অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকত অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রচলিত পাঠ্য, নোটবই, এনজিও টাইপের কিছু না লেখেনি। তিনি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পদ ও জনমিতি নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং আমাদের সামনে আৎকেওঠার মত তথ্য হাজির করেছেন। তিনি উগ্রবাদ ও মৌলবাদের রাজনীতি-অর্থনীতির নিয়ে কাজ করেছেন এবং এ বিষয়ে ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক তথ্য সামনে এনেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি ৫০ বছরের বিভিন্ন সরকারের শাসনামালে কি পরিমান লুটপাট হয়েছে তার পিলে চমকানো চিত্র তুলে ধরেছেন।

আবুল বারাকাতের কয়েকটি গবেষণা; ১। “সম্প্রদায়ের বঞ্চনা: অর্পিত সম্পত্তির সাথে বসবাস” গ্রন্থে তিনি গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, কিভাবে শত্রু সম্পত্তি আইন অর্পিত সম্পত্তি নাম ধারণ করে হাজার হাজার একর হিন্দু সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে।‘অতীতে অর্পিত সম্পত্তি দখলের সময় সর্বোচ্চসংখ্যক ৩৭ শতাংশ সুবিধাভোগী মুসলিম লিগের সঙ্গে, বিএনপি ৪৫ শতাংশ, আওয়ামী লীগ ৩১ শতাংশ, জামায়াত ৮ শতাংশ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ৬ শতাংশ সুবিধাভোগী সংশ্লিষ্ট।’
২। তিনি তার ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক গবেষণায় দেখিয়েছেন পাঁচদশকে (১৯৬৪-২০১৩) ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দু’তিন দশক পরে এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী খুঁজে পাওয়া যাবে না।
৩। ”বাংলাদেশে মৌলবাদ ও মৌলবাদী জঙ্গীত্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি”, নামের বাংলাদেশের জর্ণাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমির এক দীর্ঘ প্রবন্ধে তিনি মাঠের গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমান করেছেন বাংলাদেশ কিভাবে- জঙ্গিবাদের তীর্থ ভূমিতে রুপান্তরিত হচ্ছে। তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশে মৌলবাদের অর্থনীতির বার্ষিক নীট মুনাফা ২,০০০ কোটি টাকা (২৫০ মিলিয়ন ডলার)! এবং বিগত ৩৫ বছরে (১৯৭৫-২০১০) মৌলবাদের অর্থনীতি সৃষ্ট ক্রম পুঞ্জিভূত নীট মুনাফার মোট পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৫০,০০০ কোটি টাকা! পাশাপাশি, বিকাশ-বিস্তৃতির সম্ভাবনা হিসেবে দেখা যায়- মৌলবাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার (বার্ষিক গড় ৭.৫% থেকে ৯) মূল স্রোতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার (বার্ষিক গড় ৫% – ৬%) এর তুলনায় বেশি!
তাঁর মতে, দেশে ১৩২ চিহ্নিত জঙ্গী সংগঠন রয়েছে, ২৩১ বেসরকারী সংস্থা, ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশন কাজ করছে। মৌলবাদী অর্থনীতির বিগত চার দশকে পুঞ্জীভূত নিট মুনাফার পরিমাণ বর্তমান মূল্যে আনুমানিক প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। যে অর্থের বড় অংশটিই ব্যয় হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে বিদেশী লবিস্ট নিয়োগে। এছাড়া ওই অর্থ জঙ্গীবাদ সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, নতুন ক্যাডার বাহিনী গঠনেও ব্যয় হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। দেশে ইসলামী জঙ্গীবাদ দাওয়া স্তর অতিক্রম করে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে উল্লেখ করে প্রবন্ধে তিনি বলেন, এদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদ দাওয়াত স্তর পার হয়েছে, অতিক্রম করেছে দ্বিতীয় স্তর ইদাদ, এখন তাদের অবস্থান জিহাদের তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের মধ্যবর্তী কোন পর্যায়ে, অর্থাৎ রিবাত ও কিলাল এর মাঝে কোন এক পর্যায়ে। তারা ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তবে একই সঙ্গে তিনি এটাও বলছেন, মৌলবাদের অর্থনীতি ও সংশ্লিষ্ট জঙ্গীবাদ এদেশে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ওই শক্তি ব্যবহার করে ধর্মের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল সম্ভব হবে না। কেন হবে না তারও ব্যাখ্যা তিনি সেখানে দিয়েছেন। এই তথ্য কত শতাংশ সত্য সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কি তার ইঙ্গিত বহন করে না?
৪। আবুল বারাকাত তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছে ”৫০ বছরে” (১৯৭২-৭৩-২০২২-২৩) দেশ পূর্ণগঠন ও উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ২৫ ভাগ ব্যবহৃত হয়েছে, বাকি ৭৫ শতাংশ লুটপাট হয়েছে! যার পরিমান ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা! কোন এক সরকারের আমলে সেটা না হলেও সেই লুটপাট চলছে ধারাবাহিক ভাবে! তাঁর এ গবেষণায় কোন দল রুষ্ঠ হবে না?
এমন একজন কৃতি সাহসী ও খ্যাতিমান অর্থনীতিককে নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর মেয়ে ড. অরণি বারাকাত অভিযোগ করেছেন, কোন ওয়ারেন্ট, কাগজপত্র, মামলা ছাড়াই তাঁর বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি যদি বড় অপরধীই হবে তাহলে বাসায় ছিলেন কেন? তিনি তো আত্মগোপন করতে পারতেন। তা করেননি। কি বলবে প্রশাসন?
