কোরিয়া ১৯৫০: এক কিশোর সৈনিকের স্মৃতিগাঁথা (পর্ব-৩)
[বিশেষ দ্রষ্টব্য: গত পর্বে জনাব কাজি মামুন এর অনুরোধ সত্ত্বেও আমি ব্যর্থ হয়েছি মূলতঃ সময়াভাবে। সেজন্যে আগেই ক্ষমা চেয়ে নেয়াটা কর্তব্য বলে মনে করছি। তবে পড়ার ধারাবাহিকতা যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে যত্নবান থাকতে আমি চেষ্টা করবো।]
এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে প্রত্যেক কোরিয়ান জমির মালিকের প্রতি জাপানী সরকারকে চাল সরবরাহের জন্যে একটা বাধা ধরা কোটা নির্ধারিত ছিলো। যখন জমির মালিকেরা নির্ধারিত কোটা অনুযায়ী চাল সরবরাহের জন্যে যথেষ্ট পরিমানে চাল উৎপাদনে ব্যর্থ হতো, তখন এই মালিকেরা বাধ্য হতো স্থানীয় বাজার থেকে তা ক্রয় করে কোটা পূর্ণ করে স্থানীয় জাপানী কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করতে। জাপানী কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত কোটার কারণে মৌসুমের শেষ অবধি চলার মতো যথেষ্ট পরিমানে চাল আমাদের আর অবশিষ্ট থাকতো না। কিছু কিছু চাষী নিজেদের উৎপাদনের উপড়ে আস্থা হাড়াতো, আর আস্থা হাড়িয়ে ওরা খাদ্যের অন্বেষনে খুঁজে ফিরতো খাওয়ার উপযোগী নরম ঘাস, বুনো গাছ, শেকড় কিংবা গাছের ছাল। অনেক সময় আমি দেখেছি মা আমার চোখের জল লুকোচ্ছেন, কারণ তাঁর কাছে যথেষ্ট পরিমানে চাল নেই বাড়ির সবার অন্ন সংস্থানের জন্যে, বিশেষ করে তাঁর ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যে। জাপানী সরকার সব সময়ই বলতো চাল তাদের দরকার মূলতঃ যুদ্ধরসদের জন্যে, কিন্তু আমরা জানতাম যে স্থানীয় জাপানীদের যথেষ্ট পরিমানে চাল আছে তাদের নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্যে। জাপানের দখলদারীত্বের সময় প্রচুর জাপানী এই অধিকৃত কোরিয়ায় বসবাস করতো। এমনকি তখন কোচাং এর মতো একটি ছোট্ট উপশহড়েও স্থানীয় মূল অধিবাসীদের বাইরেও একটি সংরক্ষিত জাপানী বসতি এলাকা ছিলো আর সেখানে এই যুদ্ধ কালীন সময়েও বিলাসব্যাসনে পর্যাপ্ত খাদ্যের নিশ্চয়তা সহ জাপানীরা বসবাস করছিলো। ভালোই ছিলো এই জাপানীরা, এমনকি পছন্দসই খাবারও তাদের জন্যে কোন সমস্যা ছিলো না। কারণ, অনেকদিন আগেই জাপান সরকার এক বিষদ আইনী কাঠামো কার্যকর করোছিলো, যা ছিলো আমাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের জাতিগত বৈষম্যের নামান্তর। যা আমাদের নিজভূমে করেছিলো পরবাসী বা পরিণত করেছিলো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে। ১৯৪০ সালে কোরিয়াতে প্রায় সাত লক্ষ জাপানী নাগরিকের বাস ছিলো এবং এদের অধিকাংশই হয় সরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো নতুবা ছিলো পুলিশ বিভাগে কর্মরত।
