উপরের প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দিতে হলে তা হবে—‘অবশ্যই না’!
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় কর্মীদের বেশিরভাগই আসে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে। এরা নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক মতাদর্শ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের দল ভারী করার চেষ্টা করে। দলভুক্ত শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দলগুলোর ক্যাডার হিসাবে পরিচিত, যাদের মূল কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার করা, দলের কর্মসূচিতে (যেমন মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ, অবরোধ ইত্যাদিতে) অংশ নেওয়া এবং দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।
ক্যাডার শিক্ষার্থীদের দলীয় কার্যক্রম কখনই শুধু নির্ভেজাল রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। সরকারি দলের ক্যাডারদের মূল লক্ষ্যই হয়ে দাঁড়ায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিট-বাণিজ্য, এমনকি মাদক ব্যবসা/ব্যবহার, অপহরণ, দৈহিক কিংবা মানসিক নিপীড়ন, ধর্ষণ কিংবা খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধও। বিরোধী দলের ক্যাডাররা হরতালে পিকেটিং এবং বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ করে থাকে। এদের বাধা দিতে আবার সরকারি দলের ক্যাডাররা সশস্ত্র মহড়া দেয় এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিরোধীদের আন্দোলন প্রতিহত করার চেষ্টা করে।
শিক্ষার্থীদের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কারণে তাদের নিজেদের পড়ালেখার ক্ষতি তো হয়ই, তারা অরাজনৈতিক সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রমেও বাধা সৃষ্টি করে। প্রায়ই দেখা যায় যে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে নিজ নিজ দলের কার্যক্রমে যোগ দিতে বাধ্য করে। এর অন্যথা হলে নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুও। আমার ছাত্রজীবনে দলবাজ শিক্ষার্থীদের ককটেল ফাটিয়ে পরীক্ষা বানচাল করতে দেখেছি। দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত শিক্ষার্থীদের এসব অন্যায় কাজকর্মে বেশিরভাগ শিক্ষক ও প্রশাসনের সায় না থাকলেও, কেউ কেউ আবার নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে এদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেন।
রাজনৈতিক গোলযোগে সেশন আটকে যাচ্ছে, সময়মতো ফল প্রকাশ হচ্ছে না, সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, যা বহু মেধাবী শিক্ষার্থীকে বিদেশে পড়তে উৎসাহিত করে মেধাপাচারকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থী–শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থী–শিক্ষক সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ করে; অনেক ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি শিক্ষার্থীদের একদর্শী ও উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী করে তোলে, যা মুক্তচিন্তার চর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থী/শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়া দেশের উচ্চশিক্ষার মানের অবনমনের একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
দলীয় রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে লাভ হয় মূলত রাজনৈতিক দলগুলোরই; দলের ছোট-বড় নেতারা শিক্ষার্থীদের দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করেন। অধিকাংশ সময় এই ব্যবহার নৈতিকতার সীমা পেরিয়ে যায়, ফলে শিক্ষার্থীরা নানা বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতিবাজ নেতাদের সংস্পর্শে এসে অপরাধজগতে তাদের পা রাখাও আজ নিয়মিত ঘটনা। যে সময় শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণ, নতুন দক্ষতা আয়ত্ত ও সুনাগরিক হয়ে ওঠার কথা, সে সময় সাময়িক লাভের আশায় তারা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। এতে যেমন চরিত্রগত অবনমন ঘটছে, তেমনি দেশও সুশিক্ষিত, দক্ষ নাগরিক পাওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে।
ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষা, গবেষণা, কিংবা অধ্যাপনার সূত্রে এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। এগুলোর কোনোটাতেই আমি শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের মতো দলভিত্তিক রাজনীতি করতে দেখিনি। বাইরের দেশের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই রাজনীতি-সচেতন। বিভিন্ন সময়ে তাদের সরকারের, এমনকি নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতির সমালোচনা করে প্রচারণা চালাতে কিংবা প্রতিবাদ সমাবেশ করতে দেখেছি। শিক্ষা-সম্পর্কিত বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরতেও তারা বেশ তৎপর। কিন্তু কখনই তাদের কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে সমবেত হতে দেখিনি। তার মানে এই নয় যে তাদের কেউ কেউ কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন না। পার্থক্য এখানেই যে তারা ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিলেও তা আমাদের দেশের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলের শাখা খুলে করেন না। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়েও এর অন্যথা চোখে পড়েনি। সেখানে ছাত্রদের প্রতিনিধিরা দলনিরপেক্ষভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত হন এবং তাদের কার্যক্রমে কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের নীতি থাকে না। নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারণা, বক্তৃতা, মিছিল—সবই উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে করা হলেও প্রতিপক্ষকে আক্রমণের কোনো ঘটনা কখনও দেখিনি। অন্যান্য দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র প্রতিনিধিদের নির্বাচন অনেকটা নীরবেই হতে দেখেছি।
অনেকেই হয়তো বলবেন যে আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতির গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে দলীয় ব্যানারে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, একটি স্বাধীন দেশে শিক্ষার্থীদের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা আদৌ জরুরি কি না এবং তাদের এই অংশগ্রহণে নিজেদের এবং দেশের ভবিষ্যৎ বড় মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না।
আমার মতে, জাতীয় প্রয়োজনে ছাত্ররা যৌক্তিক যে কোনো ইস্যু সামনে নিয়ে আন্দোলনে নামতে পারে—হতে পারে সে আন্দোলন একটি স্বৈরাচারী সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে; কিন্তু সেজন্য কোনো দলীয় ব্যানার অপরিহার্য নয়। গত বছরের সফল বর্ষা-বিপ্লবেই আমরা এর প্রমাণ পাই। বিরোধী দলগুলো এক দশকের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি; যা সম্ভব করেছে একটি রাজনৈতিক-পরিচয়হীন ছাত্র-জনতার আন্দোলন।
সারকথা, শিক্ষাঙ্গনে দলীয় ঘাঁটি নয়—থাকুক পড়াশোনা, গবেষণা আর মুক্ত চিন্তা। ছাত্রদের মতপ্রকাশের অধিকার অটুট থাকুক, কিন্তু তা যেন দলীয় রাজনীতি এবং আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে না ওঠে। ক্যাম্পাসকে দলদাস রাজনীতির মাঠ বানালে শিক্ষা, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নন-পার্টিজান ছাত্রনেতৃত্ব, প্রয়োজনে ইস্যুকেন্দ্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আর কঠোর আচরণবিধির অনুসরণই শিক্ষার মঙ্গল ও দেশ আর জনগনের স্বার্থ নিশ্চিত করে। গত বছরের বর্ষা–বিপ্লব দেখিয়েছে, দলীয় ব্যানার ছাড়াই ন্যায্য পরিবর্তন সম্ভব; ক্যাম্পাসেও সেই পথই শ্রেয়।
আজ একটি দৈনিকে দেখলাম, ‘রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখে না শিক্ষার্থীরা’। কেন রাজনীতিবিদরা সম্মান হারিয়েছেন, তা অজানা নয়। রাজনীতিতে মেধার অভাব দুর্বৃত্তায়নকেই আরও উৎসাহিত করবে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতিতে অংশ না নিয়েও মেধাবী শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে আসার পথ খোলা থাকা উচিত।