(এই রম্যরচনাটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক, জীবিত বা মৃত কারও সাথে কোন মিল সম্পূর্ণ কাকতালীয়)
প্রিয় দর্শক, আমি শিথিল মর্জিনা, টক্কর টিভির পক্ষ থেকে আজকের বিশেষ আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাই। দেশের এই পরিস্থিতিতে আমরা চলমান ঘটনাগুলোর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করছি। আমাদের আজকের অতিথি দলকানা পুরস্কার-প্রাপ্ত স্বনামধন্য পদার্থবিদ ডঃ ফাঁপর ভুলভাল, সাথে আরও আছেন প্রাক্তন শপথ-বদ্ধ রাজনীতিবিদ এবং বিশিষ্ট আইন-অজ্ঞ মাইনকা দলদাস।
ডঃ ভুলভাল, এই যে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ, দুই শতাধিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে, হাজারের উপর আহত হয়েছে, বাড়ী থেকে তরুণ-যুবকদের তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে এগুলোর জন্য তো কোনমতেই সরকারকে দায়ী করা চলে না। তো, আপনার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মাধ্যমে কিভাবে এই অভিযোগগুলো ভুল প্রমাণ করবেন?
ডঃ ভুলভাল: ধন্যবাদ শিথিল! আসলে এর খুব সহজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। আমরা জানি আমাদের এই মহাবিশ্বের পৃথিবীর মতো আরও অসীম-সংখ্যক প্যারালাল বিশ্ব আর পৃথিবী আছে। সেখানে হয়তো আপনি আছেন, আমি আছি, মাইনকা’দাও কোন চিপায় চাপায় আছেন, নেত্রী আছেন, সবাই আছি। কিন্তু সেই পৃথিবীগুলো একটা আরেকটার থেকে একটু আলাদা। যেমন, হতে পারে এমনই এক প্যারালাল বিশ্বের পৃথিবীতে আমরা তিনজনই রাজাকার ……
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: (উচ্চ কণ্ঠে) না, না, না, ফাঁপর ভাই এটা হতেই পারে না, প্যারালাল, সিরিয়াল, হরাইজন্টাল, ভার্টিকাল কোন ওয়ার্ল্ডেই আমি রাজাকার না…
ডঃ ভুলভাল: (একটু বিব্রত হয়ে) মাইনকা’দা, আমি জাস্ট একটা সম্ভাবনার কথা বলছি, অসীম সংখ্যক পৃথিবী যখন…
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: ইউ কান্ট জাস্ট সে থিংস… লিসেন …লেট মি টক…আমি আমি আজকে এখানে আসার সময় রাজাকারের বাচ্চারা আমার গাড়ি আটকে দিয়ে……
শিথিল: মাইনকা স্যার প্লীজ, আমাদের হাতে সময় বেশী নেই, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলার কোমল-মতি জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমি আপনার কাছে একটু পরেই আসছি।
ডঃ ভুলভাল, আমি বুঝতে পারছি, আপনি বলতে চাইছেন যে দুঃখজনক ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো আসলে আমাদের এই পৃথিবীতে ঘটেনি…
ডঃ ভুলভাল: বাঃ আপনি তো দেখছি ভারী বুদ্ধিমতী!
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: জী, কেবল নেত্রীকে ওই বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নগুলো না করলে আজকে পরিস্থিতি……
শিথিল: (চট-জলদী উচ্চারণে) দর্শক, একটা ছোট্ট বিরতির সময় হয়েছে, বিরতির পর আবার ফিরছি।
(মঞ্চ-কাঁপানো, ডগমগে, ওজনদার নায়িকা ফুলপরীর ন্যাকা শিশুকণ্ঠে কিটো ডায়েটের বিজ্ঞাপনের পর)
শিথিল: ডঃ আপনি বলছিলেন যে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের ঘটনাপ্রবাহ ব্যবহার করে আমাদের জনগণকে ভুল বোঝানো হয়েছে।
ডঃ ভুলভাল: হ্যাঁ আসলে এই যে অভিযোগগুলো উঠেছে – প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার পাচার, পনের লাখের ছাগল, নজীর-বিহীনের অজস্র বালাখানা, নেত্রীকে আপনার প্রশ্ন এবং তার বেফাঁস উত্তর, ছাত্র-বিক্ষোভ, তারপর কাকের ডাক শুনে হেলমেট বাহিনীর আক্রমণ, পুলিশের গুলি ……
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: (উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে) রাবিশ! কিসের কাকের ডাক, হেলমেট বাহিনী? কি বলছেন এসব?
