এক

হোমো স্যাপিয়েন্সের উৎপত্তি ঘটেছে আজ থেকে মোটামুটি তিন লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায়। কিন্তু দীর্ঘদিন তারা খুব একটা দূর-দূরান্তে বেরিয়ে পড়েনি। এক লক্ষ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে তাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। তারা পৃথিবীর আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে যে দিকে চোখ যায় সেদিকে। আমরা নিচের ছবি লক্ষ্য করি (এখানে ka মানে হচ্ছে এত হাজার বছর আগে)।

নিয়ানডার্থালরাও এগিয়ে গিয়েছিল অনেক দূর। আমাদের অন্যান্য প্রজাতিগুলোও ক্রমে অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু H. Sapiens দের মত অতটা নয় কখনো। আমাদের একই গণের অন্তর্ভূক্ত অন্য সদস্য কিন্তু কম ছিল না। যাদের ফসিল পাওয়া গেছে তাদের নাম হচ্ছে H. rudolfensis, H. ergaster, H. georgicus, H. antecessor, H. cepranensis, H. rhodesiensis, H. neanderthalensis, Denisova hominin, Red Deer Cave people, and H. floresiensis। ফসিল বা কোনো প্রমাণ না পাওয়া হোমিনিড প্রজাতির পরিমাণ তাই খুব একটা কম হওয়ার কথা নয়। এরা সবাই কিন্তু আমাদের মতই একই গঠনের মানুষ ছিল। কেউ কেউ ছিল বেশ সুঠাম। তারপরেও আমরাই জিতে গেলাম। অন্যান্য গ্রেট এইপ বা লেজ বিহীন বানররাও অতটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নয়। কোনো প্রাযুক্তিক অগ্রগতি ছাড়াই কেন আমরা অস্ট্রেলিয়া থেকে রাশিয়ার সাইবেরিয়া এবং আমেরিকার দুর্গম এলাকাগুলো পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিলাম? এমনকী ভাষার উদ্ভব ঘটা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করিনি, ভাষার উদ্ভবের সময়কাল ধরা হয় পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।

এ প্রশ্নটি বেশ ভাবিয়েছে। তারপর স্বস্তিদায়ক একটি উত্তর পেয়েছি। নিশ্চয়ই এদের মানসে তখনই আবির্ভূত হয়ে গিয়েছিল কোনো এক অভিজিৎ রায় যে চেতনা তাদেরকে টেনে নিয়ে যায় অজানার দিকে, দুর্গমের দিকে মৃত্যুকে পরোয়া না করেই। এই যে অভিজিৎ রায় সেটি মানুষকে নিয়ে যাবে একদিন মহাবিশ্বের অসীম পানে। হয়ত লক্ষ বছর পরে কোনো এক সুদূর গ্যালাক্সিতে বসে কেউ আবারো নিজেকে অভিজিৎ রায় বলে ঘোষণা দেবে। অভিজিৎ রায়রা ক্ষণজন্মা হয়। তারা মৃত্যবরণ করে কিন্তু বেচে থাকে মানুষের অগ্রযাত্রার মধ্যে। ইতিহাস তাদের স্মরণ করুক বা না করুক তারা বেচে থাকে।

দুই

আমাদের অভিজিৎ রায় আসলে কী চেয়েছিলেন?

বিশেষ করে যারা আন্তর্জালে নতুন শরিক হয়েছেন তাদের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি দেখা যায় এ ব্যাপারে। আর তারও কারণ আছে। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি ধর্মের ষাড়গুলো, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুছে দিতে অভিজিৎ রায়কে। কিন্তু সেটা যে লেখা হয়ে গেছে অমোচনীয় কালিতে সে ব্যাপারে তারা সচেতন থাকলে এতদিনে খুনি থেকে মানুষ হয়ে উঠত।

