লিখেছেন: সাগর মল্লিক
সবগুলো রাজ্য অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসের আক্রমণে দিশেহারা। খাম্বাজ, মুর্শিদাবাদে ইতিমধ্যে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে! তখন কৃষ্ণনগরের রাজা মন্ত্রীকে ডেকে বলল, “মন্ত্রী মশাই আমাদের এখন কি করা উচিত”? মন্ত্রী বলল “মহারাজ আমাদের রাজ্যে ভাইরাস আক্রমণের কোন সম্ভবনা নেই। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন”।
মন্ত্রী মনে মনে ভাবতে লাগলো! কোন ক্রমেই এখন ভাইরাসকে আটকানো ঠিক হবে না। ভাইরাসকে শুধু একবার আসতে দেওয়া দরকার। তখন চারিদিকে মোহরের ছড়াছড়ি। যেমন পারো লুটে নাও!
দিন গড়িয়ে সপ্তা যেতে না যেতে কৃষ্ণনগরে ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হল। মহারাজ চিন্তায় অস্থির! জরুরী সভার তলব করা হল। সবাইকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু গোপালের কি হয়েছে কি জানি বাপু তার কোন খবর নেই। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সবার কাছে জানতে চাইলেন “এখন রাজ্যে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার”? তখন মন্ত্রী বলল “মহারাজ সব ব্যবস্থা আমি করছি আপনি শুধু মোহরের ব্যবস্থা করুন”। “যা লাগবে নাও মন্ত্রী, শুধু আমার রাজ্যটাকে রক্ষা করো”।
মন্ত্রী রাজকোষ থেকে ৫০ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে চলে গেল। মন্ত্রী সেনাপতিকে ডেকে ৫ সহস্র মুদ্রা দিয়ে বলল “অন্য রাজ্য থেকে যারা আসবে সবাইকে গারদে পুরবে। খরচ বাবদ এই মোহরগুলো রাখ”। সেনাপতি সীমান্তে পাহারা বসালো৷ অন্য রাজ্য থেকে যারা আসছে তাদের গারদে পুরতে থাকলো। হঠাৎ বটা আর ঘটা আসছে অন্য রাজ্য থেকে। তারা সেনাপতিকে ১০০ মহর গুজে দিয়ে চলে আসল কৃষ্ণনগরে৷ এই কান্ড দেখে অনেকে ২০/৫০ মোহর গুজে কৃষ্ণনগরে প্রবেশ করতে লাগল। সেনাপতিও দেখল উপরি কামায়। এরপর যখন রাজ্যে আরো মহামারি ছড়াবে তখন তো আরো কামায়।
বিজ্ঞানী মহারাজের কাছে এসে বলল “মহারাজ ভাইরাস নির্ণয়ের যন্ত্র আবিষ্কার করতে হবে। একাজে তো অনেক ব্যায়”। মহারাজ তাকে ২০ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে দিল। বিজ্ঞানী বাজার থেকে একটা যন্ত্র কিনে বাকি মোহর ঘরে রেখে দিল। বিজ্ঞানী একাই সব করতে লাগল। যন্ত্র আবিষ্কারের কাজ চলতে লাগল। কবে নাগাদ হবে কোন ঠিক নেই।
দিনদিন ভাইরাসের আক্রমণ বাড়তে লাগল। রাজ্য নিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র বড়ই উদ্বিগ্ন! আবারো জরুরি সভার তলব করা হল। কিন্তু গোপালের দেখা নেই। সভায় অলোচনা হচ্ছে কি দিয়ে কি করা যায়। মহারাজ বললেন “রাজ্য জুড়ে বন্ধ ঘোষণা করা হোক, কেউ যেন ঘর থেকে বের হতে না পারে”। মন্ত্রী বলল, “মহারাজ ঘর থেকে বের না হলে সবাই খাবে কি? সবাইকে খাওয়াতে গেলে তো অনেক মুদ্রা খরচ হবে”। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বলল “যা লাগে রাজকোষ থেকে নাও মন্ত্রী। শুধু আমার রাজ্যটাকে রক্ষে করো”। রাজকোষ থেকে ৫০ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা আর চাল ডালের গাড়ি বোঝায় করে মন্ত্রী চলে গেল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মন্ত্রীকে ডেকে বলল “আমার রাজ্যে যেন না খেয়ে কেউ না মরে”।
রাজ্যে ঘোষণা করা হল কেও যেন ঘর থেকে বের না হয়। সবার বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে যাবে। কিন্তু রাজ্যের জনগণ কে শুনে কার কথা। রাখে আল্লা মারে কে! পুরোহিত মশাই বলে দিয়েছেন, মা শিতলা আছে। তোমরা ভাইরাসের ভয় করো না। সবই তার উপর ছেড়ে যে যার মত ঘুরে বেড়াতে লাগল। পাঠশালা ছুটি পেয়ে ছেলেরা ঘুরতে গেল।
ওদিকে মন্ত্রী বেটা ছক কষছে কি দিয়ে কি করা যায়। সেনাপতিকে নির্দেশ দিল “কয়েকটিকে দু’ঘা দিয়ে মহারাজকে দেখাও আমরা কত কি করছি। কিন্তু খবরদার ভাইরাসের বিস্তার যেন রোধ করা না হয়। আর শোন সবাইকে খাবার বিলি করে দাও। দশ কেজির যায়গায় ৬ কেজি করে চাল দিবা। কাউকে তেল দিবা তো কাউকে ডাল। বাকিটা আমার গুদাম ঘরে তুলে রাখ। বটা ঘটাকে সাথে নাও। তোমরাও ভাগ পাবে চিন্তা করো না”!
