত এই গুতোটাও হজম করে নিলো সে। আসলে ছোটবোনদের এই খোঁচাগুলো মাহমুদের একেবারে মন্দও লাগে না। ভাইবোনদের অদ্ভুত এই মিছে অভিনয়ের মাঝে একটা আন্তরিকতা আছে। মিশে আছে ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ।
ঠিক আছে ম্যাডাম। মাফ চাই। আর এ ভূল হবে না। এখন ছবির ঐ লাল বক্সগুলোর দিকে তাকান। এই বক্সগুলোই আকাশের কৌণিক সীমার সাথে সিএমবিআর তাপমাত্রার পরিবর্তন নির্দেশক। L এর মান যখন বাড়ছে তখনই এই বক্স এর আকারও বাড়ছে। তার মানে সিএমবিআর-এ বেশি বেশি বিচ্যুতি দেখা দিচ্ছে। আগেই বলেছি এই বিচ্যুতি বর্তমান সিএমবিআর তাপমাত্রার তুলনায় প্রায় লক্ষ ভাগের ১ ভাগ। তোদের মনে করিয়ে দিচ্ছি বর্তমানে মহাজাগতিক এই বিকিরণের তাপমাত্রা কিন্তু ২.৭ ডিগ্রি কেলভিন মাত্র।
L এর মান বড় বলে গ্রাফের প্রথম দিকের অংশটি আকাশের বিশাল এক অংশের সিএমবিআর ছবি ধারণ করে। তাই এখানকার বিচ্যুতি আদি গোটা মহাবিশ্বের প্রাথমিক ফ্লাকচুয়েশন বা দোলনের স্মারক বহন করে। অনেকটা পানির ঢেউয়ের মত। এভাবে যতই সামনের দিকে যাওয়া যায়, যেতে যেতে যখন L এর মান ১০০ থেকেও বেশি বা ১ ডিগ্রিতে আসা যায় তখন দেখা যায় এই বিচ্যুতি রেখাটিতে বেশ কিছু চূড়ার দেখা মিলে। অর্থাৎ বেশ কয়েকটা জায়গায় তাপমাত্রার বিচ্যুতি সর্বোচ্চ হয়। এইসব একেকটি চূড়াকে শব্দ তরঙ্গের সাথে তুলনা করে শব্দচূড় বা শক্তিচূড় বলা হয়।
এভাবে কৌণিক রেজুলেশন বাড়িয়ে বাড়িয়ে আমরা সিএমবিআর নিয়ে আরো সূক্ষ সূক্ষ্ম তথ্য বের করে নিয়ে আসতে পারি। কোব দিয়ে আকাশের বড় পরিসরে ছবি তুলা গেলেও আকাশের খুব ছোট অংশের ছবি তুলতে কিন্তু বিজ্ঞানীরা অন্য দুটি বেশি ব্যবহার করে থাকেন। এদের একটি হল বুমেরাং অপরটি ম্যাক্সিমা।
কিরে ঘুমিয়ে পড়লি নাকি! খাটের শেষ মাথায় বালিশ দিয়ে হেলানো শান্তাকে সত্যিই ঘুমন্ত মনে হল।
নাহ ভাবছিলাম একটা জিনিস। সিএমবিআর তো আমাদের আদি মহাবিশ্বের ছবি যেটাকে তুমি ইলেকট্রন আর প্রোটনের স্যুপের সাথে তুলনা করেছো।
হ্যাঁ।
তো সেই আদিম মহাবিশ্বেই তাহলে এমন কিছু উলটা পালটা অঘটন ঘটছিল যা এখন আমাদের চোখে এসে তাপমাত্রার বিচ্যুতি হিসেবে ধরা দিচ্ছে।
একদম ঠিক ধরেছিস। ক্যুছ গড়মিল থা।
কিন্তু কী ঘটেছিল আসলে? স্যুপগুলো কি পানির ঢেউয়ের মত এদিকে ওদিকে নড়ছিলো? নাকি ভিন্নতা ছিল ইলেকট্রন আর প্রোটনের গঠনেও?
নারে না। এখন ইলেকট্রন, প্রোটন দেখতে যেমন ঠিক তখনো এমনি ছিল। এই মৌলিক কণাদ্বয় সৃষ্ঠির পর থেকে এখনো পর্যন্ত একই গড়নেরই আছে। কিন্তু শান্তা, তুই তো বিশাল একটা আবিষ্কার করে ফেললি রে!
কী !
এই যে বললি স্যুপের মাঝে পানির ঢেউয়ের মত উত্থান পতনকে সিএমবিআর তাপমাত্রা বিচ্যুতির কারণ বললি, এমনি কিছু একটা ঘটেছিল বলে বিজ্ঞানীদেরও ধারণা। তুই তো দেখি বিজ্ঞানী হয়ে গেছিস!
কিন্তু এমন দোলটা খেলই বা কিভাবে? এই দোলের পেছনে কাজ করেছে কোন শক্তি? শান্তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
হ্যাঁ,সেটার গল্পই আরেকদিন বলবো। আজকে রাতে ভাবতে থাক। এমন কী কারণে দোল খেল ইলেকট্রন-প্রোটনের সেই স্যুপ? হয়তো তুই-ই বের করে ফেলতে পারিস রহস্যের আঢালে ঢাকা আমাদের আদি মহাবিশ্বের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী।
ওদিকে মাও ডাকছে। অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই আজ ওদের উঠে যেতে হল। যাওয়ার সময় মনে হল পলিও কী জানি ভাবছে!
আমার না জানা অনেক প্রশ্নের জবাব পেলাম। ধন্যবাদ লেখককে।
বাকি পর্বগুলা আমার কাছে আছে। ভাবতাছি আমি পোষ্ট করে দিবো নাকি। 😀
চমৎকার, বইটি কিনে ফেলবো এরপরে মেলায় গেলে।
অভিনন্দন এবং শুভকামনা রইলো মাহমুদ। (F) বইটা যে একটা চমৎকার বই হচ্ছে, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই নেই। 🙂
আপনাকে এখানে দেখে অতি প্রসন্ন বোধ করলাম।বইটা কেনার ইচ্ছা ছিল।কিন্তু বাড়ি থেকে আমার বই কেনা ব্যান করায় কেনা হবে না।শুভকামনা রইল।আশা করি মুক্তমনায় নিয়মিত হবেন 🙂
@সাদিয়া মাশারুফ, মুক্তমনার পাঠক/লেখকের বই কেনা ব্যান করা হয়েছে। How come! আর হ্যাঁ, নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করবো। 🙂
মুক্তমনায় একটি চমৎকার লেখা দিয়ে বউনি করার অভিনন্দন।
আপনার এই বইটির বহুল প্রচার আমি কামনা করি। বইটির প্ল্যান এবং ধরণ সত্যই চমৎকার ।
@অভিজিৎ, ধন্যবাদ। 🙂
এই বইটা আসলে একটা এক্সপেরিমেন্টের অংশ। সফল হলে এ ধাঁচে আরো লেখে যাবো।