“আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।”
– ডঃ অভিজিৎ রায়, ১৯৭১-২০১৫, প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তমনা ব্লগ।
আজ ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০। জগতে মুক্তচিন্তা প্রসার ও প্রচারের, চিন্তা জগতে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষজনকে আলোর সন্ধান দেয়ার আর দুনিয়ার মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার স্বপ্নদ্রষ্টা, ডঃ অভিজিৎ রায়ের আজ ৪৯তম জন্মবার্ষিকী। অভিজিৎ বাংলা ভাষাভাষী কমিউনিটিতে যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা, এবং বিজ্ঞান চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে অনলাইনে সর্বপ্রথম বাংলা কমিউনিটি ব্লগসাইট ‘মুক্তমনা’ প্রতিষ্ঠা করেন ২০০১ সালে। বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মুক্তচিন্তক, মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রচুর লেখক ও পাঠক তার ডাকে সাড়া দিলেন। শুরু হলো সমাজ থেকে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ দূরীকরণে আর জগতের মানুষকে সত্যের সন্ধান দিতে আলোহাতে আঁধারের যাত্রীদের পথচলা। কিন্তু এ পথ যে কুসুম কাননের সুবাসিত পুষ্পে ছড়ানো পথ নয়, বরং মারাত্বকভাবে বিষাক্ত কণ্টকাকীর্ণ তা অভিজিৎ জানতেন। কারণ এই পথের ইতিহাস তার জানা, তাই লিখেছিলেন;
” যারা ভাবেন বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালেখি করছি”।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার ভালবাসা ও মমত্ববোধ ছিল অপরিসীম। অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তের অসীম সাহসী মানুষ ছিলেন অভিজিৎ। মৌলবাদীদের প্রচ্ছন্ন খুনের হুমকি আর তার বাবার সতর্কবাণী উপেক্ষা করে সত্যি সত্যি জীবন হাতে নিয়েই ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বই মেলায় অংশ নিতে চলে আসেন বাংলাদেশে। সুযোগ পেয়ে ধর্মান্ধ ঘৃণ্য বর্বর ইসলামী সন্ত্রাসীরা ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বই মেলায় অভিজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। অভিজিতের লেখনীসমুহ যুক্তি ও দর্শনে এতোই ভরপুর এতোই সমৃদ্ধ ছিল যে, ধর্মান্ধদের জন্যে তা নাইটমেয়ার দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। অভিজিতের কলমের খুঁচায় ধর্মের প্রাসাদ থরথর করে কেঁপে উঠে। একটি একটি করে ইট খসে পড়তে থাকে ধর্মের প্রাচীর থেকে। কিন্তু অভিজিৎ ধর্ম নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতেন না, ধর্মের সমালোচনার চেয়ে বিজ্ঞানের আলোচনায় তার অধিক উৎসাহ আগ্রহ সব সময়েই ছিল। তাই মুক্তমনায় ধর্মগ্রন্থ সমালোচনামূলক কোনো লেখায় সাধারনত অভিজিতের সাড়া পাওয়া যেতো না। কিন্তু যখনই বিজ্ঞানের কোনো শাখা নিয়ে কেউ আলোচনা করেছেন অভিজিৎ আনন্দিত খুশি মনে সেখানে এসে হাজির হয়ে যেতেন। সেটা আমি টের পেয়েছিলাম যখন একবার “মা” দিবসে মায়ের ভালবাসা বঞ্চিত ট্রান্সজেন্ডার শিশু নিয়ে একটি লেখা ও মানব জাতির জীবন ধারার বিবর্তন নিয়ে একটি লেখা মুক্তমনায় লিখেছিলাম। অভিজিৎ খুব খুশি মনে আমার দুটো লেখারই প্রশংসা করেছিলেন। অভিজিৎ সমকামীতা রুপান্তরকামীতা ট্রান্সসেস্কুয়ালিটি, বাইসেস্কসুয়ালিটি, সমকামিতা, উভকামিতা, মানুষের দৈহিক মানসিক ভিন্নতা, জীবন ও জগতকে বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করে এর মধ্যকার রহস্য উদ্ঘাটন করে আসল সত্যটা দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করেছিলেন। আর এটিই হয়েছিল ধর্মবাদীদের বড় মাথা ব্যাথার কারণ। তারা বুঝতে পেরেছিল, এই ব্যাখ্যা মেনে নিলে ধর্মগ্রন্থে জগত ও জীবন সৃষ্টির যে তথ্য ব্যাখ্যা ধর্মবাদীরা লিখে রেখেছেন তা মিথ্যে প্রমাণ হয়ে যায়। কলমের মাধ্যমে অভিজিতের লেখার মোকাবেলা করা অন্ধকারবাসীদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা তাই তাদের ধর্মকে বাঁচাতে অভিজিৎকে খুন করা ছাড়া তারা আর কোনো উপায়ন্তর দেখলোনা। কিন্তু মূর্খরা বুঝতে পারলোনা, অভিজিৎ ততক্ষণে উর্ধগগনে বিকশিত এক আলোর ধারা, অকুল সমুদ্রমাঝে পথহারা নাবিকের পথের দিশা, মুক্তচিন্তার আকাশে এক ধ্রুবতারা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপে উদ্ভাসিত হয়ে গেছেন। এই অণির্বাণ শিখার আলো কোনোদিন নিভানো যায় না। অভিজিৎ অগণিত আঁধারের যাত্রীদের