একজন কাঠমিস্ত্রির গল্প:

২০১০ সালে আমি মতিউল্লাহ ওরফে মতি ঘারা নামে একজন কাঠমিস্ত্রি লোকের সাথে পরিচিত হই। ঘারা একটি উর্দু শব্দ যার বাঙলা করলে অর্থ দাঁড়ায় কাঠমিস্ত্রি। আমার সাথে পরিচয়ের সময় তার বয়স বোধহয় ৭০ এর কাছাকাছি হবে। মতি উত্তর পাঞ্জাবের মাখাদ অঞ্চলের আটক নামে একটা জেলা শহর থেকে এসেছেন যেটা একইসাথে আমারও পূর্ব পুরুষের পৈত্রিক এলাকা।

আমার দাদু ১৯৫০ সালের দিকে মতিকে কাঠমিস্ত্রির কাজ করা জন্য নিয়োগ দেন। কয়েক বছর পরে ১৯৬০ সালে দাদু করাচীতে টেক্সটাইল মিল দিলে মতিকে সেখানে বদলি করেন। সে বছরই মতি ঘারা চাকরি ছেড়ে দিলেন, কারণ তিনি নতুন একটা চাকরি পেয়ে মুসলিমদের পবিত্র শহর সৌদি আরবের মক্কায় পাড়ি জমান। ঠিক একই বছর আমারও জন্ম হয়। তিনি আমাকে ঠিকই মনে রেখেছেন, যদিও তার কোন স্মৃতিই আমার মনে নেই।

যাইহোক, একবার আমার দাদুর সাথে দেখা করতে গিয়ে মতি ঘারার সাথে আলাপ হয়, সেটা হবে ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি একটা সময়ে। তার সাথে আলাপের সময়ে দেখলাম তিনি বার বার বিমর্ষ হয়ে পড়ছেন। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম অতীত স্মৃতি নিয়ে তিনি কোন কথা বলতে চান না।
তিনি পাঞ্জাবি ভাষায় বললেন, আমি তোমার দাদুর কাছে এসেছি আমার ছেলে মুনিরের খোঁজে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে আপনার ছেলের?

বেদনা ভারাক্রান্ত যেন গভীর খাঁদে ডুবে যাওয়া কণ্ঠে তিনি উত্তর দিলেন, সৌদি আরবে তার শিরশ্ছেদ হয়েছে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত আমি জানতাম না। সৌদি কর্তৃপক্ষ মুনিরের কী হয়েছে আমাকে বলতে অস্বীকৃতি জানায়, আর পাকিস্তানী দূতাবাস জানায়, আপনার ছেলে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে সে বিষয়ে আমাদের কোন তথ্য নেই। কয়েক বছর পরে আমি জানতে পারি, তাকে রিয়াদে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। মতি ঘারা একজন সুদক্ষ কাঠমিস্ত্রি। তিনি করাচীর চাকরি ছেড়ে স্ত্রী এবং তিনটা ছোট ছোট ছেলে নিয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে মক্কায় চলে যান। ১৯৬৭ সালে তিনি একজন আরব যুবরাজের মালিকানা এবং একজন পাকিস্তানী দ্বারা পরিচালিত আসবাবপত্রের কারখানায় কাজ শুরু করেন। মতি ছিলেন তেল সমৃদ্ধ সৌদি আরবে পাকিস্তান থেকে আগত প্রথমদিকের অভিবাসী।

১৯৬০ সালে মক্কা শহর

মতি বলতে লাগলেন, আমি যখন সৌদি আরবে যাই তখন সেখানে পাকিস্তানী ছিল না বললেই চলে। সৌদি আরবের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখনও অনুর্বর অসমতল, অতিসামান্য কিছু উঁচু ভবন আর অনুন্নত রাস্তা। সবকিছু তখন সবে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে, ১৯৬৪ সালে যখন সৌদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক সন্তান ক্ষমতায় আরোহণ করলেন। তিনি সৌদি আরবকে পৃথিবীর মধ্যে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হলেন। তিনি ১৯৩৮ সালে আবিষ্কৃত তেল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মরুভূটিতে স্বর্গ রচনার অভিলাষে লেগে গেলেন। সেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সন্তানের নাম ফয়সাল। সৌদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজের মৃত্যুর পরে তার ছেলে সউদ পিতার আসনে স্থলাভিষিক্ত হলেন। কিন্তু ফয়সাল বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। তিনি বাদশাহ’র বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন, বর্তমান বাদশাহ সৌদি আরবের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছেন এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় অক্ষম, অদক্ষ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সফল ফয়সাল বাদশাহ সউদকে সিংহাসনচ্যুত করে ১৯৬৪ নিজেই নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করলেন; বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ।

ক্ষমতা গ্রহণ করে সুদূর প্রসারী বাদশাহ ফয়সাল উদ্বিগ্ন হয়ে খেয়াল করে দেখলেন, তার রাষ্ট্র ইসলামের জন্মভূমি হলেও মুসলিমবিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মিশর থেকে। বাদশাহ’র দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল মিশরের নেতা এবং শাসকগণের ধর্মীয় উদারনীতি, বিশেষ করে গামাল আবুল নাসেরের বাম ঘেঁষা সেক্যুলার মতাদর্শ, আরব জাতীয়তাবাদ আর বাথ পার্টির সমাজতান্ত্রিক চেতনা মুসলিমদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না।

ঠিক এই কারণেই বাদশাহ ফয়সাল, আবু নাসের শাসনে মিশর থেকে পালিয়ে আসা এবং নির্বাসিত ধর্মীয় উগ্রপন্থী “মুসলিম ব্রাদারহুড” সদস্যদের অকাতরে সৌদি আরবে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে লাগলেন। তিনি পরিকল্পনা করলেন আরব জাতীয়তাবাদের বিপরীতে কিভাবে ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি করা যায়। বাদশাহ ফয়সাল ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন ইসলাম যতটা ধর্ম, তার থেকে বেশি রাজনীতি এবং তার থেকেও বেশি সাম্রাজ্যবাদ। একমাত্র ইসলামের সাহায্যেই বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করা যাবে। তিনি অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মুসলিম দেশগুলোতে পেট্রো ডলার ছিটানো শুরু করলেন। গ্রামে গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠল পাকা মসজিদ এবং মাদ্রাসা। কিন্তু এতসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সময় তো একটু লাগবেই, তাই না? সুতরাং বিচক্ষণ ফয়সাল হাতগুটিয়ে বসে না থেকে মিশরের আবু নাসেরকে মোকাবেলা করার জন্য সৌদি আরবে সর্ব ক্ষেত্রে আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা হাতে নিলেন। তিনি সৌদি আরবের রাস্তা, সড়ক, জনপথ, অবকাঠামো আধুনিকায়নে বিপুল সংখ্যক আমেরিকান ইউরোপিয়ান কোম্পানি এবং প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ দিলেন। বিশ্ববিখ্যাত ভোগ্যপণ্যের কোম্পানিদের আহ্বান করলেন তার দেশে শাখা বিস্তারের জন্য।

