একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করা যাক-
বাংলাদেশের কোন এক কলেজের স্নাতক শ্রেণী; প্রথম বর্ষের আদুভাই, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী ছেলেটাকে অনেক চেষ্টার পর বহিষ্কার করা গেছে। তবে, কিছু ফেলু ছাত্র আবার অবিলম্বে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে নকল করে হলেও পাস করে বেরিয়ে যাওয়ার জোর দাবী তুলেছে; আর বাকিরা চাইছে নিয়মিত ক্লাসে যেয়ে, প্রত্যেক বছরের কারিকুলাম ঠিক মতো শেষ করে, ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে।

এবার ধরুন, আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে শিক্ষিত এবং যোগ্য লোক নিয়োগ দেবেন। উপরের কোন গ্রুপ আপনার পছন্দ হবে?
ক) বহিষ্কার করা ছাত্র,
খ) চট-জলদী পরীক্ষা দিয়ে নকল করতে চাওয়া ছাত্র, না কি
গ) বাকি ছাত্রদের একজন, যে প্রস্তুতি নিয়ে কারিকুলাম শেষ করে যথাযথভাবে পরীক্ষা পাস করেছে ।
উত্তরটা কি হবে তা আমাদের জানা। দেশের দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি – দায়িত্ব আমরা তাদের হাতেই দেব, যাদের আমরা সবচেয়ে যোগ্য মনে করব।

কিছু স্বনামধন্য মানুষ, যারা একাধারে সফল, যোগ্য এবং নীতিবান, এবং অভিজ্ঞ, আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁদের সাথে আছেন আমাদের ব্রিলিয়ান্ট নতুন প্রজন্ম, যারা একটা অসম্ভব কে সম্ভব করে, তাঁদের নেতৃত্বগুণে আমাদের মুগ্ধ করে এরমধ্যেই সুন্দর একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন। নবীন-প্রবীণের এই অভূতপূর্ব মেলবন্ধন আমাদের ভবিষ্যতকে যে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, তা বোধহয় আমরা এখন কল্পনাও করতে পারি না। তবে, যেকোনো মহৎ কাজে সফল হতে হলে কেবল মেধা, যোগ্যতা আর সৎ উদ্দেশ্যই যথেষ্ট না, একটা ভাল পরিকল্পনার সাথে দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রমও এর জন্য অপরিহার্য। স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা ভ্রান্ত নীতি, সামরিক শাসন, অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর স্বৈরশাসন আমাদের সংবিধান এবং রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে একেবারে অকেজো করে দিয়েছে। এগুলো ঠিকঠাক করে একটা আধুনিক সফল রাষ্ট্রের উপযোগী করতে সময় লাগবে। কতটা সময় লাগবে তা উপযুক্ত ব্যক্তিরা মিলে ঠিক করবেন, তবে তা বেশ কয়েক বছর হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

দেশের কিছু চেনা-মুখ রাজনীতিবিদ, যারা এতদিন স্বৈরাচারের দাপটে ম্রিয়মাণ হয়ে, কোনও মতে শ্বাস নিচ্ছিলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হটাত তাদের গা ঝাড়া দিয়ে ওঠতে দেখা যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনে যাচ্ছেন, গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে বিশাল স্ক্রিনে মুখ দেখিয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা দিচ্ছেন। পরাজিত স্বৈরাচারও চুপ করে বসে নেই, তারাও ছলে-বলে প্রথাগত রাজনীতির জটিল সমীকরণ থেকে ফায়দা পাওয়ার ছক আঁকছেন। এরা হাবে-ভাবে এমনটা বোঝাচ্ছেন যে অতি শীঘ্রই একটা নির্বাচনের মাধ্যমে এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে – যেন বলতে চাইছেন – ওহে জনগণ, আমাদের শাসনই তোমাদের ভবিতব্য, আমরা রাজনীতিবিদরা ছাড়া তোমাদের অন্য গতি নাই। সাধারণ মানুষ তাঁদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয় বুঝে গেছেন যে চেনা-মুখ রাজনীতিবিদদের রাজনীতি কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ করারই রাজনীতি। এদের অতীত বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভীষণ রকমের প্রশ্নবিদ্ধ। এদের খুব অল্পসংখ্যকই আসলে দেশ আর জনগণের স্বার্থ নিয়ে ভাবেন, এবং আমি সন্দিহান যে একটা আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা আসলে তাদের আছে কি না?

