লিখেছেনঃ রিমেল সরকার

নাটক আগে সম্পূর্ণ ছিলো সঙ্গীত। সংলাপ অনেক পরে এসেছে, নাটকে নাট্যকারকে হতে হয় ইশ্বরের মতন, কারো প্রতি মায়া মমতা থেকে তিনি পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন না, স্বেচ্ছাচারিও হতে পারেন না আমাদের ঘুমকাতুরে ইশ্বরের মতন তবে, এই ইশ্বর এক ভিন্ন ইশ্বর আদতে সত্যিকারের ইশ্বর, যিনি স্রষ্টা। পাণিনীর ব্যাকরণ, মহাভারত, রামায়ণ, হিন্দু পুরাণ এসকলের থেকেও পুরোনো সঙ্গীত শাস্ত্র। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূলে সামবেদ কে ধারণা করা হয়। ভারতের আদিতে বিভিন্ন মন্দিরে যে স্তব স্ততি, স্তোত্র হতো সেখান থেকেই এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এসেছে, এইযে প্রকৃতির নাদ থেকে সা রে গা মা এর উৎপত্তি এই নাদ বিদ্যা তেও সামবেদ এর ভূমিকা আছে, তাই আমার কাছে সঙ্গীতের ব্যাকরণ কিংবা সঙ্গীত শাস্ত্র হিসেবে সামবেদ অত্যন্ত সমাদৃত এবং প্রিয়, তবে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। তবে এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যে ২০০০ বছর আগে থেকে প্রচলিত এমন তথ্য ওইকিপিডিয়া কিংবা অন্য কোনো গবেষণা প্রবন্ধ খুঁজলেই পাওয়া যায়। তবে কীর্তন আদতে সব থেকে আদি ফর্ম অব মিউজিক, এখন অনেকেই বলতে পারেন, কীর্তন তো বৈষ্ণব মতের গান কিংবা অনেক বাঙালি আবার কীর্তন কে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন কিংবা ওনার সাথে জড়িয়ে ফেলেন। কারণ আমাদের এদিকে আমরা কীর্তন হিসেবে যা জানি বা শুনি তা হলো নাম কীর্তন, “হরি বল, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ” এই ধবনি গুলো বা নাম গুলো সুরের সাথে গাওয়া হয় বলে নাম কীর্তন বলে আর বাঙালিরাও একে কীর্তনের আদি রুপ হিসেবে ধরে নেয়। লীলা কীর্তন এ যদিও কীর্তন এর ছিটে ফোটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নাম কীর্তন কিংবা লীলা কীর্তন বৈষ্ণব মতের, আসলে কীর্তন কিংবা কীর্তনের বৈদিক শেকড় কী?

ছবিঃ গোপাল চন্দ্র ত্রিবেদী [ ত্রিবেদী গুপু ]

কীর্তন আসলে একক কোনো ফর্ম অব মিউজিক বলে আমি মনে করি না,

কিংবা এই নাম কীর্তন কি আসলেই কীর্তন?

আমরা যদি একটু ওইকিপিডিয়া থেকে দেখি

*কীর্তন (সংস্কৃত: कीर्तन) সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ ধারণা বা গল্পের বর্ণনা করা, আবৃত্তি করা, বর্ণনা করা,[১][২] বিশেষ করে ভারতীয় ধর্মে। এটি ধর্মীয় সাধন ভান ধারাকেও বোঝায়, যা আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় ধারণার বর্ণনা বা ভাগ করা আবৃত্তির সঙ্গীত রূপকে বোঝায়।[১] মূলত কীর্তন হলো কোন দেব-দেবীর নাম, গুণাবলী বা কীর্তিকাহিনী সম্বন্ধিত গান। প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দম, কীর্তন গানের প্রকৃত উৎস।