কিন্তু বাধ সাধল তার পিতার আমলে নিয়োগ প্রাপ্ত অতিরক্ষণশীল ধর্মীয় নেতারা। বাদশাহ ফয়সাল সমালোচনার মুখে পড়ে গেলেন। ফয়সালের পিতা আবদুল আজিজের শাসন আমলেও আমেরিকান ও ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, কৌশলী, প্রযুক্তিবিদ তেলের খনিতে কাজের জন্য আসত, কিন্তু ফয়সালের সময়ে পশ্চিমাদের আনাগোনা রাতারাতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেল।

বাদশাহ ফয়সাল মিশরের উদারপন্থী নাসের এবং আরব অঞ্চলের সেক্যুলার ইরাক, সিরিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়াকে রুখতে সৌদি আরবের আধুনিকায়নে মরিয়া হয়ে উঠলেন। কারণ এইসব দেশের উদারপন্থী নেতারা মনে করতেন সৌদি আরব পিছিয়ে পড়া সামন্ত এবং গোষ্ঠীগত দেশ যারা আধুনিক চিন্তাভাবনা এবং প্রগতির সাথে মুসলিমদের পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যর্থ। বাদশাহ ফয়সালকে সৌদি আরবের আধুনিকায়নে প্রতি পদক্ষেপে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়েছে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে মনে রাখতে হবে, বাদশাহ ফয়সালের পিতা সৌদি সাম্রাজ্য গড়ে তুলছিলেন মরুভূমির উগ্র ‘ইখওয়ান’ বেদুইন যোদ্ধাদের সাহায্য নিয়ে।

আবদুল আজিজ বেদুইন ইখওয়ান সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে তখনকার সময়ে মক্কার ক্ষুদ্র জাতিগত দ্বন্দ্ব দমন এবং জর্ডান থেকে আগত হাশেমি শাসকদের পরাজিত করে ১৯২৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে তার নিজের সউদ গোত্রের নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম দেন সৌদি। ইখওয়ান সম্প্রদায় ইসলামের গোঁড়া অনুসারী যারা পরে ওহাবি সালাফিস্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ত্রিশের দশকে তেলের খনি আবিষ্কার হওয়ার পরে আবদুল আজিজের আহবানে দলে দলে যখন পশ্চিমা ব্যবসায়ী আর কৌশলীরা সৌদি আরবে আসতে শুরু করে তখন ইখওয়ান সম্প্রদায় বাদশাহ’র বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলে বলতে লাগল, বাদশাহ শয়তানের সাথে হাত মিলিয়েছেন।

আবদুল আজিজ ইখওয়ান সম্প্রদায়কে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করলেন যে, “সৌদি আরব হবে পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র” যেখানে কঠোরভাবে শরিয়া আইন মেনে চলা হবে। সে জন্য তেল সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে এবং এর জন্য পশ্চিমা সুদক্ষ জনবলের দরকার আছে। কিন্তু ইখওয়ান সম্প্রদায় তাদের দাবীতে অনড়। তারা আবদুল আজিজ সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ইসলামের পবিত্র-ভূমি অ-পবিত্রকারী পশ্চিমাদের আক্রমণ করার হুমকি দেয়। বাদশাহ আবদুল আজিজ ইখওয়ানদের হুমকিতে সতর্ক হয়ে গেলেন এবং রাতারাতি সউদি-ইরাক সীমান্তে ইখওয়ানদের শক্ত ঘাঁটিতে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে দিলেন। শত শত ইখওয়ান গোত্রের মানুষ মরতে লাগল পাইকারি হারে। ইখওয়ান নেতারাও সৌদি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। সৌদি বাহিনী আর ইখওয়ান বাহিনী ক্ষমতা আর আদর্শের লড়াইয়ে মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেল। সিদ্ধান্তের লড়াই কে টিকে থাকবে। অত্যাধুনিক ব্রিটিশ অস্ত্রে সুসজ্জিত সৌদি বাহিনী আক্ষরিক অর্থেই ইখওয়ান গোত্রকে কচুকাটা করে ফেলল।

ইখওয়ান যোদ্ধাদের একটি গ্রুপ (১৯২৯)

ইখওয়ান গোত্রের অল্প কয়েকজন যোদ্ধা এই যুদ্ধে প্রাণে বেঁচে ছিলেন এবং মরুভূমিতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুহম্মদ বিন সাইফ এমনই একজন বেঁচে যাওয়া ইখওয়ান যোদ্ধা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এই মুহম্মদ বিন সাইফই ১৯২০ সালে আজকের বাদশাহ আবদুল আজিজকে ক্ষমতার চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার প্রধান কারিগর ছিলেন। সৌদি বাহিনীর হাতে ইখওয়ানদের পরাজয়ের সাত বছর পরে সাইফ বিয়ে করলেন এবং একটা পুত্র সন্তানের বাবা হলেন। সাইফ তার নাম রাখলেন জুহাইমান আল ওতায়বি।

আমার পুত্র:

ইখওয়ান গোত্রকে নির্মূলের পর বাদশাহ আবদুল আজিজ আরবে ইসলামিক আইন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী আলেম প্যানেল তৈরি করলেন যারা শরিয়া মোতাবেক পরামর্শ দিবে। কিন্তু শর্ত দেয়া হলো, তারা কখনও রাজবংশের কোন কাজের সমালোচনা করতে পারবে না। আলেম প্যানেলের প্রধান হলেন আবদ আল আজিজ ইবনে বাজ নামের একজন অন্ধ ইসলামি চিন্তাবিদ। কিন্তু ১৯৪০ সালে ইবনে বাজ আরবের পবিত্র ভূমিতে ‘শয়তানের আখড়া’ বানানোর জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার হয়ে গেলেন ইবনে বাজ। তবে দ্রুত তাকে মুক্তিও দেয়া হলো, মজার বিষয় হলো সৌদি রাজ পরিবারের সমালোচনা করতে পারবেন না এই শর্তে তাকে প্রধান ধর্মীয় নেতা করা হলো, তিনি রাজিও হয়ে গেলেন। কাবা মসজিদে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে অতিউগ্র ধর্মীয় বক্তৃতা দেয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় মদদ পেয়ে গেলেন। তিনি মনে করতেন কম্যুনিস্টদের কারণে আল্লাহর কাছ থেকে আরবের মুসলমানদের মন দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি তার প্রিয় পবিত্র ভূমিতে আধুনিকতার নামে পশ্চিমা বেলেল্লাপনার ঘোর সমালোচনা করে বললেন এই অবস্থা চলতে দেয়া কখনো উচিত নয়। যখন ফয়সাল আরবের আধুনিকায়ন শুরু করলেন, ইবনে বাজ মোটেও খুশি হতে পারেন নি। কিন্তু ফয়সাল ইবনে বাজকে রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে কোন হুমকি মনে না করায় তার ব্যক্তিগত অসন্তোষকে তেমন পাত্তা দিলেন না।

