অভিজিৎ রায়ের সাথে কখনো দেখা হয়নি। ফোনে কথা হয়নি। ফেসবুকের ইনবক্সে চার বাক‍্য কথা লেনদেন আর একটি ইমেইল ছাড়া লোকজনকে বলার মত স্মৃতি আমার কাছে নেই। সর্বশেষ যোগাযোগ ওই ইমেইলটা। যেখানে লেখা ছিলো মুক্তমনায় আমার জন‍্য একটা আইডি খোলা হয়েছে, যদি নিয়মিত লিখি তাহলে তিনি খুশি হবেন।

মুক্তমনায় সবাকের লেখা দেখে তিনি কতটা খুশি হবেন বা হয়েছেন, জানি না। তার ইমেইল পেয়ে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। ব্লগিংয়ের শুরু থেকে মুক্তমনার নিয়মিত পাঠক ছিলাম। সবার লেখা পড়তাম আর ভাবতাম ইস্ যদি মুক্তমনায় লিখতে পারতাম!

বাংলা ব্লগস্ফিয়ারে পদচারণা বেশ চঞ্চল হলেও কিছু অলিগলিতে হাঁটাচলার সময় আমি অত‍্যন্ত বিনয়ী ও ভীতু। বিশেষত মুক্তমনা এবং সচলায়তন ব্লগের প্রতি এক ধরনের সম্মান, ভয় কাজ করতো। সামহোয়ার ইন ব্লগকে বাপের বাড়ি মনে করতাম। মুক্তমনাকে মনে হতো এলাকার সম্ভ্রান্ত বিত্তশালী কারো বাড়ি। সে বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটা যায়, এলাকায় পরিচিতির কারণে উঠোন পর্যন্ত যেতে পারি, বড়জোর এক গ্লাস জল খেতে পারি, কিন্তু কোনভাবেই ওই বাড়ির ঘরে ঢুকতে পারি না। শুনতে বিশ্রী শোনাচ্ছে, কিন্তু সত‍্যি সত‍্যি এরকমই মনে হতো।

অভিজিৎ রায়ের মেইল পেয়ে খুশি হয়েছি। আবার অজান্তে গলাও শুকিয়েছে। ভয়ে। মুক্তমনায় কী লিখবো! অমুক বিজ্ঞানী, তমুক দার্শনিক, এই তথ‍্য, ওই উপাত্ত, হাফ ডজন ছবি মিলিয়ে ইয়া বড় লেখার পর আবার নিচে ক্রমানুসারে সেসব রেফারেন্সের উল্লেখ করতে হয়। এটা মহা আতংকের ব‍্যাপার।

তাই একাউন্ট থাকলেও মুক্তমনায় সেভাবে আর লেখা হয়নি। গত দুই বছরে কিছু লিখেছি। বেশিরভাগই গল্প। অভিজিৎ রায়ের সাথে দেখা হয়নি, কথা হয়নি, তার জীবদ্দশায় মুক্তমনায় তেমন লেখাও হয়নি। তাহলে স্মৃতিচারণ লিখতে বসেছি কেন? কারণ আছে।

অভিজিৎ রায়ের সৃষ্টিকর্মের সাথে আমার সম্পর্ক আছে। মায়ের সাথে, শিক্ষকের সাথে যেমন সম্পর্ক, তেমন। এই সম্পর্কের একটা বিশেষ অনুভূতি আছে। এই অনুভূতিটা বলে শান্তি পাই না, লিখে শান্তি পাই না। পুষে শান্তি পাই। তাই পুষে যাচ্ছি। অপরদিকে তার জন্মদিন বা মৃত‍্যুবার্ষিকী এলে একটা লেখার দাবি জন্মায়। গত দুই বছর এই দাবি উপেক্ষা করেছি। এবার আর পারছি না। কারণ ফেসবুকে ব‍্যান আছি। অন্তত একটা লাইনও যদি লিখতে না পারি, বেশ যন্ত্রণা হবে। যন্ত্রণা ভালো লাগে না।

