২০১৩ সালের ৬ মে সকাল বেলা। খবর ছড়িয়ে পড়ে সরকার গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙ্গে দিয়েছে। সহযোদ্ধাদের অনেকে ভাঙ্গা মঞ্চ দেখতে গিয়েছে। আমি যাইনি। লালার ভয়ে। লোভের লালা। ক্ষমতার লালা। আমার একটা সমস‍্যা আছে। কিছু জিনিস দ্বারা ভিজ‍্যুয়াল টেররের শিকার হই। এর মধ‍্যে একটি হচ্ছে লালা। লালা শব্দটা শোনা বা পড়ার সাথে সাথে আমার চোখের সামনে লালা ভেসে উঠে। যেমন পুকুর ভর্তি লালার মাঝে কিছু মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে – এমন দৃশ‍্য। অথবা একজন মানুষকে টর্চার সেলে হাত পা বেঁধে হাঁটুগেঁড়ে বসিয়ে তার মাথার উপর ড্রামভর্তি লালা ঢালছে কেউ। কিংবা কেউ একজন স্নান করতে বাথরুমে ঢুকে দেখলেন শাওয়ারে জল নেই, লালা ঝরে পড়ছে। প্রাচীন লালা। দুর্গন্ধময় পঁচা লালা। এরকম আরো অনেক বিচ্ছিরি জিনিসপাতি দেখি। বিরক্তিকর।

সেদিন শাহবাগে যাইনি। গেলে দেখতাম হাঁটু অথবা কোমর পরিমাণ লালাবদ্ধতা। বিশ্রী কুশ্রী সরকারি লালা। এটা অসহ‍্য। না গিয়ে ভালো করেছি। এসব আপোষাবর্জনা এড়িয়ে চলা ভালো। নিজেকে দূষণমুক্ত রাখা ভালো।

আসলে শাহবাগে সে সময় কোন মঞ্চ ছিলো না। ছিলো একটা মিডিয়া সেল। সরকার সেটি ভেঙ্গে দেয়। সেদিন দ্বিতীয়বারের মত ভিজ‍্যুয়াল টেররের শিকার হই। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মতিঝিলে হুজুর তাড়িয়ে ফেরার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গায়ের চামড়া ফুলে উঠে। ফোস্কা ধরে। ফোস্কা বিস্ফোরিত হয়ে পুঁজ বের হতে থাকে। তাদের চোখ ঠেলে বেরিয়ে যায়, আবার ভেতরে ঢোকে। পুঁজে ভেজা গায়ের জামাগুলো গলে খসে পড়ে। হাতের অস্ত্রগুলো একেকটি বিষাক্ত সাপে পরিণত হয়ে বিস্ফোরিত ফোস্কাক্ষতে ঠোকর মারে। র‍্যাব পুলিশ জওয়ানদের গগনবিদারী চিৎকারে ঢাকার আকাশ বাতাস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ছিলো। রাজপথে যেন নরকনৃত‍্য। রাস্তায় গড়াতে গড়াতে, হামাগুড়ি দিয়ে কোনমতে শাহবাগ পর্যন্ত আসার পর কে যেন সব জওয়ানের ঘাড় ধরে গণজাগরণ মঞ্চের মিডিয়া সেলের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তারপর কানে কানে ফিসফিস করে বলে দেয়, “ব‍্যালান্স কর!” এটা শুনেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অহিংস আন্দোলনের মিডিয়া সেলের উপর।

উপরে অত‍্যন্ত হাস‍্যকর এবং ভয়ংকর দৃশ‍্যায়ন পড়লেন। জম্বি মুভির মত বিরক্তিকর। এটা যে অবিশ্বাস‍্য, অকল্পনীয়, সেটা আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। কিন্তু আপনি কি বলতে পারেন, সেদিন গণজাগরণ মঞ্চের মিডিয়া সেল ভাঙ্গার আর কী কারণ থাকতে পারে?

আমরা বলেছি গণজাগরণ মঞ্চ কোন বাঁশ কাঠের তৈরি স্থাপনা নয় যে, এটা ভেঙ্গে দেয়া যাবে। আরো বলেছি গণজাগরণ মঞ্চ মানুষের হৃদয়ে বসতি গড়েছে, এটা ভাঙ্গার সাধ‍্য কারো নেই। – এসব কথার কথা, আজগুবি কথা। শুনতে কাব‍্যের মত শোনায়, স্লোগান অথবা গানের মত শোনায়। এর বাইরে এসব কথার কোন উপযোগিতা নাই। মিডিয়া সেল অথবা মঞ্চ কিংবা মানুষের হৃদয়, যাই বলুন না কেন, সরকার তা ভেঙ্গে দিয়েছে। আতংকগ্রস্থ মনে ভীরু পায়ে এগিয়ে আত্মসমর্পনের হাত দিয়ে তা ভেঙ্গেছে। এটা ভাঙ্গার পর থেকে বিএনপি-জামাত-হেফাজতের সাথে ক্ষমতাসীন দল তাদের ব‍্যবধান আরো গুচিয়েছে। আওয়ামী লীগের লোকজনও গণজাগরণ মঞ্চকে গাঁজা মঞ্চ কিংবা যৌন জাগরণ মঞ্চ বলেছে। আরো বলেছে ইমরান রাজাকারের নাতি। বলেছে শাহবাগে বিরিয়ানির লোভে নাস্তিকরা জড়ো হয়েছিলো।

একটা সময় এ’তে আর ও’তে কোন পার্থক‍্য রইলো না। হেফাজতকে আওয়ামীলীগ ভেবে সালাম দিয়েছি, আওয়ামীলীগকে হেফাজত ভেবে। তারপর কী হলো? শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার নতুন করে মুসলমান হলো। মধ‍্যপ্রাচ‍্য থেকে বিতাড়িত আল্লাহ বাংলাদেশে এসাইলাম নিলো। ইসলামের জয় হলো। সবার মুখে ইনশাল্লাহ, মাশাআল্লাহ, আল্লাহু আকবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, র‍্যাব, সবার নতুন করে সেন্টিমেন্ট নির্মিত হলো। ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট। রাষ্ট্র সেই সেন্টিমেন্ট হেফাজতের দায়িত্ব নিলো। রাষ্ট্রের সাথে সাথে পুরো জাতি, গৃহপালিত-অগৃহপালিত জাতির বিবেকগণ, রাষ্ট্রীয় মৌচাকের চারপাশে ঘুরতে থাকা ভবঘুরেগণ, সকলেই সেন্টিমেন্টের যত্ন নিতে উঠেপড়ে লাগলেন।

এমনকি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালও! হঠাৎ করে তিনি আরবি শব্দে অনুভূতি প্রকাশ শুরু করেন। তার কলম দিয়ে, মুখ দিয়ে বের হতে থাকে আল্লাহ, ইনশাহআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ জাতীয় শব্দমালা। নাস্তিকদের কলমাস্ত্রে তিনিও ক্ষতবিক্ষত হলেন। ২০১৬ সালে বই মেলায় প্রকাশিত একটি নাস্তিক‍্যবাদী বইকে তিনি অশ্লীল আখ‍্যায়িত করে সকলকে পড়তে নিষেধ করেছেন। অথচ যে কারণে তিনি বইটিকে অশ্লীল বলেছেন, সেই কথাগুলো বইয়ের লেখক নিজের মন থেকে লিখেননি। কোরআন হাদিস থেকে লিখেছেন। ওই বইকে অশ্লীল না বলে কোরআন হাদিসকে অশ্লীল বলবেন, এই আশা আমি করি না। কিন্তু তিনি কেন আগ বাড়িয়ে ওই বইটিকে অশ্লীল বলতে গেলেন, কেন বুঝে শুনে সেন্টিমেন্টের গার্ড হলেন? কারণ তিনি হঠাৎ নিজেকে একটা নতুন মিছিলের মাঝে আবিষ্কার করলেন, যে মিছিলে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শামিল হয়েছে। সেন্টিমেন্টের মিছিল। অবশ‍্যই সে মিছিল থেকে বেরিয়ে আসার স্বাধীনতা তাঁর ছিলো, কিন্তু সুতোর টান এড়াতে পারেননি। শেখ হাসিনার সাথে, আওয়ামী লীগের সাথে প্রগতিশীল লেখক সাহিত‍্যিক বুদ্ধিজীবীদের হালকা সরু কিঞ্চিত সুতোর বাঁধন আছে। এই বাঁধন কখনোই দৃঢ় বা মজবুত ছিলো না। তবুও কেন এই বাঁধন ছেঁড়া যায় না, আমার জানা নেই অথবা আছে। মুক্তিযুদ্ধের নামে, দেশপ্রেমের নামে, মৌলবাদ বিরোধিতার নামে এই জড়িয়ে থাকা।

