ক্যাস্ট্রোর কিউবাতে বাক স্বাধীনতা। জুলাই ১১, ২০১৬ লী লকউড,তাশেন, জার্মানি।

১৯৫৯ সালের শেষ দিকে বাতিস্তার শাসনের পতন দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের ফটোসাংবাদিক লী লকউড কিউবায় যান। অনেক সন্ধানের পর তিনি সদ্য ক্ষমতায় আরোহণ করা ক্যাস্ট্রোর সাক্ষাৎ পান। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্বেও লকউড এবং ক্যাস্ট্রোর মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে যায়। লকউড পরবর্তী কয়েক দশকে একাধিকবার কিউবা ভ্রমণ করেছেন এবং লকউড খেয়াল করে দেখলেন ক্যাস্ট্রো, লকউডকে কিউবাতে অবাধ প্রবেশের অলিখিত অধিকার দিয়েছেন। ১৯৬৫ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে লকউড সাতদিন ব্যাপী ম্যারাথন সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেন। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। লী লকউড তার সাক্ষাৎকারে ক্যাস্ট্রোকে উপস্থাপন করেন একজন অন্তর্ভেদী মানুষ হিসেবে। ২০১০ সালে লী লকউড মারা যান। লী লকঊডের সম্মানে জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র এবং কিউবার সম্পর্ক নিয়ে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে জার্মানির শিল্পকলা বিষয়ক প্রকাশনী সংস্থা ‘তাশেন’। সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম ছিল, “ একজন আমেরিকান সাংবাদিকের চোখে ক্যাস্ট্রোর কিউবা, সময়কাল ১৯৫৯-১৯৬৯ ” সাক্ষাৎকারের সাথে প্রকাশিত হয়েছিল শত শত ছবি। ক্যাস্ট্রোর সাথে লী লকউডের আলাপের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল কিউবার সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি এবং বাকস্বাধীনতা। এই অনুবাদ অংশে ক্যাস্ট্রোর কিউবায় বাকস্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

লী লকউড: কিউবার শিল্প-সংস্কৃতিতে কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার সম্ভাবনা আছে? যেমন ধরুন সাহিত্যক্ষেত্রে?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: প্রতিটি শিল্প মাধ্যমেরই নিজস্ব চরিত্র আছে। এই তো দেখেন, চলচ্চিত্র থেকে চিত্রকলা আলাদা। চলচ্চিত্র একটা আধুনিক শিল্প মাধ্যম এবং প্রচুর সরঞ্জামের দরকার হয়। সুতরাং সিনেমা বানানো আর ছবি আঁকা অথবা বই লেখা বিষয়টা এক রকম নয়। কিন্তু যদি আপনি বলেন সেখানে কোন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আছে কি না? আমি বলব, কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণ নেই।

লী লকউড: একটা বিষয় দেখে খুব অবাক লাগছে যে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের তুলনায় কিউবায় শিল্পী, আঁকিয়ে, ভাস্কর ইত্যাদি সৃষ্টিশীল মানুষেরা সংখ্যায় বেশি তবুও প্রকাশনার সংখ্যা খুবই কম। এরকম কেন হলো?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: কারণ হতে পারে সাহিত্য সরাসরি প্রকাশনার সাথে যুক্ত। প্রধানত এটা অর্থনৈতিক সমস্যা। স্কুলের বই, পাঠ্য, রেফারেন্স বা অন্যান্য বই প্রকাশনার জন্য আমাদের প্রাকৃতিক উপাদানের স্বল্পতা আছে। ফলে অনেক সময়ই আমরা কাগজের অপচয় করতে পারি না। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা। তারমানে এই নয় যে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে না। যে বই আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী সেগুলো আমরা প্রকাশ করতে দিতে পারি না।