জীবনে একটা সময় পার করেছি যখন বাড়ির সাথে, ঘরের মানুষের সাথে, উঠোনের সাথে, বন্ধুদের সাথে, খেলার মাঠের সাথে আমার দূরত্ব বেড়ে যায়। বাবার সাথে দূরত্ব বাড়ে ধর্মীয় কারণে। বাবা যেন হঠাৎ করে অচেনা হয়ে যান। গান শোনেন না, টিভি দেখেন না, তেমন একটা হাসেনও না। তিনি বদলে যান। চেয়েছেন তার সাথে সাথে আমরাও যেন বদলে যাই। এমনিতেই বাবা ছিলেন রাজা বাদশাহদের মত। উনাকে দেখলেই ‘খামোশ,’ ‘বরদাশত করবো না,’ ‘আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও’ জাতীয় শব্দগুলো কানে বাজতো। তবুও যতটুকু সম্পর্ক ছিলো, গানের কারণে। বাবার একটি প‍্যানাসনিক ব্র্যান্ডের ক‍্যাসেট প্লেয়ার ছিলো। এখনো আছে। একদিন গুনেছি, তার সংগ্রহে ছয়শ’র বেশি গানের ক‍্যাসেট ছিলো। পুকুর পাড়ে নতুন লাগানো গাছে বেড়া দেয়ার সময়, গরু গোসল করানোর সময়, গানের ক‍্যাসেটগুলো রোদে দেয়ার সময়, ধান ক্ষেতের আইলে হাঁটার সময়, পুকুরে মাছ ধরার সময় তিনি গুনগুন করে গাইতেন। তখন তার চেহারা থেকে বাদশাহী মুখোশটা খসে পড়তো। কী যে আপন মনে হতো তাকে তখন! যখন গান শোনা ছেড়ে দিলেন, ক‍্যাসেটগুলো বস্তাবন্দী করলেন, ক‍্যাসেট প্লেয়ার প‍্যাকেট করলেন, তখন থেকে তিনি ফুলটাইম বাদশাহ হয়ে গেলেন। আর তার কাছে যাওয়া যায় না, পাশে বসা যায় না, আঙ্গুল ধরে পাশাপাশি হাঁটা যায় না। ভয়ে। তার সাথে ভালোবাসার সম্পর্কটা আর রইলো না। আমরা একে অপরের কেয়ারটেকার হয়ে গেলাম।

ঘরে তার শাসন নতুন রূপ পায়। ভাই বোন সবাই নিজেদের বদলে নেয়। বাবার মনের মত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা সবার মাঝে। চেষ্টা করেছি তাদের ধরে রাখতে, পারিনি। কিছুদিন পর ভাই বোনদের সাথেও একটা দূরত্ব হলো। ভালোবাসা কমেনি একটুও, কিন্তু বন্ধুত্ব কমে যায়। আড্ডার বিষয়, দিনের রুটিন, সব বদলে যায়।

ওদিকে বন্ধুরা বদলাচ্ছে না। আমি বদলে যাচ্ছি। তারা এখনো অমুক মেয়ে তমুক মেয়ে নিয়ে রসালো আলাপে ব‍্যস্ত। এটা সেটা বলে হা হা হি হি করে হাসে। সবাই আমার দিকে তাকায়, বুঝতে পারে তাদের এই বন্ধুটি আনন্দ পাচ্ছে না। তার সাথে দূরত্ব হয়ে যাচ্ছে।

বাড়ি পালিয়েছি কয়েকবার। একবার বাবা ধরে এনেছেন। বাকি ক’বার নিজে নিজে ফিরে এসেছি। একাকীত্ব, অস্থিরতা আর সহ‍্য হয় না। সমবয়সীদের সাথে আড্ডা দেয়া বন্ধ করে জুনিয়র ও সিনিয়রদের সাথে মিশতে শুরু করি। এবার কিছুটা কাজ হলো। কিন্তু ঠিক জমতেছিলো না। মনের ভেতর হাজারো কৌতুহল, জিজ্ঞাসা। অব‍শ‍্য দু’চারজন বন্ধুর সাথে কখনোই দূরত্ব হয়নি। আজও না। ওটা ভালোবাসা। কিন্তু তখন শুধু ভালোবাসায় চিড়ে ভিজেনি। ভালোবাসার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো চিন্তা ভাগাভাগি. তর্ক অথবা সমর্থন। সেটা বন্ধুদের সাথে হয়নি, সিনিয়রদের সাথেও হয়নি।

বাবা ধর্মকে যত আঁকড়ে ধরেছেন, আমি তত দূরে গিয়েছি। বাবার সাথে দূরত্ব আর ধর্মের সাথে দূরত্ব যেন আনুপাতিক ছিলো। কী জানি, হয়তো ভেবেছি যে জিনিস বাবাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে, তার সাথে কোন সম্পর্ক রাখবো না। বাবার সাথে কেবল গানের সাথে কিংবা তার ছেলে সাথে দূরত্ব হয়েছে, এমন নয়। বরং প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমৃত ঘোষের সাথেও দূরত্ব হয়। স‍্যারের বাড়ি আমাদের বাড়ির পেছনে। আত্মীয়তা ছিলো। পূজার সন্দেশ, ঈদের সেমাই, এমনকি মাঝে মাঝে তরকারিও লেনদেন হতো। দুই পরিবারের মানুষের মাঝে আড্ডা হতো, চুলে চিরুনি আর উঁকুন বাছা হতো। কিন্তু হঠাৎ করে তা থেমে যায়। সন্দেশ আসে, সেমাই যায় না। তারপর ধীরে ধীরে তরকারির আসা যাওয়া হয় না, আড্ডা হয় না, চিরুনি হয় না। উল্টো অমৃত স‍্যার বেহেশতে যাবে না, এ নিয়ে আমার মা বাবার দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

খুব অসহায়বোধ করতাম। ঘরের পেছনে বাগান পেরিয়ে অযথা কোন কারণ ছাড়াই স‍্যারের বাড়ি যেতাম। জল সন্দেশ খেতাম, শীতের বিকালে স‍্যার ও তার গরুর সাথে রোদ পোহাতাম। আমার যাওয়া আসা নিয়ে অবশ‍্য বাবা মা কিছু বলতেন না। কিন্তু মাঝে মাঝে খাওয়া নিয়ে বলতেন।

একসময় মা বাবার এসব বলাবলি অসহ‍্য লাগে। কারণ ওই বয়সে বন্ধুদের বেশিরভাগ ছিলো হিন্দু ধর্মালম্বী। স‍্যারের বাড়ি যাওয়া যাবে না, বন্ধুর বাড়ি খাওয়া যাবে না, গান শোনা যাবে না, টিভি দেখা যাবে না। এরকম আরো অনেক ‘যাবে না’র কারণে আমার ভেতরে জন্ম নেয় ‘এই বাড়িতে থাকা যাবে না।’ অন্ততপক্ষে মা বাবার কাছ থেকে ঘৃণা বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক চিন্তার শিক্ষা নিতে চাইনি। একেবারেই না।

কিন্তু যাবো কোথায়? লাইব্রেরী নেই, ধর্মের ভয়মুক্ত একটা মানুষ নেই, যার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায় আমি যা ভাবি তা সঠিক অথবা ভুল। এই আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। এটাই যে বেরিয়ে আসার একমাত্র কারণ, তা নয়। নিজের ইচ্ছেমত ভবিষ‍্যত নির্মাণ, অন্ধকার ও ভয়হীন একটা নির্মল জীবনের লোভও ছিলো।

কয়েক ঘাটের জল হাওয়া খেয়ে অবশেষে ২০০৮ সালে এসে আশ্রয়ের সন্ধান পাই। কিন্তু পেছনে যে পিছুটান রেখে এসেছি, তা থেকে মুক্ত হওয়া খুব কঠিন ছিলো। বিশেষত ছোট তিন ভাই বোন ও মৃত বড়বোনের দুই সন্তান। তাদের কণ্ঠ, তাদের ছবি, তাদের হাসি জ্বালিয়ে মেরেছে ওসময়। যাহোক, আশ্রয় পেলাম। বড় ভাই অথবা শিক্ষক যাই বলি না কেন, তার দেখা না পেলে ধ্বংস হয়ে যেতাম।

তিনি হাসিখুশি, ব‍্যস্ত, প্রাণবন্ত। আমি নির্জীব, নিথর, অলস। সমস‍্যার কারণ বুঝতে পেরে একদিন কিছু কথা বললেন। কথাগুলো শুনে মনে হলো হাজার মাইল সমুদ্রের জল ছুঁয়ে আসা একদল শীতল বাতাস আমাকে অতিক্রম করে যায়।

– বাড়ি ছেড়ে এসে আপনি কোন পাপ করেননি। এসব পাপ পূণ‍্য, আল্লাহ খোদা ভুয়া জিনিস। নিজেকে প্রমাণ করেন, পরিশ্রম করেন। আবার সব ফিরে পাবেন।

খুব সাধারণ একটি কথা, তাই না? কিন্তু সময়ের বিবেচনায় তা এত সাধারণ ছিলো না। এসব, পাপ, পূণ‍্য, দোযখের ভয় তখনো পুরোপুরি যায়নি। বরং আতংকিত করে রেখেছিলো। যাহোক, এই কথাটা নিজের ভাবনায়ও ছিলো। চেয়েছি অন‍্য কেউ বলুক, আমার চিন্তায় একটু সমর্থন দিক। কয়েক বছর ধরে সেই মানুষটিকে খুঁজে বেড়িয়েছি। অবশেষে পেয়ে গেলাম। কিন্তু তিনি অনেক ব‍্যস্ত মানুষ। দিনরাত কাজ নিয়ে মেতে থাকেন। তার সাথে প্রাণ খুলে কথা হয় না।

এই সমস‍্যাও তিনি বুঝলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন সামহোয়ার ইন ব্লগ, ফেসবুক আর ইউটিউবের সাথে। ফেসবুক ইউটিউব ক’দিন আগে থেকে চিনি। আগ্রহ পেতাম না। ওখানে পরিচিত কেউ নেই। ব্লগের বিষয়টা সম্পূর্ণ অজানা ছিলো। কিন্তু বড় ভাই খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন ব্লগ, ফেসবুক আর ইউটিউবে আমার কী কাজ, কী সম্পর্ক।

ব্লগ ফেসবুকে আইডি খোলার কিছুদিন পর গুগলে ধর্ম ও নাস্তিকতা নিয়ে কী যেন খোঁজার সময় মুক্তমনা সাইটের লিংক পাই। যেন কেউ আমাকে আকাশ থেকে বিশাল এক মহাসমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। যে সমুদ্রে যত খুশি ডোবা যায়, ভাসা যায়। ভাসা ডোবার ওই সময়ে টানা কয়েক বছরের অস্থিরতা, একাকীত্ব, যন্ত্রণার অবসান হয়।

কর্মস্থল ছিলো একটা আইটি সেন্টার। দিনের কাজ শেষে মুক্তমনায় ঢুকতাম, ভোরে বের হতাম। একে একে প্রায় সব প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পিডিএফ বই পড়ে শেষ করছি। এ যেন এক স্বপ্নযাত্রা। এই যাত্রায় কেবল আনন্দ আর আনন্দ। কোন ভয় নেই, বাধা নেই, অন্ধকার নেই। তীব্র আলো, সম্ভাবনা আর সৃষ্টিসুখ। সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম ভাবনার মিলে। মুক্তমনার স্বপ্নযাত্রায় নিজের ভাবনার নিরঙ্কুশ সমর্থন পাই। বুঝতে পারি আমি একা নই, বিভ্রান্ত নই।

এই হলো অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার সম্পর্ক। অন্ধকার পেরিয়ে এসে, ভ্রান্তি ছেড়ে এসে একটু সমর্থনের আশায়, একটু সাহসের আশায় উদভ্রান্তের মত ছুটতে থাকা মানুষের জন‍্য অভিজিৎ রায় ছিলেন এক নিরাপদ আশ্রয়। তার সৃষ্টির দুয়ারে এসে আমার মত মানুষেরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, প্রাণ খুলে হাসে।

দিন যায়, পড়া চলতে থাকে। বুঝতে পারি বেহেশতের লোভ আর দোযখের ভয় কাটিয়ে উঠলেও নিজের মাঝে অনেক পুরোনো আবর্জনা, প্রচুর অন্ধত্ব, গোঁড়ামির বাস। পড়ি, ভাবি, বিবেচনা করি, হিসেব মেলাই, বুঝি, তারপর সিদ্ধান্ত নিই। একে একে ঝেড়ে ফেলতে থাকি সব পশ্চাৎপদতা। না, মুক্তমনা আমাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়নি। মুক্তমনা কেন, পৃথিবীর কোন বই কিংবা লাইব্রেরীর এই ক্ষমতা নেই। কিন্তু মুক্তমনা একটা পথ দেখিয়ে দিয়েছে, যে পথে আমার মত হাজারো মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। এই পথে এগিয়ে যেতে যেতে একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারবো। এই চেষ্টা, এই পথ ও প্রেরণার সন্ধান পেয়েছি মুক্তমনায়।