মতি ঘারা ১৯৬০ সালে কাবা মসজিদে ইবনে বাজের আগুনঝরা ধর্মীয় বক্তৃতা শুনেছিলেন, যার ধর্মীয় বয়ানে মিশে থাকত বিধর্মীর প্রতিহিংসার আগুন আর ঘৃণা। মতি ঘারা আমাকে বললেন, “ফয়সালের কর্মকাণ্ডে বাজ খুশি ছিলেন না, তিনি কখনো ফয়সালের বিরুদ্ধে টু শব্দ করেন নি, কিন্তু সবসময় বলতেন, পবিত্রভূমি শয়তানের আখড়া হয়ে যাচ্ছে।” মতি ঘারা বলতে লাগলেন, পরবর্তী কয়েক বছরে সৌদি আরবের শহরগুলো আমূল বদলে গেল। অধিক সংখ্যায় বিদেশী নাগরিকের পদচারনায় ভরে গেল শহর। এর মধ্যে কাজের জন্য দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে প্রচুর শ্রমিক এসেছে, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন রাস্তা ও উঁচু উঁচু ভবন। এবং এই সময়ের মধ্যে মক্কায় হজ্জ পালনের জন্য আগতদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। সৌদি নাগরিক, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে ফয়সাল ভীষণ জনপ্রিয়। অন্যান্য গরীব মুসলিম দেশ থেকে আগত সৌদি আরবে সদ্য-স্থায়ী মানুষ ফয়সালকে ভীষণ ভালবাসে। কারণ তিনি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। মতি ঘারা বলতে লাগলেন, সুন্নি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আমার সন্তানেরা সৌদি আরবে অবস্থিত ইরানের স্কুলে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। ইরানে তখন শাহ’র শাসনামল চলছে এবং ইরানি স্কুলগুলোতে ধর্ম শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। তখনকার দিনে সৌদি আরবে কোন পাকিস্তানী বিদ্যালয় ছিল না। মতি ঘারার বড়ছেলে মুনিরের যখন ১৬ বছর বয়স তখন তার মা তাকে পাকিস্তানের এক ইসলামী ধর্মগুরুর কাছ থেকে ধর্মশিক্ষা নেয়ার জন্য আদেশ দিলেন। মক্কায় দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে এই আলেমদেরকে আহ্বান করলেন।

এই মাদ্রাসাগুলো প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল পাকিস্তান, ভারতীয় এবং অন্যান্য দরিদ্র দেশ থেকে আগত শ্রমজীবী পরিবারের শিশুদের মাঝে সুকৌশলে ওয়াহবিজমের বীজ বপন করে দেয়া। মতি ঘারা জানালেন, তার ছেলে মুনির ১৯৭৩ সাল থেকে মাদ্রাসায় যাওয়া শুরু করে। তখন থেকেই সে আমাদের প্রতিদিনের প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করল। নতুন স্কুল থেকে সে জানতে পারল, ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানেরা আসলে ইসলামের কিছু জানে না এবং গুনাহ করছি। ইতিমধ্যেই আমি সৌদি আরবে আমার অবস্থান তৈরি করে ফেলেছি, তাই মুনিরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।

শুরু থেকেই আমার খুব বিরক্তি শুরু, যখন দেখলাম মুনির তার ছোটভাইকেও ইরানের স্কুল বাদ দিয়ে মাদ্রাসায় নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে এরা তাহলে পড়বে কোথায়? বছরের মাঝ সময়ে ইরানীদের পরিচালিত স্কুল ছেড়ে দেয়াকে স্কুল কর্তৃপক্ষ মানবে না। তাছাড়া সে তো আরবি বলতে বা বুঝতে পারে না। ইরানের স্কুলে অন্তত শিশুদেরকে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করত। আর অভিবাসী ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকানদের প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমা ধারার স্কুলে তো অনেক খরচের ব্যাপার। মুনির বলল, তার ভাইয়ের এইসব ইতিহাস, বিজ্ঞানের মত ফালতু বিষয়ে পড়ার কোন দরকার নাই। সে আমার সাথে মাদ্রাসায় পড়বে এবং এই বিষয়ে আমার স্ত্রীর সম্মতি ছিল। মুনির আমাকে বোঝাল, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ইসলাম ধর্ম শিক্ষা ফরজ করা হয়েছে। আমার ছেলে মুনির আর আমার মধ্যে এই বিষয়ে ভীষণ বিরক্তিকর তর্ক বিতর্ক দেখা দিলো। এক পর্যায়ে ছোট ছেলেকে ইরানের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে আমি পাকিস্তানে আমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। সেখানে কয়েক বছর পাকিস্তানের সরকারি স্কুলে পড়েছিল, কিন্তু পড়ালেখা আর শেষ করতে পারল না। সে এখন কৃষিকাজ করে। আহারে! মুনিরের চাপে পড়ে আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিলাম!!

