সৌদি আরব একটি ওহাবী রাষ্ট্র। ওহাবীপন্থী কিংবা সালাফিপন্থীরা নিজেদের বাহিরে অন্যদের মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করে না। ওহাবী, সালাফি কিংবা বাংলার আহলে-হাদিস মূলত একই মায়ের পেটের ভাই। তাদের মতাদর্শ এক কিংবা কাছাকাছি। এখন যেহেতু ওহাবীদের হাতে কাচা পয়সা আছে সেহেতু সারা পৃথিবীতে ওহাবী মতাদর্শের বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এই মতাদর্শের ফলে এখন একজন সাধারণ মুসলিমও অন্যদের মৃত্যুর পর “রেস্ট ইন পিস” বললে হারাম কিংবা গুনহা হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে ভোগে। অথচ আগে এমনটি লক্ষ্য করা যায়নি। এর মূল কারণ চারিদিকে ওহাবী/সালাফিদের প্রচারণা। ইসলামিক টিভি সালাফি মতাদর্শই প্রচার করে (এ বছর ব্রিটেন পিস টিভিকে উগ্রতা ও ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে ৩ লাখ পাউন্ড জরিমানা করে)। যাই হোক, এই ওহাবী সালাফিদের চিনতে হলে ওহাবীদের ইতিহাস আপনাকে জানতে হবে।

সিরিয়ার ঐতিহাসিক পালমিরা নগরী আইএসের দখল করে তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমরা আফগানিস্তানের আল-কায়দার বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংসের কথা স্মরণ রাখতে পারি। তাদের আদর্শ হল; বিধর্মীদের এমন কোন কিছু রাখা যাবে না যা মুসলমানের মনে শিরকের জন্ম দেয় ফলে এসব ওহাবী সালাফিদের হাতে কোন ঐতিহাসিক স্থাপনাও নিরাপদ নয়। ওহাবী/সালাফি মতবাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে সৌদি আরব। এই রাজবংশের হাতে ইসলামের প্রাথমিক যুগের যেসব স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস হয়েছে তার মধ্যে নবী মুহাম্মদের চাচা হামজার কবর, কন্যা ফাতিমার মসজিদ, মুহাম্মদের স্ত্রী খাদিজার বসতভিটা, মুহাম্মদের মদিনার বসতভিটা, মুহাম্মদের তৈরি করা প্রথম বিদ্যালয়, তার মা আমিনার কবর, আলীর বসতভিটা, সাহাবি সালমান আল ফারসির মসজিদ অন্যতম। শিরকের জন্ম দিতে পারে এই ফতোয়া দিয়ে এসব ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। শিরকের নামে এগুলো ধ্বংস শুরু হলেও বর্তমানে এরকম আরো স্থাপনা ধ্বংস করা হচ্ছে শুধু হজ্জ ব্যবসাকে মাথায় রেখে। এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করে নির্মাণ করা হচ্ছে হাজীদের জন্যে হোটেল। নবী মুহাম্মদের করব রাখার পক্ষেও ওহাবীরা নয়। এই কারণে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ওহাবী সেনাবাহিনী মদিনায় হামলা চালিয়ে নবীর পরিবার সদস্যদের ও অনেক সাহাবীর কবর গুড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত তারা যখন নবীর কবর ভাঙ্গার উদ্যোগ নেয় তখন বিশ্বের মুসলমানদের প্রতিবাদের মুখে এই কবর ভাঙা তারা ক্ষান্ত দেয়। (বিস্তারিত জানতে, মুসলিম দুনিয়ার ক্ষমতার সম্পর্কের ইতিহাস: জিহাদ ও খেলাফতের সিলসিলা-পারভেজ আলম)

চার্লস অ্যালেন ‘গডস টেরোরিস্ট-ওয়াহহাবি ধর্মীয় মতবাদ এবং আধুনিক জিহাদের গুপ্ত মূলপথ’ বইতে ওহাবীদের মতাদর্শের ইতিহাস ও প্রসারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। কীভাবে ওহাবী সৌদি আরবের সৃষ্টি, ভারতবর্ষে ওহাবী মতবাদের ইতিহাস, তুর্কি ও ইরানের সাথে ওহাবীদের দ্বন্দ্বসহ ওহাবীদের সম্পূর্ণ ইতিহাসই এই বইতে উঠে এসেছে। বর্তমান মুসলিমরা অনেকেই ওহাবী ইসলামকেই একমাত্র সত্য ইসলাম হিসেবে জ্ঞান করে সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে। কারণ বেশির ভাগ মানুষেরই জানা নেই ওহাবীবাদ ও ওহাবী রাষ্ট্রের উত্থান সম্পর্কে। আসুন জেনে নেওয়া যাক ওহাবীদের হাতে নবী মুহাম্মদের স্মৃতিস্তম্ভের পবিত্রতা নাশ ও হুসাইনের সমাধি ধ্বংসের ইতিহাস।

*১৮০২ সালে ওয়াহবাবি হামলাকারী দলে নেতৃত্ব দিয়ে আমিরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সৌদ ইবনে সৌদ আধুনিক ইরাকে কারবালা আক্রমণ করেন। শিয়াদের সর্বাধিক পবিত্র স্থান। এখানে রয়েছে মহানবী (সা.)র দৌহিত্র ও ইমাম আলীর পুত্র তাদের প্রধান পবিত্র ব্যক্তি হুসাইনের সমাধি। লেপটেন্যাস্ট ফ্রান্সিস ওয়ার্ডেন লিখেছেন, ‘এর সব কিছুই তারা লুণ্ঠন করেছিল এবং একইভাবে হোসেনি সমাধিসৌধ তাদের লোলুপ থাকা থেকে নিষ্কৃতি পায়নি এবং এরই সাথে অভিনব নৃশংসতার নজির সৃষ্টি করে পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। এই বিষয়টি যা তুর্কিদের, আরবদের ও পারসিকদের মনে গভীর ছাপ ফেলে এবং বিশেষ করে তুর্কীদের সাথে এক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল যে তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে সৈন্য পাঠিয়ে অন্তত হোসেনি সমাধিসৌধকে সামান্যতম সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। প্রচুর পরিমাণে লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে নেয়া হলো, আমির ও ইমাম তাঁর নিজের জন্যে এক পঞ্চমাংশ নিয়ে বাকিটা তার ওয়াহহাবি সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন, একক অংশ দেয়া হলো প্রত্যেক পদাতিক সৈন্যকে আর দ্বিগুণ অংশ দেয়া হলো প্রত্যেক অশ্বারোহী সৈন্যকে।

১৮০৩ সালে আব্দ আল-আজিজ ইবনে সৌদ মক্কাধিপতির নিকট তেকে অনুমতির আবেদন করেন যার মাধ্যমে তাঁকে ইসলামের পবিত্রতম সৌধ কাবায় হজ্জ পালনের বিষয়টি পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চাওয়া হয়। ‘এ মেমোর্যাণ্ডাম অন দ্য সেকট অব ওয়াহহাবিস’ গ্রন্থের লেখক টি.ই. র্যাভেনশ এর মতে, ‘তারা অনেক শেখ ও অন্যান্য বিশ্বাসীদের হত্যা করে যারা ওয়াহাবিবাদকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা মোহাম্মদী সাধু-সন্তদের স্মৃতিফলক লুণ্ঠন করে নেয় যারা ওখানে প্রবেশ করেছিল। আর তাদের ধর্মান্মোত্ততা প্রসিদ্ধ মসজিদকেও রেহাই দেয়নি, যেখানে তারা প্রচুর সম্পদ ও দামী আসবাবপত্র লুট করে যেগুলো ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মোহাম্মদী রাজপুত্রবৃন্দ তাদের অংশে দান করেছিল।

১৮০৪ সালে একজন ওয়াহহাবি সৈনিক মহামরুভূমি অতিক্রম করে হিজাজে গিয়েছিলেন এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সমাধি অপহরণ করে মদিনায় তারা একটি অতি প্রাচীন সমাধিসৌধ ধ্বংস করে। পরবর্তী বছরে ওয়াহহাবিরা দ্বিতীয় বারের মতন অনুপ্রবেশ করে এবং তারা তাদের ওয়াহহাবি মতধারা গ্রহণে আপত্তি জানায় তাদেরকে সহিংস-ভাবে বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ চালায়, নিজেদের জন্য একটা দাবি করেছিল। মক্কা থেকে উদগীরিত ওয়াহহাবিদের আঘাতের তরঙ্গ অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বশেষ প্রান্ত পর্যন্ত অনুভূত হতো; ইসলামের নবীর পবিত্র সমাধি ফলক অপবিত্র করার ধৃষ্টতা যা কট্টরপন্থী ওয়াহহাবিরা স্পর্ধা প্রদর্শন করেছিল তা অধিকাংশ মুসলমানের কাছে একটা জঘন্যতম ঘৃণ্য অপরাধ। তীর্থ যাত্রার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে ওয়াহহাবিরা মুসলমানদের পরিত্রাণের পথ বন্ধ করে দেয়। তবে তাদের ধর্মমতে জীবন যাপন করা ব্যক্তিদের জন্যে তীর্থ যাত্রার পথ উন্মুক্ত ছিল। এই বিষয়ে যে সমস্ত প্রত্যক্ষদর্শী ব্যাখ্যা প্রদান করত তাদের বর্ণনা মতে, তারা ভণ্ড নবী আদ-দজ্জালের দাবি যে পৃথিবী ধ্বংসের সূচনা শুরু হয়েছে এই দাবী ধূলিসাৎ করে দেয়, কেননা ইসলামের নবী এই বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। এখানে বলে রাখা ভাল; ১৯২৪ সালের পরেও সৌদি সরকার নবী (সা.)র কন্যা ফাতিমার সমাধিসহ অনেক মুসলিম দরবেশের সমাধির পবিত্রতা নাশ করে ফেলে।