এখনো এই চিন্তার পথে, ভাবনার পথে হাঁটতে হাঁটতে নিজের মাঝে ঘৃণা, বিদ্বেষ, গোঁড়ামি টের পাই। বোকা হয়ে যাই! ভাবি এই জিনিস আগে বুঝতে পারিনি কেন? অবিশ্বাস‍্য লাগে সবকিছু। যত দ্রুত পারি এসব অন্ধকার ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি। সফলও হই। কারণ মুক্তমনা আমার মগজ ধোলাই করেনি। মাথায় কিছু জোর করে ঢুকিয়ে দেয়নি। বরং আমিই মুক্তমনাকে খুঁজে বেড়িয়েছি মাথা বোঝাই প্রশ্ন নিয়ে। মুক্তমনা প্রশ্নের জবাব সাজিয়ে রেখেছে, আমি মিলিয়ে নিয়েছি। অবশ‍্যই তা সন্দেহাতীত ভাবে নয়। ওই যে, বড় বড় লেখার নিচে একগাদা রেফারেন্স থাকে, লেখার মাঝে প্রমাণ থাকে, বিপক্ষের কথাও থাকে। আমার নিজস্ব চিন্তা আছে, বিবেচনাবোধ আছে, সন্দেহ আর অবিশ্বাস আছে। মুক্তমনা আমার চিন্তা, বিবেচনাবোধ, সন্দেহ আর অবিশ্বাস কেড়ে নেয়নি, দখল বসায়নি। বরং আরো মজবুত করেছে, দৃঢ় করেছে।

শুধু ধর্মীয় অন্ধত্ব নয়, মুক্তমনার পুরোনো সাইটের লেখাগুলো রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। সংস্কৃতিগত চিন্তা ভাবনা স্বচ্ছ করেছে। আলী আকবর টবির একটা বইয়ের পিডিএফ ছিলো একাত্তরে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার ভূমিকা নিয়ে। এর আগে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে এত শক্ত প্রমাণ পাইনি। গ্রামীণ জীবনে এসব প্রমাণ সহজলভ‍্য ছিলো না। এটা ঠিক যে, মুক্তমনায় না পেলেও এই তথ‍্য পেয়ে যেতাম। কারণ সামহোয়ার ইন ব্লগে এই ইস্যুতে তখন প্রচুর লেখালেখি হতো। মুক্তমনার কথা এজন‍্য বলেছি যে, এখানে শুধু ধর্ম নির্ধর্ম নিয়ে কাজ হয়নি। বরং চিন্তা ভাবনার সকল শাখায় এই সাইটের অংশগ্রহণ ছিলো, আছে, থাকবে।

অভিজিৎ রায় আর বন‍্যা আহমেদ যেদিন আক্রান্ত হলেন, সেদিনের স্মৃতি আছে। মনে রাখতে চাই না। কাউকে বলতেও চাই না। আমি কেবল মুক্তির কথা মনে রাখতে চাই, নিরাপদ আশ্রয়ের কথা মনে রাখতে চাই। এখন আর খুব বেশি বই পড়া হয় না। পিসিতে অভিজিৎ রায়ের বইগুলোর ই-ভার্সন আছে। মাঝে মাঝে খোলা হয়। পড়া হয়। পুরোনো সাইটে গিয়ে সেই লেখাগুলো পড়ি, ভালো লাগে।

মুক্তমনার কাছে আমার অনেক ঋণ। অভিজিৎ রায়ের কাছে অনেক ঋণ। অভিজিৎ রায়সহ মুক্তমনার সকল প্রতিষ্ঠাতার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এটা সবসময় করি। কারণ এই ঋণ আর এসব দায় দায়িত্বের কোন শেষ নেই। তাই বয়ে বেড়াচ্ছি। এবং বয়ে বেড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।