সুতো এবং বাঁধনের ব‍্যাপারটা পরিষ্কার করি। ১৯৯৮ সালের ৬ অক্টোবর তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন –

“তসলিমা নাসরিন এবং তাকে যারা হুমকি দিচ্ছে, তারা সবাই সীমা ছাড়িয়ে গেছেন।”

শেখ হাসিনা সীমায় আটকে থাকা মানুষ। তিনি তার চারপাশের মানুষজনকে নিয়ে এই সীমার ভেতর বসবাস করেন। দুই হাজার তের চৌদ্দ পনের ষোল সতের আঠারতে এসে তিনি তার সীমা আরো ছোট করেছেন, সংকুচিত করেছেন। তিনি তার লোকজনকে নিয়ে ছোট্ট সীমায় কোনঠাসা হয়ে গেছেন।

২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল তিনি বলেছেন-

“লেখালেখির জন‍্য কেউ মারা গেলে তার সরকার এর দায় নিবে না।”

সরাসরি নিহতের উপর তার মৃত‍্যুর দায় চাপিয়ে দিলেন। আর ১৯৯৮ সালে তার বলা ‘এও দোষী, সেও নির্দোষ নয়’ তত্ত্ব ২০১৫ সালের পর থেকে ব‍্যাপক জনপ্রিয় হয়। লোকজন বলাবলি করতে থাকে “জঙ্গিদের উচিত হয়নি ব্লগার হত‍্যা করা, আবার ব্লগারদেরও উচিত হয়নি জঙ্গিদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করা!”

তো, জঙ্গিদের সেন্টিমেন্ট আছে, শফি হুজুরের সেন্টিমেন্ট আছে, শেখ হাসিনার সেন্টিমেন্ট আছে, মুহম্মদ জাফর ইকবালেরও সেন্টিমেন্ট আছে। এই সেন্টিমেন্টের কারণে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ইতিহাসে ঢুকে গেলেন। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বই মেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামের বইটি নিয়ে হেফাজতিদের সুরে সুর মেলানোর মাধ‍্যমে তার নতুন করে ইতিহাসে প্রবেশ হলো।

এর আগেও এভাবে অনেকে ইতিহাসের অংশ হয়েছিলেন। যেমন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সে সময় শিখা পত্রিকা ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সাথে জড়িত শামসুল হুদা এক ঘরোয়া সভায় নবী মুহম্মদ ও ইসলামের সমালোচনা করে মুসলিম সমাজের নিন্দার মুখে পড়েন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ কথা শুনে বলেছিলেন-

“এমন কথা বলে থাকলেতো শামসুল হুদার মাথা কেটে নেয়া উচিত।”

আরো আছেন। জনপ্রিয় সাহিত‍্যিক হুমায়ুন আহমেদ। ২০০৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “হুমায়ুন আজাদকে কেন মরতে হলো?” জবাবে তিনি বলেছেন-

“কারণ যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না।”

তারপর তাকে প্রশ্ন করা হয়, ঠিক একই কারণে তসলিমাও দেশ থেকে বিতাড়িত?
তিনি বলেছেন-

“হয়তোবা!”

যাইহোক, ধর্মানুভূতির অতন্দ্র প্রহরী হওয়া বা না হওয়া যার যার ব‍্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু এখানে সমস‍্যা আছে। সমস‍্যা হচ্ছে ড. শহীদুল্লাহ, হুমায়ুন আহমেদ কিংবা ডক্টর জাফর ইকবালরা নিজেদেরকে ধর্মানুভূতির প্রহরী বানানোর সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক যোগসূত্রতা আছে। এই যোগসূত্রতা ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়া কিংবা টোকা মেরে গুড়িয়ে দেয়ার মত নয়। বরং এটা রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে এমনই এক খাদ সৃষ্টি করে, যে খাদে কেউ পড়লে আর উঠতে পারে না। উল্টো খাদের তলায় বসে আরো অনেকগুলো খাদ তৈরি করে।

সেই ২০১৩ সালে উচ্ছেদে সাম‍্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মতিঝিল থেকে হুজুর বিতাড়নের পর মঞ্চের মিডিয়া সেল ভেঙ্গে দিয়ে, তারপর স্বজন-শুভাকাঙ্খীদের নিয়ে শফি হুজুরের দুয়ারে মূর্ছা খেয়ে, ব্লগারদের মৃত‍্যুর দায় না নিয়ে কী লাভ হলো? জাফর ইকবালদেরকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা গেলো না।

