(১)
গৌরী লঙ্কেশের নাম আগে শুনিনি। কন্নডভাষি কোন পত্রিকার সম্পাদকের নাম কেউ না জানতেই পারে। ব্যাঙ্গালোরে উনাকে কালকে গুলি করে মারা হয়। উনি একজন বাম লিব্যারাল ঘরানার সম্পাদক। হিন্দুত্ববাদিদের বিরুদ্ধে লিখতেন। আবার কংগ্রেসকেও গালাগাল দিতেন। উনার পত্রিকা লঙ্কেশ পত্রিকে। তবে ইদানিং কালে উনার সাথে সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিল ব্যাঙ্গালোর বিজেপির। কে খুন করেছে এখনো পুলিস জানে না-কিন্ত অনুমান করা শক্ত না।
কন্নড় ভাষার এই রাজনৈতিক সাপ্তাহিকটি গোটা ভারতেই ব্যতিক্রম। এর প্রতিষ্ঠাতা গৌরীর পিতা পি লঙ্কেশ। ছাপা হয় কয়েক লাখ। কোন বিজ্ঞাপন এরা নেন নি কোনদিন। কারন বিজ্ঞাপন নিলেই দেহবিক্রি আবশ্যক। কোন রাজনীতিবিদকেই ছেড়ে কথা বলে না লঙ্কেশ পত্রিকে। কারুর তাবেদারি করে না। ফলে নীতিগত কারনে তারা কোনদিন বিজ্ঞাপন নেয় না। লসেই চলে পত্রিকা। কিন্ত ওদের পাবলিকেশন হাউসে বেশ কিছু কেরিয়ার সংক্রান্ত লাভ জনক প্রকাশনাও আছে।
পি লঙ্কেশের মৃত্যুর পরে পত্রিকার হাল ধরেন তার কন্যা। এখানেও ইতিহাস বর্ণময়। পি লঙ্কেশ কন্নড জাতীয়তাবাদি। উনিই বলেছিলেন হৃদয়ের কথা একমাত্র মাতৃভাষাতেই লেখা সম্ভব। গৌরী কিন্ত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছাত্রী। মিডিয়া কমিউনিকেশনে ডিগ্রি নেওয়ার পরে বাবার পত্রিকাতে আসেন নি- জাতীয় লেভেলেই সাংবাদিকতা করেছেন কুড়ি বছর। এই কুড়ি বছর বাবার পত্রিকাতে একটিও লাইন লেখেন নি।
বাবার মৃত্যুর পরে যখন কর্পরেট হাউস ছেড়ে এই ঐহিত্যবাহী কন্নড় পত্রিকার হাল ধরেন গৌরী-উনি অকপটে স্বীকার করেন, এর আগে পর্যন্ত শুধুমাত্র মালিকপক্ষের জন্য লিখেছেন। নিজের পত্রিকা হাতে পাওয়ার পরে, কোন কম্প্রোমাইজ না করেই ভ্রষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে কলম ধরেন গৌরী লঙ্কেশ। পরিনতি মৃত্যু।
কোন সন্দেহ নেই, ভারত এবং আমেরিকাতেও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এখন আগ্নেয়গিরির লাভাশ্রোত। শাসক দলের মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই, তাকে পিটিয়ে দাও, গালাগাল দাও। বেশী জ্বালালে মেরেই দাও!!