মন্ত্রী মহারাজার কাছে গিয়ে বলল “রাজ্যের অবস্থা ঠিকঠাক মহারাজ। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। সবাই শান্তিতে বসবাস করছে। আপনি বিশ্রাম করুন আমি সব দেখে নিচ্ছি”।
কিছুদিনের মধ্য রাজ্যে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হল ভাইরাসের আক্রমণে। মহারাজ আবার জরুরি সভার তলব করল।
-কি হে মন্ত্রী, সব যে বললে ঠিকঠাক তবে মানুষ মরল কেন?
-মহারাজ ও তো বৃদ্ধ ছিল, এমনিই মারা যেত। ভাইরাস আক্রমণ করলেও মরত না করলেও মরত। আপনি এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না মহারাজ।
-ও আচ্ছা আচ্ছা! তা বিজ্ঞানী, রাজ্যে কতজনের আক্রমণ হয়েছে?
-তা মহারাজ ৩ জনের মত।
-কি বলো বিজ্ঞানী! এত কম? বাহ্ বাহ্ তোমরা তো ভালোই কাজ করছ।
বিজ্ঞানী মনে মনে বলল, ‘নো পরীক্ষা নো রুগী’!
-মহারাজ, রাজ্যে চিকিৎসার জন্য কিছু জিনিস কেনা লাগবে। অনেক মোহরের দরকার।
-এই নাও ৫ লক্ষ মুদ্রা। রাজ্যকে বাঁচাও।
মন্ত্রী বলল,
-মহারাজ রাজ্যে সবার খাদ্যের জন্য আরো মোহর লাগবে। বণিকদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেও অনেক মোহর প্রয়োজন।
-মন্ত্রী আমার রাজ্যকে ভাল রাখতে আমি সব করতে রাজি। তুমি শুধু সব ঠিকঠাক করে দাও। আমি তোমাকে এক লক্ষ মোহর পুরস্কার দেবো। এখন রাজকোষ থেকে ১ কোটি স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে যাও। রাজ্যের যেন সবকিছু ভাল থাকে।
-আপনি কোনকিছু চিন্তা করবেন না মহারাজ। মন্ত্রী থাকতে এই কৃষ্ণনগরের কিছু হতে দেবে না।
সবাই সবার বরাদ্দের অর্থ নিয়ে ফিরে এল। মন্ত্রী, বিজ্ঞানী, সেনাপতি এরা কেও এখন ঘর থেকে বের হয় না ভাইরাসের ভয়ে। মন্ত্রী সেনাপতির সাথে পরামর্শ করে প্রহরীদের কটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আবার প্রহরীরা ক্ষমতা পেয়ে যা ইচ্ছা তাই শুরু করেছে। যাকে পাচ্ছে তাকে ধোলাই দিচ্ছে। মানুষদের খাবার না দিয়ে বাড়িতে বোঝাই করছে। এদিকে রাজ্যে মানুষ মরতে শুরু করেছে। রাজ্যের মধ্য অরাজকতা শুরু হয়েছে। ওদিকে মন্ত্রী সেনাপতিরা টাকা রাখার যায়গা পাচ্ছে না।
দিন যায় দিন আসে মহারাজ চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। এদিকে আবার রাজ্য জুড়ে মানুষের মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। কৃষক ফসল ফলাতে পারছে না। মাঠে পাঁকা ধান নষ্ট হচ্ছে। এখন আর কোথাও কোন ঘরে খাবার নেই। রাজ্যে একটা মানুষও আর বেঁচে নাই। খাবার জন্য কোথাও কিছু আর অবশিষ্ট নেই। মন্ত্রী, রাজা, সেনাপতি সব কি খেয়ে থাকবে? টাকা খেয়ে তো আর বেঁচে থাকা যায় না। মন্ত্রীর প্রতি রাজার অন্ধ বিশ্বাস সোনার কৃষ্ণনগর রাজ্যকে শ্মশান বানিয়ে দিল।
“ওহে গোপাল তুমি কোথায়? কৃষ্ণনগরকে রক্ষা করো!”
রাজা মশাইয়ের কি আসলেই রাজ্য বাঁচানোর ইচ্ছা ছিল।
নাকি এই সুযোগে তার তোষামোদকারীদের মধ্যে প্রজাদের খাজনার ভাগ বাটোয়ারার মতলব ছিল?