স্কুল:

১৯৭৩ সালের মিশর আর ইজরায়েল যুদ্ধে সৌদি আরব হঠাৎ করে তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়। আহ! সৌদি আরবের ঘরে যেন দৈবধন আসতে লাগল। ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এলেন আনোয়ার সাদাত। রাশিয়ার বানানো আধুনিক অস্ত্র এবং বিমানে সজ্জিত হয়ে মিশর এবং সিরিয়া জোটের সাময়িক বিজয় অর্জনে মিশর জুড়ে আনোয়ার সাদাতের জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী। যাইহোক, আমেরিকার সাহায্যে ইজরায়েল মুহূর্তেই ঘুরে দাঁড়িয়ে গেল এবং ততক্ষণে মিশর-সিরিয়া জোট ছত্রখান।

এখনই ফয়সালের সময় মুসলিম বিশ্বে নিজে নিজেকে সর্বোচ্চ নেতা প্রমাণ করার। ফয়সাল তেল উৎপাদন কমিয়ে তেলের দাম তিনগুণ বাড়িয়ে দিলেন। ফলে তিনি তেলের ব্যবসায়ে পশ্চিমাদের কাছ থেকে বিশাল অর্থ ঘরে তুলে নিলেন। ফয়সালের উঠতি ইমেজ দেখে সাদাত ফয়সালকে তোষণ শুরু করলেন। ফয়সাল, সাদাতকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যদি তিনি তার দেশ থেকে নাসেরিজম দূর করেন তাহলে মিশরের অর্থনীতিতে চাঙ্গা করে দেবেন। সাথে সাথেই সাদাত মিশর থেকে রাশিয়ার মিলিটারি ক্যাম্প তুলে নেয়ার জন্য রাশিয়াকে বলে দিলেন। ফয়সালের নির্দেশে সাদাত, নাসেরের আমলে বহিষ্কৃত মুসলিম ব্রাদারহুডকে দেশে ফিরিয়ে নিলেন।

১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিশরের কর্মকর্তাদের সাথে সাদাত (মাঝখানে)

মতি ঘারা স্মৃতি থেকে বলতে লাগলেন, মুনির একদিন ফিরে এসে জানালো সে তার কিছু বন্ধুদের সাথে মিশরে যাচ্ছে। পরে আমি জেনেছিলাম তার সেই বন্ধুদের প্রায় সবাই ছিল আসলে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য। তাদের কেউ কেউ পাকিস্তান থেকে আগত। তারা পাকিস্তানিদের নিয়ে পাকিস্তানে মুসলিম ব্রাদারহুড করতে চায়। কিন্তু শুরুতেই ভুট্টো তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে জেলে ভরে দিলো। এই ঘটনায় মুনির বলল, ভুট্টো দ্বিমুখী খেলা খেলছে। সে একই সাথে ফয়সালের দ্বারা প্রভাবিত এবং আবার পাকিস্তানে মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ করেছে। প্রচণ্ড রাগে ক্ষোভে মুনিরকে আগুনের মত দেখাচ্ছে। মুনির অভিযোগের সুরে বলতে লাগল ভুট্টো চাইছে ফিলিস্তিনের পিএলও পাকিস্তানে কূটনৈতিক যাত্রা শুরু করুক যারা প্রকৃত অর্থে মুসলমানই না। কায়রো থেকে ফিরে মুনির ঘোষণা দিলো, আনোয়ার সাদাতও আসলে সত্যিকার মুসলিম নন। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে সাদাত আলগা একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মাত্র। বাদশাহ ফয়সালের প্রতিও মুনিরের শ্রদ্ধা নেই। মুনিরের মত ফয়সাল মুসলিমবিশ্বে রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে অর্থ খরচ করছেন ঠিকই কিন্তু ইসলামের জন্য তিনি কিছুই করছেন না।

মুনিরের পিতা, মতি ঘারা বলতে লাগলেন, স্কুলে মুনির ধর্মীয় উগ্র বিশ্বাসের চর্চা ছাড়া আর কোন শিক্ষা অর্জন করেনি। “আমি (মতি) তাকে বলেছিলাম, তুমি কি করতে চাও ভবিষ্যতে? কিভাবে বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে চলবে?” এ কথার উত্তরে মুনির বলল, ইসলামের সেবা করা ছাড়া তার জীবনে কোন চাওয়া নেই। আমার স্ত্রী খুবই ধার্মিক। কিন্তু যখন মুনির জানালো, তার মায়ের ধর্মচর্চা সঠিকভাবে হচ্ছে না, তখন ভদ্র মহিলা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। মুনির যখন বলল টিভি দেখা হারাম, রেডিও শোনা গুনাহ তখন আমরা চমকে উঠেছিলাম।

মুনিরের কাছে এইসব শুনতে শুনতে আমরা বিরক্ত। সৌদির টিভি, রেডিওতে তো অসামাজিক কিছু হচ্ছে না। টিভি, রেডিওতে সবসময় আরবি ভাষায় ইবনে বাজের ধর্মীয় বয়ান চলছে। তাহলে সমস্যা কোথায়? কিন্তু মুনির ধর্মীয় মতবাদে খুবই গোঁড়া অবস্থানে রইল। তখন আমি মুনিরের স্কুলে গিয়ে প্রিন্সিয়াপালকে জানালাম আমার সন্তানকে (মুনির) এখানে আর পড়াব না, আপনি তাকে ছাড়পত্র দিয়ে দিন। দুইদিন পরে দুইজন পাকিস্তানি আর একজন বাংলাদেশি আমার সাথে দেখা করে ছেলেকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার ঘটনায় সতর্ক করে দেন। কারণ এটাকে সৌদি কর্তৃপক্ষ সরকার বিরোধী আচরণ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। তারা বলল আমার তো আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করা উচিৎ কারণ আমার সন্তান ইসলামের দ্বীনি শিক্ষার পথে আছে। তার কিছুদিন বাদে একজন বিশাল-দেহী মানুষ আমার সাথে দেখা করতে এলেন, এবং ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বলল, আমি যেন সন্তানকে ( মুনির ) সাবধান করে দিই। আমি সত্যিই জানতাম না কে এই সৌদি ভদ্রলোক।

১৯৭৫ সালে বাদশাহ ফয়সাল আততায়ীর হাতে খুন হন। খুন প্রসঙ্গে অফিসিয়ালভাবে প্রকাশিত সৌদি দলিলে দেখা যাচ্ছে, খুনি একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং বিপথগামী যুবক। প্রায় দশ বছর আগে এক দাঙ্গায় সৌদি পুলিশের গুলিতে তার এক কাজিন মারা যায়। সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই এই যুবক বাদশাহকে খুন করেছে। দাঙ্গা শুরু হয়েছিল কিসের জন্য জানেন? ১৯৬৫ সালে রিয়াদে টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তখন ধর্মীয় আদর্শিক ও তাত্ত্বিক নেতা ইবনে বাজ এর সমর্থকরা বাদশাহ ফয়সালের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা।

