অভিজিৎ রায়।  একদম সাদামাটা তার চাল-চলন-ভাষা; কোনো বক্রতা নেই, কোনো কুটিলতা নাই। অভিজিৎ রায় যখন কিছু বলতেন তা সরাসরিই বলতেন, এর তরজমা-তফসিরের প্রয়োজন হত না। স্পষ্টবাদিতা ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান গুণ। আর ছিল সারল্য মাখা শিশু-সুলভ কৌতুহল যেটা তার অন্তর্দৃষ্টি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করলে সহজেই ধরা পড়ে। কেন মহাবিশ্ব এ অবস্থায় এলো, এর স্বরূপ কী, মহাবিশ্বের ঘটনাবলী, এর উৎপত্তি, প্রজাতির বিবর্তন ও উদ্ভব, মানুষের বিভিন্ন আবেগের স্বরূপ এগুলো নিয়ে তিনি লেখে গেছেন পাতার পর পাতা। নিজে জানার এবং অপরকে জানানোর যে অধীর আগ্রহ তার মাঝে ছিল সেটা তাকে নিয়ে গেছে ভিন্ন ধাপে।

আধুনিক বিজ্ঞানের যুগান্তকরী, চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী কোনো আবিষ্কার, যা হয়ত হৃদয়াঙ্গম করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে কিন্তু অভিজিৎ রায় এসে দাঁড়ালেন ত্রাণকর্তা রূপে। একদম সহজ ভাষায় সবার জন্য লিখে দিলেন শিগগিরই। এভাবেই চলছিল  দেড় দশক।

যদিও তার লেখার বিষয় ছিল বিজ্ঞান ও দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে, তারপরেও মানবিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের জন্য লেখেছেন, সংখ্যালঘু-আদিবাসী নিয়েও তিনি খোঁজখবর রাখতেন। সমকামীদের অধিকার নিয়ে তো পুরো একটি বই-ই লিখে ফেলেছিলেন। এদের অধিকারের পক্ষে এভাবে কেউ হয়ত দাঁড়াত আরো শতাব্দিকাল পর, অনেক অনেক নিপীড়নের পর। কিন্তু অভিজিৎ সেটা করে দেখালেন এ সময়েই।

তিনিই বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম আমাদের শিখিয়েছেন বিজ্ঞান আর অবিজ্ঞানের পার্থক্য, এ বিষয়ে লেখে গেছেন বিস্তর। তিনি-ই দেখিয়েছিলেন কোনো কিছুর ঐশ্বরিক ব্যাখ্যার কোনো মানে হয় না, ইশ্বর একটি বাড়তি হাইপোথেসিস মাত্র। এগুলো বলতে গিয়ে পতিত বুদ্ধিজীবীদের মত কোনো সুবিধাবাদের অন্তরালে নিজেকে ঢেকে নেন নি, কোনো রাখঢাক তার ছিল না। এটা একদিকে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল সত্য সন্ধানীদের কাছে, অপরদিকে তিনি এক বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ছদ্মবিজ্ঞানের আশ্রয়ে থাকা অন্ধকারের ফেরিওয়ালা ও ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে।

মনে পড়ে, মুক্তমনা তখন শুধু ওয়েব সাইট ছিল, ব্লগ হয়নি। সেখানে লেখতেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য লেখক। ঐ সময়কার বেশ কিছু লেখা এখনো মনে গেঁথে আছে। আর অভিজিৎ রায় তো লেখতেনই। তখনকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা নিয়ে তাঁর প্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৫ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গানের এই কলিকে বইটির নাম হিসাবে নিয়েছিলেন। বইয়ের এই নাম থেকেই তাঁর চিন্তাভাবনার কিছু দিক প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বইটির এক জায়গায় এসে এখন থমকে দাঁড়াই, তিনি ব্রুনো প্রসঙ্গে বলেছেন,

“বোঝাই যায়, ব্রুনোর নশ্বর দেহ যখন আগুনের লালচে উত্তাপে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, ‘ধর্ম বেচে গেল’ ভেবে ধর্মবাদীরা কি উদ্বাহু নৃত্যই না করেছিল সেদিন! তারপরও ইশ্বর আর তার পুত্ররা সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরা শেষ পর্যন্ত থামাতে পেরেছিলেন?”

অভিজিৎ রায় কেও হত্যা করা হল চরম নৃশংসভাবে। এর আগে হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা হল। হত্যা করা হল অনেকগুলো মেধাবী ব্লগার-লেখককে: অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর বাবু, রাজীব হায়দার, নীলাদ্রি নিলয়। কিন্তু মানুষের অগ্রগতি কি তাতে থামানো গেছে? এসব হত্যাকাণ্ড হাস্যকর অপবিশ্বাসগুলোকে কি বাস্তব করে তুলেছে?

আবহমান কাল থেকেই যারা প্রথা-বিরোধী, সমাজের অচলায়তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন তাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এদেরই হাত ধরে মানুষ এগিয়ে গেছে বহু বহু দূর, অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এসেছে আলোর দিকে। আমরাও নি:সন্দেহে অভিজিৎ রায় এর মশালের আলোয় এগিয়ে যাব এক সভ্য পৃথিবীর দিকে। কিন্তু দু:খ একটাই, তাঁর সাথে আরো অনেক অনেক দূর হেঠে যাওয়ার কথা ছিল, আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল।

অভিজিৎ রায়কে কেন মরে যেতে হল? এটা নিয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবার ক্ষমতা হয়ত কখনো হবেনা। কিন্তু তিনি নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। পুরো একটা বই রচনা করে গেছেন, বলে গেছেন কিভাবে বিশ্বাসের ভাইরাস কিছু মানুষকে খুনি ও নৃশংস করে তোলে।

অভিজিৎ রায় জন্ম নিয়েছিলেন একাত্তরে যখন আমাদের দেশের মানুষ জীবনপণ লড়াই করছে একটা মুক্ত সমাজের জন্য, যেখানে অর্থনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় নিপীড়ন থাকবে না। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা দেখতে পেলাম দেশটা ফের পাকিস্তান হয়ে উঠছে। কথা ছিল মাদ্রাসাগুলোকে মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার,  সেরকম কোন উদ্যোগই নেয়া হয় নি। অর্থাৎ ধর্মীয় বিষবৃক্ষকে তার আপন পরিবেশে লালন করতে দেয়া হয়। এর ফল পাওয়া যাচ্ছে এখন। ধর্মীয় উগ্রতা আর আদিম মূল্যবোধ মানুষের কণ্ঠ চেপে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রীকেও নতজানু হতে হচ্ছে এমন এক আল্লামা শফীর কাছে যিনি নারীকে তেতুলের সাথে তুলনা দিয়েছেন, ক্লাস ত্রি পর্যন্ত পড়তে বলেছেন, গার্মেন্টে কাজ করা মেয়েদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পুরো দেশটা পরিণত হয়েছে এক মাদ্রাসায়, যেখানে আর কিছুনা, শুধু ধর্মানুভূতি লালন করা হয়। আপনি দেশের মধ্যে এমন এক টুকরো জায়গাও পাবেন না যেখানে ধর্মের উদার ব্যাখ্যাকে সহজভাবে দেখা হয়, ধর্মকে স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করা যায়।

কিন্তু একইসাথে বিশ্ব কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। নিত্য নতুন মানুষের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। ভবিষ্যত সময়টা ধর্মান্ধ-খুনি আর তার লালনকারীদের জন্য অত্যন্ত দূ্রহ হয়ে উঠছে। অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর আমরা যেসব হায়েনাদের উল্লাস দেখেছি, সময়টা খুব প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে তাদের। সময় এসেছে, মানুষকে ফিরে আসতেই হবে জ্ঞানের কাছে, বিজ্ঞানের কাছে, ধর্মান্ধতাকে বিদায় জানিয়ে।

ধর্মের শুধুই প্রশংসা করতে হবে, কোন সমালোচনা নয়, নিন্দা নয়। পৃথিবীটাকে আক্ষরিক অর্থেই ‘মামাবাড়ি’ বানিয়ে ফেলেছে ধর্মান্ধরা। আপনার ধর্ম সত্য, তাহলে এটা নিয়ে এত ভয় কেন যে এর সমালোচনা বা নিন্দা করলে হত্যা করে ফেলতে হবে? কেন এই কাপুরুষোচিত পরাজয়? কলমকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে এবং এই হিংস্রতাকে সমর্থন করে ধর্মান্ধরা যে অসভ্যতার নজির দেখিয়েছে সেটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।

কোনো ধর্ম বা মতবাদ সত্য কিনা তা যাচাই করতে, উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই এমন একটি পরিবেশ বজায় রাখতে হবে যেখানে মুক্তভাবে এর সমালোচনা করা যায়, নিন্দা করা যায়। যদি এই পরিবেশ না থাকে তবে যেকোনো মিথ্যাচারকে ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বর্ণ প্রথার সমালোচনাকে যদি মেনে নেয়া না হয়, সতীদাহ প্রথার নিন্দা করার পরিবেশ না থাকে তবে হিন্দু ধর্মের বর্বর রূপ পুনরায় ফিরে আসবে। একটি ধর্ম সত্য, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হওয়া উচিত এর সমালোচনাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে, ইচ্ছেমত নিন্দা করার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে, কলমের জবাব কলম দিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। নিন্দা করাকে মেনে নেয়া হবে না, শুধুই প্রশংসা করতে হবে এরকম শর্ত আরোপ করলে সকল প্রশংসা স্তুতিতে পর্যবসিত হয়। প্রকৃত প্রশংসা তখনই পাওয়া সম্ভব যখন নিন্দা করার স্বাধীনতা থাকে।

বিশ্বের দেড়শ’ কোটি মুসলমান নবির নামে প্রতিদিন দরুদ পড়ছে, আল্লাহর নাম নিচ্ছে, ধর্মের প্রশংসা করছে সেখানে শ’খানেক মানুষের সমালোচনা যদি একে এমনভাবে ধ্বসিয়ে দেয় যে তাদের উপর আঘাত করে ধর্ম বাচাতে হয় তবে বুঝতে হবে ঐ ধর্মে সমস্যা আছে, এবং তা অত্যন্ত ভয়াবহ।

শেষ পর্যন্ত চাপাতি রেখে কলমকেই সম্বল করতে হবে, এটা মধ্যযুগ নয়। আর বাংলাস্তান মানেই সারা বিশ্ব নয়। হত্যা করে প্রলয় থামানো যাবে না।

যদিও আমরা অভিজিৎ রায় সহ অনেক প্রতিভাবান লেখকদের হারিয়েছি তারপরেও নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। এখন বিশ্বায়নের যুগ, পৃথিবীর কোথাও অন্ধকার জমে থাকবে না বেশিদিন । অতি দ্রুত অমানবিক এবং হাস্যকর মিথগুলো মানুষের মধ্য থেকে বিদায় নিবে, বিলুপ্ত হবে কলমের বদলে হাতে চাপাতি নেয়া অসুরের দল।

আলোর মশাল হাতে অভিজিৎ রায় আমাদের মধ্যে ছিলেন, আছেন ও থাকবেন।

অভিজিৎ থাকবে, অন্ধকার থাকবেনা।