ওয়াহাবিজমের প্রচার ও প্রসার-পর্ব ২
ওয়াহাবিজম থেকে আইসিসে উত্তরণ- পর্ব ৩

ওয়াহাবিজম কি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয় ওয়াহাবিজম হল উগ্রপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ইসলাম চর্চা। ২০১৩ সালে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে ওয়াহাবিজমকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের প্রধান উৎস ঘোষণা করা হয়। ওয়াহাবিজম বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত প্রভাবশালী হয়ে উঠার পিছনে কারণ প্রথমত সৌদি আরবের তেল বেচা বিপুল পরিমাণ কাঁচা টাকা আর দ্বিতীয়ত ইসলামের পবিত্রভূমি মক্কার অধিকর্তা হিসেবে মুসলিম জাহানের কাছে সৌদি আরবের একক আধিপত্য। যদিও সৌদি আরবের প্রধান মুফতি আইসিসকে চরমপন্থা, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের দায়ে অভিযুক্ত করে আসছে এবং বলছেন ইসলাম কখনো চরম পন্থাকে সমর্থন করে না। তিনি বারংবার বলার চেষ্টা করছেন ইসলামে সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই। যাইহোক, দৃশ্যত মুখে বিরোধিতা করলেও সৌদি আরবের শাসকগোষ্ঠী এবং অভিজাত শ্রেণী সালাফি মতাদর্শের অনুসারী ওয়াহাবিজমকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন জুগিয়ে চলছে বিগত কয়েক দশক। কারণ সৌদি আরবের শাসকগোষ্ঠী মনে করছে ওয়াহাবিজম প্রকৃত ইসলামের অনুসারী শিয়াদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ।

সৌদি আরবে ইসলামের জন্ম এবং বিকাশ ঘটলেও প্রথমদিকে মুসলিম জাহানের নিয়ন্ত্রণ সৌদি আরবের হাতে ছিল না। তখন ক্ষমতা ছিল অনেকটাই বিকেন্দ্রিক। মিশর থেকে ইসলামের দেখভাল করা হয় আর এদিকে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা হয় ইরাকের বাগদাদে। সেখানে সৌদি আরবের কোন ভূমিকায় নেই। এটা খুব স্বাভাবিকভাবেই সৌদি আরবের মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু রুক্ষ কঠিন মরুভূমির দেশ এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সৌদি আরবের পক্ষে তখন ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তেল আবিষ্কার সৌদি আরবের হাতে নিয়ে আলাদীনের প্রদীপ। ১৯৭০’র দশকে তেল রফতানির টাকা দিয়ে সৌদি আরব বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান নেয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু কি উপায়ে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান নেয়া যায়? তাদের হাতে কি আছে? জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা? প্রযুক্তি? তাহলে তাদের সামনে আছে কি? সৌদি আরবের বাদশাহর সামনে আছে অত্যন্ত সহজ সমাধান “ইসলাম”। ইসলামের ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা দখল করা যেতে পারে। সৌদি আরব দাতব্য প্রতিষ্ঠানের নামে দেশে দেশে মসজিদ এবং মাদ্রাসা স্থাপন করা শুরু করে, আর সেই সাথে চলতে থাকে ওয়াজ মাহফিলে ধর্মীয় বয়ান ও হিংসার বাণী প্রচার। সৌদি আরব এই সিদ্ধান্তের ফলাফল হাতেনাতে পেতে শুরু করে। বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসের বিস্ফোরণ ঘটে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, হাটে, মাঠে, ঘাটে, বাসে, অফিসে সর্বত্র বিগত দিনের তুলনায় মানুষকে বেশি ধর্মপ্রবণ মনে হয়। মানুষের মাঝে ধর্মীয় সচেতনতা বেড়েছে অনেকগুণ সেই সাথে বেড়েছে অসহিষ্ণুতা। মানুষ ধর্মপ্রাণ থেকে ধর্মগ্রস্ত হয়ে গেছে।

ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক পরিসংখ্যানে বলছে, গত চারদশকে রিয়াদ মূলধারার সুন্নি ইসলামের গায়ে উগ্রপন্থা ওয়াহাবিজমের প্রলেপ লাগাতে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে এত এত ডলার বিনিয়োগের ফলাফল বৃথা যায়নি। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জিহাদি উৎপন্ন হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি ইউরোপের উন্নত দেশের মাদ্রাসায় আর মসজিদে যারা আল-কায়েদা এবং অন্যান্য জঙ্গি গ্রুপের সাথে সংযুক্ত হয়েছে।

ওয়াহাবিজমের প্রতিষ্ঠাতা মহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহাব সর্বশক্তিমান আল্লাহর একক কর্তৃত্বের উপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ওয়াহাবিজম বুঝতে হলে সালাফিজমও বুঝা দরকার। ওয়াহাবিজম এবং সালাফিজম মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। সালাফ অর্থ পূর্বপুরুষ। যারা ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে যে ধরণের ইসলাম চর্চা করতেন সেই আদি ও অকৃত্রিম মৌলিক ইসলাম মেনে চলেন তাদেরকে বলা হয় সালাফি। ওয়াহাব ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকের তিন প্রজন্মের ইসলামী আদর্শের উপর নির্ভর করে সালাফি মতবাদ প্রচার করেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে ইসলামধর্মে ওয়াহাবিজম চিন্তাধারার জন্ম নেয়। শুরু হয় কট্টরপন্থী ধর্মচর্চা। মহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহাব মুসলমানদের জন্য নতুন করে কিছু নীতিমালা প্রচার করেন।

সালাফ অর্থাৎ পূর্ববর্তী প্রথম তিন প্রজন্মের আচরিত ইসলাম মেনে চলতে হবে।দর্শনের চর্চা মানুষের মনে সন্দেহের বীজ বুনে দেয়। সুতরাং অনুমান নির্ভর দর্শন চর্চা বন্ধ করতে হবে।কোন ব্যক্তির কবর, মাজার জিয়ারত নিষিদ্ধ করতে হবে। কবর এবং মাজার ধ্বংস করে দিতে হবে। ইসলামে ব্যক্তি পূজোর কোন স্থান নেই। পীর বা বুজুর্গ ব্যক্তির জন্য আলাদা সম্মান প্রদর্শনের সুযোগ নেই। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হবে কোরআন এবং হাদিসের মাধ্যমে। ধর্মীয় শুদ্ধতার চর্চা সেখানে নমনীয়তার কোন স্থান নেই।তাকফির (কাফের) সম্পর্কে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। কারণ তারা ইসলাম ধর্মকে এবং মুসলিমদেরকে বিপথগামী করে। কুরান এবং সুন্নাহর আলোকে সমাজ গড়তে হবে। ওয়াহাব ছিলেন অত্যন্ত কট্টরপন্থী এবং রক্ষণশীল। তিনি ইসলামধর্মের কোনরূপ সংস্কারের ঘোর বিরোধী। তিনি প্রথম প্রজন্মের মুসলিমদের মাঝে বিশুদ্ধ ইসলাম দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি সালাফি মতাদর্শের ভিত্তিতে সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। মহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহাব, ইবনে তাইমিয়া নামে একজন ধর্মগুরুর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ইবনে তাইমিয়া মনে করতেন রাষ্ট্র ধর্মেরই একটা বর্ধিতরূপ, সেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ধর্মের মাধ্যমে এবং তিনি ধর্মের দ্বান্দ্বিক ও তার্কিক আলোচনা সমালোচনার ঘোর বিরোধী ছিলেন।

ইবনে তাইমিয়া তার জীবদ্দশায় মঙ্গোলিয়া শাসকদেরকেও কাফির হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। যদিও তারা নবীর প্রচারিত ইসলামের নীতিমালা আদর্শ মেনে চলতো। ইসলামের সব নীতি আদর্শ যাতে সঠিকভাবে মানুষ পালন ও চর্চা করতে পারে সেজন্য তিনি বিশুদ্ধ ইসলামী আন্দোলন শুরু করেন। মহম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহাব এই আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেন এবং এই আন্দোলনের তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ওয়াহাবিজম গণমানুষকে নামাজের কাতারে দাঁড়াতে বাধ্য করে, পুরুষদের দাড়ি কামানো এবং ধূমপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তিনি প্রচার করেন ওয়াহাবিদের মসজিদ হবে একেবারে সাদামাটা। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সৌদি রাজপরিবার এবং রাজনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে ওয়াহাবিজমের ধর্মীয় আদর্শ পুরো আরব পেনিনসুলা অঞ্চলে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে এবং দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সৌদি রাজপরিবার এখনো ওয়াহাবিজম মতাদর্শদ্বারা প্রভাবিত। ১৮২৫ সালে ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা মক্কার দখল নেন। কিন্তু তারা মুসলিমদেরকে মক্কায় হজ্জ করার জন্য অনুমতি অব্যাহত রাখে। ওয়াহাবিজমে প্রভাবিত সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ধর্ম পুলিশ নামে একধরনের নিরাপত্তা বাহিনী সৃষ্টি করেন যাদের কাজ হল অবৈধ মদ্যপায়ী আটক করা। নামাজ চলাকালীন সময়ে দোকানপাট বন্ধ আছে কি না সেটা নিশ্চিত করা। ১৯৮০ সাল থেকে সৌদি আরবের বিপুল সংখ্যক বেকার নবীন যুবক সালাফি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওয়াহাবি মতবাদে দীক্ষিত হয়। তখন তাদের চোখে মুখে চকচক করছে পূর্বপুরুষের প্রকৃত ইসলামে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন। তারা তখন কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাজে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার দাবিতে মুখরিত।

আল কায়েদা, আইসিস, বোকো হারাম এরকম যত জঙ্গি সংগঠন আছে পৃথিবীজুড়ে তাদের সবার তাত্ত্বিক বয়ান শুরু হয় ইবনে তাইমিয়ার ভাবাদর্শে প্রভাবিত ওয়াহাবি ইসলাম। ওয়াহাবি ইসলাম চর্চা এখন আর শুধু সৌদি আরবের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বাসের ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের মত পৃথিবীর দেশে দেশে। কাফের হত্যা করলেই বেহেশতে যাওয়া যায় এই আকর্ষণীয় পর্যটন প্যাকেজে মুসলিম যুবক বুকে বিস্ফোরক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ট্রেন লাইনে, বিমানবন্দরে, জনাকীর্ণ শপিং কমপ্লেক্সে, সামাজিক উৎসবে আগত হাসিখুশি নিরপরাধ জনতার উপর চালিয়ে দিচ্ছি ট্রাক-লরি। সবচেয়ে আশ্চর্য মানুষ হত্যার জন্য তাদের মনে সামান্যতম অপরাধবোধ জাগ্রত হয় না। অন্যকে হত্যা করতে নিজের শরীর উড়িয়ে দিতেও তাদের কোন দ্বিধা নেই। প্যারিস, ব্রাসেলস, বৈরুত, লাহোর, মুম্বাই সর্বত্র কাফের হত্যা করে বেহেশতে যাওয়ার দীর্ঘ লাইন।

একি পরিহাস! মুসলিম স্কলার নুয়াম বিন হাম্মাদ প্রণীত হাদিস সংকলন গ্রন্থ “কিতাব আল ফিতান” বা বুখারি শরিফে দেখা যাচ্ছে নবী মুহম্মদ এবং ইমাম আলী সতর্ক করে দিয়েছিলেন শেষ জামানায় ধর্মের নামে উগ্রপন্থা বৃদ্ধি পাবে। ইমাম আলী আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, হে মুসলিমগণ, নবী বলেছেন, “ যদি তোমরা দেখতে পাও কালো পতাকা তবে তোমরা যেখানে আছো সেখানেই অবস্থান নাও এবং তোমরা তোমাদের হাত, পা চালনা করো না। কিছু দুর্বল মানুষ তোমাদের সামনে আসবে, যাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই, তাদের হ্রদয়ে যেন মোহর দিয়ে সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। তারা আব্বাসিয় খেলাফতের অধিবাসী এবং তারা চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি কিছুই রক্ষা করে না”

“এবং তারা নিজেদেরকে সত্য পথের অনুসারী দাবি করবে, কিন্তু বাস্তবে তাদের সাথে সত্যের কোন যোগসূত্র নেই। তাদের নাম হতে পারে আবু মহাম্মদ এবং তাদের নামের শেষ অংশ হবে তাদের শহরের সাথে মিলিয়ে যেমন হালাবি। [আবু আল বাগদাদির সাথে মিলে যাচ্ছে?] এবং তাদের চুল হবে মেয়েদের মত এলোকেশী। তাদেরকে ছেড়ে দাও, যেতে দাও যেথা তাদের খুশি যতক্ষণ না তারা নিজেদের মাঝে যুদ্ধ করে। তারপর আল্লাহ তার ইচ্ছামত তোমাদের মাঝে কোন একজনের কাছে সত্য প্রকাশ করবেন।

মূল প্রবন্ধ-What is Wahhabism? The reactionary branch of Islam said to be ‘the main source of global terrorism’