২৩ বছর আগের কোনো একদিন লেখা হয়েছিলো এই চিঠি। কথাছিল মুধমতির তীর থেকেই চিঠিটা লিখবো। কিন্তু ১৫ বছর আগের ভরা নদীকে মরা অবস্থায় দেখে এক নতুন প্রেক্ষাপটের মুখোমুখি হয়েছিলাম। চিঠিটা আমি লিখেছিলাম। প্রিয় কাউকে, কখনো কখনো মনে হয় নিজেকে। নদী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা চিঠিটি এখানে তুলে ধরলাম…
ইরা
আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু হলো ট্রলারে। বড়ফা থেকে খুলনা। মধুমতি হয়ে চিত্রা নদীর মধ্য দিয়ে, ছুটে চলেছি খুলনার পথে। মধুমতি, চিত্রা নদীগুলো অনেকটা একই রকম। এর কোনো পাড় ভেঙে চলেছে নির্দয়ের মতো। কোনো পাড়ে চর জাগছে, আর সেই পাড়ে জেগে উঠছে সোনালি ফসল। তবে মধুমতি যেখানে আরম্ভ তার দু’পাশে চর পড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, পুরো নদীটাই প্রায় হেঁটে পার হওয়া যায়। ভয়াবহ! নদী মরে গেলে পানির কষ্ট থেকে যাতায়াত ব্যবস্থা পর্যন্ত সবই বিপর্যস্ত হয়। এই কষ্ট যারা ভোগ করে তারাই জানে। ঋত্বিকের তিতাসেও (তিতাস একটি নদীর নাম) নদীহীন মানুষের কষ্টের ভয়াবহ সব দৃশ্যায়ন আছে।
বুধবার সকালে যখন কালিগঙ্গা পাড়ি দিয়ে চাপোলি ও মূলশ্রী গ্রাম হয়ে পহরডাঙ্গার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন দু’পাশের দিগন্ত বিস্তৃত ডাঙা- যা ফসল বোনার উপযোগী জমি। মাঝে মধ্যে খেজুর আর সুপারি গাছ। আমার ভেতরে অসম্ভব আনন্দ ভরে দিচ্ছিল। পহরডাঙ্গা আমার মায়ের বাড়ি। জ্যামিতিক বক্রতার জগৎকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে দুপুরে কলই খেতে শুয়ে পড়েছিলাম। একটু দূরেই বাবলা গাছগুলো কেমন দুলছিল, পাশেই বয়ে যাচ্ছিল মধুমতির ক্ষীণ ধারা। আমি যেন ‘৪৭-উত্তর ভারতের একটি রূপ দেখতে পাচ্ছিলাম। শুধু দেশই ভাগ হয়নি, নদীও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
ওখান থেকে দু’দিন পর বড়ফা। তারপর হরিদাসপুর হয়ে টুঙ্গিপাড়া গেলাম। বিকেলে টুঙ্গিপাড়া গ্রামটা ভ্যানে করে ঘুরে বেড়ালাম। পাশের পাটগাতি গ্রামেই আমার নানির শৈশব কেটেছে। নানির ছোট ভাই মানিক মিয়ার সঙ্গে দেখা হলো। এখন চুলে কলপ মাখেন। টান টান হয়ে বসেন। উনি মজিবরের কৈশোরের বন্ধু। মজিবর মানে হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান; বঙ্গবন্ধু নামে পৃথিবীতে পরিচিত। ৭৫ বছরের বৃদ্ধ যখন তার আজীবন বন্ধুর গল্প করছিলেন, যার সঙ্গে একসঙ্গে অনেক সময় কেটেছিল, স্কুলে অদ্ভুত সব কাণ্ড করেছিল- তা শুনে আমি বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম, এসে বলব! বঙ্গবন্ধু জন্ম দিয়েছিলেন ‘৬৬-এর ৬ দফা, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণের মতো সব ঘটনার। ‘৭৫-এর বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের গতিধারাই পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
নদীর মধ্য দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি। ঘণ্টা তিনেক হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে রওনা দিয়েছি। একটানা ট্রলার ইঞ্জিনের শব্দ, বেজেই চলেছে। আমরা এখনও চিত্রা নদীতে। নড়াইল শহরের পাশঘেঁষে চিত্রা নদীর প্রবাহ। অনেকেই বলেন, এই নদীর দু’কূল চিত্র বা ছবির মতো সুন্দর ছিল বলেই এর নাম হয়েছে চিত্রা। চিত্রা নদীর সঙ্গে কেমনভাবে যেন এসএম সুলতানের নাম জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে তার স্বপ্নের সেসব কৃষকের কথা। সালভাদর দালি, পাবলো পিকাসোর পাশাপাশি সুলতানকে পৃথিবীর মানুষ চেনে। এক দুপুরে তার সঙ্গে বসে আমি শুনেছিলাম মোজার্টের নবম সিম্ম্ফনি। সেই সিল্ফম্ফনির শব্দই যেন ভেসে এসে আমার কানে বাজছে, যেন বলছিল বিজ্ঞানের প্রথম পথিকেরা ছিলেন কৃষক, নাবিক আর তাঁতিদের সন্তান; যারা চাঁদ আর নক্ষত্রের অবস্থান দেখে জীবনের পথ চলতেন- ইজিয়ান সাগরের উপকূল, পাথরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ।
ইরা, কথা ছিল মধুমতি নদীর তীরে বসে তোমাকে চিঠি লিখব। কিন্তু ছোটবেলার দেখে যাওয়া ভরা নদী ১৫ বছর পরে ফিরে এসে দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এই নদীতে মা-খালারা স্নান করতেন, গোসলের আগে খোলা পৃথিবীর আনন্দ দেখা যেত তাদের চোখে। সেই নদী শুকিয়ে গেছে। তখন এত আনমনা হয়ে পড়েছিলাম যে, চিঠি লেখা আর হয়নি। এরপর মধুপুর, সরসপুর, যোগানিয়া, ডুমুরিয়া, দেবদূন, জয়নগর, পানিপাড়া, পুঁটিমারী, শুকতাইল, দীঘলিয়া, বিজয়পাশা, পাইককান্দা, হরিদাসপুর, পাটগাতি হয়ে টুঙ্গিপাড়া- গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে টুঙ্গিপাড়ায় কিছুটা স্থির সময় কেটেছিল। এ যেন ছিল শুধু যশোর আর গোপালগঞ্জ, গোপালগঞ্জ আর যশোর। এরপর আবার বড়ফা হয়ে খুলনার পথে। চলন্ত ট্রলারে তোমাকে লেখার কথা মনে হলো।
এ ট্রলারের মাঝিদের জিজ্ঞেস করছি- সুন্দরবনে যাওয়ার পথঘাট কী? শুনলাম হিরণ পয়েন্টের বেশি নাকি যাওয়া যাবে না। সেটুকুই যেতে অনেক কষ্ট। আমাদের চারপাশটা একদম খোলা। চোখের দৃষ্টি কিছু দূর যাওয়ার পরই ধোঁয়াটে হয়ে যায়। রূপসা নদী দেখার অনেক ইচ্ছে আছে। জীবনানন্দের কবিতায় পড়েছি :
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়;- রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।
-(আবার আসিব ফিরে, জীবনানন্দ দাশ)
মনে হচ্ছে, এভাবে ছুটে চলাটা বেশ লাগছে। আর না ফিরলে কেমন হয়। মার্ক টোয়েনের হাকফিন আর মিসৌরি নদীর মধ্য দিয়ে তার পথচলার কথাই মনে হলো। ১১ বছরের শৈশবের স্মৃতি পৃথিবীর কিশোরদের স্বপ্নময় জীবনের উদ্দীপনা জুগিয়েছিল এই মার্ক টোয়েন, অথচ নিজেই শৈশবে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে পরিবারের জন্য জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। আমরা গ্রামে পাঁচ-ছয়দিন ছিলাম ঘোরের মধ্যে। মানুষের ভালোবাসায় ছিলাম আপল্গুত। ফিরে আসার সময় সবকিছু কেমন মমতা নিয়ে ডাকছিল। হঠাৎ করে ট্রলার থেমে গেল। দেখলাম এসে পড়েছি খুলনার গাজীর হাটে।
চা খাওয়ার জন্য নামলাম। কিন্তু চা পাওয়া গেল না। আমাদের একজন খাবার কিনে নিয়ে এলো। পরোটা ও কাঁচা গোল্লা। মেজ চাচির রান্না করা হাঁসের মাংস ও চিতোই পিঠে খেয়ে রওনা দিয়েছিলাম। সঙ্গে দিয়েছিল কই ভত্তা। খোলা আকাশের নিচ দিয়ে নদীর স্রোত জীবনের মানে অন্যরকম করে দিচ্ছিল, ভাবতে ইচ্ছে করছিল কত কিছু : জীবন কী, কোথায় এর পরিপূর্ণতা?
এখনও চিত্রা নদী দিয়ে ছুটে চলেছি। নদীর দু’পাশে নারিকেল, খেজুর, তালগাছ আর বাঁশঝাড়ের সারি। মাঝে মাঝে গ্রামের মানুষরা স্নান করছে, কেউ কলসি ডুবিয়ে পানি নিচ্ছে। কখনও হালকা ঢেউয়ের শব্দ। কেমন আছ ইরা?
আসিফ
রচনাকাল ৮-২-১৯৯৫
১২টা ৩৫মিনিট –
৫-২-১৯৯৫
রাত ১০ টা
আমার চেনা পরিবেশ নিয়ে লেখা।
অপূর্ব বর্ণনা। কি কাব্যিক, অসাধারণ। আপনার লেখা অনেক অনেক দিন পর পেলাম আসিফ।
ধন্যবাদ