লী লকউড: অন্য কথায় বিষয়টা কি এরকম যে, ধরুন একজন লেখক বিপ্লব বিরোধী উপন্যাস লিখল, তাহলে কি সেটা প্রকাশ করা যাবে না?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভব না। এমন দিন আমাদের আসবে যখন প্রকাশনার সব কাঁচামাল থাকবে আমাদের হাতের কাছেই পর্যাপ্ত পরিমাণে। যে বইয়ের আবেদন সর্বজনীন বিশ্বসাহিত্যের জন্য সেই অমূল্য বই আমরা অবশ্যই প্রকাশ করব। তখন আমরা বিস্তৃত পরিসরে সব ধরণের বই প্রকাশ করতে পারব এবং যেকেউ যেকোনো বিষয়ে বই প্রকাশ করার জন্য কথা বলতে পারবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের স্বতন্ত্র এবং বিস্তৃত বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার সমর্থক। কেন জানেন? কারণ আমি মানুষের মুক্তি চাই। আমি চাই সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী, আমি চাই মানুষ চিন্তা করতে শিখুক যে হবে মুক্তমনের স্বাধীন এবং বিশ্বাসের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আমি চাই সাহসী মানুষ। আমি মনে করি প্রত্যেকে তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনা দিয়ে নিজেকে পরিচালিত করবে। আমি বই, সিনেমা নিষিদ্ধ করার বিরোধী।

ব্যক্তিগত চিন্তায় ভবিষ্যতে কোন আদর্শের মানুষকে আমি চাই জানেন? মানুষ হবে সুশিক্ষিত এবং তারা শুভবুদ্ধির চর্চা করবে যাতে তারা অপশক্তির সামনে বিভ্রান্ত এবং ভীত না হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দেখুন, আমরা কখনো নিজেদের নিয়ে একটু চিন্তা করেছি? আমরা চিন্তা করি যে ভালো বই পড়ব, ভালো সিনেমা দেখব, কিন্তু আমাদের বিশ্বাসের গোঁড়ামি ত্যাগ করব না। ধরুন কোন বইতে একটা মৌলিক চিন্তা-লিখিত হয়েছে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন হতে পারে, যা আমাদের মঙ্গল করতে পারে তার কতটুকু আমরা বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন করি? ভবিষ্যতে আমাদের দেশের সব নাগরিক কি একই রকম মূল্যবোধের উন্নত মানুষ হয়ে যাবে ঠিক যেমন চাই? যদি আমরা মূল্যবোধের পরিবর্তন করতে না পারি তাহলে আমরা হবো দর্শনহীন মানুষ, নিজেদের সংগ্রামে আমাদের কোন আস্থা থাকবে না।

লী লকউড: কিন্তু এখন কি প্রকাশনা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: এখনি প্রকাশনা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা কিছুটা কাটামুণ্ডের দিবা স্বপ্নের মত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। প্রথমত অর্থনৈতিক সমস্যা তো আছেই, আর মনে রাখতে হবে আমাদের সংগ্রাম এখনো চলমান।

লী লকউড: কিউবান প্রেস যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এককভাবে নেতিবাচক প্রচারণা লিখেই যাচ্ছে। এটাও কি সংগ্রামের অংশ?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: আমি বলছি না যে আমরা এটা করি না। এটা খুবই সত্য যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যা কিছু লেখা হয় সেটা পুঁজিবাদের নেতিবাচক দিক আর আগ্রাসনের কথা বিবেচনা করেই লেখা হয়। আর এদেশে তো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে লেখার কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সাথে যেমন আচরণ করে স্বাভাবিকভাবে আমরাও তেমনটাই করি। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সাথে সবসময় বৈরি ব্যবহার করে আসছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আমাদের কাছে শুধু পালটা প্রতিবাদই জমা থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো আমরা মিথ্যা কথা লিখি না, প্রোপাগান্ডা করি না।

লী লকউড: তাহলে তো একই অর্থ দাঁড়ালো। আপনি আমেরিকানদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেটাও কম ক্ষতিকর নয়।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: সেটা নির্ভর করছে ঠিক কাকে বা কোন জিনিসকে আপনি মিথ্যা বলছেন।আমি মেনে নিচ্ছি নেতিবাচক প্রচারণা ক্ষতিকর। মিথ্যা হলো তাই যার অস্তিত্ব নাই সেটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপস্থাপন করা।মিথ্যা আর তথ্যের বিকৃত উপস্থাপন এক নয়। যদিও এই দুইয়ের একই রকম প্রভাব আছে। আদর্শগতভাবে মিথ্যা অথবা তথ্যের বিকৃত উপস্থাপন গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এটা করতে আমরা বাধ্য হয়েছি এবং এর জন্য আমরা কোনভাবেই দায়ী নই।যদি পৃথিবীতে সত্যিকার বিশ্বাস এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতো তাহলে এমন প্রচারণার কোন প্রয়োজন ছিল না।

লী লকউড: কিন্তু যদি আপনি ক্রমাগত অপপ্রচার করতেই থাকেন তাহলে তো কিউবার জনগণের মাঝে আমেরিকার প্রতি বিদ্বেষ বাড়তেই থাকবে। সেখানে আপনি শান্তি আশা করেন কিভাবে?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: আবারও বলছি, নেতিবাচক প্রচারণার জন্য কিউবা এককভাবে দায়ী নয়। যুক্তরাষ্ট্রই প্রথমে কিউবার সাথে সব ধরণের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

লী লকউড: আমার মনে হয় না প্রশ্নের সাথে উত্তরের কোন সম্পর্ক আছে।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: আপনার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়ার জন্যই আপনার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করছি। আমাদের তরফ কি ঘটেছে গণমাধ্যমকে সেটা সম্পূর্ণ জানানো আমার দায়িত্ব। প্রকৃত ঘটনা গণমাধ্যমের সামনে বলার মত সৎ সাহস আমার আছে। ঠিক একই বিষয়ে কয়জন আমেরিকান নেতা এভাবে বলতে পারবেন?

লী লকউড: স্বীকার করি আপনি অনেক খোলাখুলি অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু আমি একটা বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করতে চাই। আপনি যদি শুধু আমেরিকার নেতিবাচক চিত্র তুলে না ধরে আমেরিকার জ্ঞান বিজ্ঞানের দুয়ার কিউবার জন্য খোলা রাখতেন তাহলে কিউবার সমাজ অনেক লাভবান হতে পারত। যেমন ধরুন, সম্প্রতি কালো মানুষের নাগরিক অধিকার অর্জনের আন্দোলনে আমেরিকান সরকার কালোদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে, নতুন আইন পাশ হয়েছে। কিউবার সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হতে পারত। কিন্তু আপনি শুধু ক্যালিফোর্নিয়াতে কালোদের দাঙ্গা, অথবা জর্জিয়া, আলাবামাতে এগিয়ে আসছে কোন বিক্ষোভ এই ধরণের খবর প্রকাশ করছে।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: আমার যতদূর মনে পড়ে কালোদের সমঅধিকার নিয়ে আইন পাশের সেই খবর আমাদের সংবাদ মাধ্যমে ছাপা হয়েছিল। যদিও আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের স্পষ্টত পার্থক্য আছে। আমরা অর্থশাস্ত্রের মধ্যেই মানুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করার উপাদান রয়ে গেছে শ্রেণি বৈষম্যের শিকার মানুষগুলো মানুষের দ্বারা নিরুপায় ব্যবহৃত হয়।

নিশ্চিত এটা মানবজীবনের একটা দুরূহ এবং জটিল সমস্যা। বৈষম্যের অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্যদিয়ে আমরা সময় অতিক্রম করছি। যখন সুবিধাভোগী শ্রেণি বিলোপের সাথে সাথে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর হয়ে গেল এবং এর জন্য কোন খরচ নেই। আমার মনে হয় না যুক্তরাষ্ট্র বৈষম্য দূর করতে পারবে। আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিপ্লবের কথা বলাটা অনর্থক। বিপ্লব বলতে ক্লাসিক সেন্সে যা বোঝায় সেই অর্থ সম্ভবত আমেরিকায় কোনদিনই বিপ্লব হবে না। কিন্তু বৈপ্লবিক পরিবর্তন অবশ্যই ঘটবে। আমি নিশ্চিত যে আগামী পাঁচশ বছরে উত্তর সমাজকে আর বর্তমানের মত বৈষম্য বয়ে বেড়াতে হবে না, বৈষম্যের সমস্যাও তখন থাকবে না।

লী লকঊড: তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তনের কথা প্রকাশ করছেন না কেন? কিউবার জনগণকে কেন গল্পের পুরোটা বলছেন না?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: কারণ সবকিছু মিলে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিবাচক কোন পরিবর্তন ঘটছে না। বরং সেখানে রাজনৈতিক অবক্ষয় চলছে। আমাদের সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে পারি যুক্তরাষ্ট্রের সব নীতিমালা, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি অতি প্রতিক্রিয়াশীল এবং আগ্রাসী।

লী লকউড: আমরা এখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতি নিয়ে কথা বলছি না।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: বাস্তবে এটাই আমাদের সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

লী লকউড: আসুন, আমরা আলোচ্য প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এখানে সরকারের সাথে কারো মতাদর্শগত পার্থক্য দেখা দিলে সে তার মত প্রকাশ করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে কিউবার সংবাদমাধ্যমে সরকারবিরোধী কোন খবরই প্রকাশ করা হয় না। এটা মনে হয় সরকারের দমননীতির প্রভাব।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: হ্যাঁ, আপনি যা বলেছেন সেটা সত্য। সরকারের সমালোচনা খুব কমই লেখা হয়। সমাজতন্ত্রের শত্রু এখানের সংবাদমাধ্যমে লিখতে পারেন না। কিন্তু আমরা তার কথা খারিজ করে দিই না। আমরা তোমাদের মত সংবাদপত্রের তথাকথিত স্বাধীনতা দাবি করি না যার বাস্তবিক কোন ভিত্তি নেই। তারপরেও আমি মেনে নিচ্ছি এখানের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় অপ্রতুল। আমি মনে করি না সমালোচনার অধিকার না থাকা ভালো কিছু বয়ে আনে। বরং সরকার পরিচালনায় সমালোচনার প্রয়োজন আছে এবং এটা সুশাসনের জন্য ইতিবাচক উপায়। আমাদের সবাইকে সমালোচনার ব্যবহার শিখতে হবে।

লী লকউড: আপনি কি মনে করেন না, কিউবায় যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকত তবে কিউবার লেখকরা গঠনমূলক সমালোচনা করে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারতেন?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: সমালোচনা, অবশ্যই – তবে শত্রুর উদ্দেশ্য সফল করার জন্য অবশ্যই নয়। এমনকি প্রতিবিপ্লবীদের পক্ষে কাজ করার জন্যও নয়।

লী লকউড: কিন্তু সীমাবদ্ধ দৃষ্টিকোণে কে বলতে পারে কোন সমালোচনা গঠনমূলক আর কোন সমালোচনা প্রতিবিপ্লবাত্মক?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: আমরা একটা চলমান যুদ্ধের মধ্যে আছি, কম-বেশি এটা প্রকাশ্য যুদ্ধ। ধরুন, যখন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় তখন কি হয়? যখন সারা পৃথিবীর মানুষের সমালোচনা সত্বেও যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন কি হয়? তোমাদের এত উদার মানবাধিকারনীতি নিয়ে কি করছিলে যখন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে গেল?

লী লকউড: আপনি কিন্তু বললেন না কে সিদ্ধান্ত নেবে?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: এরকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক শক্তি, বিপ্লবী দল সিদ্ধান্ত নেবে।
করছিলে যখন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে গেল?

লী লকউড: কিন্তু মধ্যবর্তী প্রায় পুরোটা সময়ে আপনার সমাজে কোন সমালোচনা নেই। কোথাও কোন সমালোচনা নেই, পত্রিকায় নেই, সাহিত্যে নেই। কিউবার রেডিও, টেলিভিশন বা যে কোন যোগাযোগ মাধ্যম বলেন না কোথাও কোন সমালোচনা নেই।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: অবশ্যই ন্যূনতা সমালোচনা অন্তত আছে। তদুপরি, আমাদের জার্নালিস্ট ক্যাডারদের প্রশিক্ষণের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে, কারণ লক্ষ লক্ষ জনতা তারা লেখে সেটা পড়ে। আমরা যদি আমাদের বিস্তৃত সংস্কৃতির মানুষ খুঁজে পেতে হয় তবে সেই মানুষ খুঁজে বের করতে হবে, সাধারণ মানুষের সাথে যার সরাসরি যোগাযোগ আছে। দরকার সে আলোকিত মানুষ দরকার যিনি ইতিমধ্যেই সংস্কৃতির চর্চা করেন। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের আধুনিক জীবনে সাংবাদিকতার গুরুত্ব অপরিসীম।
আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আমেরিকার মত পুঁজিবাদী দেশের সবধরনের আগ্রাসন রোধ করতে হবে। এবং সেজন্য সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা শতভাগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

লী লকউড: কিন্তু সমালোচনার সবধরনের পথ বন্ধ করে কি ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনছেন না?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: আমি জানি। আমি বলছি না সমালোচনা বন্ধ হয়ে গেলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বরং কখনো কখনো বিপ্লবের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

লী লকউড: এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য আপনি কি কি বিষয় দায়ী করেন?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: অনেক বিষয় জড়িত। কিন্তু প্রধানত এখন আমাদের এখন জরুরী পরিস্থিতিতে টিকে থাকার লড়াই চলছে। যা কিছু চলছে সব অস্তিত্বের জন্য।

লী লকউড: আমার মনে হয় প্রতি বিপ্লবের বিরুদ্ধে আপনার অতি রক্ষণশীল অবস্থানের কারণেই হয়ত আজকের পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। যখন সমাজতন্ত্রের আদর্শে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল তখন হয়ত বুদ্ধিজীবী, সমালোচকগণ চুপ হয়ে গেলেন এই ভয়ে যে, “তাদের চিন্তা, সমলোচনাপূর্ণ লেখা প্রতি বিপ্লবী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে”। বাক স্বাধীনতা নিষিদ্ধ করার কারণেই সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যারা ভালো মন্দের পার্থক্য করতে পারে এবং সুশাসনের জন্য সুপরামর্শ দিতে পারে তাদের সাথে আপনার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নিজের খোলসের বাইরে গিয়ে কখনো মুখোমুখি বসে শুনে দেখেছেন সমালোচনাকারীদের মন্তব্য, তাদের অভিমত?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: আমি মেনে নিচ্ছি, নিকট ভবিষ্যতে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আমাদের বদ্ধপরিকর হতে হবে। এখন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের চিন্তার পথ আটকে আছে। মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে কিছু কিছু মৌলিক প্রশ্ন দৃষ্টি সীমার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

লী লকউড: শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিদ্যমান, যেকোনো দ্বান্দ্বিক আলোচনা এখানে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিউবার অনেক স্কুলে আমি গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি শিশুদের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা মেনে নিতে শেখানো হয় আর এমনভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হয় যাতে শিক্ষার্থী আপনি কি মনে করেন না, এতে আপনার দেশের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সম্ভাব্য বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছে?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: আমি মনে করি ছাত্রদের শিক্ষার গুনগত মান কেমন অর্জিত হবে সেটা নির্ভর করে যিনি পাঠদান করেন তার উম্মত প্রশিক্ষণের উপর। সুতরাং এটা কোন নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রশ্ন নয়। শিশু অবশ্যই সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠবে, চিন্তা করতে শিখবে।, প্রশ্ন করতে শিখবে। বুদ্ধি,মেধা ও প্রজ্ঞা বিকশিত করাই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। যাইহোক, আপনার পর্যবেক্ষণ আমি অবগত হলাম। শিক্ষকদের পাঠদান উন্নত করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখন আমাদের মৌলিক লক্ষ্য। আমাদের অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না, যে আমরা যে পরিস্থিতিতে বাস করছি সেটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। এখানে শ্রেণি সংগ্রাম এবং সংঘাত আছে, মতাদর্শের দ্বন্দ্ব আছে, বিচার ব্যবস্থায় ত্রুটি আছে এবং অনুভূতি প্রকাশে বৈকল্য আছে। এসব কিছু মিলেই আমাদের আজকের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রতিকুল পরিস্থিতি হয়েছে। যাইহোক, বাক স্বাধীনতা, সমালোচনার অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আমরা শুরু থেকে এতটা চিন্তিত ছিলাম না। আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল শিক্ষা ক্ষেত্রে। কিউবাতে একসময় প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার জন্যেও পর্যাপ্ত শিক্ষক ছিল না যারা লিখতে পড়তে শেখাতে পারে। আমাদের ক্ষমতাগ্রহণের প্রথমদিকে আমরা প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ করলাম। আমাদেরকে ব্যাপকভাবে শিক্ষা সংস্কার করতে হয়েছিল কারণ আমাদের পর্যাপ্ত জনবলের অভাব ছিল। আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয় আমাদের শিশুদের উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করা যারা ভবিষ্যতে আমাদের দেশের জ্ঞান, বিজ্ঞান, মেধা প্রজ্ঞার চর্চা করবে। যারা আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিক হবে তাদেরকে কখনো গোঁড়ামিপূর্ণ কুশিক্ষা দিতে চাই না। বরং এমন পাঠদান নিশ্চিত করতে চাই যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের ভালোমন্দের বিচার করতে পারে।

লী লকউড: আমি আরো দেখেছি শিশুদেরকে গোঁড়া মতাদর্শের শিক্ষা দেয়ার প্রবণতা আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আমি শিশুদের সাথে কথা বলে দেখেছি কিউবার প্রকাশনা ব্যবস্থা কেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক দিক নিয়ে লেখা প্রকাশ করে না। যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যেসব লেখা কিউবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় সেগুলোর সত্যতা নিশ্চিত না করে শ্রেনিকক্ষে শিশুদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াচ্ছে? এই কোমলমতি শিশুরা তাদের প্রাথমিক শিক্ষাজীবনেই একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মনোভাব নিয়ে বড় হচ্ছে। তারা বড় হয়ে কি যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে কি ভাববে?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: কোন সন্দেহ নেই, তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্র যা কিছু প্রতিনিধিতিত্ব করে সে সম্পর্কে অত্যন্ত বাজে ধারণা নিয়ে বড় হবে, ঠিক যেমনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শিশুদেরকে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে নেতিবাচক শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কিছুই করার নেই।

লী লকউড: সেদিন দূরে নয় যেদিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কিউবার মধ্যে আবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। যখন সেটা ঘটবে তখন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে বড় হওয়া আগামী দিনের যুবসমাজ কেমন করে মানিয়ে নেবে?

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: এই প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই। তাছাড়া ইতিপূর্বে এমন ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি। প্রকৃতপক্ষে এই প্রথমবারের মত কোন উত্তর আমেরিকানের কাছে এমন ধরণের সম্ভাবনার কথা শুনলাম। আমাদের নিজেদের মনেও এমন সম্ভাবনা উঁকি দেয় নি। বলা যেতে পারে সচেতনভাবে কোনদিনই আমরা এই সমস্যার কথা ভাবিনি। হতে পারে আমাদের মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতার কারণেই এমন হয়েছে। আমেরিকানদের বাক স্বাধীনতার অবাধ সুযোগের কারণেই আপনি হয়ত ভবিষ্যতে কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বন্ধুত্বের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব। এমনকি আমরা নিজেরাও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি কিভাবে কালো আর সাদা মানুষের সাম্যতা কিভাবে আমেরিকার সাদা মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপর আমাদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে আমরা সেভাবেই মূল্যায়ন করে থাকি। কিন্তু এমন মূল্যায়নের পিছনে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রনীতির ভূমিকা আছে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। হতে পারে আপনার দেশের যেসব বই আমাদের দেশ প্রকাশ করে সেখানে এমন প্রশ্নের অবতারণা হয়। আমার পক্ষ থেকে তাদের সাথে আলোচনা করে বলতে চাই এমন প্রসঙ্গে মনোনিবেশ করার সময় আসে নি। আপনার প্রশ্নের সূত্র ধরেই আমার মনে হয় সত্যিই হয়ত একদিন বহুদিন, বহু বছর পর আমাদের এই দুই দেশের মানুষের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে।

লী লকউড: আমার মনে হয় অপ্রয়োজনীয় কারণে শত্রুতা না বাড়িয়ে আমাদের চেষ্টা করা উচিত অপেক্ষার সময় যাতে কমিয়ে আনা যায়।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো: হ্যাঁ, আমার কাছেও সেটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়। চলুন মধ্যাহ্নভোজনে যাওয়া যাক।