এতে কোনো দ্বিধা নেই যে অভিজিৎ রায় ধর্মবিরোধী ছিলেন। আবহমান কাল থেকেই অসংখ্য মানুষ ধর্মের নামে হানাহানি, বিবাদ, বিভাজন আর বিরোধে জড়িত। এই দল ঐ দলকে হত্যা করছে, এই দল ঝাপিয়ে পড়ছে ঐ দলের উপর, রায়ট, অযৌক্তিকভাবে ধর্মভিত্তিক দেশবিভাগ, কোটি কোটি মানুষের অসীম দুর্ভোগ। গঠিত হল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যা থেকে বেরিয়ে আসতে নিহত হতে হল ত্রিশ লক্ষ প্রাণকে। এসব ব্যাপার যেকোনো মানবিক চেতনার মানুষকে আহত করবে সেটাই স্বাভাবিক। আর যিনি পরিষ্কারভাবে জানেন ধর্মগুলোর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে কিছু বিশাল মাপের প্রতারকদের মাধ্যমে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল মানুষকে অসীমকাল পর্যন্ত বিভাজিত ও কূপমণ্ডূক করে রাখার, তাঁর পক্ষে বিদ্রোহী হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

কিন্তু এটাই অভিজিৎ রায় এর একমাত্র পরিচয় নয়।

তিনি চেয়েছিলেন আমরা প্রকৃতিকে চিনব বিজ্ঞানের মাধ্যমে, চিন্তা করব মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। শিশু থেকে আরম্ভ করে সবার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বিরাজ করবে, কোনো কিছুর আনুগত্য করা যাবেনা প্রশ্নহীনভাবে। তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটির নামের মধ্যেই অভিজিৎ রায়কে খুঁজে পাওয়া যায়। রবি ঠাকুরের এই কলি এক ঘোরের জন্ম দেয়। মনে হয় অভিজিৎ রায় ঘন অন্ধকারে একটি পিদিম হাতে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর গন্তব্যে আর মৃত্যুর দিকে চেয়ে হাসছেন মিটিমিটি।

তিন

আল্লাহু আকবার!

ইসলামি জঙ্গিরা যখনই মানুষ হত্যা করে তখনই ঘোষণা দেয় ‘আল্লাহু আকবার’ বলে। ব্লগার ও প্রকাশকদের উপর হত্যার সময়ও তারা এই স্লোগান দিয়েছিল। একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবি। আল্লাহু আকবার এর মানে হচ্ছে আল্লাহ সর্বশ্রষ্ট, আল্লাহ বড় ইত্যাদি। কিন্তু ভাল করে ভাবলে দেখা যায় আল্লাহু আকবার বলার মানে হচ্ছে আল্লাহ বলতে কিছু নাই, সবই ভুয়া! আবার তা বলে যখন মানুষকেই হত্যা করে ফেলা হয় যাদের নাকি আল্লাহ ইবাদতের উদ্দেশ্যে বিশাল পরিকল্পনা করে সৃষ্টি করেছেন তখন এর মানে দাঁড়ায় খুবই অশ্লীল।

কথা হচ্ছে, বড়-ছোট-শ্রেষ্ট-মহান-খারাপ-ভাল এসব বিশেষণ খুবই আপেক্ষিক এবং মানুষ আরোপিত ধারণা। যখন কারো ব্যাপারে এগুলো প্রয়োগ করা হয় তখন তাদেরকে কারো সাথে তুলনা করতেই হয়। যখন আমরা একজন মানুষকে বড়, ছোট, সর্বশ্রেষ্ট এগুলো বলব তখন নিশ্চয়ই সেটা কারো সাথে তুলনা করেই বলব। এছাড়া এসব বিশেষণের কোনো অর্থই থাকে না। আর কেউ যদি আসলেই সর্বশ্রেষ্ট হয়, সবজান্তা হয় তবে বারবার এগুলো জপ করার মানে কী? এই স্তুতিকে বাধ্যতামূলক করে দেয়া হাস্যকর রকম উদ্ভট।

আবার ভাল খারাপ-মহান এগুলোর প্রয়োগ নির্ভর করবে ব্যক্তির উপর। আপনার কাছে যাকে ভাল-খারাপ-মহান বলে মনে হবে তাকে আমার কাছে ঠিক উল্টোটা মনে হতেই পারে। মানুষকে আল্লাহ যেহেতু আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দিবেন তাই তাকে মহান মনে করা দূরে থাক আমি হয়ত তাকে খুবই হিংস্র মনে করতে পারি। আবার তার শরিক করলে তিনি প্রবল বেগে রেগে উঠেন তাই তাকে আমি অত্যন্ত হিংসুক মনে করতে পারি। আবার আমি যদি নিজে নিজে স্বাধীন ভাবে চিন্তা না করে কারো দেখানো পথে আল্লাহ বড় বলে চেঁচাই তবে আল্লাহ নামক কারো যদি কমন সেন্স থাকে তবে সে খুশি হতে পারেনা।

একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে দেখা যায়, মহাবিশ্বকে এক নিমিষে সৃষ্টি করে ফেলার ক্ষমতা সম্পন্ন কারো কাছে মানুষের উপাসনা বা স্তুতির কোনো মানেই হতে পারে না। আপনি সারাদিন নামাজ পড়লে, রোজা রাখলে, তসবিহ জপলে আল্লাহর কোন লাভটা হয়? মহাবিশ্বের স্রষ্টা যদি আমাদের অবোধগম্য হয় তবে উনি আসলেই ভাল না খারাপ, উপাসনার উপযুক্ত কীনা সেটা আমরা কিভাবে বলব আর কিসের ভিত্তিতে বলব? মহাবিশ্বের কোনো স্রষ্টা থাকলে তার মানবোচিত গুণাবলি থাকবে কেন?

আল্লাহ নামক আরব পৌত্তলিকদের দেবতার উপর অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম থেকে নানা ধারণা, গুণাবলি সংগ্রহ করে, এর সাথে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এক প্রচণ্ড রাগী, বদমেজাজী রাজাধিরাজের অবয়বে একেই নতুনভাবে গড়ে তুলেছেন ইসলামের প্রবক্তারা। এই আল্লাহকে যদি কেউ অবিশ্বাস করে তবে তাকে চিরদিন আগুনে পোড়ানো হবে! কী মুশকিল, আপনি এত মহান যে আপনার অস্তিত্বে বিশ্বাস না করলে সর্বনাশ করে ছাড়বেন; এটা কোন ধরনের মহানুভবতা? কোরানে আছে, জাহান্নামের অধিবাসীদের ক্ষত নি:সৃত পুঁজ খেতে দেয়া হবে, চামড়া একবার পুড়ে গেলে আবার তাকে নতুন চামড়া দেয়া হবে আজাব ভোগ করার জন্য। কী বিভৎস, ইতরামি ও নোংরা চিন্তার সমাহার! বিশাল সংখ্যক মানুষ এসব গোবর্জনায় বিশ্বাস করলে এর মধ্যে কিছু মানুষ আইএস জঙ্গী, আল কায়দা ইত্যাদি হবেই।

যেখানে লক্ষ লক্ষ শিশু দুধ পাচ্ছেনা, প্রায় ২১ হাজার মানুষ না খেতে পেরে মারা যায় প্রতিদিন সেখানে কোনো এক পরম করুণাময়, সর্বোৎকৃষ্ট রিজিকদানকারী( আর-রাজ্জাক) ঘোষণা করেন আপনাকে মৃত্যুর পর জান্নাতে নাকি পানি, দুধ, মধু আর মদের নদী দান করবেন আর এসব বমি উদ্রেককারী আয়াতে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে কিছু মানুষ চাপাতি হাতে চেঁচিয়ে উঠেন আল্লাহু আকবার বলে! এ কী অদ্ভূত বাস্তবতায় বেচে আছি আমরা! (বিস্তারিত এ ব্লগের তৃতীয় অংশে)।

যা বলছিলাম, যখন কেউ আল্লাহু আকবার বলে মাথা খারাপ করে তখন হাসি পায় কারণ এর দ্বারা আল্লাহর অনস্তিত্ব ঘোষণাই হয়।

প্রিয় মুসলমান ভাইবোনেরা। অভিজিৎ রায় কোনোদিনও তোমাদের ঘৃণা করেননি। এমনকী ঘৃণাকে প্রশ্রয়ও দেননি। অভিজিৎ রায়ের শেষ মুহূর্ত কেটেছে এমন মানুষের সাথে যিনি এক বিশাল ধার্মিক বলে সুপরিচিত। ইসরাইলী আগ্রাসন থেকে আরম্ভ করে যেখানেই মুসলমানদের উপর নিপীড়ন হয়েছে সেখানে স্পষ্টভাবে তাঁর প্রতিবাদটুকু তুলে ধরেছেন। (শুধু তিনি নয় তাঁর আশেপাশে থাকা এই তুচ্ছ সৈকতের একটা মন্তব্যও কেউ দেখাতে পারবেনা যেখানে মুসলমানদের ধ্বংশ কামনা করা হয়েছে। তোমাদের ভালবাসি বলেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট করে বুঝাতে চেয়েছি দেড় হাজার বছর আগে জন্ম নেয়া এক ধর্মগুরুর থেকে উত্তম জীবনাদর্শ সম্ভব। আর বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ওহাবি ঘরানোর ইসলাম মোটেই যায় না। মুসলমানদের বিনাশ কামনা করলে নিরব থাকাই শ্রেয় হত- হানাহানিতে এমনিতেই তারা পিছিয়ে যাবে, পরাজিত হবে, লাঞ্চিত হবে, হারিয়ে যাবে।)

অভিজিৎ রায় সহ অন্যান্য ব্লগারদের হত্যা করা হলে আপনাদের ধর্মপুরুষরা উল্লাসে মাতাল হয়ে উঠলেন। এখনো তার প্রমাণ আছে অলনলাইনের অলিতে-গলিতে। হেফাজতিদের তথা বাংলাদেশী ধর্মান্ধদের নেতা হয়ে উঠা আল্লামা শফি ব্লগারদের হত্যা ওয়াজিব হয়ে গেছে আগেই ফতোয়া জারি করেছিলেন। দেশে লক্ষ লক্ষ ইমাম, মুফতি আছে, কেন এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেলনা যিনি নিরস্ত্র মানুষ হত্যার বিরোধিতা করেছেন? কেন একজনও বললেন না, কলমের জবাব কলম দিয়ে দিতে? শুধু এখন নয়, একাত্তরেও আমরা অবাক হয়ে দেখলাম এই ইসলামী বুজুর্গদের পাকিস্তানিদের প্রতি দুর্বলতা। এখন পর্যন্ত গণমানুষের কোন ন্যায্য চাওয়াতে এরা অংশগ্রহণ করেছেন ফতোয়াবাজি আর দুররা ছাড়া? যখন আল্লামা শফি দেশকে গুহাযুগে ফিরিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসাবে তের দফা হাজির করলেন তখন এর বিপরীতে একজন ইমাম-মুফতিকে একন পাওয়া গেল না কথা বলতে?

চার

বিশ্বাসের ভাইরাস

একটা সাম্প্রতিক ঘটনা শেয়ার করতেই হচ্ছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারির খবর, প্রথম আলো থেকে

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মোমেনা সোমা অনলাইনে জঙ্গিবাদের উপকরণ দেখে উদ্বুদ্ধ হন। ছোট বোন আসমাউল হুসনা সুমনাকেও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। তবে দেশের কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা সুমনাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এসব তথ্য পেয়েছেন। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক আলাপে এ কথা বলেন।

মোমেনাকে অস্ট্রেলিয়া পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ অস্ট্রেলিয়া পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

মনিরুল ইসলাম জানান, মোমেনা সোমা ও তাঁর বোন আসমাউল হুসনা অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। দেশের কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অনলাইনে আইএস-আল–কায়েদাসহ জঙ্গিদের ছড়িয়ে রাখা বিভিন্ন উপকরণ দেখে নিজেরা উদ্বুদ্ধ হয়ে এ পথে আসেন সোমা। তিনি তুরস্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভিসা না পাওয়া যেতে পারেননি। এরপর অস্ট্রেলিয়ায় যান। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর কথা আগেই বোনকে বলে গিয়েছিলেন তিনি। বাসায় পুলিশ এলে তাঁদের ওপর হামলা করার নির্দেশ ছোট বোনকে তিনিই দেন।

মনিরুল ইসলাম আরও জানান, ২০১৫ সালের দিকে জঙ্গিবাদে জড়ান সোমা। তবে দেশের অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠন বা হোলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। দেশের কোনো জঙ্গি সংগঠন বা ব্যক্তির সঙ্গে দুই বোনের যোগাযোগ ছিল কি না, তা জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, কোনো জঙ্গি সংগঠন বা হোলি আর্টিজানে হামলাকারী কারও সঙ্গে এঁদের যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে সিরিয়ায় চলে যাওয়া নজিবুল্লাহ আনসারীর সঙ্গে মোমেনা সোমার সম্পর্ক ছিল। ২০১৪ সালের শেষ দিকে তাঁদের বিয়ে হওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু নজিবুল্লাহর পরিবার সেটা না চাওয়ায় বিয়েটা হয়নি। পুলিশের ধারণা, ওই সময় সোমা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৫ সালে সোমার মা মারা যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে জঙ্গিবাদ আরও তীব্র হয়।

