বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা নয়া মেরুকরণ হয়ে গেছে। একটাপক্ষ মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা চেতনা বিজনেসের সোল এজেন্ট আওয়ামীলীগ এবং অপরপক্ষ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিজনেস করলেও মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে নি। সত্যি কথা বলতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িকতাও প্রশ্নবিদ্ধ। তার শাসন আমলও বিতর্কের উর্ধে না। তার মত ক্যারিসমেটিক রাজনৈতিক নেতাও পাহাড়িদের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা ভাবনা না করে বলে ফেললেন তোরা বাঙালি হয়ে যা।
শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মাঝখানে ১৫বছরের বিশাল সময় চলে গেছে। তারমানে ২০০৯ সালে যাদের বয়স ছিল ১৭বছর তারা ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত রাজনীতি করতে পারে নি। গণতান্ত্রিক চর্চা করতে পারে নি। তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি। বাক স্বাধীনতার চর্চাও করতে পারেনি। ৫৭ ধারার ক্যামোফ্লেজ ব্লাসফেমি “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন” আইনে শেখ হাসিনা বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করেন। চিন্তা করেন ৩২ বছর বয়স পর্যন্ত একটা মানুষ অন্তত একবার সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারে নাই। এই সময়ে আপনি দেশকে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার থেকেও উন্নত করতে পারতেন। সিরিয়াসলি বলছি, এত কোটি কোটি কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার না হলে বাংলাদেশকে আসলেই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারতেন। শেখ হাসিনা, আপনার সেই সুযোগ ছিল। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বানাতে পারতেন অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হইছে একেকটা বিশ্বমাদ্রাসা। আপনার সময়ে সবেচেযে বেশি মুক্তচিন্তার মানুষ খুন হইছে।
ইলেকশন মেকানিজম করে রাতের বেলা নির্বাচন নির্বাচন ভোটের খেলার জিতলেও ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে যেন সয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষের চাপা ক্ষোভ ছিল। আওয়ামীলীগ কৌশলে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বিভিন্ন ইসলামি দলগুলোকে প্যাট্রোনাইজ করেছে। আওয়ামীলীগ কীভাবে বাংলাদশকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিয়ে আসছে তার সিক্যুয়েন্স এখানেই। বিএনপি দলটারও বিভিন্ন দোষ। এরাও জঙ্গিবাদ লালনপালন করতো, পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের সাথে যোগসাজশ ছিল। সীমাহীন দুর্নীতি ছিল, হাওয়াভবন ছিল, ২১ আগস্টের বোমা হামলা ছিল। এক প্রতিহিংসার জবাবে আরেক প্রতিহিংসা করে আওয়ামীলীগ বিএনপি দলটাকেই নাই করে দেয়। বাংলাদেশের মানুষের কপাল এত পোড়া যে তাদেরকে বারবার সহ্য করতে হয় মূর্খ লোকদের শাসন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে সুনাগরিক বানাতে পারতেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক করতে পারতেন। কিন্তু উল্টা কওমী মাদ্রাসাকে মাস্টার্সের স্ট্যাটাস দিলেন। বিএনপিকে নাই করতে গিয়ে হেফাজতকে প্যাট্রোনাইজ করতে লাগলেন। শিক্ষাব্যবস্থায় হেফাজতের প্রেসক্রিপশনের পাঠ্যক্রম বানালেন। আপনার সময়ে দেশে মূলধারার শিক্ষা মাধ্যম থেকে মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেও মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে। মূলধারা এবং মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য হলো রেগুলার পড়ালেখার পাশাপাশি মাদ্রাসাতে ভিন্ন ধর্মের প্রতি আনুষ্ঠানিক ঘৃণা চর্চা ও বিদ্বেষের চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশের আওয়ামীলীগের এতদিনের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনকার এই মেধাবি ছাত্ররা শুদ্ধভাবে বাংলা বা ইংরেজি কোনভাষাতেই একটা প্যারাগ্রাফ লিখতে পারে না। আরবী কতটা পারে তা অবশ্য আমি জানি না।
শেখ হাসিনা, আপনি আপনার রেজিমের পতন ঘটাইছেন নিজে হাতে। বিএনপি দলটাকে নিশ্চিহ্ন না করে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পারতেন। বিএনপি এবং ইসলামপন্থী দল কিন্তু এক না। বিএনপি জাতীয়তাবাদী হলেও ধর্মীয় রাজনীতি করতো না। হেফাজত ধর্মের রাজনীতি করে, জামাত ধর্মের রাজনীতি করে, হিজবুত তাহরির ধর্মের রাজনীতি করে, চর্মনাই ধর্মের রাজনীতি করে। ইসলামে ধর্মীয় রাজনীতিটা বুঝতে পারাটা খুব জরুরী। ইসলাম যতটা ধর্ম তার থেকেও বেশি রাজনীতি এবং তার থেকেও বেশি সাম্রাজ্যবাদ। যতগুলো ইসলামি দল বাংলাদেশে রাজনীতি করে তাদের মতবাদের ভিন্নতা থাকতে, তরিকা ভিন্ন থাকতে পারে কিন্তু খেলাফত প্রতিষ্ঠায় কোন দ্বিমত নাই। আপনি মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি নিয়ে ব্যবসা করেন আর ইসলামপন্থীদলগুলো ইসলামের রাজনীতি করে ইসলামের প্রচারের জন্য। ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম। চিন্তা করেন ইসলামিদলগুলোর আপনার সামনে আপনার কী অবস্থান!?
বিএনপি নাই করে হাওয়া ভবন নিশ্চিহ্ন করে আপনি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে হাওয়া ভবন বানায়ে দিছেন। যেহেতু ইলেকশন মেকানিজম করেন সেহেতু মেকানিজমের সব ইঞ্জিয়ারদের খুশি করতে হয়। ফলে একজন আমলা, পুলিশ, বড় কর্মকর্তা, এমনকি পিওন, ড্রাইভার পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। আপনার রেজিম টিকে ছিল পুলিশ, প্রশাসন, সামরিকবাহিনী দিয়ে। প্রত্যেকেই ক্ষমতার স্টেক মত টাকা পয়সা ইনকাম করছে। বাংলাদেশ আর্মি বাংলাদেশের সবচেয় বড় ব্যবসায়ী। মানুষ এসব মনে রাখছে। যখন ইসলামি দলগুলোর সাথে আপনি রাজনীতি করতেছিলেন তখন তারা আপনার সাথে পলিটিক্স করে ফেলছে। আপনি যতই তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন না কেন যে ইসলামি দলগুলোর সাথে ক্ষমতার দরকষাকষি করছেন তারা ইসলামি খেলাফত চায়, শরিয়া চায়। আইরনিকলি, শরিয়া অনুযায়ী নারী নেতৃত্ব হারাম। আপনার স্থাপন করা ৫৬০টা মডেল মসজিদে, ওয়াজে, মাদ্রাসায় প্রচার করে নারী নেতৃত্ব হারাম।
আপনি ঢাকা শহরের চারটি প্রবেশ পথ দেখেন। মনে করেন, যাত্রাবাড়ি থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ যেতে রাস্তার দুইপাশে কয়েক হাজার মাদ্রাসা আছে। এরকম অবস্থা ঢাকার প্রতিটি প্রবেশপথ। আপনি যদি ৫৬০টা মডেল মসজিদ না বানিয়ে ৫৬০ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতেন তবে আপনার আজ এরকম দশা হতো না। বাংলাদেশ থেকে কীভাবে যেন সংস্কৃতি চর্চা উধাও হয়ে গেল। নগরকেন্দ্রিক যা সংস্কৃতি চর্চা হয় সেখানে জামাত বা হেফাজতের মোলায়েম শাখার লোক। হেফাজত তোষণ করে আপনি ঢাকার চারিদিকে মাদ্রাসার পরিখা খনন করে ফেলছেন, সেখানে আপনি অবরুদ্ধ। ঠিক যেন ইহুদি বনু কুরাইজা গোষ্ঠীকে পতনের আগে অবরোধের মত স্ট্রাটেজি। আজকেই জানতে পারলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সভাপতি নাকি ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। এই এত বছরে একটা দেশের নতুন প্রজন্মকে আধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত না করতে পারাটা অপরাধ। একটা অতিপ্রজ প্রজন্ম জন্ম নিছে যারা মানুষকে পিটায়ে মেরে ফেলে, মরার পরেও মারে, লাশ গাছে ঝুলায়ে দেয়। কেউ পিটানোর ভাত তরকারি খেতে দেয়।
রাজনীতির নয়া মেরুকরণে স্বাধীনতার পক্ষের লোক বলে বিবেচিত যেকোন মানুষ এখন আক্রমণে লক্ষবস্তু। শেখ হাসিনা, ৩২ নাম্বারের আপনার বাবার বাড়ি আর দেশব্যাপি আপনার বাবার যত ভাষ্কর্য, শিল্পকর্ম ধ্বংস হইছে তার জন্য আপনি দায়ী। এই কালেকটিভ ঘৃণাজীবী গড়ে উঠছে আপনার সামনে, আপনার ছত্রছায়ায়। যাদের একটা ফেইক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠছে যা গড়ে উঠতে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলা খুব কাজে দিছে। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন এরশাদ দূষিত করেছিলেন নারী আর কবিতা আমি বলতেছি শেখ হাসিনা নষ্ট করছে গণতন্ত্র এবং দেশের সুশীল সমাজ। সাংবাদিকরা পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলনে কিছু না জিজ্ঞাসা করে শুধু শেখ হাসিনার প্রশংসা করে তাদের দায়িত্ব পালন করতেন। শিল্পীরা হাত কচলাতে কচলাতে হাতের রেখা ক্ষয় করে ফেলত একটা রাষ্ট্রীয় দাওয়াত পাওয়ার আশায়। অথচ হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সব।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক ব্যবসা করলেও সাধারণ মানুষের কোন লাভ হয়নি কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এখন তারাই বেশি। মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটাকে লালন করেন যারা অসাম্প্রদায়িকতা দাবি করেন যারা, তারাই এখন সংকটে। টার্গেট কিলিং হচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে কিলিং হচ্ছে। রাজনীতির নতুন পোলারাইজেশনে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সব। আওয়ামীলীগ আমলে সমতলে হিন্দু এবং পাহাড়ে আদিবাসীদের উপর আক্রমণ হতো কটেজ ইন্ডাস্ট্রি স্কেলে আর এই মেধাবী ডক্টরেট সরকারের আমলে আক্রমন হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে। ভিন্নমতের মুসলিমরাও এখন আক্রান্ত। মন্দির ধ্বংস করে মাজারও ভাঙা হচ্ছে।
এই মেধাবী আন্দোলনে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। মেধাবী ডক্টরেটদের বলি, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন দিয়ে রাজনৈতিক মিথ্যাচার করবেন না। মন্দির ভেঙে মাদ্রাসার ছাত্র দিয়ে নিরাপত্তার প্রস্তাব দেয়াটা অতি নিম্ন মানের রাজনৈতিক চর্চা। বায়তুল মোকাররমের ভিতরে মারামারি করলেন এখন যদি হিন্দুরা আপনাদের মসজিদের নিরাপত্তা দিতে চায়! কী করবেন? যতই অত্যাচার করেন, ধর্মান্তর করেন স্টিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য জাতিগত লোকজন মোটজনসংখ্যার ৮.৮৬ শতাংশ।
এই আগ্রাসী ধর্মীয় রাজনীতি থেকে রক্ষা পেতে সংখ্যালঘুদের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় থাকা দরকার। সক্রিয় রাজনীতি দরকার।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই
অভিজিৎ রায়ের কথা মনে পড়ে!
অভিজিৎ রায়ের কথা মনে পড়ে!