জাফর ইকবালে শুরু কিংবা শেষ নয়। বরং জাফর ইকবালের আগে অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন, পরে আরো আক্রান্ত হবেন। এসব আক্রমণ হচ্ছে একটি বড় গর্তের তলায় ছোট ছোট গর্ত। গর্ত একটা বিপদ, গর্ত একটা গন্ডি, গর্ত হচ্ছে সীমা। এই সামান‍্য সীমা, বিপদ, গন্ডি হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিনরা লংঘন করতে পারেন। ব্লগাররা রুখে দিতে পারেন। কিন্তু আহমেদ আর ইকবালরা পারেন না। না পারার বিপদ অনেক বড় বিপদ। এই বিপদে দেশের মানুষ, মানচিত্র, পতাকা, সব একসাথে পড়েছে। চোখ বুঁজলেই দেখি একটি মাঝারি সাইজের গভীর কুয়ার তলায় শেখ হাসিনা তার উজির নাজির, সৈন‍্য সামন্ত, পণ্ডিত ও সভাকবিদের নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছেন। এতে আমার আনন্দ হয় না। ভয় হয়, আতংক হয়, লজ্জা হয়। ক্ষমতার প্রদীপের নিচে এই অন্ধকার-অসহায়ত্ব অত‍্যন্ত ভয়ের, আতংকের।

জনপ্রিয়, নন্দিত শিক্ষক, লেখক ও প্রযুক্তিবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন। তার মাথায়, ঘাড়ে ও হাতে ২৬টি সেলাই দিতে হয়েছে। ঠিক এই সময় এসব কথা কেন বলছি? কারণ ছুরিকাঘাতের ঘটনা এই কথাগুলোকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত হামলাকারীর পরিচয় পাওয়া গেছে। জানা জায়নি আক্রমণের কারণ। কেউ দায় স্বীকারও করেনি। কিন্তু হামলার ধরণ, এবং জাফর ইকবালের প্রতি একটি গোষ্ঠীর ক্ষুব্ধতা, মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানির বই, বিভিন্ন হিটলিস্ট বিচার করে সন্দেহ ও আশঙ্কার তীর জঙ্গি গ্রুপগুলোর দিকে। হামলাকারী ফয়জুরের মূল বাড়ি সুনামগঞ্জে। পরিবারসহ বসবাস করতো শাবি ক‍্যাম্পাসের পাশের এলাকায়। ঘটনার পর তাদের ঘরে তালা, পরিবার লাপাত্তা। ফয়জুর এলাকায় নিজেকে মাদ্রাসা ছাত্র বলে পরিচয় দিতো, কিন্তু কোন মাদ্রাসার ছাত্র তা নিয়ে লুকোচাপা করতো। এসব তথ‍্য হামলাকারীর সাথে জঙ্গিগ্রুপগুলোর সম্পৃক্ততার বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে। অপেক্ষায় আছি হামলার কারণ ও দায়িত্ব সম্পর্কে সত‍্য ও সঠিক তথ‍্যটি জানার জন‍্য।

[আপডেটঃ হামলাকারী স্বীকার করেছে জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই হামলা করেছে।]

শুধু জাফর ইকবাল বলে নয়, সবক্ষেত্রে সত‍্য ও সঠিক তথ‍্য জানা অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর, জাফর ইকবাল সত‍্য ও সঠিকের মতই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের লাখ লাখ তরুণ তাঁর বই পড়েন, কথা শোনার জন‍্য উদগ্রীব থাকেন। তিনি উল্লেখযোগ‍্য সংখ‍্যক মানুষের কাছে অনুসরণীয়। আবার যারা মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী, তাদের কাছে বর্জনীয়। তার লেখা কিশোর উপন‍্যাস, গল্পের ভেতর তরুণদের জন‍্য মৌলবাদ বিরোধী নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রেরণা থাকে। তিনি স্পষ্ট, তার অবস্থান স্বচ্ছ, তাকে শনাক্ত করা যায়।

‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটি পড়তে নিরুৎসাহিত করার কথাটি ছোট কথা। কিন্তু সে কথা বলার পর যে বিপদের সৃষ্টি হয়, সেটা অনেক বড় বিপদ। আমাদেরকে বিপদের মুখে ফেলেছেন, নিজেও পড়েছেন, তাই বলে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে জাফর ইকবালের অংশগ্রহণ সামান‍্যও মিথ‍্যা হয়ে যায় না। তিনি তাঁর গুরুত্বসহ আমাদের মাঝে আছেন, থাকবেন। তাকে থাকতে হবে। জাফর ইকবাল না থাকলে সমস‍্যা আছে। চিন্তা, ভাবনা ও সংস্কৃতির লড়াইয়ে বিশাল অংশ জুড়ে তার অবস্থান।

