মার্চ ২৩, ১৯৭২ সালে দৈনিক পূর্বদেশ(বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস এ সংরক্ষিত)পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়,
তৎকালীন অর্থ মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান। সেখানে দালাল আইনে গ্রেফতারকৃত মোট ৯ হাজার ৪৯৩ জন আসামী ছিল, যারা কোন না কোন ভাবে দেশের বিপক্ষে গিয়ে পাকীদের গণহত্যায় মদদ যুগিয়েছে। সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল এদের মধ্যে ৫০ জন নারীও ছিল যারা পাকিস্তানীদের সহচরী হিসেবে কাজ করায় দালাল আইনে গ্রেফতার হয়েছিল।এছাড়া সারা দেশে দালাল হিসেবে যে লিস্ট করা হয়েছে ছিল সেখানে ৬২ জন নারীর কথা উল্লেখ আছে।
এই সম্পর্ক বিস্তারিত জানতে গিয়ে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম পুরুষ দালালদের রেকর্ড থাকলেও এই ৫০ জন নারীর রেকর্ডগুলো পুরোপুরি মুছে দেয়া হয়েছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জানতে পারলাম এই ৫০ জনের মধ্যে বেশির ভাগ মহিলাই সম্ভ্রান্ত এবং ক্ষমতাধর পরিবারের ছিল। এদের বেশির ভাগই ছিল ইয়াহিয়া সহ পাকিস্তানী আর্মির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কেপ্ট, সোজা বাংলায় শয্যা সঙ্গিনী। এরা মনে প্রাণে পাকিস্তানের গণহত্যা সমর্থন করত ।মূলত নিজের এবং স্বামীদের উন্নতি সহ নানা সুযোগ সুবিধা পাবার জন্য এরা পাকিস্তানী অফিসারদের সাথে ঘনিষ্ঠ হত এবং দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করত।
জানুয়ারি মাসের সংবাদ। রবিবার ১৭ই পৌষ ১৩৭৮। সাইম সরকার নিখোঁজ। সেই সংবাদের পাশেই নিউজ হয়েছে- আরো ৩৯ জন দালার গ্রেফতার। ৩৯ জনের নাম প্রকাশ করা হয় হয় এর মধ্যে দুইজন নারীর নাম রয়েছে। এদেরকে গ্রেফতার করা হয় ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে।
নামগুলো হল-
২৫ নম্বর নামটি বেগম রোকেয়া আব্বাস।ঢাকা
২৯ ফরিদা বেগম। শিবচর ফরিদপুর।
তৎকালীন বেশ নাম-ডাক ওয়ালা ঔষধ কোম্পানি করিম ড্রাগস এর মালিকের স্ত্রী এই তালিকায় ছিল। পরবর্তীতে মেজর জিয়া দালাল আইন বাতিল করার সুযোগে মামলা মুক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখি পরবর্তীতে করিম ড্রাগস-এর বড় একটি শেয়ার বর্তমান বেক্সিমকো কোম্পানি কিনে নেয়। এছাড়াও আফরোজা নূর আলী নামে এক মহিলার নাম পাওয়া যায় যে তৎকালীন এক উচ্চপদস্ত সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রী ছিল।
এখানে আরও একজনের নাম পাওয়া যায়। শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হকের মেয়ে রইসী বেগম, যে তৎকালীন পাকিস্তান জমিয়তুল সিলমের প্রেসিডেন্ট ছিল, সে (১২ই এপ্রিল ১৯৭১) সালে তার বিবৃতিতে লিখেছে-
আমাদের প্রিয় পাকিস্তানের সীমান্তের ওপার থেকে শত্রুপক্ষ কর্তিক সংগঠিত ও প্ররচিত কতিপয় দেশদ্রোহীদের দ্বারা চরম ভয়ভীতি ও হুমকির মধ্যে কাল কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্ মহান আল্লাহ্তালা লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত মুসলমানদের সারা রাতের আকুল প্রার্থনা কবুল করেছেন এবং পাকিস্থান কে সমূহ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এটা এখন দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার যে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের জাত শত্রুদের সহায়তায় পাকিস্তানের সাতকোটি জনগণের এ অঞ্চলকে বিশ্বনাথ, কালি, ও দুর্গার মন্দিরে পরিণত করার ষড়যন্ত্র লিপ্ত ছিলেন। আল্লাহ্ আকবরের স্থলে শেখমুজিব পৌত্তলিকদের যুদ্ধের শ্লোগান জয় বাংলা আমদানি করেছিলেন।
এই মহিলা ধর্ম কে ঢাল বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী , ধর্মদ্রোহী আর শেখ মুজিবুর রহমান কে ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিয়েছিল। সে হুমকি দিয়েছিল যে পাকিস্তানের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করলে পাকিস্তান এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবে।
