মুক্তমনা পরিবার সাংবাদিক জীবন আহমেদকে বারবার কৃতজ্ঞতা জানাবে। জীবন আহমেদ রক্ত মগজ মাখা অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে শুধু ছবি তুলেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করেননি, তিনি একজন সুস্থ ও আদর্শ মানুষের দায়িত্বও পালন করেছিলেন।

 

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পর নয় বছর পেরিয়ে গেছে। ২৬শে ফেব্রুরারি ২০১৫, সন্ধ্যায় অভিজিৎ রায় মৌলবাদীদের হাতে খুন হয়ে যায় । তাঁর প্রিয় সাথী, স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকেও খুন করার উদ্দেশ্যে মাথা, হাত ও অন্যান্য যায়গায় চাপাতির আঘাত করা হয়।

 

সাংবাদিক জীবন আহমেদের জীবনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি ফেসবুকে বিভিন্ন সময় তিনি লিখেছেন। সেইসব লেখা থেকে তিনটি এখানে তুলে দেওয়া হলো যেগুলো নিজেই কথা বলবে।

 

[দুইখানি ছবি রয়েছে এখানে। প্রথমটি জীবন আহমেদের তোলা এবং পরেরটি সৈয়দ মাহমুদুর রহমানের তোলা।]

 

 

Avijit Roy Murder. February 26, 2015. Photo by: @Jibon Ahmed

 

 

Avijit Roy Murder. February 26, 2015. Photo by: @Syed Mahamudur Rahman

ফেসবুক পোস্ট, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৯, জীবন আহমেদ ((Jibon Ahmed)

 

আমার সাংবাদিকতার মূল্যবোধ

 

আমি অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ! কিন্তু আমার দেশের প্রতি আমার দ্বায়বদ্ধতা বিশাল! আমার নেশা পেশা এবং ভালোবাসা সবই ছবি তোলাকে ঘিরে! বহমান সময়কে ফ্রেমে আবদ্ধ করে দেয়াতেই আমার একমাত্র স্বার্থকতা! আমার জীবন যুদ্ধে আমার ক্যামেরাই আমার এক মাত্র অস্ত্র! এই অস্ত্র দিয়েই সত্যের গুলি ফুটাতে চেয়েছিলাম অসত্যের বুকে! যখন যেখানে অন্যায়ের কালো হাত থাবা মেরেছে, যেখানে নিপিড়ন হয়েছে, অত্যাচার, অবিচার, রক্ত ঝরেছে আমি আমার অস্ত্র উচিয়ে ধরেছি জীবনের পরোয়া না করে! আমি সত্যকে বড় ভালোবাসি! সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরতে এক হাতে আমার কলিজা আরেক হাতে আমার অস্ত্র একের পর এক গুলি ছুড়েছি অন্ধকারের দিকে!

 

সাংবাদিকতার পেশায় আসার পর প্রথম যে ঘটনাটি আমার জীবন বদলে দিয়েছিল এখনো মাঝে মধ্যেই সেই সময়টা ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠে। হঠাৎ মাঝ রাতে যখন ভয়ে ঘুমটা ভেঙে যায় তখন ভাবি কি দেখছি চোখের সামনে? আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারি না। এখনো মনে হয় একটা জীবিত মানুষের মাথার গরম মগজ আমার হাতের তালুতে বেরিয়ে আসছে। তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। এ রকম নির্মম দৃশ্য এর আগে আমি কখনো দেখিনি।

 

ওই ঘটনার পর অনেক যুদ্ধ করেছি একা। কেউ সাথে ছিল না তখন। সবাই দূরে চলে গিয়েছিল, সেই সময়ই আমি বুঝে গেছি এই শহরে বিপদে পড়লে কেউ পাশে থাকে না। সেই স্মৃতি কখনো ভুলবো না, তা ভোলার না।

 

চার বছর আগে আজকের দিনে (২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) রাত ৮টা ৩০ মিনিট। তখন আমি ফটো এজেন্সি বাংলার চোখে কাজ করি। প্রতিষ্ঠানের হয়ে সেদিন বইমেলা কভার করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসি। কাজ শেষে টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের ভেতরে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ এক নারীর আর্ত চিৎকার আমার সমস্ত মনযোগ আকর্ষণ করে। গ্রিলের ফাক দিয়ে দেখতে পাই একটি মোটরসাইকেল রাস্তার উপর পড়ে আছে। তার উপর এক নারী পড়ে আছে, তার মাথা মাটিতে। ওই ঘটনা দেখার সাথে সাথেই আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। উদ্যানের মূল ফটক থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে দেখি চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে আছে। ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই দেখতে পাই লাল পাঞ্জাবী পরিহিত আরেকজন পুরুষ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন ফুটপাতের উপরে। তার মাথার দিক থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে। তখন আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আশপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম তারা নিশ্চুপ হয়ে সব দেখছেন। কিন্তু কেউ সাহায্যের জন্য সাহস দেখিয়ে এগিয়ে আসছেন না। মেলার দায়িত্বরত কয়েকজন পুলিশ সদস্যও সেখানে ছিলেন, কিন্তু তারাও ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়।

 

আমি সাহস করে রাস্তায় পড়ে থাকা ওই নারীর দিকে এগিয়ে যাই। তাকে কাধে হাত দিয়ে কয়েকবার ধাক্কা দেই উঠার জন্য। কিন্তু তিনি অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন। কয়েকবার ধাক্কা দেয়ার পর তিনি সাড়া দেন। তবে তিনি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন, ভাবছিলেন আমিই আক্রমণকারী।

 

ওই নারীর কপালে আঘাত লাগায় সেখান থেকে রক্ত বের হয়ে দুই চোখের কোনায় পড়ছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে আমি একটু পেছনের দিকে সরে আসি। সেই ভয়ঙ্কার চাহনি আজও আমি ভুলতে পারিনি। এক পর্যায়ে ওই নারী উঠে আমাকে জিজ্ঞেস করে এখানে কি হয়েছে? তখন আমি তাকে আঙ্গুল দিয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকা লোকটিকে দেখিয়ে দেই। তখন ওই নারী ‘অভি’ বলে চিৎকার দিয়ে ওই লোকটাকে জড়িয়ে ধরে। বলতে থাকে- ‘অভি উঠো, তোমার কিছু হবেনা। এই অভি উঠো।’ এক পর্যায়ে সে দাড়িয়ে হাত নেড়ে সাহায্যের জন্য আশপাশে জড়ো হয়ে থাকা মানুষদের ডাকতে থাকে। ওই নারী যখন সবার কাছে সাহায্য চাইছিলেন তখন মানুষগুলো পিছনে সরে যাচ্ছিল। ওই মুহূর্তে আমি ক্যামেরা বের করে রক্তাক্ত ওই দম্পতির ছবি তুলি। কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে না আসায় আমিই ভীড় ঠেলে বাইরে বের হয়ে যাই সিএনজি ডাকার জন্য। সিএনজি নিয়ে আসার পর দুই একজনের সহযোগীতায় তাদের সিএনজিতে তুলে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের দিকে রওনা হই।

 

তাদের যখন হাসপাতালে নিয়ে যাই তখন সিএনজির ভেতরে বন্যা তার স্বামীর শরীর জড়িয়ে বসেছিল। আর অভিজিতের মাথাটা ধরে বসেছিলাম আমি। হঠাত অনুভব করি চাপাতির আঘাতে কেটে যাওয়া মাথা থেকে মগজ বের হয়ে আমার হাতের তালুতে লাগে। তখন হাত সরিয়ে মাথা থেকে বেরিয়ে আসা মগজ ভেতরে ঠেলে দেই।

অভিজিতের মাথা থেকে রক্ত বের হয়ে ততক্ষণে আমার সারা শরীর ভিজে গিয়েছে। আমি আগে জানতাম না মানুষের রক্ত এত উষ্ণ থাকে, আমি এখনো সেই উত্তাপ অনুভব করি।

 

ঘটনাস্থল থেকে সিএনজি হাসপাতালের দিকে যাবার সময় বন্যা ভয় পেয়ে ভাবছিলো আমি তাদেরকে আটকে বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছি। সে আমাকে বলছিলো তাদেরকে ছেড়ে দিতে, বিনিময়ে যত টাকা লাগে দিবে। আমি ক্যামেরাটা উচু করে ধরে বার বার বলতে থাকি আমি ফটো সাংবাদিক আমি আক্রমনকারী না। কিন্তু সে আমাকে বিশ্বাস করছিলো না।

 

যাওয়ার পথে পুলিশ চেক পোস্টের কাছে রাস্তা জ্যাম হয়ে গেলে গাড়ি থেমে যায়। পুলিশ দেখা মাত্র বন্যা চিৎকার করে সাহায্য চাইছিলো এবং বলছিলো আমি তাদেরকে আটক করেছি। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে আমাকে এবার পুলিশের লাঞ্চনার শিকার হতে হবে। হঠাত দেখলাম যে, আমাদের পিছন পিছন একটা মোটরসাইকেলে পুলিশ আসছিলেন, যিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন এবং শুরু থেকে সব দেখেছেন। তার ইশারায় চেক পোস্ট খুলে দেয়া হলো এবং তাদেরকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে গেলাম।

 

ঢাকা মেডিকেলে আসার পর জরুরী বিভাগে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। তখন আমার ফটো সাংবাদিক বন্ধুরা আমাকে কল করে বলে আমার এই ঘটনায় জড়ানো উচিত হয়নি। আমার কাজ ছবি তোলা, আমি কেন ঝামেলায় জড়াতে গেলাম। তাদের কথা শুনে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও তাদের জবাব দিয়েছিলাম যে আমার প্রথম দায়িত্ব ছিল ছবি তোলা, সেটা আমি করেছি। তারপর আমি যে সাংবাদিক সেটা ভুলে গিয়ে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছিলাম।

 

হাসপাতালে রক্ত মাখা টি-শার্ট পরিস্কার করে সেদিন মতিঝিলে আমার অফিসে ফিরে আসে। অফিসে এসেই টিভিতে দেখতে পাই তারা দুজন অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদ, যাদের আমি আগে চিনতাম না। অফিসের বস আমাকে দূরে কোথাও কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে বলেন। কিন্তু আমি তাতে রাজি না হয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসি। ততক্ষণে আমার তোলা ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। সেখানে শত শত কমেন্ট আসছে, কেন আমি তাদেরকে সাহায্য না করে ছবি তুলছিলাম। টিভির টকশোতেও আমাকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হলো। এরমধ্যে পুলিশ আমাকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করলো।

 

অফিসের চাপে আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলাম। তারা বললো আমার কোন দায়ভার তারা নিতে রাজী না। বন্যা সুস্থ হওয়ার পর অভিজিত হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নিশ্চিত করলেন যে ঘটনার সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই, আমি সেদিন তাদের উদ্ধার করেছিলাম। এরপর থেকে প্রশাসনের কেউ আমার সাথে আর ওই বিষয়ে যোগাযোগ করেননি।

 

ওই ঘটনার পর ছবির মাধ্যমে সত্যকে তুলে ধরায় আরো অসংখ্যবার আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। গেল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, দিনটি ছিল ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮। অন ডিউটিতে ছিলাম। খবর পেলাম মিরপুর-১০ এ ককটেল বিস্ফোরণ। ছুটে গেলাম। ছবি তুললাম। অন্যান্য চ্যানেলের সহকর্মীরাও যে যার ডিউটিতে। একজন এসে বাঁধা দিলেন। ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে চাইলেন। কিন্তু আমি দিলাম না। আমার শক্ত হাতে আমার শক্তির এক মাত্র উৎসকে রক্ষা করতে চাইলাম। আমারে ধরে নিয়ে যাওয়া হল একটা জায়গায়। বদ্ধ জায়গায়। আবার ধস্তাধস্তি ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার। আমার হাত আরো শক্ত করে ধরল ক্যামেরা। এর পর শুরু হল একের পর এক আঘাত। হাতের উপর শক্ত লাঠি দিয়ে পিটানো হল। ৪০/৫০ জন মানুষ মারতে থাকল একের পর এক। চোখে আঘাত করল, ভেবেছিলাম অন্ধ হয়ে যাব। চোখে রক্ত জমে গেল! ভেবেছিলাম মেরে ফেলবে আমায়৷ কিন্তু আমাকে ধরে আনার সময় আশে পাশে লোকজন দেখে ফেলেছে, তাই মেরে ফেলাটা উচিত হবে না বলে ওরা আমায় জানে মারল না। আমি ছবি তুলি, ছবিতে রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত দৃশ্য ছাপে। তবে কি আমিও কখনো ক্ষত বিক্ষত ছবি হয়ে ছেপে যাব পত্রিকার পাতায় ????

 

যাই হোক, এর আগে ওই বছরেই কোন দিন ইজতেমা মাঠে ছোট ছোট শিশুদের মাদ্রাসা থেকে ধরে এনে ছেড়ে দেয়া হয় দুদলের সংঘর্ষের মধ্যে। এই রকম ছোট্ট একটি শিশু সংঘর্ষের ভিতর থেকে ছুটে এসে পুলিশকে জাপটে ধরে বাঁচার আকুতি জানায়। এমন দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার পর আমার সেই ছবিটি ভাইরাল হলে তা নিয়ে আলোচনা সমলাচনা শুরু হয়।

 

কাজ করলে তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হবেই। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে মনোনয়নপত্র বিতরণের সময় বিএনপির কর্মীদের পুলিশের গাড়ি ভাংচুর, ম্যাচের কাঠি দিয়ে পুলিশের গাড়িতে আগুন, গাড়ির উপরে লাফিয়ে গাড়ি ভাঙ্গার দৃশ্য এবং বিএনপি নেত্রীর দগ্ধ গাড়ির সামনে সেল্ফি তোলার বেশ কিছু ছবি তুলি যা বেশ সমালোচনার ঝড় তুলেছিল।

 

তার আগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবিতে আন্দোলনের সময় শাহবাগের রাজপথে চার পাঁচজন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে আন্দোলন কারীর ঘুমন্ত অবস্থার দৃশ্য, মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। আন্দলনকারীরা রাস্তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

 

টিএসসির বর্ষা মঙ্গল কাব্য রচনা! আহা! কি সুন্দর! এক জোড়া ভালোবাসাময় যুগল চুম্বনরত ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে, ঠোঁটে ঠোঁটে এরা প্রম বিলোয় ভর দুপুরে! এমন দৃশ্য কি ধারন না করলে চলে? এমন দৃশ্য কি সবার মাঝে না বিলিয়ে দিলে চলে? এই ভালোবাসা ছড়িয়ে গেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে! এর পরের ঘটনাও কারো অজানা নয়! এক দল নোংড়া লোক নিন্দা ছড়াতে লাগল, আরেকদল চটে গেল, আমার চাকরি চলে গেল! কিছু মানুষ সহমর্মিতা জানানোর বদলে বিপক্ষে গিয়ে দাড়ালো! মারধর করল! অপমান অপদস্থ লাঞ্চনা সয়ে গেলাম দিনের পর দিন। কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী প্রবলভাবে সাহস আর ভালোবাসা দিয়ে গেলেন৷ তাদের কাছে আমি ঋনী।

 

এরপর আবার ঘুরে দাড়ালাম। মানবজমিনে চাকরি হলো! ক্যামেরা নিয়ে আবার ছুটলাম সত্যের পিছু! লোভ লালসা বিসর্জন দিয়ে অস্ত্র হাতে ছুটলাম। মানুষেরা বলল জীবন সাবধান। পেশার চেয়েও নিজের জীবন বড়। জীবনকে ভালোবাসো৷ কিন্তু আমিতো সত্যকে ভালোবাসি। ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম, একের পর এক ছবি সমালোচনার ঝড়।

কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তানজিন স্যারকে ছাত্রলীগ কর্মীদের লাঞ্চনার দৃশ্য তুলে আনলাম৷ পাছে সবাই বলতে লাগল এত সাহস ভালো নয়, সব কিছু নিয়ে ঘাটতে নেই। আমি শুনিনি। আমি ছাপিয়ে দিলাম সত্যকে! এর পর হুমকি একের পর এক সয়ে গেলাম।

 

আমাদের প্রথম পরিচয়, আমরা সংবাদকর্মী। তারপরও আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যে আছে মনুষত্ববোধ, মানুষের প্রতি অবাধ ভালবাসা। পেশাগত দায়িত্ব পালণ করতে গিয়ে আমরা অনেকে অনেক ঘটনার সম্মুক্ষিন হই। কোন কোন সময় জীবন বাজী রেখে কাজ করতে হয় আমাদের। মানবিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে অনেক সময় অনেক কিছু করতে ইচ্ছে হলেও করতে পারিনা। কারণ আমাদেরও কিছু নীতি নৈতিকতা আছে। তারপরও মানুষ আমাদের ভুল বোঝে।

 

সেদিন আমি মানবতার জায়গা থেকেই রক্তাক্ত ওই দম্পতিকে সাহায্য করেছিলাম। আমি চাইলেই পারতাম ঘটনার ছবি তুলে সেখান থেকে চলে আসতে। কিন্তু আমার বিবেক তাতে সায় দেয়নি। সে কে আমি জানার প্রয়োজন বোধ করিনি। একজন মানুষ হিসেবে আমার মনে হয়েছে তাদের সাহায্য করা প্রয়োজন তাই করেছি।

 

ঢাকার রাজপথে অভিজিতের মতো অনেকেই মরে পড়ে থাকেন। কেউ ফিরেও তাকায় না। সেখান থেকেই বোঝা যায় আসলে আমাদের মনুষত্ব বোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা কোন জায়গায় গিয়ে দাড়িয়েছে।

 

লেখক- ফটো সাংবাদিক, মানবজমিন

 

২।

 

ফেসবুক পোস্ট, ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, জীবন আহমেদ ((Jibon Ahmed)

 

আমার দেখা সন্তান হারা একজন অজয় স্যার!

 

কেউ যদি কখনো প্রশ্ন করে- জীবন ভাল মানুষ দেখতে কেমন হয়? তখন আমার চোখের সামনে সবার আগে যে মুখটি ভেসে উঠবে, তিনি হলেন অধ্যাপক অজয় রায়। জীবিত অবস্থায় তাকে সন্তানের লাশটি নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিল, এটা যে কতটা কঠিন ও কষ্টকর তা শুধু একজন বাবাই বলতে পারবেন।

 

মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে সরব কণ্ঠ অধ্যাপক অজয় রায়। তিনি এতটা দৃঢ়চেতা ও অদম্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, যে এই বাবা মৌলবাদীদের চাপাতির কোপে প্রাণ হারানো ছেলের লাশের সামনে বলেছিলেন, আই অ্যাম প্রাউড অব মাই সান!

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী অজয় রায়। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন রাজপথে। পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়ে তিনি বাঙালির পরিচয় জনগণকে জানাতে বই পর্যন্ত লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ, তার মতো আর কজন করেছেন আমার জানা নেই। শিক্ষক রাজনীতির নেতা ছিলেন সেই স্বাধীনতা পূর্বেই। বিজ্ঞান ও যুক্তির চর্চায় সংগঠন করেছেন অসংখ্য। শিক্ষার আন্দোলনে তিনি সর্বাগ্রে। অথচ যুদ্ধ করে যে দেশ তিনি স্বাধীন করেছেন, সে দেশেই তার সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

 

মানুষটির খুব কাছে না গেলে হয়তো জানতাম না ভাল মানুষ দেখতে কেমন হয়। তার সাথে আমার যতবার দেখা হতো, বলতেন- জীবন বেঁচে থাকবে মাথা উচু করে। কোনোদিন অন্যায়ের সাথে আপস করো না। নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে মানুষের জন্য কাজ করো।

 

অজয় স্যারের বাসায় প্রথম যেদিন ডাকলেন আমি খুব অবাক হলাম! তিনি বললেন- জীবন আসার সময় অভিজিতের মৃত্যুর সময় তোমার তোলা ছবিগুলো নিয়ে এসো। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তাকে বললাম- স্যার এই ছবিগুলো আপনি দেখতে পারবেন না। আপনার দেখা ঠিক হবে না, সমস্যা হতে পারে। জবাবে স্যার বললেন- তুমি চিন্তা করো না। আমি যখন আমার সন্তানের লাশ কাঁধে বহন করতে পেরেছি, তুমি দেখে নিও ওই ছবিগুলোও আমি দেখে সহ্য করতে পারবো। তুমি নিয়ে আসো।

 

সন্তান হারানো একজন বাবা সেদিন আমাকে বলেছিলেন- জীবন তুমি কি চাও? আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি, শুধু মনে মনে বলেছিলাম-আপনার সন্তানের রক্ত মাখা ছবি দেখিয়ে ব্যবসা আমি করবো না। সত্যি বলছি স্যার আপনার পরিবারের কাছে আমার কখনো কিছুই চাওয়ার নেই। আপনারা আমাকে যে ভালবাসা দিয়েছেন তা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি জীবন এখনো এই শহরে বেঁচে আছি শুধুমাত্র আপনাদের জন্য। স্যার আপনার পরিবার আমার পাশে না থাকলে হয়তো আমি আমার পরাজয় স্বীকার করে এই শহর ছেড়ে চলে যেতাম। আমি যতোবারই বিপদে পড়েছি ততোবারই ছায়ার মতো আগলে রাখেছেন আমাকে। আমি এখনো বিশ্বাস করি আপনার পরিবার আমার পাশে সারা জীবন থাকবে। যেখানেই আছেন ভাল থাকবেন স্যার। আপনার আশির্বাদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

 

জীবিত অবস্থায় আপনি ছেলের খুনিদের বিচার দেখে যেতে পারেননি। জানি না আমরাও অভিজিৎ হত্যার বিচার দেখে যেতে পারবো কিনা! তবে মনে প্রাণে দোয়া করি, যত দ্রুত সম্ভব এই বিচারটা হোক। আপনার আত্মা শান্তি পাক, স্থাপন হোক ন্যায় বিচার ও মানবতার দৃষ্টান্ত।

 

৩।

 

ফেসবুক পোস্ট, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৯, জীবন আহমেদ ((Jibon Ahmed)

 

আদালতের কাঠগড়ায়

আজ জীবনে প্রথম বারের মতো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ৩০ মিনিট। কিছুটা ভয়ও ছিলো কারণ মামলাটি সাধারণ নয়, অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার সাক্ষী হিসাবে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। অথচ পাঁচ বছর পর জানলাম এই মামলার সাক্ষী দিতে আদালতে যেতে হবে আমাকে তাও মেনে নিলাম যদি বিচার হয় এই আশায়। এই রাষ্ট্র কখনো কারো নিরাপত্তা দেয় না যদি দিতো তাহলে হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে অভিজিৎ রায়ের মত মানুষ নিজের স্বদেশে প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকত না। এমন কি এই রাষ্ট্র আমারও নিরাপত্তা দিবে না তা আমি জানি, আমাকেও হয়তো অভিজিৎ রায়ের মত চাপাতির আঘাতে রাস্তার ফুটপাতে পরে থাকতে হবে । ২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০১৫’র পর থেকে অনেক বার ডিবি থেকে শুরু করে এফবিআইও ডেকেছিলো। সব কিছু একাই সামলে নিয়েছি, একটুও ভয় পাইনি কারণ আমি জানি আমি কোন পাপ করিনি। ওই সময়টা দেখেছি প্রিয় মানুষগুলোকে দুরে সরে যেতে, তার পরেও একটুও থেমে যাইনি, আমি যা করছি তা হচ্ছে পেশাগত দায়িত্ব পালন আর পাশাপাশি একজন মানুষ হিসাবে কাজটা করার দরকার তাই, আর কিছুই না। একজন মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি এটা আমার জীবনের সব থেকে বড় অর্জন। তবুও প্রতিনিয়ত একটা ভয় আমাকে তাড়া করে। কিসের ভয় তা আজও অজানা। এই ঘটনার শুরু থেকে চেয়েছিলাম মুহুর্তটা ভুলে থাকতে কিন্তু তা আর হয় না। বহু ঘটনাবহুল জীবন আমার, সব কিছু হাসি মুখে মেনে নিয়েছি শুধুমাত্র একটু ভাল থাকার আশায়। অভিজিৎ রায়ের ওই ঘটনার পর আজও মাঝ রাতে ভয়ে চমকে উঠি, রক্ত মাখা দুইটা চোখ আমার দিকে এগিয়ে আসে। ভয়ংকর মানসিক ট্রমার মধ্যে রাতগুলো কেটে যায় আজও। যদি কেউ জানতে চায় আমি কেমন আছি… এক কথায় সহজ উত্তর- মহাসুখে আছি, একজন সুখি মানুষ যে ভাবে বাঁচে আমিও তেমন বেঁচে আছি ওই সুখি মানুষগুলোর মতো।