১৯৪৫ সালে কোরিয়া যখন স্বাধীনতা লাভ করে, দেশে তখন একটা বৌদ্ধিকবৃত্তিকতা জনিত শূন্যতা বিরাজ করছিলো। বাম ভাবাদর্শগত জোটটি দ্রুত সামনের সারিতে এগিয়ে আসে, এরা কমিউনিষ্ট প্রপাগান্ডা সম্বলিত প্রচার সামগ্রী বিতরণে খুবই একাগ্র এবং সিদ্ধহস্ত ছিলো। তাদের এই গোপন অথচ ঝটিকা তৎপরতা তরুণ এবং উঠতি কিশোরদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় এমনকি একটা বিশেষ আবেদনও ছিলো। সত্যি বলতে কি, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কৃষকের বা শ্রমীকের উঠতি তরুণ ছেলেরা বিশেষ ভাবে এইধরনের বাম সংগঠন গুলোতে যুক্ত হতো। তবে ডানপন্থী সংগঠন গুলো এগিয়ে আসার আগে এরা সংগঠিত হতে পেরেছিলো খুবই স্বল্পতম একটি সময়ের জন্যে। অচীরেই ডান ভাবাদর্শ ব্যপক শক্তি অর্জন করে এবং নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে স্বল্প কিছু কোরিয়ান নাগরিক জাপানী ছত্রছায়ায় স্বাচ্ছ্বন্দের সাথে বসবাস করতো। অথচ আমরা সহ অধিকাংশ কোরিয়ান নাগরিকই যাপন করতাম অত্যন্ত কঠিন এবং মানবেতর জীবন। ব্যপক সামাজিক অনুশাসন ও আইনী কাঠামোর মধ্যেও এই জাপানী দখলদারীত্ত্ব মাঝে মাঝেই অত্যন্ত অপ্রীতিকর অস্বস্তির জন্ম দিত। তবে আমাদের অনেকেই মনে করতেন যে জীবন যাত্রার মান ১৯৪৫ পরবর্তী স্বাধীন দেশে জাপানী দখলদারীত্ত্বকালের চাইতে খুব একটা সুখকর হয়নি। কেউ কেউ মনে করতো, আমরা তো আমাদের নিজেদের সরকারের পরিচালনাধীনেই আছি এ সরকার তো জনগনের, এটিই আমাদের আরাধ্য ছিলো, আমরা তো আমাদের স্বাধীন মাতৃভূমিই চেয়েছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের মতোই, তখন খোলা বাজারে পর্যাপ্ত সামগ্রীর সরবরাহ ছিলো, কিন্তু তা জীবনযাত্রাকে মোটেও স্বাভাবিক করতে পারেনি, যে অভাব সেই অভাবই রয়ে গেলো, সবই আছে বাজারে কিন্তু কিছুই আমাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নয়। আমরা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু হায়, আমরা যদি শুধু জানতাম কিকরে এই অর্জিত স্বাধীনতা কে ব্যবহার করতে হয়! একটা গনতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির অধীনেই আমরা বাস করতাম, কিন্তু সত্যিই আমরা জানতাম না যে গনতন্ত্র জিনিসটা আসলে কি ছিলো। কিছু কিছু ক্ষুদ্র মনোবৃত্ত্বির মানুষেরা অন্যকে আঘাত করতে চাইতো যে, এটি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। পরষ্পরকে অগ্রাহ্যকরার প্রবণতা ছিলো ভয়ংকর, ছিলো অজ্ঞানতার ভীষন কালো অন্ধকার!