হাতে আলোর মশাল ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। বর্বর ধর্মান্ধরা ব্যক্তি অভিজিৎকে থামিয়ে দিতে পেরেছিল সত্য কিন্তু তার আদর্শ তার চেতনাকে থামিয়ে দিতে পারেনি। অভিজিতের হাতে গড়া মুক্তমনার লেখকেরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো তারা অভিজিতের আদর্শ চেতনা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবে। ধর্ম উম্মাদেরা অভিজিৎকে খুন করে মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধিচর্চা ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলনের যে বিরাট ক্ষতি করতে পেরেছে তা অনস্বীকার্য। কারণ অভিজিতের তুলনা একমাত্র অভিজিৎই। তার মৃত্যুর পর থেকে এ যাবত বিশ্বে যা কিছু অন্যায় অবিচার অপরাধ সঙ্ঘাত ধর্ম-পাগল স্বর্গলোভী মৌলবাদীরা আর অর্থ ও ক্ষমতা লোভী অসৎ রাজনীতিবিদরা ঘটিয়েছে, তার মৃত্যুর পর যত সব ব্লগার লেখককে খুন করা হয়েছে, শাহবাগ থেকে বই মেলা টিএসসি হয়ে হোলি আর্টিজান পর্যন্ত নিরপরাধ মানুষের রক্তে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া হয়েছে, মসজিদে আগুনে পুড়ে মানুষ মরেছে, ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রাম মন্দির তৈরি করা হয়েছে, তুরস্কে মিউজিয়ামকে মসজিদ বানানো হয়েছে, করোনা ভাইরাস নিয়ে মোল্লাদের অবৈজ্ঞানিক ইতং বিতং, মহামারি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে রাজনীতিবিদদের ভন্ডামী বাচালতা, মাদ্রাসায় হুজুর কর্তৃক কচি বালকদের বলাৎকার, শিশু বালিকাদের ধর্ষণোৎসব এ সব পরিলক্ষিত করে অভিজিৎ তার নিজের মতো করে যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে আসতেন তা থেকে বিশ্ববাসী বঞ্চিত হয়েই গেলো। সেদিন অভিজিৎকে খুন করতে পারার সাফল্যে অন্ধকারবাসীরা ঈদের আনন্দে মেতে উঠেছিল। আমরা শোকাহত হয়েছিলাম কিন্তু কলম সারেন্ডার করিনি।
সাধারন পাঠকের কাছে বিজ্ঞান পৌছে দেয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল অভিজিতের। সহজ বোধগম্য করে সাহিত্যের ভাষায় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করতে পারতেন ইহজাগতিক পারলৌকিক, আত্মিক কিংবা দৈহিক যে কোনো জটিল সমস্যার সমাধানে। তাই তো বলি, কেউ যদি একই সাথে রবীন্দ্রনাথ ও আইনষ্টাইনকে পাশাপাশি পড়তে চান তাহলে অভিজিতের বইয়ের দিকে তাকান। অভিজিৎ সব সময়ই অধিকার বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন, হউক সেই বঞ্চিতরা পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো বর্ণের বা ধর্মের। প্রচুর লিখেছেন ন্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কখনও সিরিয়া ইরাক মিশর ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষে আর কখনও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা আর অত্যাচারী ইসরাইলের বিরুদ্ধে। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবী নিয়ে, সমকামী এলজিবিটি রূপান্তরকামী উভলিঙ্গ মানব সমাজের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে, লিখেছেন অধিকার বঞ্চিত আদিবাসী পাহাড়িদের নিয়ে।
অভিজিতের পরিচয় শুধু একজন বিজ্ঞান লেখক নয় , তিনি একাধারে ছিলেন একজন বিজ্ঞানমনস্ক ভাল মানুষ, একজন ভালবাসার আদর্শ স্বামী, একজন দায়ীত্ববান কেয়ারিং সুযোগ্য বাবা। এসব আমরা জেনেছি তার প্রীয়তমা স্ত্রী বন্যা আহমেদ ও তার স্নেহের কন্যা তৃষার লেখনীতে। অভিজিৎ স্বপ্ন দেখতেন এক শান্তিকামী বিশ্বের, যেখানে থাকবেনা মানুষে মানুষে ঘৃণা বিদ্বেষ, হানাহানি মারামারি খুন হত্যা অন্যায় অবিচার, যেখানে জগতের সকল মানুষ শান্তিতে সুখে বসবাস করতে পারবে। অভিজিতের আদর্শ, চেতনা বুকে ধারন করে অভিজিতের জীবনের লক্ষ্য স্বপ্ন বাস্তবায়ণ করা হউক তার জন্ম দিনে আমদের দৃঢ় প্রত্যয়। আমার সকল লেখার প্রেরণা আমার লেখক জীবনের স্রষ্টা প্রীয় অভিজিৎ, আপনাকে নত মস্তকে প্রণাম জানাই।
আকাশ মালিক।
ইংল্যান্ড, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০।
২০১২ সাল থেকে মুক্তমনার নিয়মিত পাঠক আমি। মুক্তমনার পোস্টের কমেন্টে আমি দেখতাম কারও কমেন্ট ভাল হলে অভিজিৎদা তাকে রিপ্লাই দিতেন। আমিও অনেকবার ভেবেছি যে কমেন্ট করি, কিন্তু তখন নোকিয়া বাটন ফোনে ইন্টারনেট চালাতাম, বাংলা টাইপ করা অনেক ঝামেলা ছিল। আর কমেন্ট করাও হয়নি, অভিদার রিপ্লাইও আর কোনদিন পাওয়া যাবে না। আমার সবচেয়ে বড় আফসোস!!