Looking into the Asian Root থেকে নেওয়া।
আমার বিশ বছর বয়স কালে চারটি নিশ্চিত মৃত্যর হাত থেকে বেঁচে যাই। প্রায় সাতান্ন বছর হয়ে গেছে। কিন্তু স্মৃতিতে প্রতিটি মূহুর্ত এখনও ছবির মত পরিষ্কার।
প্রথম ঘটনা – মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতা
১৯৬৭ সালের জুন মাসে এক বিরাট ভরা নদীতে আমি ডুবেই গিয়েছিলাম। মৃত্যুর একেবারে কিনার থেকে বেঁচে যাই।
উচ্চতর শিক্ষার আগে হাই স্কুল পাশ একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। ঢাকা বোর্ডের ব্যাবস্থাপনায় কোন শহরে এক মাসব্যাপী পরীক্ষা চলে। তারপর পরীক্ষার ফলাফলের জন্য প্রায় তিন মাসব্যাপী অপেক্ষার পালা। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। বাড়ি থেকে প্রায় দুমাইল দূরে নদীতে দল বেঁধে স্নান করতে যেতাম। বিশাল নদী। প্রায় ছয়শত ফুট প্রস্থ। হিমালয় পর্বতের বরফ গলা জলে নদী কানায় কানায় পূর্ণ। উজান থেকে ভেসে আসা পলি মাটিতে ঘোলা জল। একদিন হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত হয় ভাটিতে সাঁতার কেটে তিন মাইল দুরের একগ্রাম পর্যন্ত যেতে হবে। আমি ভাল সাঁতার কাটতে পারি না। তাই আমার একদম ইচ্ছা ছিল না। আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোট রণ নামের একটি ছেলে থেকে গেল আমার সাথে। কিন্তু মূহুর্তেই রণ মত পালটে সাঁতারে যোগ দিল। আমি একা পড়ে রইলাম। আমার আত্ম সম্মানে আঘাত এলো। মানসিক চাপ অনুভব করলাম। দ্বিতীয় কোন চিন্তা না করে আমিও আত্মঘাতি সাঁতারের দলে যোগ দিলাম। ভাবলাম কেউ বাদ দিলে আমিও বাদ দেবো। দূর্ভাগ্যবশত কেউ বাদ দিল না। এখন কী করবো ভাবতে ভাবতে সবার পিছনে পড়ে থাকলাম। এভাবেই নদীটার সব চেয়ে বিপজ্জনক জায়গায় পৌছে গেলাম। জলের গভীরতা এখানে সব চেয়ে বেশী। প্রায় ২০ ফুট। আমি এত দূর্বল হয়ে গেলাম যে আর হাত পা নাড়াতে পারছিলাম না। মাথা ঘুরিয়ে ডান বা বাম পাশের কোন দিকটা কাছে সেটিও বুঝতে পারছিলাম না। একটু একটু ঢেঊ ছিল। ফলে কোন সাঁতারুও আমার নজরে পড়ছিল না। আমার শক্তি শেষ হয়ে এলো। বাঁচার আশা ছেড়ে দিলাম। মাথা কাজ করছিল না। জলে ডুবে আমার মৃত্যু হচ্ছে সেটা নিশ্চিত হলাম। মা-বাবা, ভাইবোনদের সাথে আমার বন্ধন ছিন্ন হলো। কারও কথা মনে পড়ছিল না। সব আবেগের সমাপ্তি হলো। সব কিছু ভুলে গেলাম। আমার নিশ্চিত মৃত্যুর এই ক্ষণে এখানে কী ভাবে এলাম সেটাও মনে পড়ল না। মৃত্যুর একেবারে চুড়ান্ত মূহুর্ত।
এই মূহুর্তে আমার চেতনা বা অনুভূতি কিছুই ছিল না। আমি অন্য একটা জগতে প্রবেশ করলাম। এটা প্রশান্তি এবং স্বস্তির ভূবন। উদ্বেগহীন মনোরম পরিবেশ। মনে হলো আমি নদীর অনেক গভীরে অবস্থান করছি। প্রায় ছয় ফুট ব্যাসের একটা গোলকের আবরণের মাঝখানে আছি। আলো খুবই কম। গোলকের ভিতরে আমি ছাড়া কিছুই নেই সেটা বুঝা যায়। আবরনের বাইরে কিছুই দেখা যায় না। আমার নীচে একটা ছিদ্র দেখা গেল। ছিদ্রটা দেখতে মাটির কলসীর গলার মত। কিনারা বেয়ে ভিতরে জল ঢুকছে। কলসীর গলাটা এত ছোট যে আমি চাইলেই ভিতরে ঢুকতে পারব না। কিন্তু একটু পরেই দেখি আমি কলসীর ভিতরে অবস্থান করছি। এবারে কলসী নয়। ভাত রান্না করার মাটির পাত্রের মত মনে হলো। কিন্তু আকারে অনেক বড় গোলক। প্রায় ছয় ফুট ব্যাস। ফাকা, কিছুই নেই। আমি এর কেন্দ্রটিতে আটকে আছি। মাটির পাত্রটি অর্থাৎ গোলকটির নীচটা ফাকা। ফলে চার ফুট নীচে নদীর তলদেশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তলদেশ একেবারে সমতল নয়। কোথাও ছোট গর্ত আছে, কোথাও ছোট ধাপ আছে। অল্প স্বল্প জল বেয়ে যাচ্ছে। উচুনীচু ধাপে এসে জল ছলাৎ করে পড়ছে। জলের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে বাদিলা ঘাস ও তার কালো