ইভান পাভলভ একবার একটি পরীক্ষা করেছিলেন কুকুরের ওপর। তিনি কুকুরকে খাবার দেয়ার পূর্বে প্রতিদিন ঘন্টা বাজাতেন। যখনই কুকুরের সামনে পশুর হাড় রাখা হতো, কুকুরের মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হতো। কিন্তু প্রতিদিন খাবার প্রদান করার পূর্বে ঘন্টা বাজাতে বাজাতে একটা সময়, ঘন্টার আওয়াজ শুনলেই কুকুরের মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হয়, খাবারের স্টিমুলেশন প্রয়োজন হয় না। এটাকে বলে “কন্ডিশন রিফ্লেক্স”।

 

১৯২০ সালে হপকিন্স ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী জন.বি ওয়াটসন শিশুদের ওপর “Little Elbert Experiment” নামক বিখ্যাত একটি এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করেছিলেন। তিনি একটি শিশুর সামনে বিভিন্ন অবজেক্ট রেখে, তার মস্তিষ্ক স্টিমুলেট করার চেষ্টা করেন। তিনি দেখতে চান, কোন বস্তুর উপস্থিতিতে শিশুটির প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। তারপর তিনি শিশুটির সামনে একটি সাদা ইঁদুর রাখলেন। প্রথমে ইঁদুরটিকে দেখে শিশুটির মস্তিষ্কে কোনো ভয়ই কাজ করছিল না। এলবার্ট ইঁদুর নিয়ে মনের আনন্দে খেলছিল। আকস্মিক ওয়াটসন পেছন থেকে একটি হ্যামার দিয়ে জোরে জোরে স্টিল বারে আঘাত করলেন। শিশুটি কিছুটা আতঙ্কিত হলো। এই ঘটনার পর থেকে শিশুটির সামনে সাদা ইঁদুর উপস্থাপন করার পরপরই, তিনি পেছন দিক থেকে স্টিল বারে আঘাত করতেন। শিশুটি ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠত।

 

একটা সময় শিশুটির মস্তিষ্কে চিরস্থায়ীভাবে ইঁদুরের ভয় সংক্রমিত হয়ে যায়। এখন সাদা ইঁদুর দেখলেই সে অযৌক্তিকভাবে আতঙ্কিত হয়ে কেঁদে ওঠে, কোনো বিশাল হ্যামার দিয়ে স্টিল বারে আঘাত করার দরকার হয় না। ছোটকালে আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন প্রকার থ্রেট ও নির্যাতনের মাধ্যমে আমাদের পরিবার ও সমাজ ভয় সংক্রমণ করে। প্রতিনিয়ত আমাদের হুমকি, ধমকি ও মারধোর করে, তারা আমাদের মস্তিষ্কে একটি মহাজাগতিক সাদা ইঁদুরের প্রতি সেনসেটিভিটি তৈরি করে, আর তিনিই হলেন আল্লাহ বা ঈশ্বর!

 

এ দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বর বিশ্বাস হলো একটি “কন্ডিশন রিফ্লেক্স”। এই কন্ডিশন রিফ্লেক্সের মাধ্যমেই সারাবিশ্বের মুসলিমদের মস্তিষ্কে নাস্তিক ও বিধর্মীদের প্রতি আতঙ্ক সংক্রমিত করা হয়। মনে করুন, নাস্তিকরা হলো, এক একটি সাদা ইঁদুর আর আপনি হলেন লিটল এলবার্ট। প্রথম প্রথম নাস্তিকদের আপনার কাছে অন্য আট দশজন সাধারণ মানুষের মতোই ন্যাচারাল মনে হতো। তাদের প্রতি আপনার হিংসা, বিদ্বেষ অথবা ঘৃণা কোনোকিছুই উপস্থিত ছিল না। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে আপনার চারপাশের মসজিদ,মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একটি বিশাল হ্যামার দিয়ে স্টিল বারে আঘাত করতে করতে ঘোষণা করেছিল, নাস্তিক ও বিধর্মীরা ঈশ্বরের চিরশত্রু, তারা কাফের, তারা মুনাফিক এবং তারা জাহান্নামী। ক্রমশ নাস্তিকদের প্রতি আপনার হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা সংক্রমিত হতে শুরু করেছিল। আর আপনি এখন নাস্তিক দেখলেই সাবকনসাসলি কষ্ট পান, আপনার নাস্তিকদের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে অন্ধকার ও ভয়ানক মনে হতে শুরু করে। আপনি কন্ডিশন রিফ্লেক্সের শিকার।