আবুল বারাকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এটি আসলে অনেকটা আলঙ্কারিক পদ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল ব্যক্তি। লেখালেখি ও গবেষণার কারণে তার বিরুদ্ধে মৌলবাদের হুমকি ক্রোধ-ক্ষোভ আওয়ামী লীগের সময় থেকেই ছিল। এখন কি তাহলে তার প্রতিশোধ গ্রহণের পালা?
এননটেক্স গ্রুপের নামে ২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আবুল বারকাতসহ ২৩ জনের নামে মামলা করেছ দুদক। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান ও আবুল বারকাত পরস্পর যোগসাজশে এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানকে এই টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। ভাল কথা যাদের এই ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে তাদের কি গ্রেফতার করা হয়েছে?
হাজার হাজার কোটি যারা পাচার করেছেন, ব্যাংকগুলোকে পথে বসিয়েছেন, সেই সব বিগ জায়ান্ট সামিট গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, হাসেম গ্রুপ কয়জনের নাম বলবো? তাঁদের কোমড়ে কি দড়ি পরানো হয়েছে? তাহলে কেন উনাকে শুধু? সেটা কি প্রতিহিংসা ও পরিস্থিতির সুযোগে নয়?
বারাকাত স্যার একজন আপদমন্তক শিক্ষক ছিলেন কিন্তু তিনি কোন চক্রে পড়ে ও লোভে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেন তা আমার বোধগম্য নয়। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে উনার সময় ব্যাংকে ব্যাপক অনিয়ম, অব্যস্থাপনা ও দুর্নীতি হয়েছে। সে দায় তিনি এড়াতে পারেন না। তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোন দক্ষ ও পরীক্ষিত ব্যক্তি নন। উনি মূলত উন্নয়ন অর্থনীতি ও পাবলিক পলিসির লোক। তাহলে উনাকে কেন এখানে বসানো হলো আর উনিই বা কেন তা গ্রহণ করলেন সেটাও একটা প্রশ্ন?
দুদক যদি সততা নিয়ে এই বিষয়ে তদন্ত করে সেটা নিশ্চয়ই বের হয়ে আসবে। এই অনিয়মের অর্থ তাঁর কোন হিসেবে গেছে কি’না সেটাও বেড়িয়ে আসবে? কিন্তু যাঁরা তদন্ত ও বিচার করবেন তারা কি নিরপেক্ষ? তাদের কাছে কি কোন ন্যায়বিচার আশা করা যায়? তারা তাদের সেই বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক আগেই হারিয়েছে। অতীত ও সাম্প্রতিক অনেক ঘটনাই এই সন্দেহকে যৌক্তিকতা দেয়।
আমি গতবছর বাংলাদেশে থাকাকালীয় একটা গবেষণা কাজে – উনার সাথে আমার একাধিকার যোগাযোগ করেছি, কথাও হয়েছে। উনার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনিও অর্থনীতিবিদ, আওয়ামী ঘরনার কেউ নন। তিনি আমার এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বারাকাত এ কাজ করেনি, অর্থ আত্মসাৎ করেনি। তাঁকে ব্যবহার করেছে আওয়ামী দৃর্বৃত্তরা। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে তিনি ব্যবহৃত হলেন কেন? তিনি কি তখন বিবৃতি দিয়ে, সংবাদ সম্মেলন করে সে কথা বলতে পারতেন না?
আবুল বারাকত’রা একটি উন্নয়ন দর্শণ হাজির করেছিলন। উনাদের বক্তব্য ছিল, সীমিত গণতন্ত্র অধিক উন্নয়ন। চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশেই সে তত্ত্ব অনুসরণ করে। তাঁদর বক্তব্য ছিল সে জন্য গণতন্ত্রের জন্য সবসময় ভাল নির্বাচন না হলেও চলে। আমি-আমরা তাদের ভাবনাকে সমর্থন করি না কিন্তু তাই বলে কি তাঁকে গণদুষমন বলতে হবে? এ দেশে যারা শরিয়া আইন চায়, তালেবানী শাসন চায়, নারীদের বেশ্যা বলে তাদের কি বলবেন?
আবুল বারাকতরা আওয়ামী লীগের থিংক ট্যাংক হিসেবে কাজ করেছেন। তার মাধ্যমে তিনি তাঁর সন্মান, মর্যাদা হারিয়েছে, দূর্নীতির ভাগীদার হয়েছে, অনেক অপমানিতও হয়েছেন। এই কাজ শুধু আওয়ামী লীগের সময়ই ঘটেনি সব শাসকের সময়ই এমননটা ঘটছে। এখন ড. ইউনূসকে ঘিরে তৈরী হয়েছে তেমনি বিএনপি ক্ষমতায় না যেতেই মহাসমারহে এক শ্রেণী তৈরী হয়ে গেছে। কি বলবেন তাঁদের-, গণদুষমণ?
আবুল বারকাত একজন প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন নিপাট ভদ্রলোক ও শিক্ষক। তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তিনি তথ্য-উপাত্ত, পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির যে গুরুতর বিপদজন তথ্য হাজির করেছেন সেই সাহস অনেক অর্থনীতিবীদ ও বুদ্ধিজীবীরই নেই। এমন একজন নির্ভিক সাহসী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদের অন্যায়, অবিচার না হোক সেটা আশা করি। তাঁর বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ থাকে, আইন-আদালতেই তার সমাধান হোক। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বারাকাতের স্বসন্মানে মুক্তি দেয়া হোক।
————————————————————————————–
ড. মঞ্জুরে খোদা, কলামিস্ট, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
Leave A Comment