ডঃ ভুলভাল: ওঃ বলেছি না কি!! (বিড়বিড় করে, আজকাল কি যেন হয়েছে! মাথায় যা ঘুরছে হটাতই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে)। যাই হোক, বলছিলাম যে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী মারা গেল বলে গুরুতর অভিযোগগুলো উঠেছে – এগুলো সবই প্যারালাল বিশ্বের ঘটনা। এর সাথে বর্তমান পৃথিবী, বাস্তবতা কিংবা আমাদের সরকারের কোন সংযোগ নেই। প্যারালাল বিশ্বের এই ঘটনাগুলোকে আমাদের পৃথিবীতে প্রজেক্ট করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
শিথিল: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব; কিন্তু, এই প্যারালাল বিশ্বের ঘটনা বাংলাদেশে প্রজেক্ট করার টেকনোলজি কার আছে?
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: পাকিস্তানের আছে!
ডঃ ভুলভাল: আরে নাহ; কার্দাশেভ স্কেল অনুযায়ী, এধরনের ক্ষমতা কেবল চতুর্থ স্তরের সভ্যতার পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব, আমাদের বর্তমান পৃথিবীর সভ্যতা এখনো প্রথম স্তরেই যেতে পারে নি। তবে স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষ কোন চতুর্থ স্তরের সভ্যতাকে প্রভাবিত করতে পারে। কিভাবে করেছে এটা জানতে হলে আমাকে আবার গবেষণায় বসতে হবে। আমি সরকারের কাছ থেকে এই মিলিয়ন ডলার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ফান্ড পেয়েছি। এর মধ্যেই আমি আমার মুক্তিযুদ্ধের ফিল্টার ব্যবহার করে এই কাজের উপযুক্ত গবেষকদের কোটা-ভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছি।
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: আরে ফাঁপর ভাই! আমি কি এতোই অজ্ঞ? বাংলাদেশে আবার গবেষণা করে কে কবে কি করেছে? ফান্ড পেয়েছেন, ভাল কথা, সেই টাকায় ডাটা কালেকশনের জন্য ভাবী কে নিয়ে হাওয়াই আর মাসুপিসু ঘুরে আসুন, যাদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের গুগল আর চ্যাট-জিপিটি দিয়ে চোথা মারতে বসিয়ে দেন…
শিথিল: আহ মাইনকা স্যার!! ভাগ্যিস লাইভ প্রোগ্রাম না! আপনি যা বলেছেন সব তো এডিটের সময় বাদ দিতে হবে!
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: (উত্তেজিত হয়ে) আপনি তো ওদের মতোই কথা বলছেন!! আই সে, এসব গবেষণা-টবেষণার দরকার নেই, সোজা কথা, জামাত-শিবিরের টাকা খেয়ে চতুর্থ না কি পঞ্চম স্তরের ভিনগ্রহের মানুষেরা এসব ইলিউশান আমাদের সোনার বাংলায় প্রজেক্ট করেছে- ব্যাটারা সব রাজাকারের বাচ্চা।
ডঃ ভুলভাল: (প্রথমে স্বগতোক্তি) ব্যাটারা রাজাকারের বাচ্চা! (তারপর, উচ্চস্বরে)… ইউরেকা!! আরেকটা আইডিয়া… ধন্যবাদ মাইনকা’ দা… আসলে পদার্থবিদ্যার একটা থিউরিতে বলে অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ সবই একসাথে বিদ্যমান- এখন সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতের পৃথিবীতে টাইম ট্র্যাভেল সম্ভব হবে। কাজেই আমরা বলতে পারি রাজাকারের নাতি-পুতি, তস্য নাতি-পুতি ,তস্য নাতি-পুতি – এভাবে চলতে চলতে বিলিয়ন বছর পরে গিয়ে চতুর্থ স্তরের সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। ওরাই ভবিষ্যতে বসে টাইম ট্র্যাভেলের টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে আমাদের বর্তমান বাংলাদেশে প্যারালাল পৃথিবীর ঘটনাগুলোর দৃশ্য প্রজেক্ট করছে, মানুষকে খেপিয়ে তুলছে। আমাদের এই অশুভ তৎপরতা রুখে দিতে হবে। অবশ্যই কোটা-ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে, যাতে কোটা বাতিলের সুযোগে সুবিধা পেয়ে রাজাকারের বংশধরেরা দূর ভবিষ্যতে চতুর্থ স্তরের সভ্যতায় পরিণত না হতে পারে!!
