বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলাফল। আন্তর্জাতিক এই ষড়যন্ত্রী চক্রের একটি খুটি ছিল লিবিয়ার গাদ্দাফি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের গাদ্দাফি লিবিয়ায় আশ্রয় দিয়েছিল, সহযোগিতা করেছিল। পরবর্তীদের খুনিদের পুনর্বাসনে সহযোগিতা করেছিল লিবিয়া।

গাদ্দাফি বাঙলা ও বাঙালির পুরোনো শত্রু। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অন্যতম মিত্রদেশ ছিল লিবিয়া। লিবিয়া সেসময় পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন এবং কূটনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ০৭ এপ্রিল, ১৯৭১-এ লিবিয়ার গাদ্দাফির সরকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে পূর্ব-পাকিস্তানে গৃহীত পাকিস্তানি পদক্ষেপ তথা গণহত্যাকে সমর্থন জানায়।

ছবিটি ১৯৭৩ সালের। আলজেরিয়াতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর সম্মেলনে তোলা। প্রথমবারের মত মুখোমুখি বঙ্গবন্ধু ও গাদ্দাফি; দুজনেই সৌজন্য ভাবে হাসছেন। এই ছবিটি আসলে একটি আইরনি; গাদ্দাফির চোখে মহাশত্রু বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্টপোষক লিবিয়ার গাদ্দাফি।

গাদ্দাফির লিবিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করতো। শেখ মুজিবকে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভাঙার কারিগর তথা, মুসলিম বিশ্বের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং লিবিয়া যেকোন মূল্যে যেকোন ভাবে পাকিস্তান তথা ইসলামের শত্রুদের মোকাবেলা করাকে সমর্থন করতো। মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় গাদ্দাফির লিবিয়া পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল।

গাদ্দাফির লিবিয়ার এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে দৈনিক হুরিয়াতে ১০ এপ্রিল, ১৯৭১-এ প্রকাশিত নিবন্ধের কিছুটা অংশ তুলে ধরা হলোঃ

We give our Arab Muslim Support to those who are striving to keep Pakistan unified. We supported Mujib in his just demand but when he claimed separation and sought to destroy the unity of the country, we have no option but to stand against the secessionist ideas and support the government in any action necessary to preserve the unity of Pakistan.

লিবিয়ার পত্রিকা আল-বালাগ্ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলাম ও মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
লিবিয়ার সে সময়কার আরেকটি প্রধান পত্রিকা আল-থাওরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও সোভিয়েত ষড়যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করে।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় গাদ্দাফির কাছে ছিল ইসলামের পরাজয়। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অন্যতম এক শত্রুর নাম। তাই, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হয় লিবিয়ার গাদ্দাফি।

১৯৭৫ সালের ০৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিশেষ বিমানযোগে দেশত্যাগ করে প্রথমে রেঙ্গুন হয়ে ব্যাংকক যায়। এরপর সেখান থেকে পাকিস্তান হয়ে লিবিয়ায় আশ্রয় নেয়। লিবিয়ায় খুনিরা গাদ্দাফির ভিআইপি অতিথির মর্যাদা পায়। গাদ্দাফির লিবিয়া এই খুনিদের আশ্রয় দেয়, ভরণপোষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা করে। গাদ্দাফির পৃষ্ঠপোষকতা ফারুক লিবিয়ায় জনশক্তি রপ্তানী ব্যবসায় ও রশীদ লিবিয়ায় ঠিকাদারির ব্যবসায়ের মালিক হয়েছিল।

আশির দশকে ফারুক-রশীদ বাংলাদেশ-লিবিয়া ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি গঠন করে। এই সংগঠনের মাধ্যমে অর্থ এনে খুনিরা এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৭ সালের ৩ আগস্ট শেরাটন হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে ফারুককে সভাপতি করে ফ্রিডম পার্টি প্রতিষ্ঠা করে। এই ফ্রিডম পার্টি মূলতঃ ছিল একটি সন্ত্রাসী তাবেদারি সংগঠন। ফ্রিডম পার্টির কর্মীরা গাদ্দাফি সরকারের সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল লিবিয়ায়। ফ্রিডম পার্টির ক্যাডাররা সারাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ওরা ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা করেছিল। লিবিয়া এ সময়কালে বছরে তৎকালীন ১-২ মিলিয়ন ডলার অনুদান পাঠাতো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে গাদ্দাফির অতি ঘনিষ্টতার আরেকটি বড় প্রমাণ হোল- ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর গাদ্দাফি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখেছিলেন যেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্ষমা করে দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আশ্রয়-ভরনপোষণ থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী তাবেদারি সংগঠন ফ্রিডম পার্টিকে পৃষ্ঠপোষকতা ও শেখ হাসিনার কাছে খুনিদের ক্ষমা করে দেয়া অনুরোধ থেকে এবিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ থাকে না যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রী হিসেবে লিবিয়ার গাদ্দাফি সক্রিয় ভূমিকায় ছিল।

সহায়ক সূত্রঃ

১. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুসলিম বিশ্ব – আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন
২. IMPACT OF THE INDO-PAKISTANI WAR ON THE MIDDLE EAST – NAJIB E. SALIBA
৩. Gaddafi And The Killers Of Sheikh Mujibur Rahman – Analysis – Rajeev Sharma
৪. Gaddafi had sought pardon for killers of Mujib