ডেথ এঞ্জেল খ্যাত ডাক্তার ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা’র কথা জানি। যিনি মৃত্যুপুরীখ্যাত অসভিৎজ ক্যাম্পের বন্দিদের উপর বিভিন্ন নিষ্ঠুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। বিশেষ করে জমজ শিশুরা ছিল তার প্রিয় বিষয়। সে ইহুদি শিশুদের উপর নিষ্ঠুর সব পরীক্ষা চালাতো। তবে আজকে আমরা রোমের ডাক্তারদের কথা বলতো যারা নাৎসিদের হাত থেকে ইহুদিদের বাঁচানোর জন্যে সিনড্রোম কে নামক এক মিথ্যা রোগ আবিষ্কার করেন।
১৯৪৩ সালের শুরুতে জার্মান সৈন্যরা ইতালি থেকে ইতালিয়ান ইহুদিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো শুরু করে। ইতালি দখলের দুই বছরের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ইহুদিকে ক্যাম্পে পাঠানো হয় যাদের মধ্যে বেশির ভাগই আর ফিরে আসেনি। তবে রোমের ডাক্তারদের একটা দল ২০ জন ইহুদিকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অন্তিম পরিণতির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তারা ঐ ইহুদিদের শরীরে ‘সিনড্রোম কে’ নামক এক মারাত্মক সংক্রামক রোগ নির্ণয় করেছিলেন।
রোমের টাইবার নদীর মাঝে ছোট্ট একটি দ্বীপে ফাতেবেনিফ্রাতেলি হাসপাতাল (Fatebenefratelli Hospital) অবস্থিত। ইহুদি পাড়া হাসপাতাল থেকে বেশি দূরে ছিল না। হাসপাতালটির বয়স ছিল ৪৫০ বছরেরও বেশি। ১৯৪৩ সালের ১৬ অক্টোবর যখন নাৎসিরা এই অঞ্চলে অভিযান চালায় তখন মুষ্টিমেয় ইহুদিরা এই ক্যাথলিক হাসপাতালে পালিয়ে আসে এবং সেখানেই তাদের হাসপাতালের নথিতে সিনড্রোম কে আক্রান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অথচ এই নামে কোন রোগ অস্তিত্ব মেডিক্যাল বইতে এমনকি চিকিৎসা চার্টেও ছিল না। আসলে এই নামে কিংবা এই ধরনের রোগের বাস্তবিক কোন অস্তিত্ব নেই। মূলত, নাৎসি ও ফ্যাসিজম বিরোধী ডাক্তার অ্যাড্রিয়ানো ওসিসিনি (Adriano Ossicini) এমন একটি কোড নাম ব্যবহার করেন। তার প্রধান কারণ হাসপাতালে প্রকৃত রোগী ও সুস্থ মানুষগুলোকে যেন সহজে আলাদা করা যাই তার জন্যে তিনি এই কাজটি করেন। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিজম বিরোধী বিপ্লবী রেডিও স্টেশনের কাজ সেই হাসপাতালের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে পরিচালিত হতো।
নাৎসি অফিসাররা যেন রোগীদের রুমগুলোতে না যায়, তাই এই নকল অসুখকে খুবই সংক্রামক রোগ হিসেবে হাজির করার জন্যে আক্রান্ত রোগীদের রুমগুলোকে বিপজ্জনক হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ইহুদি শিশুদের বলা হয়েছিল, সেনারা যখন তাদের পাশ দিয়ে যাবে তারা যেন যক্ষ্মা রোগীর অনুকরণে কাশতে থাকে।
ভেট্টোরিও স্যাসার্দোতি (Vittorio Sacerdoti) সেই হাসপাতালের একজন ডাক্তার ছিলেন। তবে তিনি কাজের জন্যে বা নিরাপত্তার স্বার্থে নিজের ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। ২০০৪ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন- “নাৎসিরা সত্যি ভেবেছিল সিনড্রোম কে ক্যান্সার অথবা যক্ষ্মা, ফলে তারা খরগোশের মতন খুব দ্রুত হাসপাতাল ত্যাগ করে,”। নাৎসিদের হাত থেকে ইহুদিদের বাঁচাতে আরেকজন কাজ করেন। তিনি হলেন ডাক্তার সার্জন জিওভায়ানি বোরোমিও (GiovaniBorromeo) যাকে পরবর্তীতে ইজরায়েল সরকার ‘ইয়াদ ভাশেম’(Israeli Holocaust remembranceorganization “righteousamong nations”) রাষ্ট্রীয় সম্মানে সম্মানিত করে।