রাজনৈতিক অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। জৈন ধর্মে আমরা শিখি অনেকান্তবাদ। অর্থাৎ একই বাস্তবতার অনেক রূপ থাকতে পারে। কেউ বামপন্থী, কেই দক্ষিনপন্থী দৃষ্টিতে তার সমাজ, রাষ্ট্রকে দেখবে সেটাই স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি, বিবাদ সব কিছুই হতে পারে। কিন্ত সেই বিতর্কের জায়গাটা না থেকে যদি তারা দাবী করে দক্ষিন পন্থী জাতিয়তাবাদই একমাত্র পথ, বা বামপন্থাই পথ-তাহলে দুদলই ফ্যাসিজমের শব সাধক।
গৌরী লঙ্কেশ একজন বামপন্থী। উনার লেখা সাবেকি বাম ঘরানার। মাওবাদিদের সমর্থনেও উনি লিখেছন। কিন্ত রাজনৈতিক ভাবে উনার বিরোধিতা না করে যখন, বুলেট দিয়ে কলম থামাতে হয়, সেটা সুস্পষ্ট ভাবেই ফ্যাসিজমের প্রতিধ্বনি।
তবে আমি আশাবাদি। আস্তে আস্তে অর্থনীতি ক্রমশ হাতুড়ে অর্থনীতিবিদদের হাত থেকে সলিড বিগ ডেটা মডেলে আসছে। যার মানে খুব নিকট অতীতেই, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও চালিত হবে ডেটা সিম্যুলেশন এবং এলগোরিদম থেকে। সেখানে বামপন্থা, বা দক্ষিনপন্থা রাজনীতির ভূমিকা থাকবে কম- গণিতের ভূমিকা থাকবে বেশী। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যত বেশী ডেটা সিম্যুলেশন, গেম থিওরীর সাহায্য নেওয়া যাবে-দেশ এবং দশের তত সুদিন আসন্ন। বামপন্থা, দক্ষিনপন্থা ইত্যাদির রাজনৈতিক আইডিওলজির ওপর দেশ চালাতে গেলে, ভরাডুবি সময়ের অপেক্ষা।
একবিংশ শতাব্দিতে বিংশ শতাব্দির রাজনৈতিক আদর্শ অচল নয়া পয়সা। অথচ ভারত, আমেরিকাতে সেই বাতিল আদর্শেরই আজ রমরমা।
আমি অফিসে ঢুকে আমেরিকান কোম্পানীর জন্য অত্যাধুনিক কোডিং করব, বাড়িতে ঢুকে হনুমান চল্লিশা- আর রাজনীতির বেলায় আদ্দিকালের জাতীয়তাবাদি, ধর্মবাদি, ধর্মঘটবাদি, টুপিবাদি ইত্যাদি বাতিল রাজনৈতিক তত্ত্বের চর্চা-খুব বেশীদিন এতগুলো স্ববিরোধিতা একত্রে চলতে পারে না।
(২)
গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুতে স্যোশাল মিডিয়াতে একদলের পৈশাচিক উল্লাশ। ট্রলের ঢল টুইটারে। নতুন কোন অভিজ্ঞতা না। অভিজিতের মৃত্যুতে যেমন ফেসবুকে উৎসব করেছিল কিছু বাঙালী মুসলমান, আজ গৌরীর মৃত্যুতে প্রকাশ্যে উল্লাসিত কিছু কট্টরপন্থী হিন্দু। গৌরী লঙ্কেশের “অপরাধ” উনি হিন্দু ধর্মের কট্টর সমালোচক ছিলেন! অভিজিতের অপরাধ, সে ইসলামের সমালোচক ছিল!
২০০৭ সালে ষষ্টি দুলে বলে একজন তৃনমূলীকে, তার সাত বছরের ছেলের সামনে চোখে উত্তপ্ত রড ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী। সেই সময় স্যোশাল মিডিয়াতে সিপিএমের হার্মাদ ট্রলরা একই দাবী করে-ষষ্টি নাকি ছিল ফরেদারদের দালাল-শ্রেনী শত্রু-তাই তার নৃশংস হত্যা জায়েজ। আমি ওই ঘটনার পর থেকে অনেক ভদ্রবেশী সিপিএম সমর্থককেও আনফ্রেইন্ড করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেটা অর্কুটের যুগ।
অভিজিতের মৃত্যুতে কিছু বাংলাদেশী মুসলমানদের উল্লাসে এটা পরিস্কার ছিল, ধর্ম এদের মানুষের বদলে অমানুষ বানিয়েছে। তবে তারা আমার ফ্রেইন্ড লিস্টের লোক না। ফলে আনফ্রেইন্ড করার ঝামেলা নিতে হয় নি। আজকে ফ্রেইন্ডলিস্টের বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদিদের আনফ্রেইন্ড করতে বাধ্য হলাম। ঠিক যেভাবে ষষ্টিদুলে হত্যার পরে, অর্কুট জমানাতে কিছু ফ্রেইন্ড লিস্টে থাকা কিছু সিপিএমকে আনফ্রেইন্ড করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
যারা মানুষের জীবনের থেকে, নিজের ধর্ম, জাতি, রাজনীতিকে বেশী গুরুত্বপূর্ন মনে করে- এতটাই বেশী গুরুত্ব দেয় যে তার জন্য খুনকেও সমর্থন করে গর্বিত পশু হতে চাইছে-তাদের এই অধপতনকে যদি নাগরিক সমাজ নীরবে প্রশয় দিতেই থাকে, একদিন না একদিন সেই ঘৃণার বিষবাস্পে সমাজে বসবাস করাই অসম্ভব হবে।
কোন ধর্ম, কোন রাজনৈতিক আদর্শই মানুষের জীবনের থেকে বড় হতে পারে না। ধর্ম, রাজনীতি সবকিছুই মানুষের জন্য-সুতরাং মানুষ মেরে যদি কেউ ভাবে তার ধর্ম, তার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পাবে-সে মূর্খ। লেনিন, স্টালিন কোটি কোটি লোক খুন করে তাদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন?? বরং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ানে আইন এনে স্টালিনকে হিটলারের সম পর্যায়ের খুনী বলে স্বীকার করা হয়েছে হলডোমার জেনোসাইডের হোতা হিসাবে।
ঠিক তেমনি ভাবে বাংলাদেশে ১০০% ইসলামের প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রতিদিনই দেখি কিছু হিন্দুকে হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি পোড়ানো হচ্ছে।
ভয় দেখিয়ে ভারতে পাঠানো হচ্ছে। এতে কি বাংলাদেশে ১০০% ইসলাম আসবে? সেসব কিছুই হবে না। পাকিস্তানের মতন জঙ্গীরাষ্ট্রে পরিণত হবে। তবে শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ যে উনি অন্তত বেশ কিছু জঙ্গী সাফ করে কিছুটা হলেও উঠোন পরিস্কার করেছেন।
ভারতেও এখন যারা হিন্দুত্ববাদের সেন্ট্রাল থিমকে চ্যালেঞ্জ করছে, তাদের নানান ভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে। এক্সট্রিম কেসে মেরে ফেলাও হচ্ছে। মহত্মা গান্ধীর খুনী নথুরাম গডসে মূর্তি বসিয়ে পূজা হচ্ছে!! এই ভাবে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হবে? শ্রীচৈতন্যের আমলে অনেক ধর্মান্তরিত মুসলমান, আবার বৈষ্ণব ধর্মের প্রেমের আঁচলে ফিরে আসে। তাকে তার জন্যে খুন খারাপি গোরক্ষা কমিটি বানাতে হয়েছিল?
জাতি, ধর্মের কারনে হত্যা নতুন কিছু না। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম দিন থেকেই এগুলো ছিল। বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতেও আমাদের সেই মৃত্যুভয়ে কাটাতে হবে ?
অথচ প্রাচীন ভারতেই ছিল মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা। গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর-এরাও হিন্দু ধর্মকে, বেদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন- কেউ কি তাদের হত্যা করেছে সে দিন ?
তাহলে কিকরে এটা সম্ভব, গৌতম বুদ্ধ যে মুক্তমনের স্বাধীনতার পরিবেশ আড়াই হাজার বছর আগে পেয়েছিলেন, একবিংশ শতাব্দির ভারত, তা গৌরী লঙ্কেশ, এম এম কুলবর্গী, গোভিন্দ পানসেরকে দিতে অক্ষম?
Leave A Comment