বৈদিক অনুকীর্তন ঐতিহ্যের শিকড় সমেত, কীর্তন হল কল-এন্ড-রেসপন্স স্টাইলের গান বা জপ, সঙ্গীতে সেট করা, যেখানে একাধিক গায়ক কিংবদন্তি আবৃত্তি বা বর্ণনা করে, অথবা কোন দেবতার প্রতি প্রেমপূর্ণ ভক্তি প্রকাশ করে, অথবা আধ্যাত্মিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করে।[৩] এর মধ্যে গায়ক কর্তৃক নাচ বা সরাসরি ভাব (আবেগপ্রবণ অবস্থা) অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।[৩] অনেক কীর্তন পরিবেশনা শ্রোতাদের যুক্ত করার জন্য তৈরি করা হয় যেখানে তারা হয় জপটি পুনরাবৃত্তি করে,[৪] অথবা গায়কের ডাকে সাড়া দেয়।[৫][৬][৭]*

এখন বৈষ্ণব মত এসেছে উপনিষদ ও পুরাণ থেকে। বৈষ্ণব মত যেমন কীর্তনের জন্য তৈরি করে নিয়েছে তার নিজস্ব ধারা ঠিক তেমনি কীর্তন আজো কীর্তনরুপেই আছে।
হাবেলি সঙ্গীত, ভজন, কীর্তন এগুলো একেক্টা অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আমরা জানি ভারতের দক্ষিণ থেকেই শুরু হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চল, এবং সেখানে “অন্ধ্রপ্রদেশে, ১৪ শতাব্দীর রহস্যময়ী তাল্লাপাকা অন্নমাচার্যের রচনাগুলি, সংকীর্তন নামক প্রাচীনতম সংগীতকে উপস্থাপন করে। তিনি তিরুমালার সাত পাহাড়ের দেবতা লর্ড ভেঙ্কটেশ্বরের প্রশংসায় লিখেছিলেন, যেখানে তিরুমালা ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে বারো শতাব্দী ধরে অটুট পূজা দেওয়া হয়ে আসছে।”

“অন্নমচার্য ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের তরবারির অবতার বলে বিশ্বাস করা হয়।[৪০] তাঁর দীর্ঘ ও প্রফুল্ল কর্মজীবনে, তিনি ৩২,০০০ সংকীর্তন এবং ১২ শতক (শত শ্লোকের সেট) রচনা ও গেয়েছেন। তাঁর কাজগুলি তেলুগু এবং সংস্কৃত ভাষায় ছিল।”

আমার মতে যা কিছু ইশ্বরের গুণ কিংবা বর্ণনা, সুর দিয়্‌ দলীয় ভাবে উপস্থাপিত হয় তাই কীর্তন।

এবার যদি একটু নাদ নিয়ে জানার ইচ্ছে হয় এটুকু পড়ে দেখতে পারেন :

“নাদ”
[নাদ অভিধান]

সাধারণ অর্থে- নাদ শব্দ বা ধ্বনির সমার্থক শব্দ। রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ √ নদ্ (অব্যক্ত ধ্বনি) + অ (ঘঞ্), ভাববাচ্য}। অব্যক্ত ধ্বনি হলো- যা কোনো বিশেষ ভাবকে ব্যক্ত করে না। মূলত ধ্বনি মাত্রেই অর্থহীন। মানুষ অর্থহীন বা অব্যক্ত ধ্বনিকে ভাবের সঙ্কেত হিসেবে প্রকাশ করলে, তা অর্থযুক্ত হয়ে যায়। মানুষের ভাষা বা ভাবের বিচারে নাদের সংখ্যা যত, অব্যক্ত নাদের সংখ্যা অনেক বেশি।

প্রাচীন ভারতের ঋষিরা শ্রবণযোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ‘‌নাদ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এঁদের মতে নাদ বা শব্দ দুই ভাবে উৎপন্ন হতে পারে। এর একটি হলো ‘ অনাহত নাদ’, অপরটি ‘আহত নাদ সাধারণভাবে অনাহত নাদের সাথে ব্স্তুর কম্পনজাত কোনো সম্পর্ক নেই। ‘আহত নাদ’ মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের মধ্যে শ্রবণযোগাযোগ স্থাপন করে থাকে। তবে সকল ‘আহত নাদ মানুষ শুনতে পায় না। তাই সকল আহত নাদ শ্রবণযোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না।

