দেখতে দেখতে সাতটি বছর কেটে গেল অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে। এই ক’ বছর স্বাধীনতা, মুক্ত ও যুক্তিবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়েছে বই, এগোয় নি। নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে, কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানাবিধ বাকস্বাধীনতা খর্বকারী আইন মানুষের ন্যায্য মতকে সামনে আসতে দিচ্ছে না। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কার্যত গণতন্ত্রের অঙ্গসমূহ, যেমন সংবাদ মাধ্যম, আইন ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। এই গণতন্ত্রবিরোধী প্রক্রিয়া যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে তা নয়, অনেক দেশেই শক্তিশালী একক ব্যক্তিত্বের প্রভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পিছনে হটছে। মার্কিন দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়াতে পুতিন, ভারতে মোদী, তুরস্কে এরদোগান এরকম কয়েকটি নাম প্রথমেই মনে পড়ে। দেশের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকার ফলেই পুতিনের পক্ষে নিরঙ্কুশভাবে ইউক্রেন আক্রমণের সুযোগ হয়েছে।
অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, হুমায়ুন আজাদসহ বাংলাদেশের মুক্তচিন্তক লেখকদের শারীরিকভাবে মুছে দেবার জন্য যেমন ধর্মীয় চরমপন্থীরা কাজ করেছে, তেমনই সরকারিভাবে তাদের সৃষ্টিকে মুছে দেবার জন্য চেষ্টা হয়েছে। চরমপন্থীদের হাতে রাখার জন্য সরকার ক্রমাগতই সমঝোতা করেছে, এতে উগ্র ধর্মান্ধতা কমেনি, বরং বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে যখন সমাজে নানাভাবে উদার মনোভাবের সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে সেখানে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সমাজ পিছিয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের সূচকে নারী প্রগতি বলা হলেও সমাজে নারীদের অবস্থানের অগ্রগতি হয়নি, ধর্ষণ-লাঞ্ছণা বেড়েছে। সমপ্রেমী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকারও আরো খর্ব হয়েছে।
অভিজিৎ রায় সাহসী এবং মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন। অন্যদিকে যেখানে বিতর্ক প্রয়োজন সেখান থেকে সরে আসেননি, তাঁর অস্ত্র ছিল যুক্তি এবং সেটির প্রয়োগে পিছপা হননি। এটি হল একধরণের সংস্কৃতি যেখানে অন্য মত পছন্দ না হলেও সেই মতটি নিরাপদে প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে। একটি সমাজ কত উন্নত সেটি এই পরমতসহিষ্ণুতার ওপর নির্ভর করে। অভিজিৎ রায়ের উদ্দেশ্যও ছিল তাই, সেটি ছিল একটি সুস্থ সুন্দর সমাজকে সৃষ্টি করা যেখানে জীবনদর্শনের জন্য চাপাতির আঘাতে মরতে হবে না, যেখানে কারগার বা জুলুমের ভয়ে সত্যি কথাটা বলা যাবে না।
জিওর্দানো ব্রুনোকে ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারি রোমের চার্চ তথাকথিত ধর্মবিরোধিতার জন্য পুড়িয়ে হত্যা করে। ব্রুনো গ্যালিলেওর মত আত্মসমর্পণ করেননি, বরং মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন, “যারা আমার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তারা হয়তো আমার মৃত্যুর থেকেও ভীত অবস্থায় বাস করে।” অভিজিৎ রোমের কাম্পো দ্য’ফিওরিতে ব্রুনোর মৃত্যুস্থান দেখতে গিয়েছিলেন, ইতিহাসের এক অদৃশ্য রেখায় ৪২৫ বছর পরে ব্রুনোর ভাগ্যকেই বহন করতে হল তাকে ঢাকার বইমেলার সামনে।