২১শে জুন আমেরিকার রাউল ওয়ালেনবার্গ ফাউন্ডেশন ফাতেবেনেফ্রাটেলি হাসপাতালকে বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্যে “হাউজ অব লাইফ” সম্মানে সম্মানিত করে। এই খবরের ঘোষণার পর, ৯৬ বছর বয়সী ওসিসিনি ইতালির এক পত্রিকায় বলেন “রোগীর কাগজে সিনড্রোম কে বলতে বোঝানো হতো এই রোগী অসুস্থ নয় এবং তিনি একজন ইহুদি। আমরা ইহুদিদের জন্যে এই বিশেষ কাজ করেছিলাম যেন আমরা ডাক্তাররা বলতে পারি এই রোগীরা কীসের অসুখে ভুগছেন। নথিতে লেখা ‘সিনড্রোম কে’র অর্থ হল আমি এই ইহুদিকে রোগী হিসেবে ভর্তি করছি। তবে শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ।
আলবার্ট কেসারলিং ছিলেন জার্মান কমান্ডার যার কাঁধে রোম দখলের দায়িত্ব ছিল। অন্যদিকে এসএস প্রধান হারবার্ট ক্যাপলার ছিলেন সিটির পুলিশ প্রধান। যিনি ইতালির ইহুদি ও রাজনৈতিক বন্দীদের উপর গণহত্যার পরিকল্পনাকারী। এই সিনড্রোম কে রোগের ‘কে’ তাদের ইঙ্গিত করে লেখা।
ওসিসিনি বলেন, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি জিনিস শিখেছি; স্বার্থ কিংবা ব্যক্তিগত আগ্রহ নয় বরং যে মানুষের নীতিগুলোর জন্যে আমাদের কাজ করতে হবে। এছাড়া সবকিছুই আসলে লজ্জাজনক, অর্থহীন।
এই ফাতেবেনেফ্রেটেলি হাসপাতাল মোট কতজন ইহুদির জীবন বাঁচিয়েছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে এই সংখ্যাটা এক ডজন থেকে কয়েকশত বলা হয়। বেঁচে আসা মানুষের স্মৃতি ও জবানবন্দির আলোকে Yad Vashem (একই সাথে জেরুজালেমের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম) বলছে; ১৬ অক্টোবরের পরও আরও কিছু ইহুদি পরিবারের জীবন এই হাসপাতালের কারণে রক্ষা পায়। অন্তত ১৯৪৪ সালে জার্মান সৈন্যদের হাসপাতালে আগমনের আগ পর্যন্ত শীতের মৌসুমে কয়েকটি ইহুদি পরিবার তাদের ছোট বাচ্চাদের নিয়ে হাসপাতালে আশ্রয় নেয়। ওয়েলেনবার্গ উৎসবে অংশ নিতে আসা ৮৩ বছর বয়সী লুসিয়ানা টেডস্কো সেই শিশুদের একজন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর। হাসপাতালে সেনাদের সর্বশেষ অভিযানের সময় তিনি হাসপাতালের একটা গোপন রুমে লুকিয়ে ছিলেন।
ইউরোপের মধ্যে অন্যতম পুরনো ইহুদি বসতি স্থাপিত হয় ইতালিতে। সেই কারণে ইতালির ইহুদিরা ইউরোপের প্রাচীন ইহুদিও বটে। আর সিনড্রোম কে-এর ইতিহাস হল অনেকগুলো উপাখ্যানের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উপাখ্যান যেখানে সাধারণ ইতালিয়ানরা তাদের মানুষদের বাঁচানোর জন্যে এক অসাধারণ কার্য সাধন করেছে। Third Reich এর নেতৃত্বে নাৎসিদের গণহত্যার শেষ বছরে ১০ হাজার রোমান ইহুদির মধ্যে প্রায় ৯ হাজারের কাছাকাছি ইহুদি বিভিন্নভাবে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। যা সত্যি অকল্পনীয়।
মূল লেখা- An Italian doctor explains “Syndrome K,” the fake disease he invented to save Jews from the Nazis
হলোকাস্ট নিয়ে আগ্রহীদের জন্যে:
মৃত্যু শিবিরে যারা উৎসবে মেতেছিল
যে ট্রেন বৈঠক বদলে দিতে পারতো নাৎসিদের ইতিহাস
নাৎসি ক্যাম্পঃ মৃত্যু হেঁটে গেছে জীবনের পথ ধরে, পর্ব ১
নাৎসি ক্যাম্পঃ মৃত্যু হেঁটে গেছে জীবনের পথ ধরে, পর্ব ২
খুবই কৌতুহল উদ্দীপক। সুব্রতর এই সিরিজটি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। রীতিমতো গবেষণালব্ধ বিষয়
ধন্যবাদ বিপ্লব দা। 🙂