 

নিউরোসায়েন্সে ইমপ্রিন্টিং নামক একটি টার্ম আছে। ইমপ্রিন্টিং কী? বলছি ওয়েট। একটি রাজহাঁসের বাচ্চা জন্মের পর, যেই প্যারেন্ট ফিগার দেখে সেটাকেই তার নিজের মা মনে করে মিসলিড হয়। কিন্তু কেন? কারণ তাদের মস্তিষ্ক খুবই ছোট আর মস্তিষ্কের নেটওয়ার্কের সংখ্যা খুবই কম। এত ছোট একটি মস্তিষ্কের মধ্যে মায়ের সকল ডিটেলস ইনপুট করা সম্ভব ছিল না। ন্যাচার তাই তার মস্তিষ্ক এমনভাবে ডিজাইন করেছিল যে, তোমার সামনে যদি বড়, গোলাকার একটি বস্তু মুভ করে, তাহলে তুমি তাকে অন্ধভাবে ফলো করবে।

 

এখন মনে করুন, শিশুটির জন্মের পর, তার সামনে একটি বিশাল ফুটবল রাখা হলো। ফুটবল তার সামনে গতিশীল। সে এখন এই ফুটবলটিকেই অনুসরণ করতে শুরু করবে, সে ফুটবলকেই তার নিজে মা মনে করে বিভ্রান্ত হবে। জন্মের পর যদি একটি রাজহাঁস সর্বপ্রথম কোনো একজন সায়েন্টিস্ট ফিগার দেখে, তার মাথার মধ্যে সেই ফিগারই ইমপ্রিন্ট হবে এবং সে তাকেই নিজের মা মনে করবে, সায়েন্টিস্ট যেদিকে মুভ করবে, রাজহাঁসটিও ঠিক সেদিকেই মুভ করবে।

 

আপনি যদি তার সামনে জন্মের পর একটি রোবট রাখেন, সে রোবটকেই তার মা মনে করবে এবং তাকেই ফলো করতে শুরু করবে। শুধু তাই নয়, ইন ফিউচার সে রোবটের মতো দেখতে কারও প্রতিই সেক্স ফিল করবে!!

 

একজন মানব শিশুর মস্তিষ্কও একটি রাজহাঁসের বাচ্চার মতো। মানুষের মস্তিষ্ক অনেক বিশাল হলেও, জন্মের পর মানুষের মস্তিষ্কে নিউরাল কানেকশন নেই বলেলই চলে। নিউরাল কানেকশন হলো এক নিউরনের সাথে আর এক নিউরনের সিন্যাপ্টিক সংযোগ। নিউরাল কানেকশনের মধ্যে একজন শিশুর অভিজ্ঞতা ও মেমরি লেখা হয়। একটি হোয়াইট পেপারে যেমন আমরা পেন্সিল দিয়ে গল্প লিখি, নিউরাল কানেকশন মানব মস্তিষ্কের ১০০ বিলিয়ন সেলের মধ্যে জটিলভাবে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা এনকোড করে।

 

জন্মের প্রথম কয়েক বছরে একটা শিশুর মস্তিষ্কে 1,000,000,000,000,000 নিউরাল কানেকশন তৈরি হয় বা এক কোয়াড্রিলিয়ন। আর তাই শিশুর সামনে আপনি যদি একটি রোবট রেখে বলেন, এই রোবটই তোমার ঈশ্বর, সে তাকেই ঈশ্বর মনে করবে, আপনি যদি তাকে একটি ইঁদুর দেখিয়ে বলেন, এটাই তোমার ঈশ্বর, সে একটি ইঁদুরের উপাসনা করবে। আপনি যদি একটি ফুটবল দেখিয়ে বলেন, এটাই তোমার ঈশ্বর, সে ফুটবল স্ট্যাডিয়ামের কাছে প্রার্থনা করবে!