ব্লগার, নাট্যকর্মী, পুরোহিত, ধর্মযাজক, শিয়া ইমাম, ধর্মত্যাগী, আহমেদীয়া, দর্জি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিল্পী, কার্টুনিস্ট, সংস্কৃতি কর্মী, লেখক, পীর, ধর্মীয় আলেম, সংখ্যালঘু মানুষ, কারারক্ষী, ছাত্র, নাস্তিক, তাঁতী, বাউল, সাংবাদিকসহ যারাই শোষক শাসকের পদানত হয়নি তাদেরকেই অত্যাচার ও খুন করা হয়েছে দ্রুত গতিতে। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে নাগরিক মনে ভয়াবহ শঙ্কা ও উদ্বেগ গেঁথে, ত্রাস সৃষ্টি করে শান্তিপ্রিয় মানুষদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কাগজ কলম ব্যবহার না করতে করতে মানুষ যেমনি করে বানান করা ভুলে যায় তেমনি করে সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তা ও তার প্রকাশ করতে না দিয়ে প্রিয় জন্মভূমির মানুষদের যুক্তিপূর্ণ ভাবনার অধিকারও ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সত্যি কথা বলা যাচ্ছে না। নাগরিক অধিকারকে তুচ্ছ করে এইসব হচ্ছে শাসক শোষক ও আঁতাতকারিদের স্বার্থরক্ষার সুবিধার্থে ।
দেশের নাগরিক তাঁদের ইচ্ছেমত নিয়োগ দেবে নাগরিক সেবকদের। নাগরিকই ঠিক করে দেয় জন-সেবকদের প্রধান কে হবে, সরকার কে হবে। নাগরিকই ঠিক করে দেয় সেবকরা কী কী পদ্ধতিতে নাগরিক জনতার সেবা করবে, কত বেতন নিবে, কতদিন সেবা করবার বিভিন্ন পদে থাকবে ইত্যাদি। উল্টোটা নয়।
নাগরিকদের সেবক বা সরকারি চাকুরে যারা তারা অবশ্যই বলবে না যে নাগরিক কী খাবে, কী পরবে, কী ভাববে অথবা কী বলবে। অথচ আমার জন্মভূমিতে ঘটছে ঠিক উল্টোটা। দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের নাগরিকের কথা বলার অধিকার নেই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। বেতন নেওয়া চাকুরে চাকর সেবকরাই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উল্টে হুকুম করছে তাদের চাকুরীদাতা নাগরিককে যে তারা কে কেমন আচরণ করবে, কী খাবে, কী পরবে, কী ভাববে অথবা কী বলবে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত যা, তা হল চর্চার অভাবে বেশিরভাগ নাগরিক নিজেই জানে না যে তাঁরা দেশের মালিক, তাঁরাই এখনকার সরকার ও যে কোন সরকারি চাকরদের চাকুরী কেড়ে নিয়ে অন্য সেবক নিয়োগ করতে পারে। নাগরিক তার অধিকার চর্চা না করতে পারলে এমনই হয় । চিন্তা ভাবনা করে মত প্রকাশের কঠিন শাস্তি জেল জরিমানা অত্যাচার এড়িয়ে থাকবার মত দুর্বল প্রবণতা গেড়ে বসে মনে। ঝামেলা এড়াতে এড়াতে চাকরদের হুকুম মত চলে । মাথা নোয়ানোর অভ্যেস থেকে অধিকাংশ নাগরিক ভুলেই গেছে যে তারাই দেশের আসল মালিক, অন্য কেউ না।
নাগরিকের নিয়োগকৃত এইসব চাকুরে সেবকরা কেন আর নাগরিকের কথা শুনছে না? শুনছে না কারণ তারা বেতনভুক চাকুরের অবস্থান থেকে প্রভু অবস্থান দখল করে নিয়েছে। হয়ে বসেছে নকল মালিক। সেবকের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে শাসক হয়েছে। শোষণ ও অত্যাচারের মজা পেয়ে গেছে। সেই লোভ ও ক্ষমতা ভোগ তাদের অধিকার ভেবে নিয়েছে। এই অন্যায় অবস্থানকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করতে তারা আপোষ করেছে সকল স্বার্থপর মহলের সাথে। লোভী ক্ষমতার আসনে থেকে তারা মৌলবাদী হেফাজত থেকে শুরু সুস্থ নাগরিক স্বার্থ বিরোধী যে কোন দল গোত্র স্বার্থপরদের সাথে আঁতাত করে অনড় হয়ে বসে আছে শাসকের আসনে। কেউ প্রতিবাদ করলে মুখ বন্ধ করতে সাতান্ন ধারা থেকে শুরু করে যে কোন অত্যাচারের পথ বেছে নিচ্ছে।
খুন করার উদ্দেশ্যে মুক্তমনা সম্পাদক ও লেখক বন্যা আহমেদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে অঙ্গহানি করা, একই উদ্দেশ্যে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা, প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে খুনের উদ্দেশ্যে মারাত্বকভাবে জখম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে হত্যার হুমকি, নীলফামারীর সৈয়দপুরে শিয়াদের একটি ইমামবাড়ার এক খাদেমকে নামাজরত অবস্থায় কুপিয়ে আহত, যাজক লুকসরকারের ওপর হামলা, আরিফ নূরকে খুপিয়ে জখম ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটানো-সহ প্রগতিশীল ও মুক্তমনের মানুষদের প্রতি সকল প্রকার ভীতি প্রদর্শন ও অত্যাচার চলছেই । নাগরিকও কিছুই ঘটেনি এমন একটা ভাব ধরে চুপ থাকছে ভয়ে।
পীর লুতফুর রহমান, তার বড় ছেলে সারোয়ার ইসলাম এবং সঙ্গে আরো ছয়জনকে জবাই করে হত্যা, মৌলানা ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা, অধ্যাপক শফিউল আলমকে নিজ বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা, চট্টগ্রামে মাজারের ফকির রহমত উল্লাহ ও তার খাদেম কাদের ইব্রাহিমকে কুপিয়ে হত্যা, নিজের বাড়িতে পীর খিজির খানকে হত্যা, শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা করে শিশু সহ দুইজন হত্যা, রংপুরের মাজারের খাদেম রহমত আলীকে কুপিয়ে হত্যা, মন্দিরের পুরোহিত হত্যা এবং এমন আরও আরও অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ও ঘটাচ্ছে আঁতাতকারীরা, শোষক শাসক ও স্বার্থপরদের সাথীরা।
অত্যন্ত বেদনার্ত হৃদয়ে স্মরণ করি, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায়’কে , ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বইমেলায় প্রিয় অভিজিতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ১২ মে ২০১৫ সিলেটে নিজ বাসার সামনে বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা, ৩০ মার্চ ২০১৫ বেগুনবাড়ীতে ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা, ৭ আগষ্ট ২০১৫ নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়কে তার বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা, নিজ বাসার সামনে আহমেদ রাজিবকে জবাই করে হত্যা, প্রকাশক ফয়সল আরেফিনকে তার কার্যালয়ে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা এসকল হত্যাকাণ্ড যে আতঙ্ক ছড়াবার উদ্দেশ্য করা হয়েছিল, অশুভ শক্তির সেই উদ্দেশ্য আপাতত প্রবল ত্রাস ছড়িয়েছে তাই চিন্তাশীল সুনাগরিক কথা বলা বা প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
অনেক হত্যা হয়েছে। অনেক গলা টিপে ধরা হয়েছে। এবার থামতে ও থামাতে হবে। নাগরিককে নির্ভয়ে কথা বলবার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এখনই ।
মুক্তচিন্তা, যুক্তি ও প্রগতির জয় হোক।
আমার সোনার দেশে সব সত্যি বলা যায় যদি সেগুলো ক্ষমতাশালীদের মতের পক্ষে যায়। অভিজিতের হত্যা আর তারপর দীপনের হত্যা আমাদের বলে দেয় এ দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটা হাস্যকর কথা মাত্র। বিশেষ করে এখন সোশাল মিডিয়ায় ধর্ম নিয়ে সাধারণ কথা বললেও গলা চেপে ধরতে দেখছি বহু চেনা বন্ধুদের। ফেসবুকের মতো সোশাল মিডিয়ায় এই কাজগুলো করেন যারা তারা সকলেই অভিজিৎ হত্যাকারীদেরই জাতভাই, এটাই জেনে আমি হতাশ।
ভাল বলেছেন। জন্মভূমিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটা হাস্যকর কথাই বটে ।