পাঠক, এপর্যন্ত পড়ে ধরে নেবেন না যে আমি এখানে কোন চিরস্থায়ী অগণতান্ত্রিক সরকার-ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে ওকালতি করতে বসেছি। মোটেই তা নয়, একটা দীর্ঘমেয়াদী অগণতান্ত্রিক সরকার যে জাতির জীবনে কি দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে তা হাসিনার অপশাসন তো বটেই, এর আগেও আমরা বহুবার দেখেছি। এই দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে জন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট সময়ে, শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পরিবর্তনের একটা ফুল্প্রুফ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সময় নিয়ে এই দায়িত্ব পালন করবেন এবং যথাসময়ে একটা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। আসলে এগুলো কোন নতুন বিষয় না – অতীতে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটা ব্যবস্থা ছিল – কেবল দেখতে হবে যে কেন সেই ব্যবস্থা ঠিক মতো কাজ করে নি, এবং কিভাবে এটাকে সংশোধন করে আরও শক্তিশালী করা যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে স্বপ্নের দেশ পাওয়ার যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছে তার সদ্ব্যবহার করে যেমন একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে হবে, তেমনি সেই ব্যবস্থাকে টেকসই বানানোর পাশাপাশি যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির একটা আঁতুড় ঘরও তৈরি করে দিতে হবে।

পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে সবখানেই। বহুদিন পর গতবছর দেশে গিয়ে দেখে এলাম কৃষি জমিগুলোতে আদিযুগের কাঠের লাঙ্গলের জায়গায় যন্ত্রচালিত টিলার ব্যবহার হচ্ছে, যা অনেক বেশী সক্ষম। কৃষকরা গতানুগতিক ধানের বীজ বাদ দিয়ে মৌসুমে বা অ-মৌসুমে উচ্চ-ফলণশীল ধানের চাষ করে খাদ্য-স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। খাল-বিল, নদী-নালায় লগি-বৈঠার নৌকা বাদ দিয়ে যন্ত্র-চালিত নৌকার ব্যবহার অনেক সময় বাঁচাচ্ছে, সেই সাথে মাঝি, জেলে, যাত্রীসহ সবার কাজ সহজসাধ্য করে তুলেছে। দোকানে দোকানে দেখলাম হরেক পণ্য আর খাদ্যদ্রব্যের সমারোহ – প্রতিদিনের কেনাবেচায় প্রচলিত দাঁড়িপাল্লা বাদ দিয়ে ডিজিটাল স্কেলের ব্যবহার আজকাল প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটে-বাজারেও শুরু হয়েছে। আসলে, লাগসই পরিবর্তনের মাধ্যমে করা টেকসই উন্নয়ন গতিশীল সভ্যতারই একটি বৈশিষ্ট্য, আর সে ধরনের পরিবর্তন কে পুঁজি করে আরও চৌকস, আরও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার সক্ষমতা অর্জন এখন আমাদের হাতের নাগালের মধ্যেই।