এই রকম এক বিশ্বজন বিস্ফোরোন্মুখ পরিবেশে তীব্র গনআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জাপানের হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্খায় আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন, যা আমাদের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ১৯২০ সালের পটভূমিতে। এসময় দেশে জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিষ্ট ভাবাপন্ন দুটি পৃথক ধারা অব্যাহত ভাবে গোপনে দেশের নিয়ন্ত্রনভার কুক্ষিগত করতে গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলো। ১৯১৯ সালের ১লা মার্চের পরে আসন্ন কর্মসূচী সহ চলমান আন্দোলন, মিছিল মিটিং এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের তৎপরতা জাপানী কর্তপক্ষ হঠাৎ বন্ধকরে দেয়। কতিপয় কোরিয়ান এসময় দেশ ছেড়ে চীন এবং তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়ে বিদেশ থেকে কোরিয়ান জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিষ্ট ভাবাপন্ন প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা জোড়দার করে। রীহ সাইংমান (Rhee Syngman) এসময় চীনের সাংহাই ভিত্তিক এ ধরনের একটি দলের তৎপরতার নেতৃত্ত্ব দিচ্ছিলেন, প্রাদেশিক কোরিয়ান সরকার নামে তার দলের তৎপরতা পরিচিত ছিলো। (রীহ হলো পারিবারিক পদবী, কোরিয়ান নামে পারিবারিক নামটি সবসময় নামের প্রথমে আসে)। কিম ইল সাঙ (Kim Il Sung) এরকম আর একটি প্রতিবিপ্লবী দলের নেতৃত্ত্বে ছিলেন। মাঞ্চুরিয়ায় ইনি গেরিলা নেতা হিসেবে কাজ করেছিলেন, ১৯৩১ সালে জাপান যখন মাঞ্চুরিয়া অধিগ্রহন করে তখন তিনিই জাপানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে অংশ গহন করেছিলেন। চীন-কোরিয়া বর্ডার এলাকায় কিম ইল সাঙ এবং তার অনুসারীরা এসময় এক শক্ত প্রতিরক্ষাবূহ্য রচনা করে সফল এবং প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রন আরোপে সক্ষম হন। পরবর্তীতে ইনিই যুদ্ধোত্তর উত্তর-কোরিয়া সরকারের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রকবৃন্দের মধ্যমনিতে রুপান্তরিত হন যখন তৎকালীন রাশিয়া ৩৮-সমান্তরাল রেখা বরাবর অধিগৃহীত উত্তর কোরিয়াকে সেভিয়েত ভুক্ত রাষ্ট্র সমূহের অন্তর্ভূক্ত করে একে প্রসাশনিক সহায়তা দিতে থাকে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্ত্ব নেয় কোরিয়ার দক্ষিনের বাকী অর্ধাংশের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তোর কালে অনেক উচ্চপদস্থ দক্ষিন কোরীয় সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ তখনো জাপানী সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাদের কিছু অংশ তখন জাপানী কোয়ান্টাং (Kwantung Army) সেনাছত্রী হয়ে চীনে জাপানী বিরুদ্ধবাদী কোরিয়ান এবং চৈনিক গেরিলা নিধনে ব্যাস্ত ছিলো। তারা জাপানীদের মতোই এমনকি তার চেয়েও বেশী ভয়ংঙ্কর এবং নৃশংস ছিলো গেরিলাদের প্রতি। ক্ষমতাধর জাপানীদের তুষ্ট করতেই তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন। কোরিয়ান অফিসারবৃন্দ সম্ভবতঃ এই ধারনা পোষন করতেন যে তাদের মাত্রাতিরিক্ত বর্বরতায় জাপানীদের সন্তুষ্টি আসবে পক্ষান্তরে তাদের কাছে বাড়বে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নির্ভরতা, যা তাদের প্রসংশা বয়ে আনবে। সুতরাং এক ধরনের ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয় সেই সব জাপান-বিরোধী বিরুদ্ধবাদী কোরিয়ান এবং চীনা গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে যারা তখন চীন-কোরিয়া বর্ডারে এবং মাঞ্চুরিয়ায় বিশ্বযুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধত্তোর কালে অবস্থান করছিলেন। এঁরাই পরবর্তীতে উত্তর-কোরীয় কমিউনিষ্ট সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন। এইরকম এক ঐতিহাসিক ঘটনা বলয়ে অনেক অনেক দক্ষিন এবং উত্তর-কোরীয় সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ পরষ্পর বিপরীত শিবিরে অবস্থান করছিলেন, এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা আবার পরষ্পরের মুখোমুখী হলেন সেই পুরোনো বিবাদকে কেন্দ্র করে সদ্য বিভাজিত কোরিয়ায়, যা ছিলো মূলতঃ কোরিয়ানদের বিরুদ্ধেই কোরিয়ানদের লড়াই!