ঢাকা, ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ । সেক্টর ২-এর অধীনস্থ সিদ্দিক বাজার গেরিলা ইউনিটের দুর্ধর্ষ সেনানীরা কুখ্যাত জরিনা’কে গ্রেফতার করা হয়। এই মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়তা করতো এবং গেরিলা কার্যকলাপ সম্বন্ধে তাদের কাছে খবরাখবর আদান প্রদান করতো। গ্রেফতারের পর জরিনা স্বীকার করে যে, তার সহায়তায় পাক বাহিনী বহু মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। জরিনা অবশ্য দাবী করে যে, এই সমস্ত মেয়েদের ভরণ-পোষণের ভার তার (জরিনা) হাতেই ন্যস্ত ছিল।
দৈনিক পূর্বদেশ এ প্রচারিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ, খুলনাতে মহিলা প্রতিরোধ কমিটি নামে পাকিস্তান সমর্থক মহিলাদের একটা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।সেখানে বক্তারা যে কোন মূল্যে পাকিস্তান রক্ষার প্রতিজ্ঞা করেন।
৭১ এ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাক প্রতিনিধি দলের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে দুজন নারী সদস্যের নাম পাওয়া যায় যারা। একজন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এবং সাবেক মন্ত্রী রাজিয়া ফয়েজ ( মৃত) এবং আর একজন ড: ফাতেমা সাদিক। এরপর রাজিয়া ফয়েজ ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ (খান এ সবুর) থেকে প্রথম নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদের সময়ে তিনি সাতক্ষীরা সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে শিশু ও মহিলা এবং সমাজ কল্যাণ বিষয়ক পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছিলেন।
।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যও ছিলেন এই রাজিয়া ফয়েজ। ২০০৬ সালের শেষের দিকে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে যোগ দেন। গত কাউন্সিল অধিবেশনে তাকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।
সোহরাওয়ার্দী কন্যা বেগম আক্তার সোলায়মান ১৯৭১ সালের ১২-ই জুন রেডিও পাকিস্তানে বক্তব্য রাখে। ভাষণে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্যদেরকে নিজ নিজ এলাকায় জনগণের মধ্যে পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা স্থাপনের জন্যে কাজ করার আহবান জানায়। আক্তার সোলায়মান তার ভাষণে ‘টিক্কা খান’ এই দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সঠিক ব্যবস্থা নিয়েছে’ বলে উল্লেখ করে।
তথ্য সূত্র – ( দৈনিক আজাদ, ১৩ ই জুন )
বেগম আখতার সোলায়মান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্পষ্টত-ই বিরোধিতা করেছিলেন। সৌদি বাদশাহ খালেদ খন্দকার মোশতাকের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন,
‘আমার প্রিয় ভাই, নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় আপনাকে আমি নিজের ও সৌদি জাতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশে আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাসীন, ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে বেগম আখতার সোলায়মান ভুট্টোকে এক চিঠিতে লেখেন:
‘আমি সব সময় আপনাকে একজন অসীম সাহসী, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও ব্যতিক্রমী দূরদর্শী মানুষ হিসেবেই জানি। “বাংলাদেশ” বিষয়ে আপনি সকল প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে গেছেন। আপনি মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন দেখিয়ে অত্যন্ত উদারতার পরিচয় দিয়েছেন।’
তথ্য সূত্র -(এ এল খতিবের, এর হু কিলড মুজিব )
রোকেয়া কবীর এবং মুজিব মেহেদী ‘মুক্তিযুদ্ধ ও নারী’ এই বইটিতে লিখেছেন , –