রংএর বিচি। আমার কোন ওজন নেই। গোলকের কেন্দ্রে আমার অবস্থান। আমার পা দুটো গুটানো। মালাই চাকি থুতুনি ছুয়ে আছে। হাত দুটো মালাই চাকি ধরে আছে। আমার গুটানো শরীরটা মাটির সাথে ৪৫ ডিগ্রী কৌনিক অবস্থানে। প্রজাপতির মত আমি যেন ফুলের মধু খেয়ে যাচ্ছি। দুনিয়ার কোন ভাবনা চিন্তা আমার নাই। জল নীচে পড়ছে, বাদিলা ঘাস এবং তার কালো বিচি জলের সাথে গড়িয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে যেন কী একটা মাদকতা কাজ করছে। আমি নিবিষ্ট মনে অনাবিল চিত্তে এক নয়নে তাই দেখে চলছি।
জল, বাদিলা ঘাস, এবং কালো বিচি চলছে উত্তর থেকে দক্ষিনে। গতি খুবই কম। গোলকটাও একই গতিতে চলছে। ফলে আমি একই ঘাস ও একই কালো বিচি দেখে চলছি। এই Hallucination এর স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক সেকেন্ড হবে। এর মধ্যেই মনে হলো আমি এখনই গোলকের কেন্দ্র ছেড়ে নদীর তলদেশে নেমে যাবো। আমার গুটানো শরীরটা কালো বিচির মত ছোট হয়ে যাবে। তারপর কালো বিচির সাথে গলাগলি করে জল ও বাদিলা ঘাসের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে থাকব। বাদিলা বিচির মত আমার কোন খেদ নেই, আবেগ নেই, অনুভূতি নেই। উদ্বেগহীন অপার শান্তি। এটাই Cutoff মূহুর্ত। হয়ত এই বিশেষ মূহুর্তে আমার চোখ বন্ধ হয়ে থাকবে। আমার ব্রেইন আর কাজ করেনি। ফলে এই মূহুর্তের পরে আমার আর কিছুই মনে নেই। আমার জীবন এখানেই শেষ। ১৯৬৭ সালের জুন মাসেই আমার জীবনাবসান।
৫৭ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু প্রতিটি মূহুর্ত ছবির মত পরিষ্কার মনে আছে। আমি জানিনা কতক্ষণ পরে আমার জ্ঞান ফিরেছিল। এক সময় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমি নদীর পশ্চিম পাড়ে মাটিতে শুয়ে আছি। পরে শুনেছি হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ সরকারের মনে পড়ে আমার কথা। পেছন ফিরে আমাকে দেখতে পান অনেক পেছনে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। প্রচন্ড শক্তিশালী দীর্ঘদেহী মানুষটি তখনই স্রোতের বিপরীতে তীরের গতিতে ছুটে আসেন। আমাকে উদ্ধার করে পাড়ে নিয়ে আসেন। আসলে তার বুদ্ধি এবং নেতৃত্বেই ভাটিতে সাঁতার কাটা শুরু হয়েছিল। আমি মরতে গিয়েছিলাম। এবং তিনিই আমার জীবনটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
বাল্য বয়সে তিনিই আমার হিরো ছিলেন। ফেব্রুয়ারী ৮, ২০২১ তারিখে তার দেহাবসান হয়। টুঙ্গীতে Alpine Water Purification এ জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ছিলাম। ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে দেখা করতে পারিনি। খুব রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি রাগ নিয়ে চলে গেলেন। আর আমি দেখা না করার বেদনায় নিয়ত কষ্ট পাই। আমি মরেই গিয়েছিলাম। আমার এই জীবনটা তারই দেওয়া। তার দেওয়া জীবনটা নিয়ে এখনও বেঁচে আছি।
সুইমিং পুলে সাঁতার শেখা আর সুইমিং পুলেই সাঁতার কাঁটা আমি কি এরকম নদী সাঁতরে পাড়ি দিতে পারবো? পারলে খুব ভালো হতো, আপনার বর্ণনার কারণেই হয়তো, ভয় লাগছে না, বরং একরকম এডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। এমনকি ডুবে যাওয়ার পরের দৃশ্যকল্পগুলোকে দারুণ রোমান্টিক মনে হচ্ছে, সেরকম অভিজ্ঞতা হলেও মন্দ হতো না, যদি শক্তিশালী ও খুব ভালো সাঁতারু শেষ মুহুর্তে আমাকে বাঁচানোর জন্যে প্রস্তুত থাকে … !
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
কী সাঙ্ঘাতিক। শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা।
Looking into the Asian Root কী, আর ‘বিশ বছর বয়স কালে চারটি নিশ্চিত মৃত্যর’ বাকি তিনটি কবে লিখবেন 🙂 ?
আনন্দে থাকুন নৃপেণ’দা।