Asadharon ak kathay
পরবর্তীতে বাঙরেজিতে করা মন্তব্য গ্রহন করা হবে না।
-মুক্তমনা মডারেটর
@গFত্যফফফ,
ধন্যবাদ পড়া এবং মন্তব্য করার আন্য। তবে মুক্তমনা মডারেটরের নির্দ্দেশনার প্রতি নজর রাখার জন্যে অনুরোধ রইলো। ভালো থাকবেন।
লেখার গুণে ৩য় পর্ব পড়ে ১ম পর্ব পড়ার জন্য যেতে হল।
ধন্যবাদ দাদা। শ্রমসাধ্য কাজটিতে হাত দেয়ার জন্য।
@গীতা দাস,
দিদি, অসংখ্য ধন্যবাদ কষ্টটুকুর জন্যে। আমি নিতান্তই অপটু লেখায় আমি নিজে তা বেশ ভালোই অনুমান করি। আমি বাক্য গঠনে, বানানে আপনার পরামর্শ আশা করবো। আমার বিশেষ করে বাক্যশৈলী খুব পুরানো ধঁচের, তার উপড়ে বানান ভুল। আপনার, অভিজিৎ, ফরিদভাই, অদিল মাহমুদ, আকাশ মালিক, সংসপ্তক, মাইনুল, হোরাস সহ সবার (যাদের লেখা আমি গোগ্রাসে গিলি, নাম লিখতে গেলে আলাদা পোষ্ট কয়েক পর্বে লিখতে হবে!) লেখা যে কি প্রাঞ্জল! আমি তাই পড়তে পড়তেই সময় শেষ করে ফেলি, নিজের লেখা আর হয়ে উঠেনা! কাজেই গত পর্বে কাজি মামুনের কথা রাখতে পারিনি মূলতঃ মুক্তমনার এই সব তুখোর ব্লগারদের জন্যে! তাই বলে আপনারা আবার লেখা বন্ধ করে দেবেন না যেনো! বাকীরা আমাকে নির্ঘাৎ মুক্তমনা থেকে তাড়িয়ে দেবে তাহলে!
জাপানীদের নুয়ে পড়া বিনম্র চেহারা দেখলে কার সাধ্য বিশ্বাস করে এই লোকেরাই কোরিয়ায় এভাবে শোষন চালিয়েছি, নানকিং এ নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোরিয়া সামরিক অফিসারদের কাজকারবার আমাদের আল বদর বাহিনীর সাথে অনেকটাই মিলে যায় :)) ।
@আদিল মাহমুদ,
যথার্থ বলেছেন আদিল মাহমুদ। সেদিন ইনসন বাস টার্মিনাল সংলগ্ন সি জি ভি সিনেমা কমপ্লেক্স-এ “২৬-নিয়ন” (মানে হলো ২৬-বছর) নামে একটা ছবি দেখলাম। ছবিটা ১৯৮০ সালে সরকার বিরোধী এক বিশাল গনবিক্ষোভের উপড়ে ভিত্তি করে রচিত। একদিকে মানবতা আর একদিকে ক্ষোভ-জিঘাংসার যে সংমিশ্রন এতে ঘটানো হয়েছে অবিশ্বাস্য! দক্ষিন কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সমাসীন। কোথাও কোন টু শব্দটি নেই! ৩ জন সম্ভাব্য প্রার্থী তাদের চিন্তা-ভাবনা, প্ল্যান বলে চলেছেন, আর জনগন প্রস্তুত হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে দারুন উত্তেজনা আছে, কিন্তু বাইরে এর কোন প্রকাশ নেই! কমিউনিটি লিডাররা সলাপরামর্শ করছেন, এরাই জনমূলে প্রভাব বিস্তার করবেন। আমি মনোযোগী হয়ে দেখতে চেষ্টা করছি যদিও ভাষা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। গোটা জাতির এইরকম সমরূপতার অন্তর্নিহীত রহস্যটা কোথায়?
উপনিবেশিকতার কুৎসিত রূপ সার্বজনীন, যেমনটি দক্ষিন এশিয়া, তেমটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়, তেমনটিই আফ্রিকা কিংবা ল্যাটিনে। আমাদের অনুন্নয়ন উপনিবেশিক শক্তির উন্নয়নের কারণ। কোন উপনিবেশিক দেশ গরীব নেই।
@জটিল বাক্য,
এতো সরল ভাবে কি সিদ্ধান্ত টানা যাবে? আর দক্ষিন কোরিয়া এখন আর দরীদ্র কিংবা তৃতীয় বিশ্বের তালিকা ভূক্ত নয়। হংকং সিঙ্গাপুর-ও নয়! ইজরাইলীরা এক সময় বাস্তুচ্যূত ছিলো, এখন জ্ঞানে বিজ্ঞানে বিশ্বে নেতৃত্ত্ব দিচ্ছে বলা চলে!
@জটিল বাক্য,
কেশবদার সাথে একমত। এত সরলীকরন আসলেই করা যায় না। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি উপনিবেশগুলি থেকে লুটপাট করেছে সেটা ঠিক আছে, সে লুটের মাল তাদের উন্নতিতে সহায়তা করেছে সেটাও ঠিক। তবে তারা সেই লুটের মালের ভোগ নিয়েই বসে থাকেনি, সে মাল ব্যাবহার করে দৃঢ় ব্যাবস্থা গড়ে তুলেছে।
কারো মধ্যে জিনিস থাকলে আর চেষ্টা থাকলে তার উন্নতি হতেই হয়। একই ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে থাকা এবং একই সাথে স্বাধীন হওয়া ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের অবস্থা তূলনা করলে কিছুটা বোঝা যায়। অনুন্নয়নের মূল কারন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির কারনে নয়। ঔপনিবেশিক শক্তি যতটা ক্ষতি করেছে সেটা নিজেরা সফল ভাবে দেশ চালালে অনায়াসে পুষিয়ে ফেলা যেত। আজকের ভারতীয়দের উন্নয়নেও কিন্তু সেই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির ভাল ভূমিকা আছে।
@আদিল মাহমুদ, কেশব অধিকারী ভাই
পাল্লাটা অনুন্নত দেশের দিকে ভারী।
উপনিবেশগুলোতে তাদের বাজার সৃষ্টি করে গেছে, কিন্তু প্রদাকশানের সব পথ রুদ্ধ করে গিয়েছিল। আর দিয়ে গেছে অশিক্ষা ও দারিদ্র্য ও উপনিবেশিক আইন কানুন। একজন লোকের সামান্য কিছু থাকলে সে যুদ্ধ করতে পারে, আর নিঃস্ব ব্যক্তির জন্য যুদ্ধ করা অনেক কঠিন।
আমি এক লাইনে দাড়ি টেনেছি বিধায় আসলেই সরলীকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু এর তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপন করেছে ডিপেনডেন্সি স্কুলের তাত্ত্বিকেরা। তারা পাশ্চাত্যের উন্নয়নের মডেলকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন। যদি পরবর্তীতে সুযোগ পাই আলচনায় অংশ নিব। লাইসেন্স না থাকার কারণে আলোচনায় ধারাবাহিকতা রাখতে পারি না।
আর
এটা অনেক পুরনো দিনের এক ইউটোপিয়ান সোশ্যালিস্টের কথা। আমার মনে হয় এটা সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য।
ধন্যবাদ আপনাদের ।
@জটিল বাক্য,
আপনাকে মুক্তমনার পূর্ন সদস্যপদ দেবার ব্যাপারে মডুদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি, যদি তারা দেখে।