জয়, আনন্দ, পরাজয়, আতংক – এসব লুকিয়ে রাখা যায় না। জাফর ইকবালের উপর হামলার ফলে যে নতুন আতংক জন্ম নিয়েছে, তা লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। হামলার নতুন ধারা শুরু হলো কিনা, এর শেষ কোথায়, এসব চিন্তার জন্ম হয়েছে। জাফর ইকবাল বাংলাদেশের মৌলবাদীদের শরীরের পুরোনো ক্ষত। তার প্রতি ধর্ম ব‍্যবসায়ীদের ক্ষোভ আজকালের নয়। জঙ্গিগ্রুপগুলোর নিশানায়ও তিনি সর্বাগ্রে। সুযোগ পেলে তারা অনেক আগে তার উপর আক্রমণ করতো। জঙ্গিদের সুযোগের অভাবে তিনি অক্ষত ছিলেন। জাফর ইকবালের শরীরে আঁচড় কাটা গেছে, রক্ত ঝরানো গেছে। এই উৎসাহে, এই উদ্দীপনায় জঙ্গিদের হামলার মুখে আর কে কে পড়বেন, বলা যায় না। আরো অনেক গবেষক, লেখক, সাহিত‍্যিকের উপর জঙ্গিদের ক্ষোভ আছে। তাদের কেউ কেউ আওয়ামীলীগ সম্পৃক্ত, কেউ কেউ সম্পৃক্ত নন। সরকার কি পারবে তাদেরকে রক্ষা করতে?

এত আপোষ, আত্মসমর্পন আর বিসর্জনের পরও আওয়ামী লীগ নিজে বিপদমুক্ত হয়নি, দলটি যাদের দ্বারা উপকৃত তাদেরকে বিপদমুক্ত করতে পারেনি। দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষতো অনেক পরের কথা। নাস্তিকদের কথা বলার মত পাগল আমি না। তাদের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার দায় দায়িত্ব ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল কেউই নেয়নি, নিবে না। ওটা নিয়ে ভাবিও না।

কিন্তু দেশ, দেশের মানুষ যে অভিজিৎ রায়ের চেয়ে, জাফর ইকবালের চেয়ে, শেখ হাসিনার চেয়েও অনেক বড়। এই দেশ, দেশের মানুষ আজ স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। ধর্মানুভূতির ভয়ংকর ভাইরাস তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। প্রতিরোধক-প্রতিষেধক না নিয়ে উল্টো ভাইরাসের হাতে নিজেকে সমর্পনের ফল মাথা পেতে, ঘাড় পেতে আর হাত পেতে নিচ্ছি। কেউ রেহাই পাবে না এই ফল থেকে। প্রজাদের জন‍্য রাজার নিজ হাতে লাগানো গাছের ফল, না খেয়ে থাকা যায়? থাকা যায়। রাজার ইচ্ছায়। রাজা যদি চায়।

সময়ের আগে পরে কেবল সময়ই থাকে। সময় কখনো পুরিয়ে যায় না। রাজার যদি সময় বুঝার সময় হয়, যদি সেই সময়ের সদ্বব‍্যবহার হয়, তাহলে আমাদের মাথা আর ঘাড় অক্ষত থাকবে। নচেৎ নয়।

—-
তথ‍্যসূত্রঃ

১.
জাফর ইকবালের শরীরে ২৬টি সেলাই বিষয়ক

২.
হামলাকারীর পরিচয় বিষয়ক

৩.
তসলিমা নাসরিনের প্রতি হুমকির ঘটনায় শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া বিষয়কঃ
বই – বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি ১৯৭১-২০১১
লেখক – মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
পৃষ্ঠা – ১১০

৪.
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব‍্য বিষয়কঃ
আহমদ শরীফের সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: কেশব মুখোপাধ্যায়
আহমদ শরীফ শ্রদ্ধাঞ্জলি
পৃষ্ঠা নং ৩৫৩-৩৫৪

৫.
হুমায়ুন আহমেদের বক্তব‍্য বিষয়কঃ
তথ‍্যসূত্র ১
তথ‍্যসূত্র ২