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: ওফ ফাঁপর ভাই কি একটা জবর থিউরি দিয়েছেন! আপনি আসলেই জিনিয়াস!! এইজন্য আপনাকে অবশ্যই নোবেল প্রাইজ দিতে হবে। এজন্য নোবেল কমিটিকে টাকা পয়সা যা দেয়া লাগবে, আমরা দিয়ে দিব, কমিটির ডাইরেক্টর কে পনের লাখ টাকার ছাগলের কাচ্চি-বিরিয়ানি খাওয়াবো!! আমি আজকেই নেত্রীর সাথে কথা বলবো! সেই সাথে, এই থিউরি সংবিধানেও জুড়ে দিতে হবে। কেউ এটা অস্বীকার করলে বিশেষ আইনে বিচার করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমি নিজেই এই রায় লিখবো, মাইনকার চিপা কতপ্রকার কি কি রাজাকারের বাচ্চাদের এবার বুঝায় দিব।
শিথিল: কিন্তু স্যার আপনি তো অবসরে, এখন কি করে রায় লিখবেন? নিয়ম অনুযায়ী…
আইন-অজ্ঞ মাইনকা: (উত্তেজিত হয়ে) আরে দূর…বারবার ইররিলেভেন্ট প্রশ্ন! আমাকে নিয়ম শেখাতে আসবেন না। নিয়ম আবার কি? বাংলাদেশে আমরা যা বলবো, করবো সেটাই নিয়ম, সেটাই আইন!
হটাত একটা সোয়া চার ইঞ্চি পাটকেলের আঘাতে দুম শব্দে দোতলার রেকর্ডিং রুমের বিশাল কাঁচের জানলাটা ফেটে গেল। আতঙ্কিত ডঃ ভুলভাল শিথিলকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে উঠলেন, আইন-অজ্ঞ মাইনকা “রাজাকারের বাচ্চা” চিৎকার দিয়ে দাঁত-কপাটি লেগে মেঝের উপর আছড়ে পড়লেন।
শিথিল: (হাঁসফাঁস করে) একি স্যার!! ছাড়ুন… দর্শক আমরা আক্রান্ত হয়েছি….স্বাধীনতা-বিরোধী জঙ্গি সন্ত্রাসীরা অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে আমাদের আক্রমণ করেছে। এই অনুষ্ঠান যদি আপনারা নির্ধারিত সময়ে দেখতে পান তাহলে অভিনন্দন…. আমাদের দল আবারও গণঅভ্যুত্থান, থুক্কু জঙ্গি-দমনে সক্ষম হয়েছে।
(পাদটীকা: ২০৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপনের দিনে এই হারিয়ে যাওয়া ভিডিও সাক্ষাতকারটি প্রথম বারের মত ইউটিউবে আপলোড করা হয়। ধারনা করা হয় যে ২০২৪ সালে ধারণকৃত এই ভিডিও কখনই সম্প্রচারিত হয় নি। সেবছর টক্কর টিভি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এটি সংস্থাটির আরও বহু যন্ত্রপাতির সাথে পুরানো ঢাকার একটি ওয়ার-হাউসে বহু বছর তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে। “বাংলাদেশের স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস” প্রকল্পের আওতায় ভিডিওটি সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে)
Leave A Comment