 

আপনি যদি একটি তিমি মাছ দেখিয়ে বলেন, এই নীল তিমিই হলো, মহাবিশ্বের ক্রিয়েটর, সে তিমি মাছকেই তার ক্রিয়েটর ভেবে উপাসনা করবে! তিমি মাছের জন্য সে মসজিদ ও মন্দির তৈরি করা শুরু করবে এবং শাহবাগ চত্তরে আন্দোলন করবে। শিশুদের মস্তিষ্কের এই অস্বাভাবিক ফ্ল্যাক্সিবিলিটি ব্যবহার করেই সুবর্ণ আইজ্যাক অথবা ফাতিয়া আয়াতের মতো বিচিত্র্য জীবগুলো তৈরি হয়, যারা একইসাথে নিজেদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রমাণ করার চেষ্টা করে এবং সমাজে ধর্মীয় ভাইরাস সংক্রমণ করে।

 

বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কে ডোপামিন ইনজেক্ট করে দেখেছিলেন, যখন ইঁদুরের মস্তিষ্কে ডোপামিনের সেনসেটিভিটি বেড়ে যায়, তখন ইঁদুর অনেক বেশি হিংসুটে ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে, সে তার গর্তের চারপাশে অন্য কোনো ইঁদুর দেখলে তার ওপর ভয়ানক আক্রমণ করে, সে তার আশেপাশে কোনো প্রতিযোগী ইঁদুর সহ্য করতে পারে না। ডোপামিন ইঁদুরের মস্তিষ্কে টেরিটরিয়াল ডিফেন্স অথবা একপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করে। একইভাবে, আমাদের সমাজ শিশুদের মস্তিষ্কে গড ভাইরাস সংক্রমণের মধ্য দিয়ে, তার ডোপামিন সার্কিট ছিনতাই করে নেয়। আর তখন শিশুটি অন্য কোনো ধর্ম ও মতাদর্শের মানুষ দেখলে ইঁদুরের মতো লাফালাফি করে। ঈশ্বর বিশ্বাস ও সাম্প্রদায়িক চেতনার পেছনে কন্ডিশন রিফ্লেক্স একটি ভয়াবহ অবদান পালন করে (বিস্তারিত জানতে পড়ুন আমার লেখা বই- ডোপামিন: দ্য মলিকিউল অব মোর , প্রস্তরযুগ থেকে স্ক্রিনওয়ার্ল্ড এবং ব্রেন তোমার কানেক্টমের গল্প।)

 

 

Reference:
Here are some reference books related to the topics discussed in My article that may support those arguments:
1) “The God Virus: How Religion Infects Our Lives and Culture” by Darrel W. Ray – This book explores the concept of religion as a “virus” that infects human minds and culture.
2) “The Belief Instinct: The Psychology of Souls, Destiny, and the Meaning of Life” by Jesse Bering – This book delves into the psychology of belief and explores why humans tend to believe in things like gods, souls, and the afterlife.
3) “Breaking the Spell: Religion as a Natural Phenomenon” by Daniel C. Dennett – Dennett, a well-known philosopher and cognitive scientist, examines religion from a naturalistic perspective, exploring its evolutionary origins and societal impacts.
4) “The Science of Fear: How the Culture of Fear Manipulates Your Brain” by Daniel Gardner – While not directly related to religion, this book discusses the psychology of fear and how it can be manipulated, which may be relevant to your discussion of fear conditioning.
5) “The Age of Em: Work, Love, and Life when Robots Rule the Earth” by Robin Hanson – This book discusses future scenarios involving artificial intelligence and the impact on human beliefs and societies.
6) “The Neural Basis of Free Will: Criterial Causation” by Peter Tse – This book explores the neural mechanisms underlying decision-making and free will, which could be relevant when discussing belief formation.
7) “The Brain That Changes Itself: Stories of Personal Triumph from the Frontiers of Brain Science” by Norman Doidge – While not directly related to religion, this book discusses the brain’s plasticity and how it can adapt and change based on experiences.
8 ) “The Evolving Brain: The Known and the Unknown” edited by John S. Allen – This collection of essays explores various aspects of brain evolution, cognition, and behavior, which can be relevant to discussions on belief and conditioning.
সহযোগী আর্টিকেল:
ভয়, কাজী রহমান, মুক্তমনা