নারীরা সর্বত্রই সক্রিয়, যেমন সক্রিয় ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী ভুমিকায়ও। যারা এ রকম ভুমিকায় লিপ্ত ছিলেন, তাদের অধিকাংশেরই ওই কাজের পেছনে পারিবারিক স্বীকৃতি ছিল। যদিও মূলে ছিল ধর্মান্ধতা। পরিবারই এদের প্ররোচিত করেছে নেতিবাচক ভুমিকায় লিপ্ত হতে। এ ক্ষেত্রে সকল শ্রেণি ও স্তরের নারীদের সক্রিয়তা থাকলেও উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত স্তরের নারীদের সক্রিয়তাই ছিল বেশী তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষণীয় যে, এরকম প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই সক্রিয়দের পিতা বা চাচা, স্বামী বা ভাই কিংবা পুরো পরিবারটিই শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। অবশ্য নিম্নবিত্তদের ক্ষেত্রে অন্য কারণও লক্ষ করা গেছে। যেমন, পাকসেনা বা রাজাকারদের ক্যাম্পসমুহে কর্মরত আয়ারা।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বইগুলো তে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনা থাকলেও নারী রাজাকারদের বর্ণনা ছিল না। যেহেতু নারী রাজাকার বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর সম্ভবত এই কারণে বিষয়টিকে আড়ালেই রাখা হয়েছে। এই নারীদের লিস্ট খোজার চেষ্টা করছি কিন্তু এদের রেকর্ডপত্র যেভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে তাতে ধারনা করতে পারি যেহেতু ক্ষমতাধরদের সাথে এদের ঘনিষ্ঠতা ছিল, সেহেতু পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা এবং অর্থ প্রয়োগের মাধ্যমে রেকর্ড বুক থেকে এরা নিজেদের নাম পরিচয় গায়েব করে ফেলেছে।
যুগে যুগে ঘষেটি বেগমরা ছিল , ৭১ এও তার ব্যতিক্রম ছিল না।এই ৫০ কিংবা ৬২ জন ঘষেটি বেগম এখন কোথায় আছে, আদৌ বেচে আছে কিনা এখনো জানতে পারিনি । বেঁচে থাকুক কিংবা না থাকুন এদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং শত ধিক থাকবে সব সময়ই।
( ব্লগটি ধীরে ধীরে আপডেট করা হবে এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া ব্লগটি অন্য কোথায় প্রকাশ করা যাবে না)
(পত্রিকার ছবিগুলোর জন্য International Crimes Strategy Forum (ICSF) and Center for Bangladesh Genocide Research (CBGR) ও সাব্বির হোসাইন এবং আরিফ রহমানের কাছে ব্যক্তিগতভাবে ঋণী। )
অনেক অজানা কথা
জানতে পারলাম।
ধন্যবাদ
ধর্মের ছুঁ মন্তরে এদেশে সবই হয়। যারা রাজাকার ছিল তারা এখন বলে ধর্মের জন্য পাকী(FUCKi)দের পক্ষ নিয়েছি। এই বল্গ পোস্ট পরেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ধর্মান্ধতার জন্য পাকীদের সাথে বিছানায় পর্যন্ত গেছে ক্ষমতার লোভে এখানে ধর্ম শুধু টিস্যুর মত ব্যবহৃত হয়েছে। এখনও একদল ধর্মকে যাচ্চেতাই ভাবে ব্যবহার করে ক্ষমতা ভোগ থেকে শুরু করে নারী বাড়ি গাড়ী সবই ভোগ করে চলেছে। আর আমরা বোকার দল শুধু তাদের কর্ম দেখি কেউ সাবাশী দেই কেউ গালি দেই, আর মুখবুজে সব মেনে নেই। ভাবি আমারতো কিছুই হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই রকম তথ্য এই প্রথম…… সাধুবাদ জানাই কষ্ট করে তথ্য প্রকাশ করার জন্য। আমি মনে করি, আরও অনেক বিষয় রয়েছে যা আমাদের এখনো অজানা। আশা করি আমাদের সামনে পর্যায়ক্রমে অজানা তথ্য প্রকাশ করা হবে। আর হবে আমাদের মুখোশ উম্মচন…।।
ধন্যবাদ।
এদেশে আর কিছু হোক না হোক এখন অবধি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রম্যকাহিনী রচনা বন্ধ হয়নি। যুদ্ধ হলে দুটো পক্ষ হবে এটাই স্বাভাবিক। যারা জয়ী তারাই সাধু ,আহা!
তাহলে আজ কি স্বাধীন বাংলার বুকে যুদ্ধ হচ্ছে না ? যা হচ্ছে তা যুদ্ধাবস্থায় এর চেয়েও খারাপ।
কিছু নাম আগে থেকে জানা। কিছু নতুন করে জানা পোস্টটি থেকে। ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। ইন্টারেস্টিং ব্যপারটি হলো বাংলার কিছু রথি-মহারথিদের কন্যারা মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছে। সেটার কারণ কি শুধুই রাজনৈতিক নাকি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বা লাইম লাইটে আসার টিপিক্যাল মনস্তত্ত্ব সেটা দেখা যেতে পারে। ইটস গনা বি মোর ইন্টারেস্টিং।
Dear Faring Camelia,
Would you pls allow me to share this writeup in Facebook?
Thanks.
Surajit
নারী হওয়ায় তাদেরকে ক্ষমা করা যায় কি?
নারী হলে কী অপরাধ লঘু হয়ে যায়?
এটা হওয়া উচিত নয়
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক তথ্যই অজানা ,অনেক অজানা তথ্য জানলাম ,অসংখ্য ধন্যবাদ এরকম অজানা অনেক তথ্য জানবো আশা করি