লিখেছেন: ঘুণপোকা

ভূমিকা

র‍্যাডিক্যাল ইসলামের যে রূপটি আমাদের সামনে সবার আগে ধরা দেয় সেটা হচ্ছে শরিয়াভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন। ইসলাম ধর্মের অধিকাংশ তাত্ত্বিক একমত যে ইসলাম শুধুমাত্র রিচুয়াল ভিত্তিক ধর্ম নয়, এটা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনা করার ক্ষেত্রেও ইসলামকে মূল ভূমিকায় রাখা উচিত। এর মূল কারণ ইসলামের প্রবক্তা নিজে একজন শাসক ছিলেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি তার নিজস্ব(?) মতবাদ(অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে খলিফাগণও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। সাম্প্রতিক সিরিয়ার রাকা শহরকে রাজধানী ঘোষণা করে আইএস যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তা থেকে আমরা শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা পাই। এছাড়া তালেবানরাও আফগানিস্তানে প্রায় অর্ধযুগ ধরে শরীয়া রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়েছিল। সুতরাং এতদিন ধরে শরীয়া রাষ্ট্রের ধারণাকে ইউটোপিয় ধারণা বলে উড়িয়ে দেয়া গেলেও এটা এখন বাস্তবতা হিসেবেই আমাদের সামনে আসছে। সেই সাথে কেমন হতে পারে ইসলামের কল্পিত স্বর্গরাজ্য, সেটাও কিছুটা পরিস্কার হয়েছে।

মূলত কোরান ও হাদিসের উপর ভিত্তি করেই ইসলামের অনুসারীগণ শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের দাবীকে সামনে নিয়ে আসেন। যেহেতু শরীয়ারাষ্ট্রের জন্য আলাদা কোন সংবিধান এবং আইন নেই তাই কোরান-হাদিসের রেফারেন্স ব্যবহার করেই পরবর্তীতে বিভিন্ন শরীয়া কিতাব লিখিত হয়েছে। পাশাপাশি মোহাম্মদ শাসিত মদিনা কেন্দ্রিক যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেটাকেও শরীয়ারাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়। যদিও প্রশ্ন আছে মোহাম্মদের সেই রাষ্ট্র আদৌ শরীয়ারাষ্ট্র ছিল কি না। অনেক আলোচক একে সমঝোতাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখিয়েছেন, যেহেতু মদিনা এবং এর আশেপাশে বহু ইহুদি বসতি ছিল। মোহাম্মদকে তার জীবদ্দশায় অনেকবারই ইহুদিদের সাথে বিভিন্নরকম সন্ধি-সমঝোতা করতে দেখা যায়, সেটা অবশ্য অন্য আলোচনা।

মোহাম্মদ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আলাদা কোন সংবিধান কিংবা আইন রচনা করেছেন এমন নয়, একটা লম্বা সময় ধরে তিনি যখন যে ধরণের সমস্যায় পড়েছেন সে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন (২৩ বছর ধরে কোরান নাজিলের মূল কারণ এটাই)। এখানে একটি বিষয় বিবেচ্য যে মুহাম্মদ পূর্ববর্তী বেদুইন অধ্যুষিত আরবে কাঠামোবদ্ধ কোন রাষ্ট্র কিংবা শাসনব্যবস্থা যেহেতু ছিল না, তাই একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেদুইন সংস্কৃতির পাশাপাশি মুহম্মদকে ইহুদি এবং খ্রিষ্টান ধর্মের বিভিন্ন নিয়মকানুন থেকেও প্রচুর ধার করতে হয়েছে। বাকিটা মোহাম্মদ নিজের উপস্থিত বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োগ করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মোহাম্মদের ব্যক্তিজীবনের নানা সমস্যা-প্রতিবন্ধকতা এবং সেটা থেকে উত্তরণের পদ্ধতি পরবর্তীতে কুরান হাদিসের বরাতে ইসলামের আইন হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছে। ফলে অনুসারীদের কাছে মুহম্মদের ব্যক্তিজীবন এবং শাসকজীবন একাকার হয়ে যেতে দেখি। সুতরাং আমিও এক্ষেত্রে কোরান-হাদিসের রেফারেন্স ব্যবহার করব। পাশাপাশি ইসলামী তাত্ত্বিকগণের মতামতও তুলে ধরার চেষ্টা করব।

তবে শরীয়া আইন বিষয়ে আলোচনা করার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কোরান-হাদিসের ব্যাখ্যার ভিন্নতা। একই আয়াতের নানা রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী তাত্ত্বিকগণের লেখায়। ফলে বিভ্রান্তি দেখা দেয়া খুব স্বাভাবিক। তবে ইসলামের যে গ্রুপটি টেক্সটের প্রতি গুরুত্ব দেন অর্থাৎ যারা কোরান-হাদিসকে ‘ভাবার্থে’ না নিয়ে সরাসরি অর্থকে গ্রহণ করেন, এখানে মূলত তাদের মতামতকেই আমি তুলে ধরেছি।

শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা কেন প্রয়োজন?