কলোনিয়াল শাসনের পূর্ন মুল্যায়ন অত সহজ নয়। তারা লুট পাট করে নিজেদের ধনী করেছে সেটা মুদ্রার এক পিঠ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। অন্যদিক চিন্তা করলে তাদের থেকে প্রাপ্তিও অস্বীকার করা যায় না।
– এটা সব সময় সত্য নাও হতে পারে। ব্রিটিশ শাসন উপমহাদেশে ব্যাপক লুটপাট করলেও তারা আধুনিক সভ্য সমাজের বহু রীতিনীতি, আইন কানুন, শিল্প বিপ্লবের সুফল এসবও এনেছিল। আধুনিক ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন ছাড়া সম্ভব হত কিনা সেটা হাইপোথিটিক্যাল প্রশ্ন হলেও আমার দৃঢ় সংশয় আছে। হিন্দু সমাজের যেসব বর্বর ধরনের কালাকানুন এ অঞ্চলে ছিল সেসব ব্রিটিশের সরাসরি আইন ছাড়া এ আমলেও বাতিল করা যেত কিনা তাতে সন্দেহ আছে। সেসব কালাকানুন এমনকি সুলতানী আমলের পরাক্রমশালী মোগল বাদশাহরাও করতে পারেননি। সুলতানী আমল কিংবা তারও আগের আমলের রাজা গজরারা কে কতটা প্রজা হিতৈষী ছিলেন, তাদের অবদান কি কি এসব প্রশ্ন বাদই থাকে। এক্ষেত্রে আপনার ইউটোপিয়ান সোশালিষ্টের কথাই বলতে হয়, সম্পত্তি চৌর্য বৃত্তির ফসল।
গান্ধীজি, নেহরু, জিন্নাহ, এমনকি ভূট্টো পরিবার কেউই পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষা অস্বীকার করতে পারেননি। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অনেকে আন্দোলন করেছেন ভারত থেকে খেদাতে আবার ব্রিটিশের স্কুলেই ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছে, এমনকি সেই খেদিয়ে দেওয়া ব্রিটিশের দেশে সন্তানদের পাঠিয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে এনেছেন। নিজেদের মক্তব, মাদ্রাসা টোল জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভরসায় থাকেননি।
আমি ঔপনিবেশিক শাসন জাষ্টিফাই করছি না, শুধু বলতে চাইছি যে এর অন্য দিকও বিবেচনায় আসা উচিত। যার যা ভাল তা গ্রহন করা উচিত। উত্তর আমেরিকায় এক সময় নেটিভ ইন্ডিয়ানদের ওপর চরম নির্যাতন হয়েছে। তাই বলে তাদের পরবর্তি প্রজন্ম যারা এখনো টিকে আছে তারা যদি দিন রাত বসে বসে সে নিয়ে আহাজারি করে এবং নিজেদের রিজার্ভে অলস সময় কাটায় তবে তাতে নিজেদেরই ক্ষতি, দূঃখজনক হলেও বর্তমানে সেটাই তারা অধিকাংশ করে। তাদের প্রচুর সুবিধে দেওয়া হলেও তারা সেসবের সুফল নেয় না।
@জটিল বাক্য,
১৯৫০ এ যে কোরিয়ানরা গনতন্ত্র বুঝতোনা বলে আক্ষেপ করছে, তারাই পরবর্তী ৩০ বছরে দেশটাকে একেবারেই বদলে ফেলেছে! আমরা অনেক আধুনিক কালে স্বাধীন হয়েও কি আপনার মনে হচ্ছে যে আমরা গনতন্ত্রের মর্ম বুঝি? আমি হলপ করে বলতে পারবো না। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত আইন প্রণয়ন করছি, আর সরকার-দেশবাসী মিলে তা অমান্যও করছি। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পরে যে অর্থসাহায্য বহির্বিশ্ব থেকে পেয়েছি, তার হিসাব আছেকি? অনেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশের (এই মুহূর্তে আমার হাতের কাছে নেই) একটা প্রবন্ধে এর বিস্তারিত পড়েছিলাম, যা দিয়ে কয়েকটা বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের ঢাকার সাজে সাজানো যেতো! উপনিবেশিক আমলে বিদেশীরা নিয়েছে ঠিকই কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক ভাবেই কি আমরা বিদেশীদের কাছ থেকে খুব কম পেয়েছিলাম? আজও বিশ্ব দরাজ সহযোগীতার হাত বাড়াতে। কিন্তু আমাদের জাতীয়চরিত্র বদলাবে কে? আমরা কি আত্ম সমালোচনা করি? এই তো সেদিন চট্টগ্রামে যে নির্মীয়মান উড়ালসেতু ভেঙ্গে পরলো, কে অর্থায়ন করেছে? আর ভেঙ্গে পরলো কেনো? কোথায়, কার, কি, অবহেলা ছিলো? কোন গ্রহনযোগ্য তদন্ত রিপোর্ট, কোন শাস্তি আছেকি? নেই। কেউ দায় স্বীকার করেছে কি? কারণ কি? আপনি আমি আমাদের কথা ভাবি, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে অবহেলিত, তাদেরও যে মেইন স্ট্রীমে আনতে হবে, কেউ কি সেটা ভাবছি? উপড়ে আদিল মাহমুদ সেই দিকটাই ইঙ্গিত করেছেন। আর অর্থ সম্পদ স্ট্যাটিক নয়, আমাদের যোগ্যতা থাকলে তা আমরা ফিরিয়েও আনতে পারি, যেমনটা কোরিয়ানরা কিংবা বিশ্বের অন্যান্যদেশও করেছে।
আসলে কি জানেন, বিদেশী শাসকরা আমাদের দেশে এসে তাদের যে স্বকীয়তা দিয়ে আমাদের জয় কিংবা জিম্মি করেছিলো, তা আমরা শিখিনি, পাশ্চাত্যের শিক্ষাকে নাজাত বলে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু ওরা যে কূটীলতায় জিঘাংসায় আমাদের সূর্যসেন দের নির্যাতন করেছিলো, তা আমরা ভালোই রপ্ত করেছি আমাদের প্রান্তিক জনমানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে! উপড়ে রেইনার এবার্টের “ওরা তো আমাদের শিশুদের মতোই শিশু” লেখাটি পড়ুন, সত্যতা খুঁজে পাবেন! আমাদের পরিবর্তন দরকার!
@কেশব অধিকারী,
আপনার এই বক্তব্যের সাথে আমাদের সহমত আছে। আমরা আমাদের দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, তাই আমাদের এমন সমস্যা, বিদেশি লুটেরার দ্বারা জায়গা দখল করে নিয়েছে দেশীও লুটেরা। মানুষের মুক্তি ঘটে নি কারণ কলনিয়াল কাঠামো থেকে দেশের শাসকেরা বেরিয়ে আসে নি। কারণ এটা টিকে থাকার একটা দুর্দান্ত পন্থা। উপনিবেশিক যুগের উপজাত/ জাত সবই আঁকড়ে আছি। তাই আমরা পিছিয়ে। উপনিবেশিকটাকে তাই বলে জাস্তিফাই করা যায় না। আমাদের অনুন্নয়নের অনেক ফ্যাক্টরের ভেতর উপনিবেসিকতা অন্যতম। আমাদের উন্নয়নের জন্য তারা এদেশে আসে নি। আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট হচ্ছে জাতীয় সততা ব্যবস্থার সব গুলো পিলারই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। কোথাও কোন জবাবদিহিতা নেই, আমলাতন্ত্র ব্রিটিশ-পাক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছে। রাজনিতিতেও মীরজাফররা বর্তমান, পুজিতে জগতশেথরা একই রকম আছে। এটার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গিকার জরুরি। আপনার পোস্টের প্রথম অংশ দেখেই আমার এমন দৃষ্টিভঙ্গি।
বর্তমানে প্রায় নিরীহ জাপানিরাও ব্রিটিশের থেকে কম করেনি।