আলোচনা কোন দিকে এগোচ্ছে, পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন! ঠিক, আমি অযোগ্য, চেনা-মুখ রাজনীতিবিদদের জায়গায় নতুন মুখ চাচ্ছি। আর সেই নতুন মুখের সন্ধানে আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে না, চলমান ছাত্রজনতার আন্দোলনের পুরোধারা আমাদের চোখের সামনেই আছেন। এদের সাথে এক বা একাধিক প্লাটফর্মে আরও অনেক যোগ্যতা-সম্পন্ন নবীন-প্রবীণ, পরিচিত কিংবা নতুন মুখ নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যোগ দিতে পারেন। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ক্যাডার-ভিত্তিক রাজনীতি করে আসা মানুষেরা অপরিহার্য নন। উপযুক্ত গুণাবলী-সম্পন্ন যেকোনো পেশার মানুষের মধ্য থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসতে পারে; গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্বের সফল নেতাদের দেখলে আমরা এরই প্রমাণ পাই।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে পুরাতন, চেনা-মুখ, পেশাদার কিংবা মৌসুমি রাজনীতিবিদদের কি পুরোপুরি বাদ দিতে হবে? অবশ্যই না; কোন বিশেষ সরকার, কিংবা সুশীল বা কোন একটা গোষ্ঠী সেই সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না; এই সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার কেবলমাত্র বাংলাদেশের জনগণের। বাংলাদেশে অবশ্যই একটা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে জনগণের সামনে অনুপযুক্ত নেতাদের বিকল্প থাকতে হবে। সেজন্য দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সৎ, যোগ্য আর গণতন্ত্রে-বিশ্বাসী নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে না। সেই নেতৃত্ব আসতে পারে বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনকারী তরুণদের মধ্য থেকেই। উপযুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ থাকলে জনগণ আর কখনই কোন দলবাজ বা স্বৈরাচারী নেতাদের পোষ্যদের প্রতিনিধি হিসাবে ক্ষমতায় আনবে না।

আন্দোলনকারী তরুণ নেতৃত্ব হয়তো এর মধ্যেই সমমনা মানুষদের নিয়ে দেশজুড়ে একটা সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ শুরু করেছেন। যত দ্রুত সম্ভব উপযুক্ত মানুষদের নিয়ে এই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এখন সময়ের জরুরী পদক্ষেপ। সারাদেশ জুড়ে যে প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্বের শূণ্যতা তৈরি হয়েছে তা এই নেটওয়ার্ক দূর করতে পারে। আঞ্চলিক নেতৃত্ব জনগণ আর সরকারের মধ্যে সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করতে পারেন। এই ব্যবস্থা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার দাবীগুলো দ্রুত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছাতে সাহায্য করবে, সরকারের সিদ্ধান্তগুলো প্রান্তিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করবে, এবং সেইসাথে জনগণ আর সরকারের মধ্যে কোন ভুল-বোঝাবুঝি হলে তা দূর করতে সাহায্য করবে। এই নেটওয়ার্ক তার লক্ষ্য অর্জনে সফল হলে এর উপর জনগণের আস্থা তৈরি হবে যার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে গড়ে উঠবে একটি সত্যিকারের জন-বান্ধব এবং জন-প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক দল। নতুন নেতৃত্ব আর তার কার্যক্রম একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্য যে সময় দরকার, সেই সময়টুকু আমাদের বর্তমান সরকারকে দিতেই হবে।

জুলাইয়ের উত্তপ্ত রাজপথে ওই যে নাম না জানা, চোখে মুখে অসাধারণ দ্যুতি-ছড়ানো তরুণী বলেছিলেন “পিছনে পুলিশ, আর সামনে স্বাধীনতা!” ওই তরুণী আর তাঁর সহযোদ্ধাদের সাহসী নেতৃত্ব আজ আমাদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক নূতন দুয়ার খুলে দিয়েছে। তাই তাঁরই মতো করে বলি, আমাদের পিছনে কেবলই অন্ধকার আর নিরাশা, কিন্তু সামনে যে ভবিষ্যৎ তা অজানা হলেও অসীম সম্ভাবনাময়। ঝুঁকি আছে বলে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে এতো মানুষের আত্মত্যাগের পরও আমরা পাব কেবল আশাভঙ্গের বেদনা। অবশ্যই আমরা আর পেছনে যেতে চাই না; সুতরাং নতুন সরকারকে সর্বত সহযোগিতা করে, পরিবর্তন আর সংস্কারের জন্য উপযুক্ত সময় দিয়ে, সাহস নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত!