সবাই ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে এরশাদের আমলে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কথা স্মরণ করছে। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকার একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখে উক্ত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ ও বাংলাদেশ সচিবালয়ে স্মারকলিপি প্রদান করার কর্মসূচী গ্রহণ করে। প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ গুলি চালায় এবং বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে প্রায় ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তখন থেকে দিনটিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। যদিও যায়যায়দিনের শফিক রহমানের কণ্যানে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে এখন মানুষ অন্যদেশের সাথে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করে আসছে। অনেকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আমদানিতে এরশাদের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন। যদিও তার কোন ভিত্তি নাই, কারণ শফিক রহমান নিজেই এরশাদের আমলে অনেকবার দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
এরশাদের স্বৈরাচারের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। তাই আজ না হয় ছফার বয়ানে এরশাদের একটা ভালোবাসার কথাই বলি। এরশাদ তার রাজনীতির স্বার্থে সবচেয়ে বেশি ধর্মের ব্যবহার করে। আবার এই মানুষটির সাথে সবচেয়ে বেশি নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা যুক্ত। অনেকগুলোর নারী কেলেঙ্কারির মধ্যে জিনাত মোশারফ তার একটি।
এরশাদ রাষ্ট্র, নারী দূষিত করার সাথে সাথে বাংলা সাহিত্যকেও দূষিত করেছে। এরশাদ যখন ক্ষমতায় তখন তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। অভিযোগ আছে এসব কবিতার অনেকগুলো আবার অন্যদের দিয়ে লেখানো। এরশাদের এসব কবিতা আবার ঘটা করে সবগুলো দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হতো। তিনি শুধু নিজে কবিতা লিখতেন না তিনি তার অধীনস্থ আমলাদের মধ্যে কবিতা লেখার বাতিকটা সংক্রমিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার অনেক সেক্রেটারির মধ্যে কবিতা লেখার বাতিকটা এতো বেশি ছিল যে অফিসে আসা মাত্র গতকাল তারা কী কবিতা লিখেছে তা পাঠ করে শোনাতেন। এরশাদের বিরুদ্ধে গান চুরিও অভিযোগ আছে। এই চুরিটা আহমদ ছফা পত্রিকায় ছাপাতে চেয়েছিলেন কিন্তু কেউ বিপদে পড়ার ভয়ে রাজি হয় নাই, মূল লেখকও ঝামেলার ভয়ে কিছু বলতে রাজি হয় নাই। ঘটনা হল- “নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা/নতুন করে আজ শপথ নিলাম।“ এই গানটি উপজাতীয় একাডেমি থেকে প্রকাশিত বার্ষিক সংকলনটিতে ছাপা হয়েছিল। এর লেখক ছিলেন সুরেন্দ্রলাল ত্রিপুরা। কিন্তু এই গানটি প্রায় প্রতিদিন রেডিও টেলিভিশনে গাওয়া হত এবং রচয়িতা হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম দেখাত। একটা দেশের প্রেসিডেন্ট অন্যের গান চুরি করে গীতিকার হিসেবে খ্যাতি পেতে চাওয়া বেশ অদ্ভুত ঘটনা। তবে আহমদ ছফা এরশাদকে লজ্জা দেওয়ার জন্যে এক দারুণ কাজ করে বসলেন। তিনি তার পত্রিকায় গানটি ছাপিয়ে বললেন যে, এরশাদের গানটি সুরেন্দ্রলাল ত্রিপুরা চুরি করেছে।
যাই হোক, এরশাদের পতনের পর খালেদা জিয়া এরশাদকে জেলে পাঠান। এরশাদ জেলে গেলেও রাজনীতিতে তার বড় প্রভাব ছিল। এই কারণে আহমদ ছফা এরশাদকে পারমানবিক বর্জ্যপদার্থের সাথে তুলনা করেছেন। কারণ পারমানবিক বর্জ্যপদার্থের তেজস্ক্রিয়তা অনন্তকাল টিকে থাকে। এই কারণে পরবর্তীতে বিএনপি এরশাদকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অফার করে কিন্তু এরশাদকে যেহেতু খালেদা জিয়া জেলে খাটিয়েছে এই ক্ষোভে এরশাদ আর বিএনপির সাথে যায় নাই। আওয়ামী লীগের সাথে জোট করে।
“এরশাদকে যখন কারাগারে পাঠান হল তখন এরশাদ অনেক ধরণের নালিশ করতেন। তাঁকে ঘিঞ্জি সেলে রাখা হয়েছে। সংবাদপত্র দেওয়া হয় না। যেসব খাবার দেওয়া হয় সেগুলো মুখে দেওয়ার অযোগ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। এরশাদের কারাবাসের সময়ে কারারুদ্ধ রাষ্ট্রপতির প্রতি বেগম জিনাত মোশারফের উথলানো দরদের কথাও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। বেগম জিনাত এরশাদকে প্যান্ট, শার্ট, পাজামা, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, এবং অন্তর্বাস জেলখানায় নিয়মিত পাঠাতেন এবং তার মন কম্পাসের কাঁটার মতন কারারুদ্ধ এরশাদের প্রতি হেলে থাকতো। এরশাদের জন্যে কষ্ট পেতাম ঠিকই, কিন্তু তাঁর সৌভাগ্যে একধরনের ঈর্ষাও বোধ করতাম।
এরশাদ এখন ক্ষমতায় নেই। তিনি কারাগারে দুঃখ দুর্দশার মধ্যে অতিবাহিত করেছেন। এই চরম দুঃসময়েও সুসময়ের বান্ধবী জিনাত মোশারফ অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে এরশাদের সুখ-সুবিধার দিকে দিকে মনোনিবেশ করেছেন। বেগম জিনাত এরশাদের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে গিয়ে তার নিজের সংসারটি ভাঙতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমি মনে মনে এই মহিলার খুব তারিফ করতাম। এরশাদ যখন জেল থেকে মুক্তি মুক্তি পেলেন তখন পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছে পাঁচকাহন করে জিনাতের প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা প্রকাশ করলেন। কিন্তু একটা সময়ে যখন তিনি অনুভব করলেন যে, তিনি জিনাতকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন না, তখন তাকে পচা কলার খোসার মত নির্মম অবজ্ঞায় ছুঁড়ে দিলেন।” (এরশাদ কেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন- আহমদ ছফা)
*জিনাত মোশাররফ জাতীয় পার্টির রাজনীতিবিদ এবং সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি জাতীয় সংসদে ২৯ নং সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য ছিলেন। জিনাতের স্বামী এ. কে. এম. মোশাররফ হোসেনকে ১৯৮৮ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে এরশাদ সরকারে চাকরি দেওয়ার আগ পর্যন্ত মোশাররফ হোসেন কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেন মোহাম্মদ এরশাদের সাথে তার দীর্ঘ ১৪ বছরের সম্পর্ক ছিল, যা ১৯৯৭ সালে সমাপ্তি ঘটে।
আগ্রহীদের জন্য:
আশির দশকে প্রেম-ভালোবাসা এখনকার যুগের মতো ছিলোনা।
আপনার লেখাটা ভালো লাগলো । ১৯৮৩ সালে আমি ঢাকা সরকারি তিতুমির কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র । সেদিন পুলিশি লাঠি পেটায় আহত হই , চিকিতসা গ্রহন করি । এরশাদ বিরোধিতা এবং তোষণ দুটোই দেখেছি। এটা রাজনিতির অংশ বেভেছি । কিন্তু মন থেকে জায়নাই যে , একটা প্রশাসন কিভাবে একজন প্রেসিডেন্ট এর পরকিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পরে । জিনাত চিফ গেস্ট মউদুদ মোয়াজ্জেম রা দারিয়ে থাকেন । কার কি প্রটকল কেউ জানেনা । শুধু জানেন কিভাবে মোসাহেবি করতে হয় । পরে শাহ মোয়াজ্জেম এক জায়গায় বলেছিলেন ” জীবনে জতবার এরশাদ এরশাদ করেছি ততবার আল্লাহ আল্লাহ করলে আউলিয়া হয়ে জেতাম “। রাজনিতিতে তিনি আউলিয়া হতে পারেন নাই তবে দেউলিয়া হতে পেরেছেন ।যাহোক ধন্যবাদ একটা সুন্দর অতিত মনে করিয়ে দেবার জন্য ,
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 🙂