নজিবুল্লাহ রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনা করেছেন। এরপর মালয়েশিয়ান মেরিন একাডেমিতে পড়তে যান। সেখান থেকে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৬ সালে তাঁর সঙ্গে পরিবারের শেষ যোগাযোগ হয়। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে মোহ ভঙ্গ হয়ে দেশে ফিরে পুলিশের কাছে দেওয়া গাজী সোয়ানের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, সোয়ানের সঙ্গে নজিবুল্লাহ তুরস্কে দেখা হয়েছে। কিন্তু এরপর বারবার যোগাযোগ করেও তিনি আর নজিবুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। সোয়ানের ধারণা, নজিবুল্লাহ তুরস্ক সীমান্তে মারা গেছেন।

গত শুক্রবার অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করার অভিযোগে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মোমেনা সোমাকে (২৪) গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ।

অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ বলছে, মোমেনা আইএসের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছেন। তাঁর ব্যাপারে খোঁজ নিতে গত রোববার রাতে ঢাকার কাজীপাড়ায় তাঁদের বাসায় যায় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দল। একপর্যায়ে সুমনা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তার ওপর ছুরি নিয়ে আক্রমণ চালান। পুলিশের অন্য সদস্যরা তাঁকে ধরে ফেলেন।

এই মেয়েটা নিশ্চয়ই মেধাবী ছিল। এর সুন্দর একটা ভবিষ্যত হতে পারত। এই দারিদ্র-জর্জরিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এভাবে একটা উন্নত দেশে গিয়ে শিক্ষা লাভের সুযোগ পায় খুব হাতে গোণা কিছু শিক্ষার্থী। কিন্তু সে নিজে একটা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে চলে গেল, তার ছোটবোনকেও সে একই দিকে নিয়ে গেল। এই মেয়েটির সাথে যার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সে নজীবুল্লাহ একটি ক্যাডেট কলেজে লেখাপড়া শেষে মালয়েশিয়ান মেরিন একাডেমিতে পড়তে যান তারপর যান যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু স্বাভাবিক জীবন বিসর্জন দিয়ে সে বনে গেল জঙ্গি, মানুষ হত্যা যাদের কাজ। এরকম অসংখ্য তরুণের সন্ধান আমরা পেয়েছি যারা এভাবে তলিয়ে গেছে বিশ্বাসের অন্ধকারে।

এরা সরাসরি জঙ্গিবাদে যোগ দিয়ে নিজেকে ধ্বংস করছে। আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে মাদ্রাসায় পড়ে (এটা নিয়ে এই ব্লগ লেখেছিলাম)। এর দায় কার? আমরা ছাড়া আর কেউ কেন এসব নিয়ে কথা বলবেনা?

পাঁচ

স্বাভাবিকভাবে আজ অশ্রু ঝরবে তাদের যারা অভিজিৎ রায়কে ভালবাসে। এর মধ্যেও আমাদের শপথ নিতে হবে ভবিষ্যতের অভিজিৎদের বাচিয়ে রাখার- মানুষের স্বার্থে, মানবতার স্বার্থে।

সান্তনা এই যে আমরা নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর, তথ্য আমরা এখন নিমিষেই জানতে পারি। অভিজিৎ রায় এর বই, ব্লগ সহ যাবতীয় লেখা লাখো পাঠকের কাছে পৌছে গেছে অনায়াসেই। তাই আমাদের আশা করতে দ্বিধা নাই, অন্ধকার হয়ত কেটে যাবে এই শতকেই।

আর কেউ যাতে বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিজে না মরে, অন্যকে না মারে। একটা সুস্থ, ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ তৈরি করে দিতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। আজকের এই দিনে এটাই হোক আমাদের শপথ।

(অভিজিৎ রায় এর প্রকাশিত সবগুলো বই এখানে রাখা আছে, এগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি)।