প্রাচীন ভারতের ঋষিরা নাদকে শুধু শ্রবণযোগ্য শব্দের মধ্যে আবদ্ধ রাখেন নি। তাঁরা নাদের বৃহত্তর একটি অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। এর ভিতরে ছিল ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে নাদাত্নক স্বরূপ সন্ধান। এঁদের কেউ কেউ একই সাথে সঙ্গীতের আদিম উপাদান হিসেবেও বিবেচনা করেছিলেন।

প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতে এই শব্দ বা শব্দের অনুভবকে নাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীন সঙ্গীত বিষয়ক উল্লেখযযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পাওয়া যায়, খ্রিষ্টীয় ১০০-২০০ শতাব্দীর ভিতরে নারদের রচিত ‘শিক্ষা’ নামক গ্রন্থ ও ২০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পূর্ণাঙ্গ অভিনয় ও নৃত্যগীত বিষয়ক মহৎ গ্রন্থ ‘নাট্যশাস্ত্র’ রচনা করেছিলেন ভরত। ২০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দের অব্দের দিকে পূর্ণাঙ্গ অভিনয় ও নৃত্যগীত বিষয়ক মহৎ গ্রন্থ ‘নাট্যশাস্ত্র’ রচনা করেছিলেন ভরত। উল্লেখিত গ্রন্থ দুটিতে নাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয় নি।

৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মতঙ্গ রচিত ‘বৃহদ্দেশী’ গ্রন্থে নাদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থমতে-

‘নাদ ভিন্ন গীত সম্পাদিত হয় না, নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়। নাদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে নৃত্ত অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সবদিক থেকে থেকেই এই জগৎ নাদাত্মকরূপে প্রতিভাত হয়। ব্রহ্মা নাদরূপ স্মৃত হন, জনার্দন নাদ স্বরূপ, পরাশক্তি নাদরূপা, মহেশ্বরও নাদরূপ।…নাদ থেকে বিন্দু হয় এবং নাদ থেকেই সব কিছু বাঙ‌ময় হয়ে ওঠে।’

বৃহদ্দেশীর এই বিবরণে নাদকে বিমূর্ত শক্তি রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। যখন নাদ গীতের স্বরনির্ণয়ের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখন তা শব্দশক্তি। আর যখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, পরমব্রহ্ম, মহাদেব নাদরূপী তখন তা হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক ভাবনায় দৈবশক্তি।

আধুনিক শব্দবিজ্ঞানের মতে বস্তু কম্পিত হলে, শক্তির প্রকাশ ঘটে। এই শক্তির দ্বারা সৃষ্ট তরঙ্গরূপ ধ্বনি রূপে প্রকাশিত হয়। বস্তু যদি তার অভ্যন্তরীণ শক্তির দ্বারা আপনা-আপনি কম্পিত হতে থাকে এবং এর দ্বারা ধ্বনি তৈরি হয়, তাহলে তা হবে অনাহত নাদ। সনাতন হিন্দুধর্মে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর যখন শক্তিরূপে বিরাজ করেন অনাহত নাদ পর্যায়ে। সাধক যোগমার্গে এই নাদ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যা অনুভব করেন, তা আহত নাদ। ধ্যানের মধ্য দিয়ে অনাহত নাদ যোগী শোনেন কিন্তু অন্যকে শোনাতে পারেন না। অনাহত নাদ যোগী অনুভব করতে পারেন, কিন্তু মনোরঞ্জনের জন্য তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন না। আবার মানুষের চেতনার ভিতরে অনাহত নাদের উদ্ভব হতে পারে। বৃহদ্দেশীতে মতঙ্গ বলেছেন- নদন ক্রিয়া থেকে নাদ শব্দের সৃষ্টি’। তাঁর মতে নাদ পাঁচ প্রকার। রকার।