আসলেই পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যেভাবে অর্থনৈতিক বিপ্লব করেছে, এটা তাদের স্বোপার্জিত তার জন্য তাদের স্যালুট । বিগত সময়ে তারা নিজেদের পশ্চিমের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। আমরা যে পারি নি তাও আমাদের সৃষ্ট। আমাদের ভেতর সমাজ বদলের অঙ্গিকার নেই অঙ্গিকার শুধু নিজেদের বদলের।
এটা পড়েছি ঐ গল্পের একটি সুক্ষ জিনিস খেয়াল করবেন শাহানা নামের মেয়েটি কিন্তু কাজের মেয়ে হিসেবে আমেরিকা ভ্রমণে যায় নি, কিন্তু কাজের মেয়ের স্ট্যাটাস পেয়েছিল , কিন্তু শারনার বাসার কাজের মেয়ে বাস্তবিকি
কাজের মেয়ে তাই তার এ রকম ব্যবহার পাওয়া টা স্বাভাবিক ছিল। তাদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার জন্যই শাহানা নামক কাল্পনিক চরিত্রটি ফ্লোরে শুয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ কিংবা ইউরোপীয় কোন অতিথি এমন আচরণ পেত না। তারা এখনো আমাদের সাদা মানুষের বোঝা মনে করে গল্পের ভেতর এই সত্যটিও প্রচ্ছন্ন ভাবে ফুটে উঠেছে।
@জটিল বাক্য,
আপনার সাথে আমার প্রকৃত কোন বিরোধ নেই। শুধু একটু আপত্তি করবো, যে আমি কখনোই উপনিবেশিকতাকে জাষ্টিফাই করিনি। আমি আপনার মতোই বলতে চেয়েছি যে বিগত ৩০ বছরের মধ্যে কোরিয়া যদি উপনিবেশিকতার বেরাজাল ডিঙ্গিয়ে ১ম কাতারে উঠে আসতে পারে, তাহলে তাদের চেয়ে অনেক আধুনিক যুগে স্বাধীন হয়ে আমরা দিন দিন অধঃপতে যাচ্ছি কেনো।
এখানে অনেক ব্যবসায়ী, এবং কুটনিতিকবৃন্দের সাথে আমার কালে ভদ্রে দেখা হয়। সবার কাছেই (বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশ গুলোর) আমার সুযোগ বুঝে একটাই জিজ্ঞাসা থাকে যে এতো সস্তা শ্রম বাজার থাকতে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে না কেনো। তাদের স্পষ্ট জবাব হলো এখনো পরিবেশ তৈরী হয়নি। একথাও আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় কখনো কখনো যে প্রস্তাবটি নাকি আমি ৫০ বছর আগেই করে ফেলেছি! আমার আর বুঝতে বাকী থাকেনা যে ৭১ সালে স্বাধীন হয়েও আমরা কতোটা বেশী পেছনে হেঁটেছি! অথচ তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ষাটের দশকে কোরিয়ায় খাদ্য সাহায্যও পাঠিয়েছিলো!
বইটা পড়তে পড়তে আমি বেশ অনুভব করি কোথায় যেনো এদের ইতিহাসের সাথে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা মিল আছে। ক্রমেই তা বেড়িয়ে আসবে আশা করি। ধন্যবাদ মূল্যবান আলোচনার জন্যে।
@জটিল বাক্য, ঔপনিবেশিকেরা কিন্তু উপনিবেশ বন্ধ হবার পরেও অনেক উন্নতি করছে, অন্তত উপনিবেশ-গুলোর থেকে বেশীই। আমি এটা নিয়ে লেখায় অনেক কমেন্ট-সহ বড়সড় আলোচনাও হয়েছিল একটা থ্রেডে।
@দিগন্ত,
আপনার দেওয়া লিঙ্ক এর লেখাটি পড়েছি। অত্যন্ত তথ্যবহুল যৌক্তিক আর মূল্যবান কোন সন্দেহ নেই। লিঙ্কটির জন্যে ধন্যবাদ। পরবর্তীতে আলোচনায় কাজে লাগবে।