সৌদির সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এলো। ফয়সাল যুব সমাজের কাছে অনেক জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত সৌদির চেহারা অন্যরকম হতে পারত। মতি ঘারা বলতে লাগলেন, ফয়সালের সময় পাকিস্তানি নাগরিকেরা সরকারের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পেত। কিন্তু ফয়সাল খুন হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানিদের সাথে স্থানীয় আরবীয়রা খারাপ ব্যবহার করত।

আমি মতিকে প্রশ্ন করেছিলাম, বাদশা ফয়সালের মৃত্যুতে মুনিরের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
মতি বলতে লাগলেন, এই সময়ে আমরা মুনিরের দেখা পেতাম না বললেই চলে। হঠাৎ একদিন কোথা থেকে সে উদয় হয়ে বলল, ফয়সাল সৌদি আরবকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বাদশাহ সৌদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলেছে, সৌদির পবিত্র মাটি অপবিত্র করে ফেলেছে। কিন্তু মুনির যখন বলল, এইবার দেশ থেকে দুর্নীতি দূর হবে, সৌদি আবার পবিত্র হয়ে উঠবে, তখন আমার কাছে মুনিরকে খুবই বিরক্তিকর মনে হল। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম তাহলে কি বাদশাহ খালিদ সব দুর্নীতি দূর করে দেবে? মুনির আমাকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, একজন বাদশাহ কখনো অনাচার দুর্নীতি দূর করতে পারে না। তার জন্য দরকার আল্লাহর পাঠানো কোন আলেম পরহেজগার মানুষের।

পরহেজগার এবং সেই একজন জুহায়মান:

১৯৩০ সালে পরাজিত সেই ইখওয়ান যোদ্ধা মুহম্মদ বিন সাইফের একটা পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। নাম তার জুহায়মান আল ওতায়বি। সে বড় হতে লাগল মরুভূমিতে বেদুইন পরিবারে। কিন্তু সাধারণ কিছু ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া সে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেল না। শৈশব থেকে সে তার পূর্বপুরুষের দুর্দশার কাহিনী শুনতে শুনতে বেড়ে উঠল। কিভাবে তার পূর্বপুরুষ সউদ পরিবারকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়েছিল আর কিভাবে সেই একই পরিবার তাদের পূর্বপুরুষকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল। একটু বড় হয়ে জুহায়মান সৌদি আরবের এক অনুন্নত অঞ্চলে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ট্রাক ড্রাইভারের চাকরিতে যোগদান করে। পাশাপাশি সে কুয়েত থেকে উটের পিঠে করে সিগারেট চোরাচালানির অবৈধ ব্যবসা করত।

১৯৭৩ সালের গাড়িচালকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মদিনা চলে আসে। সেখানে সে ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায় থাকত আর মাঝে মাঝে মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবদ আল-আজিজ-ইবনে বাজের জ্বালাময়ী ভাষার ধর্মীয় বয়ান শুনত। আবদ আল-আজিজ-ইবনে সৌদি আরবের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা যদিও তখন পর্যন্ত সৌদি সরকারের বেতন-ভুক্ত ইমাম ছিলেন। ফয়সালের সময়ে আবদ আল-আজিজ-ইবনে বাজ কিছুটা অগোচরে সরকারের সমলোচনা করত। ফয়সালের মৃত্যুর পর খালিদ বাদশাহ হয়ে বসলেন এবং তার ছোটভাই যুবরাজ ফাহাদ তার পিতার শুরু করা উন্নয়নমুলক কাজের গতি আরও ত্বরান্বিত করে দিলেন। মক্কা, মদিনায় বিলাসবহুল বিপনিবিতানের যাত্রা শুরু করে দিলেন। সৌদির টেলিভিশনে চলতে লাগল আমেরিকার নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল। সেই সাথে যুবরাজ ফাহাদ লেইট নাইট পার্টি, মদ, জুয়া, নারীতে আসক্ত হয়ে ‘প্লে বয়’ খেতাব অর্জন করে ফেললেন।

আবদ আল-আজিজ-ইবনে বাজ তো রেগে অগ্নিশর্মা। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় বয়ানে তিনি সরাসরি খালিদ এবং ফাহাদকে আক্রমণ করে বয়ান দিতে লাগলেন। তিনি সিগারেট এবং প্রকাশ্যে হাত তালি দেয়া নিষিদ্ধ করতে সরকারের কাছে দাবী করলেন। ফয়সাল নারীদেরকে অফিসের কাজ, চাকরি করার অনুমতি দিয়েছিলেন, খালিদ কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিয়োগ উৎসাহিত করলেন। আবদ আল-আজিজ-ইবনে বাজ বলতে লাগলেন নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে শয়তানের ইশারাতে।

কিন্তু যেহেতু বাজের বেশিরভাগ শ্রোতা হলো অন্য দেশের অভিবাসী অথবা জুহায়মানের মত ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম সেহেতু খালিদ বাজকে খুব একটা পাত্তা দিলেন না। ১৯৭৬ সালে আবদ আল-আজিজ-ইবনে বাজ সিদ্ধান্ত নিলেন এই শয়তানের বদ, গুনাহর কাজ বন্ধ করতে হলে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। যাদের কাজ হবে সৌদি সাম্রাজ্যে আধুনিকতার নামে বেলেল্লাপনা বন্ধ করা এবং যারা পবিত্র ভূমির পবিত্রতা এবং বিশ্বাস রক্ষা করবে। তিনি এর নাম দিলেন দাওয়া সালাফিয়া এবং সৌদি-জুড়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহে নেমে পড়লেন। জুহায়মান এরকম একজন সালাফিস্ট। সে দ্রুত পদোন্নতি করতে লাগল। হাজার হাজার সৌদি নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে ১৯৭৮ সালের মধ্যে দাওয়া সালাফিয়া খুবই শক্তিশালী ধর্মীয় সংগঠনে পরিণত হয়ে গেল। সৌদি নাগরিকের বাইরে ইয়েমেন, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, সুদান, সোমালি, মিশর এমনকি আমেরিকার কিছু কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মান্তরিত মুসলিম বাজের সংগঠনে যোগ দিলো।

মতি বলতে লাগলেন, কয়েক বছর পরে আমরা জেনেছিলাম মুনির বাজের দাওয়া সালাফিয়া সংগঠনে যোগ দিয়েছিল। তারা সাধারণত সৌদির সাধারণ ঘরের অল্প বয়সী যুবকদের দলে নিত। ভাগ্য অন্বেষণে আসা শ্রমিক যুবকরাও দাওয়া সালাফি সংগঠনে যোগ দিত। তারা স্কুল প্রশাসনের সাহায্যে স্কুলে ঢুকে তাদের কার্যক্রম প্রচার করত। তারা এই সময়ে শিক্ষিত যুবকদের দলে ভেড়াতে শুরু করল। কারণ এতে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এই সময়ে আমরা মুনিরকে খুবই কম দেখতে পেতাম। সে কোথায় আছে, কী করছে সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কোন হদিস ছিল না। আমরা ভাবতে শুরু করলাম মুনির বোধহয় আমাদেরকে ঘৃণা করে।