১. সূক্ষ্ম: এই গুহাবাসী। অর্থাৎ চৈতন্যের গভীরে এর অবস্থান।
২. অতিসূক্ষ্ম: এর অবস্থান হৃদয়ে। অর্থাৎ মনোলোকে এই নাদ অবস্থান করে।
৩. ব্যক্ত: এই নাদের অবস্থান কণ্ঠদেশে। এই নাদ কণ্ঠ দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং তা মানুষের শ্রবণের যোগ্য। এই নাদের দ্বারা মানুষ ব্যক্তি মাত্রেই অন্যের কাছের তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে এবং অন্যের মনোভাব অনুভব করতে পারে।
৪. অব্যক্ত: এর অবস্থান তালুতে। এই নাদ মনের গভীরে চৈতন্যের দ্বারা অবস্থান করে। বাণীর ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, বাক্‌যন্ত্রের সাহায্যে তা প্রকাশ করা যায় না।
৫. কৃত্রিম: এর অবস্থান মুখদেশে। এই নাদ মুখ থেকে বাণীরূপে প্রকাশিত হয়।

আধুনিক সঙ্গীতের ধারায় নাদকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো- অনাহত নাদ ও আহত নাদ।”

কীর্তনে বহু বহু বহু রেয়ার কিংবা দুষ্প্রাপ্য রাগের প্রচলন ছিলো, নিদ্রামোহিনী কিংবা নিদ্রামোহনী মাল্গুঞ্জি তেমনি একটি রাগ। এই রাগ নিয়ে আরো পরে কথা বলা যাবে।
যেহেতু সামবেদ থেকে সঙ্গীত এসেছে ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এসছে, ধ্রুপদ কিন্তু নাদ ব্রহ্মের গান, তাই বলা যায় আদিকালের কীর্তন, ভজন , হাবেলি সঙ্গীত ও ধ্রুপদের থেকেও কীর্তন পুরোনো, যেহেতু কীর্তন মানে সুরের সহিত বর্ণনা করা ( উপরে বিস্তারিত সংজ্ঞা দেয়া), সাম্বেদ কিংবা মন্দিরে যে ইশ্বরের গুণের বর্ণনা করা হত, বা স্তব স্তুতি, স্তোত্র হত তা আদতে কীর্তনই।

শুরুর দিকে এতো ফরমেটেড ওয়ে তে গাওয়া হতো না, ধীরে ধীরে এই সর্বজনীন কীর্তন ভেঙে হাবেলি সঙ্গীত, ধ্রুপদ, ভজন এলো।মানুষ একক হয়ে যাওয়া শুরু করলো, কীর্তন এর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ “দল” তবে একক ভাবে যে কীর্তন গাওয়া যাবে না এটাও আমি মানি না( একান্তই আমার মতামত) দক্ষিণ ভারত যে কতটা সমৃদ্ধ ছিলো এবং আজো সমৃদ্ধ আছে সঙ্গীত ও নাট্যের দিক দিয়ে, নৃত্যের দিক দিয়ে তা সত্যি ঈর্ষণীয়, আবারো বলি দক্ষিণ থেকেই আস্তে আস্তে নর্থ এ আসে সঙ্গীত এখানে যে চল ছিলো না তা না, তবে বর্তমানে যেমন সমৃদ্ধ কিংবা ঐ সময়ে সমৃদ্ধ ছিলো না। আভাং নিয়েও বলতে হয় এখন তবে লেখা টা অতি দীর্ঘ হয়ে যাবে।

এই কীর্তন আর নাট্য শাস্ত্রের যে যোগ আছে তা নিয়ে সামনে আরেকদিন বলা যাবে। সুতরাং কীর্তন নিয়ে যে একটা লোক ধারণা ছিলো আপনার মনে , ঝেড়ে ফেলুন।
কোনো কিছু যোগ করার কিংবা ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন। ধন্যবাদ।

কীর্তন – উইকিপিডিয়া (wikipedia.org)

অনুশীলন, অভিধান, বাংলা পাঠ্য-ভাষাংশ এবং সহায়ক বিশ্বকোষ কার্যক্রম (onushilon.org)

বহিরাগত সকল তথ্য শুধু এই দু জায়গা থেকে নেয়া, বাকি সব আমার গুরুজি, নাট্যগুরু মামুনুর রশিদ ওনাদের সাথে আলোচনার ফলশ্রুত

[ ত্রিবেদী স্যারের এই ছবিটা ভালো লাগলো তাই ফেসবুক থেকে নিয়ে ব্যবহার করলাম। এটা ওনার করা কাজ “রাগ বসন্ত-বাহার” ]