লিখেছেন: বক-শালিক
বাংলাদেশে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের দর্শন, বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তি ও মুক্তচিন্তার সাথে জড়ানো এক উজ্জ্বল তারকার নাম অভিজিৎ রায়।
অভিজিৎ রায় তাঁর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে যুক্তি, কারিগরি শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার অপ্রতুলতায় ব্যথিত হয়ে প্রায়শই বলতো এত সব ঠিক হবে কী করে, কবে? বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধকে কে? অভিজিৎ নিজের জীবনদানের বিনিময়ে তা বেঁধে দিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রমাণ করে গেছে যে সে যুক্তি, জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চার প্রতি কতটা আপোষহীন আর আন্তরিক ছিল। ইতালির জিওর্দানো ব্রুনোর মতো আরেক জিওর্দানো হয়ে সে ধানসিঁড়ি বাংলার বুকে ক্ষণিকের জন্য জন্ম নিয়েছিল। জঙ্গি ঘাতকরা তাঁকে বাঁচতে দেয় নি। ঘাতকগুলো নির্মম এই ঘটনা ঘটিয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বইমেলায় টি এস সি’র গোলচত্তরের পাশে, ২০১৫ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি। কী বিপুল সম্ভাবনাময় একজন মানুষকে ওরা নির্মমভাবে কুঁপিয়ে হত্যা করলো।
বই হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক, বই মননের বিকাশ। সেই বিকাশে বিজ্ঞানের সাহিত্য, বিজ্ঞানের দর্শন, বিজ্ঞানের ইতিহাস মানুষের জীবনকে আমূল-পরিবর্তন করে দেয়। বলাই বাহুল্য অভিজিৎ রায়ের লেখা বইগুলো নানাবিধ জ্ঞানের বই। প্রগতি বিরোধীরা চায়নি যেন জ্ঞানের বই পড়ে মানুষের মুক্তচিন্তা মন-মননের বিকাশ ঘটে। মানুষ যেন নির্বিকার অজ্ঞানতার অন্ধকারে তলিয়ে থাকে সেইজন্যই অভিজিৎ রায়-কে হত্যা করা হয়। সেদিন তাঁর সহধর্মিণী বন্যা আহমেদ চাপাতির ভয়াবহ আঘাত নিয়েও বেঁচে গিয়েছিল, অভিজিৎ বাঁচতে পারেনি।
বন্যা আহমেদ বেঁচে আছে সেই ভয়ংকর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে, অসুস্থ হয়ে। মাথায় ও ঘাড়ে যেখানে যেখানে জঙ্গিরা কুঁপিয়েছিল সেগুলোর কষ্টকর প্রতিদিনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে বেঁচে আছে বন্যা। মৃত্যুর বিভৎসতা, জঙ্গি ঘাতকদের চাপাতির কোপ, কোপে কোপে নিজের চোখের সামনে প্রিয় বন্ধু, স্বামীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ইত্যাদির আতংক, এত সব মানসিক যন্ত্রণা সাথে নিয়ে জীবনভর তাঁকে ভুগতে হবে। এমনি হিংস্রতা এ রক্তের হোলিখেলা দেখে কোনও মানুষের পক্ষে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা কি সম্ভব? বড্ড অসহনীয় সেই বাঁচা। পাঠক, আপনারা নিজেরা পাঁচ মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করে অমন রক্তাক্ত বেদনার, আতংকের চিত্র কল্পনা করুন, কেমন লাগে অনুভব করুন, দেখুন সেগুলো কেমন কষ্টকর।
অভিজিৎ রায় আরও বলতো ‘বাংলাদেশের কেউ যদি মনে করেন যে আমরা নিরাপদে বসবাস করছি তাহলে সেটা হবে বোকার স্বর্গে বাস করা’। মৌলবাদীর আক্রমণের লক্ষ্য হয়তো আপনি আমি আমরা, এবার আপনার পালা, আপনি কী করবেন?
মানুষের দেহ মরে যায়, কিন্তু চিন্তা ও মেধার মৃত্যু হয় না যদি সে তার চিন্তাভাবনা, মেধা, গুণ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা মানুষের জন্যে বিলিয়ে যায় । অভিজিৎ রায় হলো তেমনই এক প্রজ্ঞাময় সুন্দর মানুষ যে তার জীবন বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিলিয়ে দিয়ে গেছে।
অভিজিৎ এক নক্ষত্রের নাম। অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যপক, মুক্তিযোদ্ধা ডঃ অজয় রায়ের দেওয়া। সেই অভিজিৎ নামের মানুষটি বাবাকে সাথে নিয়ে আজ সত্যিই উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আলো ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্ম যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, যে স্বাধীনতা নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য, যে অধিকার জনগণের একান্ত মৌলিক তা যেন দেশের মানুষ আপন বলে ধারন করে, চর্চা করে এবং সুরক্ষা করে। অভিজিৎ এবং তার মত ভাবনার সকল মানুষ এটাই চেয়েছে বারবার। এ চাওয়া সকলের মঙ্গলের জন্যই।
লাখো অভিজিতের জন্ম হোক এই বাংলায়। প্রিয় অভিজিৎ রায়ের জন্য রইলো শ্রদ্ধাঞ্জলি।
Leave A Comment