*১৮০৪ সালে মদিনায় আব্দ আল-আজিজ ইবনে সৌদের জিহাদিদের দ্বারা মহানবী (সা.)র স্মৃতিস্তম্ভের পবিত্রতা নাশ আর পরবর্তীতে মক্কা দখল মুসলিম উম্মাহ, একই সঙ্গে সুন্নি আর শিয়া সম্প্রদায়কে আঘাত করে। কিন্তু সুন্নিদের মধ্যে কিছু গোঁড়া ব্যক্তিবর্গ ছিল যারা ওয়াহহাবিদের প্রতিমাভঙ্গ পবিত্রকরণ ও পুনরুদ্ধারকরণের কাজ হিসেবে দেখল। তাদের সুমাত্রার একদল তীর্থযাত্রী মক্কায় উপস্থিত ছিল ১৮০৩ সালে ওয়াহহাবিদের হানা দেয়ার সময়। দুই বছর পর তাদের জনৈক ফকির মিসকিন বিন রহমতুল্লাহ নামে নেতা জাভার কেন্দ্রস্থলের (ইন্দোনেশিয়ায়) উপরাংশে ওযাহাবিবাদ প্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। এখানে বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের গোত্রীয়রা প্রাথমিকভাবে তাঁর এই ধর্মান্তরকরণ অভিযান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বাধা সৃষ্টি করে তাঁদেরকে অন্তরীণ করা হয়েছিল। তৎকালীন জনৈক মুসলিম পণ্ডিতের মতে, তারা জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও দস্যুতা করে নেয় আর অপমানিত করে ‘ওর্যাং কায়াদের’কে (গুরুত্বপূর্ণ জনগণ) তারা হত্যা করে উলেমাদের ও ‘ওর্যাং ইয়্যাং সারডিক’ (ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিতবর্গ) কে তারা বিবাহিত মহিলাদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের লোকজনের সাঙ্গে বিয়ে দিত এবং তাদের মেয়েদেরকে উপপত্নী হিসেবে বন্দী করে রাখত। তারপরেও তারা তাদের কার্যকলাপকে বলত, ‘এই কার্যকলাপগুলো করা হচ্ছে সঠিক ধর্ম রক্ষার জন্য।‘ (গডস টেরোরিস্ট-ওয়াহহাবি ধর্মীয় মতবাদ এবং আধুনিক জিহাদের গুপ্ত মূলপথ, লেখক- চার্লস অ্যালেন, অনুবাদক- সরকার আলী মনজুর, বই থেকে)

সৌদি আরবের প্রথম ইতিহাসবিদ ওসমান ইবনে বসির নাজদি লিখেছেন, ১৮০১ সালে ইবনে সউদ কারবালায় গণহত্যা করেছেন। ইতিহাসে লেখা আছে, ইবনে সউদ গর্বের সাথে বলছেন, আমরা কারবালার দখল নিলাম এবং এর অধিবাসীদের দাস করে নিলাম তারপর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে নামাজ আদায় করলাম। ঐ দিনের জন্য আমরা দুঃখিত নই, কারণ বিধর্মীদের জন্য এটাই প্রাপ্য ছিল। ১৮০৩ সালে আবদুল আজিজ মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন, ভীষণ সন্ত্রাস ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন ঠিক একইভাবে মদিনারও পতন ঘটে। বিজয়ের মুহূর্তে আবদুল ওয়াহাবের যোদ্ধা-বাহিনী মক্কা মদিনার যাবতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থাপনা, মসজিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় কাবা শরিফের কাছেই কালের সাক্ষী শত বছরের পুরনো ইসলামিক স্থাপত্য শিল্পকলা। কিন্তু ১৮০৩ সালে হঠাৎ একদিন কারবালা হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধে একজন শিয়া আততায়ীর হাতে খুন হন বাদশাহ আবদুল আজিজ। তার ছেলে সউদ বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতা গ্রহণ করে আরব দখল বজায় রাখেন।