১৯৭৭ সালে জুহায়মানের সাথে দাওয়া সালাফি সংগঠনের সাথে একটু বিচ্যুতি ঘটে গেল। জুহায়মান একদিন ইবনে বাজের প্রচণ্ড সমালোচনা করে বলেছিল, সে কেন এখনো সৌদি বাদশাহর কাছ থেকে বেতন নিচ্ছে? ইবনে বাজ, জুহায়মানকে বুঝিয়ে বললেন, হতে পারে সৌদি রাজপরিবার দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা যুবরাজ মদ্য ও নারী আসক্ত কিন্তু এই রাজপরিবারের কারণেই এই অঞ্চলে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মীয় নিরপেক্ষতাবাদ শিকড় বিস্তার করতে পারছে না। ইবনে বাজের ব্যাখ্যা ও যুক্তি জুহায়মানের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। তাই সে দাওয়া সালাফিয়া ছেড়ে দিলো এবং তার সাথে যোগ দিলো আমাদের গল্পের মুনির। মুনির কোনদিন আমাদের কাছে জুহায়মানের নাম বলে নি। সে শুধু বলত একজন পরহেজগার মুসলিম বান্দা একদিন সৌদির পবিত্র ভূমির পবিত্রতা রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। পরে মুনির নাকি বুঝতে পেরেছিল জুহায়মান সেই আল্লাহর বান্দা।

জুহায়মান সৌদি রাজপরিবারের সীমাহীন দুর্নীতি, বিলাসী জীবন যাপন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা লেখা শুরু করল, কিভাবে যুবরাজ এবং ভিনদেশি বিধর্মীদের মাধ্যমে সৌদির পবিত্র ভূমি অপবিত্র হচ্ছে। এমনকি ইবনে বাজের মত সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা মসজিদে যে বয়ান দিচ্ছেন, বাস্তব জীবনে সেটা পালন করেন না ইত্যাদি বিশদভাবে লিখতে লাগল।

কিছুদিনের মধ্যেই জুহায়মান সৌদি পুলিশের নজরদারিতে পড়ে গেল। বিশেষকরে সে যখন সৌদি আরবে বসবাসরত মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুড অভিবাসীদেরকে কিভাবে সাদাত সরকারের পতন ঘটাবে তাই নিয়ে লিখতে শুরু করে তখন সৌদি সরকার তার পরিচয় জেনে যায়। জুহায়মানের বেশিরভাগ অনুসারী হলো মরুভূমির দরিদ্র বেদুইন পরিবারের যুব সমাজ। এই বেদুইন যুবকেরা সৌদি আরবের বড় বড় শহরে এসে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করলেও নিজেদেরকে বঞ্চিত, অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী মনে করত। সৌদি আরবে কাজ করতে আসা দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার মুসলিম তরুণরাও জুহায়মানের দলে ভিড়েছিল। ১৯৭৭ সালে জুহায়মান তার অনুসারী তরুণ যুবকদের নিয়ে একটা গোপন সংগঠনের যাত্রা শুরু করল। সে তার অনুসারীদের বলত সব ধরণের বিলাসিতা ত্যাগ করার জন্য। অনুসারী কেউই চুল কাটত না, শেভ করত না, এবং নোংরা সাদা জোব্বা পরে “আল্লাহর সত্য বাণী” প্রচার করে বেড়াত। তারা নিজেদের পরিচয়পত্র নষ্ট করে মক্কা, মদিনা এবং রিয়াদে গোপন আস্তানায় একসাথে থাকত, আহার করত, নামাজ পড়ত এবং দীনি ইসলাম প্রচার করত। সৌদি পুলিশ শেষ পর্যন্ত জুহায়মান এবং তার সঙ্গীদের আস্তানার খোঁজ পেয়ে যায় এবং তাদের গ্রেফতার করে। কিন্তু ইবনে বাজের হস্তক্ষেপে সৌদি পুলিশ তাদেরকে ছেড়ে দেয়। তারপর, ১৯৭৮ সালে জুহায়মানের ছোটভাই মহম্মদ আবদুল্লাহ আল কুয়াতানিহাত জুহায়মানকে কোরআনে বর্ণিত শেষ জামানার ‘ইমাম মাহদি’ বলে ঘোষণা করে।

জুহায়মান আল ওতায়বি সঙ্গীদের নিয়ে কিছুদিনের জন্য ছদ্মবেশে অজ্ঞাতবাসে চলে গেলেন। অজ্ঞাতবাস নিজেকে ‘ইমাম মাহদি’ প্রমাণ করা তার জন্য আরও সহজ হয়ে গেল। জুহায়মান তার অনুসারীদের আদেশ দিলেন যেন তারা সংগঠিত হয়। কারণ অত্যাচারী, লোভী বাদশাহ ও তার হিংস্র নিরাপত্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। জুহায়মানের অনুসারীরা অস্ত্র, গোলাবারুদ যোগাড় করতে শুরু করে দেয়। সৌদি নিরাপত্তাবাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র আর তাদের ইউনিফর্ম পরে জুহায়মানের নিজস্ব একটা বাহিনী দাঁড়িয়ে গেল। চোরাচালানির মাধ্যমে ইয়েমেন থেকে যোগাড় করা হলো মেশিনগান, রাইফেল। ইসলামের দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন জনযুদ্ধে বিধ্বস্ত লেবানন থেকে কেনা হলো বোমা, আরও ভারি অস্ত্রশস্ত্র। ১৯৭৮ সালের শেষদিকে জুহায়মান একটা জাল হাদিসের মাধ্যমে ঘোষণা করলো, ইমাম মাহদি এসে গেছে এবং সে নিজেই সেই ইমাম মাহদি যে মক্কার প্রধান মসজিদ পবিত্র কাবা শরীফ থেকে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে।

ঝড়ের গর্জন:

১৯৭৯ সালের ২৯ নভেম্বর হাজার হাজার মুসল্লির উপস্থিতিতে যখন কাবা মসজিদের প্রধান মুফতি ফজরের নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন জুহায়মান ৫০০ অনুসারী নিয়ে ভারী অস্ত্র, বোমা, গ্রেনেড নিয়ে কাবা ঘর জিম্মি করে ফেলল। জুহায়মান কাবা শরীফের টেলিফোন, পানি ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো আর কেউ কেউ মুক্ত হতে পারলেও ভেতরে আটকা পড়ে গেল হাজার হাজার মুসল্লি। জুহায়মান আল ওতায়বি সবথেকে দক্ষ গেরিলাকে কাবার ছাদে নজরদারি করতে পাঠালেন যাতে সরকারি বাহিনী কাবা পুনর্দখল করতে এলে প্রথমেই প্রতিহত করা যায়। আক্রমণের প্রথমভাগেই জুহায়মানের ভারী মেশিনগানের গুলিতে কয়েক ডজন সৌদি পুলিশ নিকেশ হয়ে গেল।

মতি ঘারা এই সময়ে রিয়াদে ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, “সেই সময়ে আমি কাজের জন্য রিয়াদে ছিলাম।” আমি যে বাসায় থাকতাম সেখানে ফোন করল আমার স্ত্রী। সে আমাকে জানায় কাবা মসজিদ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। আমাদের কথা বলার মাঝেই ফোনের সংযোগ কেটে গেল এবং শত চেষ্টা করেও আর সংযোগ করা গেল না। ফোন লাইন সম্পূর্ণ মৃতের মত নিস্তব্ধ। মনের মধ্যে অজানা আশংকার মত একটা কথা উঁকি দিল, তবে কাবা ঘর আক্রান্ত হয় নি তো!! চারিদিকে প্লেগের মত গুজব ছড়িয়ে গেল কাবা মসজিদে কে বা কারা যেন আক্রমণ করেছে। সবাই যেন মুখে কুলুপ এঁটে আছে। কেউ কোন টু শব্দ করছে না। রেডিও টেলিভিশনে এই বিষয়ে কোন খবর প্রচার করছে না। আমি একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে দ্রুত মক্কা চলে এলাম। ট্যাক্সির ড্রাইভার একজ পাকিস্তানী। সে আমাকে জানালো ইতিমধ্যে বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরেরদিন আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলাম তখন সত্যি সত্যিই আমার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম কাবা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। ঠল পুলিশ মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে সবাই দরজা জানালা বন্ধ রাখুন। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। আমি আমি ভাবছিলাম শুধু মুনিরের কথা, কোথায় আছে ছেলেটা। আমি জানতাম সে নিয়মিত কাবা ঘোরে নামাজ পড়তে যায়। আমার স্ত্রী বার বার বলছে মুনিরের খোঁজ খবর নিতে। আমি বাড়ির বাইরে বেরলাম, মুনিরের স্কুলের দিকে হাঁটছি। স্কুল ইতিমধ্যে সিল-গালা করা হয়ে গেছে, সেখানে পাহারা দিচ্ছে সৌদি সামরিক বাহিনী। আমি মুনির! মুনির!! বলে চিৎকার করছি। আর্মি আমাকে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি করছে, তাদের কোনক্রমে ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম।
এমনি কাবা মসজিদে কেউ অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে পারে না। সৌদি সরকার প্রধান প্রধান মুফতি, ইমামদের তলব করলেন অস্ত্র হাতে কাবায় প্রবেশ করার ফতোয়া দেয়ার জন্য। লিখিত ফতোয়া নিয়ে সৌদি আর্মি কাবার দখল নিতে ভিতরে প্রবেশ করল। কিন্তু ভারী মেশিনগানের মুহুর্মুহু গুলি, মিশাইল আর গ্রেনেডের সামনে সৌদি আর্মি অসহায়ের মত প্রাণ দিতে লাগল। কাজের কাজ কিছুই হল না। সৌদি সরকারের কপালে রীতিমত চিন্তার রেখা। কিভাবে হবে এই সমস্যার সমাধান।

ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো দেশ যেন থমকে গেছে, পাথরের মত নিশ্চল। রেডিও টেলিভিশনে কোন খবর প্রচারিত হচ্ছে না। এমনকি বিবিসি পর্যন্ত কোন কাজ করছে না। ফোন কাজ করছে না। শুধু বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কেউ কোন কথা বলছে না, কারো কোন কথা বলার অধিকার নেই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ফোন বেজে উঠল। ফোন অপারেটর জানালো পাকিস্তান থেকে কল এসেছে। কল করেছে আমার মা। মা প্রশ্ন করলেন, কাবায় কি ঘটেছে? আমি তাকে কিছুই জানাতে পারলাম না। মা জানালেন, উন্মত্ত জনতা ইসলামাবাদের আমেরিকান এম্বাসি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। আমার খুব খারাপ লাগল, আমেরিকা তো কাবায় আক্রমণ করেনি, তাহলে কেন তাদের উপর আক্রমণ? ফোন আবার বন্ধ হয়ে গেল। পাকিস্তানের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন পিটিভি সেদিন ভারত পাকিস্তানের মধ্যে একটা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ প্রচার করছিল। হঠাৎ টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল। পর্দায় ভেসে উঠল একজন সংবাদ পাঠকের মুখ। তিনি প্রায় মৃত কণ্ঠে খবর দিলেন, কাবা শরীফ আক্রান্ত। কিন্তু আর কিছুই বললেন না, কে বা কারা আক্রমণ করেছে, কখন এই দুর্ঘটনা ঘটল। পিটিভি সেই টেস্ট ম্যাচে আর ফিরে গেল না, পরিবর্তে হামদ, না’তে রসুল আর কোরআন তেলাওয়াত চলতে লাগল। পিটিভি কৌশলে চেপে গেল আক্রমণকারী সবাই আসলে মুসলিম। মুসলিম হয়ে কাবা শরীফে আক্রমণ আর একটা মুসলিম-দেশের টিভি চ্যানেল কেমন করে প্রচার করবে, তাই না?

মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে ধোঁযা উঠছে

পাকিস্তানের বিবিসি উর্দু সার্ভিস, ইরানের একটা গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে প্রচার করতে লাগল “আমেরিকার ইহুদি নাসার গোষ্ঠী পবিত্র কাবা মসজিদে হামলা করেছে।” পরের দিন ইসলামাবাদসহ পাকিস্তানের বড় বড় শহরে আমেরিকা আর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও গণ-জমায়েত শুরু হয়ে গেল। উত্তেজিত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হাজার হাজার মানুষ আমেরিকান এম্বাসির সামনে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগল। হঠাৎ করেই উত্তেজিত জনতা মারমুখী হয়ে গেল। উঠতি যুবক, কিশোর, ছাত্ররা কাবা মসজিদ আক্রমণের দায় সরাসরি আমেরিকার ষড়যন্ত্র বলে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে লাগল। মুহূর্তে উন্মত্ত জনতা আমেরিকান এম্বাসি আক্রমণ করে বসল। পুড়িয়ে দিল আমেরিকার পতাকা, ভেঙে ফেলল নিরাপত্তা দেয়াল, আগুন ধরিয়ে দিল যত্রতত্র। কয়েক ঘন্টাব্যাপী চলমান সেই আক্রমণে পাকিস্তান পুলিশ, নিরাপত্তা কর্মী নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমেরিকান এম্বাসি পড়ে যাওয়া দেখছিল। হাতে বাঁশি থাকলে তারা হয়ত নিরোর মত এম্বাসি পোড়ার সময়ে বাঁশি বাজাত। পাকিস্তান আর্মি হেলিকপ্টার নিয়ে এম্বাসির চারিদিকে টহল দিচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে একটা পোড়া, ধ্বসে যাওয়া ভবনের উপর হেলিকপ্টার নামল। কিন্তু ততক্ষণে এম্বাসিতে কর্মরত কয়েকজন আমেরিকান নিহত হয়ে গেছে।

ইস্তাবুলে মার্কিন এম্বাসীতে হামলা (১৯৭৯)

উন্মত্ত জনতা ইরানের যে সংবাদের উপর ভিত্তি করে এই বিক্ষোভ করছিল, মূলত সংবাদটাই ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ইরানের সংবাদ মাধ্যম ভালো করেই জানত কাবা আক্রমণের পিছনে রয়েছে সৌদি আরবেরই কিছু উগ্র ধর্মগ্রন্থ মুসলিম যুবক। কিন্তু আমেরিকান এবং সৌদি সরকারকে বিপদগ্রস্ত করতেই এমন সংবাদ প্রচার করে।

পরপর তিনবার চেষ্টা করেও সৌদি আর্মি জুহায়মান ও তার অনুসারীদের কিছুই করতে পারল না। মাঝখান থেকে প্রাণে মরে গেল ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশিক্ষিত সৈন্য। তখন সৌদি সরকার ফ্রান্সের কাছে সাহায় চাইল যদিও এর আগে জর্ডান এবং পাকিস্তান তাদের সৈন্য দিয়ে কাবা মুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু কাবা শরীফ অবরোধ মুক্ত হবে বিধর্মী নাসারাদের হাতে এটা বোধহয় কাবার নিয়তি। ফ্রান্স সরকার তিনজন আর্মি কমান্ডো পাঠিয়ে দিল যাদের নেতৃত্বে সৌদি আর্মি আবার কাবা দখলের প্রস্তুতি গ্রহণ করল। ফ্রান্সের তিন কমান্ডোর তত্ত্বাবধানে সারাদিন বন্দুক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত সৌদি-বাহিনী কাবার ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হল। মারা গেল ২৫৫ জন জিহাদি, মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসা অবরুদ্ধ মুসল্লি এবং ১২৭ জন সৌদি সৈন্য।

কিন্তু ভয়াবহ এই বন্দুক যুদ্ধে কাবা শরীফের অবস্থা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গেল। জুহায়মানের অধিকাংশ অনুসারী কমান্ডো অপারেশনে মারা গেলেও জুহায়মান ৬৭ জন সঙ্গী নিয়ে ততক্ষণেও বেঁচে ছিল। আটক করা হল তাদের সবাইকে। ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসের এক সুন্দর দুপুরে জুম্মার নামাজের পরে তাদের সবাইকে শিরশ্ছেদ করা হয়।

শিরশ্ছেদ হওয়া অপরাধীদের মধ্যে এই গল্পের মুনির একজন অন্যতম। মতি ঘারা কখনই বিশ্বাস করতে পারেন নি তার সন্তান এই ধর্মীয় উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়বে। মনে মনে হয়ত আশঙ্কা ছিল, কিন্তু বাস্তবে ঘটবে সেটা মতি ঘারা বুঝতে পারেন নি। মক্কায় আক্রমণের পরে মুনিরকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিহত হজ্ব যাত্রীদের তালিকায় মুনিরের নাম নেই। এদিকে সৌদি সরকার কাবা আক্রমণকারীদের শিরশ্ছেদ তালিকাও সম্পূর্ণ প্রকাশ করে না। মুনির কোথাও নেই, কোথাও মুনিরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। মতি ঘারা রিয়াদের পাকিস্তান এম্বাসিতে মুনিরের খোঁজ নিতে যান, পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করেন তার সন্তান মুনিরকে খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু পাকিস্তান এম্বাসি পরিষ্কার জানিয়ে দেয় মুনিরের কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। প্রায় চার বছর পাকিস্তান এম্বাসি মতি ঘারাকে নিশ্চিত করে যে মুনিরের শিরশ্ছেদ হয়েছে।

মতি ঘারা বলতে লাগলেন, “ আমি জানি না কাবা আক্রমণে মুনিরের কি ভূমিকা ছিল। আমার স্ত্রী তার প্রথম সন্তান মুনিরের ভাগ্যে কি ঘটেছিল সেটা জানার আগ পর্যন্ত মুনিরের জন্য অপেক্ষা করত। আমরা আসলে কেউই জানতাম না আমাদের আদরের মুনির ধর্মীয় উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়েছে। মুনিরের মা আহাজারি করে বলত, জান্নাত তো মায়ের পায়ের নিচে, তুই পাগলের মত কোথায় জান্নাত খুঁজতে গিয়েছিস?” আমার স্ত্রী (মুনিরের মা) ১৯৯৪ সালে মারা যান। মারা যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই নারী ভাবতেন, তার ছেলে মুনির একদিন তার কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু মুনির আর কোন দিন ফিরে আসেনি, আসবেও না। সে জান্নাতের লোভে দুনিয়াকে জাহান্নাম বানিয়ে নিজে মরে গেছে, অন্যদের মেরে গেছে।

সকল আসামীকে শিরচ্ছেদ করা হয়

References
• The Siege of Mecca: Yaroslav Trofimove
• The Looming Tower: Lawrence Wright
• Inside the Kingdom: Kings, Clerics, Modernists, Terrorists, and the Struggle for Saudi Arabia: Robert Lacey
• War on Sacred Grounds: Ron E. Hassner

(প্রবন্ধটি Dawn পত্রিকায় প্রকাশিত Storming heaven: A revolt in Makkah প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ)