আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২ চুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার খবর শুনে ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে আমি যারপরনাই আনন্দিত। তাই শুরুতেই চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই এরকম একটি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য। মূলত দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। ফলে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব অধিকার রক্ষার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা ও বিকাশের যে নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পন্থা, তা হতে তারা বঞ্চিত বহুদিন। যতটুকু জানা গিয়েছে, দীর্ঘ প্রায় এক যুগেরও অধিক সময় ধরে চুয়েটে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি ছিলো না। সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ’৯৮/ ’৯৯ সালের দিকে। একই অবস্থা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না ২২ বছরেরও অধিক সময় যাবৎ। একই বেড়াজালে আটকে আছে জাকসু, রাকসু, চাকসুসহ অন্যান্য প্রখ্যাত ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একদিনে যেমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে চর্চা তা লোপ পাচ্ছে, অপরদিকে সবচেয়ে ভয়ংকর যে বিষয়, তা হলো, শিক্ষার্থীদের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় তাদের সমস্যা, সংকট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সময়মতো তুলে ধরার কোনো নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকছে না, থাকছে না বিশ্ববিদ্যালয় নিত্য নতুন যে সকল আইন ও নীতিমালা তৈরি করছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার খাতিরে সেই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত দানের সুযোগ। অথচ, সকলেই একথা স্বীকার করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা হচ্ছে তার শিক্ষার্থীরা! ফলে বর্তমানে চুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার যে ঘোষণা, তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ও সাহসী উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আমার মত গণতন্ত্রমনা সকল শিক্ষার্থীকেই আশান্বিত করেছে নিশ্চিতভাবেই। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্যও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তড়িৎ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, এমন আশা করাটা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না।
কিন্তু আশার পাশাপাশি আশঙ্কার জায়গাটিও রয়েছে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আশঙ্কাগুলো বিবেচনায় রেখে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে নিশ্চিতভাবে শান্তিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ ও সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। প্রথমেই যে আশঙ্কার জায়গাটি, সেটি হলো চুয়েট ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর যে বিজ্ঞপ্তিটি জারি করা হয়, সেখানে সবশেষে কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, “সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ কমিটির সুপারিশ মোতাবেক নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সার্বিক আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কোনো আশঙ্কা দেখা দিলে তাৎক্ষনিক নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করা হবে”। এই লাইনটি খুবই উদ্বেগজনক। দীর্ঘদিন পরে যেহেতু নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, ফলে এখানে নানামাত্রিক প্রবণতা থাকতে পারে, এটা অস্বাভাবিক নয়। যেমন ইতোমধ্যেই কোনো প্রকার পূর্বালোচনা ব্যতীত হঠাৎ করেই মাত্র ১৪ দিন আগে নির্বাচনের তারিখসহ ঘোষণা দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন চুয়েটের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীবৃন্দ। অনেকেই মনে করছেন এটা ভিসিপন্থী ছাত্রলীগকে যাতে বিনা প্রতিদ্বন্ধ্বিতায় পুরো প্যানেলে জিতিয়ে নিয়ে আসা যায়, তারই একটি অপপ্রচেষ্টা, নির্বাচনটা কেবলই লোকদেখানো! আমি মোটেও এভাবে ভাবতে চাই না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, এই উদ্যোগটিতে অসততা নেই, আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু এখন যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং তাতে কোনো কারণে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের প্রতিদ্বন্ধ্বিতাকারী ব্যক্তিরা জয়লাভ করতে সক্ষম না হয়, এবং নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে তার কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে, তবে কর্তৃপক্ষ কী নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করে দেবেন? শোনা যাচ্ছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিবির-হিজবুত তাহরীর মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো পরিচয় গোপন করে নিজস্ব প্যানেল দেওয়ার এবং নির্বাচনে জিততে না পারলে তা বানচালের চেষ্টা করতে পারে। এমতাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবিকারী বর্তমান প্রশাসন কি করবেন? নির্বাচন বন্ধ করে দেবেন? নাকি আসলে যেকোনো পরিস্থিতিতেই কর্তৃপক্ষের উচিৎ হবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা, প্রয়োজনে এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের জন্য সংবাদ মাধ্যমের বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে যেসকল সংগঠন বা ব্যক্তিই অন্যায়ভাবে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচনকে বাঁধাগ্রস্ত করতে চাইবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে যেকোনো মূল্যে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটাও আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। তাদের মধ্যে সেই সাহসী প্রত্যয়টি আমরা দেখতে আগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক গণতন্ত্র নিশ্চিত করার জন্যই। নিশ্চয়ই গণ্ডগোল বা বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে- এই যুক্তিতে আমাদের দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হয় না! যারা সেই চেষ্টা করেছে অতীতে, তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রবিরোধী এবং স্বার্থান্বেষী মহল হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে দেশবাসীর কাছে। তাই কোন পরিস্থিতিতেই এই নির্বাচন বন্ধ না করে বরং যতই প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হোক না কেনো, সেটাকে মোকাবেলা করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ই ছাত্র সমাজ এই মুহূর্তে চুয়েটের কর্তৃপক্ষের নিকট আশা করে।
আশঙ্কার আরো একটি বিষয় তৈরি হয়েছে যে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে, তা আসলে কোন প্রক্রিয়ায় ঘটবে? আমাদের হয়তো খেয়াল আছে এই সরকারের আমলেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কিছু কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো, হয়েছে দু’ একটিতে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো বরিশালের বি.এম. কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন। সেখানে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছিলো “সিলেকশন” এর মাধ্যমে, মোটেও “ইলেকশন” এর মাধ্যমে নয়! সেই ছাত্র প্রতিনিধিদের টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ পরবর্তীতে নানা সংবাদ মাধ্যমের দ্বারাই আমরা জানতে পেরেছিলাম। চুয়েটের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও একইভাবে “ইলেকশন” না হয়ে শেষপর্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট “সিলেকশন” এর মধ্য দিয়ে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করা হতে পারে বলে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছেন, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করেও একই ধরণের সন্দেহের সুর পাওয়া গেছে। জনসম্মুখে এই বিষয়টিকে পরিষ্কার করা উচিৎ চুয়েটের কর্তৃপক্ষের। প্রকৃতই যে সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক পন্থা “ইলেকশন” এ ভোটদানের মধ্য দিয়েই নিজেদের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করবে চুয়েটের শিক্ষার্থীরা- সেই ব্যাপারে সকলকে নিঃসন্দেহ করার দায়িত্বটি প্রশাসনেরই।
এছাড়াও প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এখনো ছাত্র সংসদের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে নি চুয়েট কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে ১৯ অথবা ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে এই তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। তফসিলে সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা না করতে পারার ব্যবস্থা রাখা উচিৎ। এটা করা উচিৎ দু’টি কারণে। প্রথমত, ধরে নেই ঐসকল সাম্প্রদায়িক চেতনাক্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনোভাবে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হলো। কোনো সাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত শিক্ষার্থী ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারবে না আসলে, উলটো শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করবে যা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। এরফলে চুয়েটের সকল শিক্ষার্থীর ন্যায্য অধিকার নিয়ে সোচ্চার তো তারা হতে পারবেই না, উলটো ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি খড়গহস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে, যার প্রমাণ আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখতে পাবো। আর দ্বিতীয়ত, যদি তারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত না হতে পারে, তখন যেকোনোভাবে তারা এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে যাতে নির্বাচন স্থগিত করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনে এর জন্য তারা সহপাঠীর দেহ হতে রক্ত ঝরাতেও কসুর করবে না। ফলে চুয়েটের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের যে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ তার ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছে, সেটি নিশ্চিতভাবেই বাঁধাগ্রস্ত হবে, এটি কোনোভাবেই কাম্য নয় গণতন্ত্রমনা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার কাছে, আমার মত আরো অনেকের কাছেই। ফলে শুরুতেই এইসকল সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদের নির্বাচনে প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে প্রশাসনের “জিরো টলারেন্স” নীতি গ্রহণ করা উচিৎ, তফসিলে সেই বিধান রাখা উচিৎ, যদি এই প্রশাসন সত্যিকারভাবেই নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষেরে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাবাহী হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চায়।
মূলত এই সকল আশঙ্কাকে চুয়েট কর্তৃপক্ষ যদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ভুল প্রমাণ করতে সক্ষম হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে দীর্ঘ এক যুগের পরে চুয়েটের এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন আমাদের সমাজের গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের যে ইতিহাসে, সেখানেই স্থান হবে এই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোক্তা চুয়েট কর্তৃপক্ষের। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে চুয়েট অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে। একজন গণতন্ত্রমনা মানুষ হিসেবে চুয়েটের কর্তৃপক্ষের নিকট এটাই আমার প্রত্যাশা।
হীরক রাজার দেশ না হয়ে যায় আবার,আমরা তো সেই আশঙ্কায় আছি।পরবর্তীতে বেশি খারাপ অবস্থার চাইতে এখনকার কম খারাপ অবস্থা ভাল।ভৌগলিকভাবে দুর্গম হবার কারণে কোন খবরই ফোকাসড হয় না এখানকার,যতটা রাজধানীকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হয়।দেখা যাবে এখানে ভেতরে ভেতরে নারকীয় অবস্থা হয়ে যাবে আর আমরা কেবল নাম দেখানো নির্বাচনটার প্রশংসাই করে যাবো।