এ বিষয়ে আবুল আ’লা মউদুদী তার ‘ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান’ বইয়ে বলছেন

‘মুসলমানরা যদি মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করতে চায়, তবে তাদের নিজেদের গোটা জীবনকে আল্লাহর আনুগত্যের অধীন করে দিতে হবে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের সকল বিষয়ের ফয়সালা কেবলমাত্র আল্লাহর আইন ও শরীয়াহ মোতাবেক করতে হবে, এছাড়া দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই। আপনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান পোষণ করবেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের আইন অনুযায়ী, ইসলামের কোন অবস্থাতেই এমনটি বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। এর চাইতে বড় স্ববিরোধীতা আর কিছু হতে পারে না। এই স্ববিরোধীটাকে বরদাশত করতে নয়, নির্মূল করার জন্য ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। আমরা যে ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসনতন্ত্র দাবী করছি, তার পেছনে এই অনুভূতিই কাজ করছে যে, মুসলমান যদি আল্লাহর আইনই মেনে না চলে, তবে তো তার মুসলমান হবার দাবীই সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে’।

আহলে সুন্নত পন্থি মাওলানা আসেম ওমর তার ‘ইসলাম ও গণতন্ত্র’ বইয়ে বলছেন

‘সীরাতে মুস্তাকী একটাই, দুনিয়াতে বাস্তবায়ন হওয়ার মত ব্যবস্থা একটাই সেটা হল ইসলামী নিজাম…। ইসলামী জীবনব্যবস্থা…। ইসলামের বিপরীতে অন্য সব জীবনব্যবস্থা বাতিল। ভ্রান্ত। আল্লাহর রাসূল খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর সহস্র উম্মত বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তা রক্ষা করেছে’।

আরেকজন বড় ইসলামী তাত্ত্বিক সাইয়েদ কুতুব তার ‘আল মুসতাকবিলু লী হাযাদ্দীন’ গ্রন্থে লিখেছেন,

‘ইসলাম একত্ববাদের প্রশ্নে আপোষহীন। সে এসেছে অপরাপর মতবাদের মূলোৎপাটন করতে। কেননা ওসব মতবাদ মানুষকে মানুষের দাসে পরিণত করে। ইসলাম সব রকমের অধীনতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাকে কেবল আল্লাহর অধীন করতে এসেছে’।

এদের সবাইই মুসলমান জাতিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দেখেন এবং অন্য সকল জাতিগোষ্ঠী বা তাদের মতাদর্শকে ছুড়ে ফেলতে চান বা মূলোৎপাটন করতে চান। এরা স্পষ্টতই বলছেন ইসলামী রাষ্ট্র হবে অবশ্যই মুসলমান শাসক দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র, যেখানে আল্লাহর নির্দেশনা মতে (কোরান-হাদিস) তা চালিত হবে। এই অবস্থান ইসলামী শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এরা সবাইই তাদের এই মতামতের ক্ষেত্রে কোরানের বেশ কিছু আয়াত উপস্থাপন করেছেন(যদিও সেখানে সরাসরি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের কথা বলা হয়নি), যেমন-

* ইনি আল্লাহ; তোমাদের পালনকর্তা, সাম্রাজ্য তাঁরই। তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তুচ্ছ খেজুর আঁটিরও অধিকারী নয়। (ফাতির-১৩)
* বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। (সুরা ইমরান-২৬)
* তিনি কাউকে নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না। (কাহফ-২৬)
* তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতি পালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না। (আরাফ-৩)
* বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। (নিসা-৬৪)

এখানে উল্লেখ্য যে কোরানে কোথাও সরাসরি ইসলামী রাষ্ট্র কিংবা শরীয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়নি বা সেরকম নির্দেশও দেয়া হয়নি। এই প্রেক্ষিতে আমার নিজস্ব মতামত হচ্ছে কোরান নাজিলের কালকে মক্কা এবং মদীনা এই দুই সময়ে যদি আমরা ভাগ করি, তাহলে দেখা যাবে মক্কার জীবনে মোহাম্মদ এবং তার অনুসারীগণ নিজেদের জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল বা রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক ভাবনার চেয়ে নিজের মতাদর্শ প্রচার এবং জীবন বাঁচানোই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। ফলে সে সময়কার আয়াতগুলোতে ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার বিষয়ে কোন নির্দেশনা নেই।

অন্যদিকে মদীনা হিজরতের শুরু থেকেই মোহাম্মদ সেখানকার প্রধান প্রশাসকের ক্ষমতা লাভ করেন। মদিনায় মোহাম্মদের শক্ত কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলনা। বিবাদমান গোত্রগুলো মোহাম্মদেকে নিজেদের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ক্ষমতা পেয়েই নিজের মনমত নিয়ম-কানুন তৈরি করতে থাকেন। ফলে এখানেও তার চিন্তায় আসেনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীর কথা, কারণ দাবী করা বা দখল করার আগেই তিনি ক্ষমতা পেয়ে যান। ফলে মদিনার জীবনেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে আলাদা আয়াত নাজিল করাতে হয়নি।

এর ফলে সমস্যা হয়েছে পরবর্তীকালের মুসলিম শাসকদের। যেহেতু তাদের সামনে কোরানের সরাসরি কোন আয়াত নেই, তাই তারা আল্লাহর একত্ববাদ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলকে ক্ষমতা দখল কিংবা ইসলামী/শরীয়া রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

এতো গেল শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীর প্রসঙ্গ। কিন্তু শরীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তারপর সে রাষ্ট্র কিভাবে চলবে সে সংক্রান্ত বহু আয়াত আছে কোরানে এমনকি হাদিসেও। সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব পরবর্তী পর্বগুলোতে।