একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের নেপথ্যে:

‘লিলিপুটরা বড় হবে’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলাম ২০০৮ সালে। বিষয় ছিল শ্রেণী বৈষম্য। ছবিটির গল্পে একটি ছেলেকে খুন করা হয়। ছেলেটির বাবা যিনি একজন শিক্ষক; ছেলে হত্যার বিচারের জন্য থানা, প্রেস ক্লাব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সভা-সমাবেশসহ তাঁর পক্ষে সর্বোচ্চ গণসংযোগ করছিলেন। সবাই তাকে আশ্বাস দেয় কিন্তু বিচার আর হয় না। শিক্ষক বাবার বোধোদয় হয় এভাবে ছেলে হত্যার বিচার তিনি পাবেন না! এক সময় অসহায় শিক্ষক তার ছাত্রদের বলেন, ‘কিছুই তো হল না! সবাই কেমন যেনও এড়িয়ে যেতে চায়! তোমরা কিছু করবে তো?’

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলায় বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করার পর অদ্ভুতভাবে আমার চলচ্চিত্রের শিক্ষকের চরিত্রটিকে আমি বাস্তবে দেখতে পেলাম অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের মধ্যে। সভা-সমাবেশ, সাংবাদিক সম্মেলন, পুলিশসহ সবদিক থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করে অবশেষে তিনি একদিন বললেন, ‘ছেলে হত্যার বিচার পাবো বলে আর বিশ্বাস করি না। পুলিশ আমাদের কোনো কিছু জানায় না, খোঁজও নেয় না। পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম, কোনো তদন্ত নেই। শুধু বলে তদন্ত চলছে।’

একদিন স্যার আমাদের যা বললেন তার সারমর্ম- ‘কিছুই তো হল না! সবাই কেমন যেনও এড়িয়ে যেতে চায়! তোমরা কিছু করবে তো?’

অভিজিৎ রায় খুন হবার পর থেকে আমাদের অনেকের মধ্যেই ‘কী করা যায়’- ধরণের নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। নির্মাতা হিসেবে আমার আন্দোলন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তাই, ‘লিলিপুটরা বড় হবে’ প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিলাম। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের দু’ সপ্তাহের মধ্যে ১২ মার্চ ২০১৫ বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা থেকে পাবলিক লাইব্রেরির হল রুমে প্রদর্শনী শুরু হয়। প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল) সবাইকে মাতিয়ে রাখে ছবি তোলা নিয়ে। আমার মুক্তমনা বন্ধুরা যারা নানাবিধ কারণে সহজে একসাথে হতে পারে না; সিদ্ধান্ত নিল গ্রুপ ছবি তোলার। সবাই বসলাম পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে; শুধু ওয়াশিকুর বাবু বসলো না। বাবু বলল, নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে সে ছবি ছাড়া ফেসবুক আইডি চালায় তাই এখানে তোলা ছবি কোনওভাবে প্রকাশ পেলে তাঁর ঝুঁকি বাড়বে। কেউ কেউ বাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, আমরা এখানে যারা আছি তারা সবাই নিরাপত্তা ঝুঁকিতে; ছবি না তুললেই কী নিরাপদ থাকা যাবে! তারপরেও বাবু ছবি তোলেনি।

অভিজিৎ রায় খুন হবার পর বাবু তাঁর ফেসবুকের প্রোফাইল ছবি দিয়েছিল, ‘আমিই অভিজিৎ’ এবং কভার ছবিতে লিখেছিল, ‘শব্দের মৃত্যু নেই’। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত প্রায় সবকটি সভা-সমাবেশে বাবু অংশ নেয়ার চেষ্টা করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখিতেও সে ছিল সরব।

আমার ‘কী করা যায়’ ভাবনাটা তখন ‘কিছু একটা করতে হবে’-তে রুপান্তরিত হয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ভাবনাগুলো চলচ্চিত্রের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। ফিকশন করবো নাকি ডকুমেন্টারি? নাকি ডকু-ফিকশন? অবশেষে ‘ডকু-ফিকশন’ করারই সিদ্ধান্ত নিলাম।

ওয়াশিকুর বাবু আমার সাথে যোগাযোগ করে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। বাবুকে বললাম, বাইরে থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণটাকে খুব ইন্টারেস্টিং কাজ মনে হলেও এটা আসলে খুব কঠিন কাজ। তোমাকে শ্রমিকদের মত পরিশ্রম করতে হবে, তুমি পারবে? আমার এ কথায় বাবু কিছুটা হতাশ হয়ে বলে,’পরিশ্রম করার মত শারীরিক ফিটনেস আমার নাই তবে যে কোনওভাবে কাজটাতে যুক্ত থাকতে চাই।’ কিন্তু বাবু যে ‘যে কোনওভাবে’ কাজটাতে যুক্ত হয়ে পড়বে তা কখনও কল্পনাও করিনি!

৩০ মার্চ ২০১৫

‘লিলিপুটরা বড় হবে’ প্রদর্শনীর প্রায় দু’ সপ্তাহ পরেই ওয়াশিকুর বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার নির্মাণাধীন চলচ্চিত্রের একটি অংশ হয়ে যায় ওয়াশিকুর বাবু। ‘শুধু অভিজিৎ রায় নয় তাঁর আদর্শ ধারণকারীরাও কিলিং মিশনের লক্ষ্যবস্তু’- এটাই হয়ে যায় তখন আমার ডকু-ফিকশনের থিম। অভিজিৎ রায়ের আদর্শ ধারণকারী অনন্ত বিজয় দাশ আমাদের টিমে যুক্ত হয়। আমাদের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়।

২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল আমার মুক্তমনা বন্ধুদের একত্রিত করে ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ শিরোনামে ফেসবুকে একটা গ্রুপ করে ডকু-ফিকশনের বিষয়ে মুক্ত আলোচনার আহবান জানাই। ১ বৈশাখ (১৪ এপ্রিল ২০১৭) বাংলা নববর্ষের ভোর থেকে শুরু হয় শ্যুটিং।

এপ্রিল ১৯, ২০১৫ প্রথম সাক্ষাৎকার শ্যুট করলাম অজয় স্যারের। স্যার সাক্ষাৎকারে অভিজিৎ হত্যা নিয়ে কথা বলতে বলতে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন! আমরা ইউনিটের সবাই মন খারাপ করে ফিরলাম।

১২ ই মে ২০১৫

অভিজিৎ রায়কে নিয়ে নির্মিতব্য ডকুমেন্টারি ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’-র গ্রুপে যুক্ত ‘যুক্তি’ সম্পাদক, বিজ্ঞান লেখক, মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে অফিসে যাওয়ার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ডকুমেন্টারির জন্য অভিজিৎ রায় বিষয়ে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যাপারে তাঁর সাথে কথাও হয়েছিলো। কিন্তু এই ডকুমেন্টারিতে তিনি যুক্ত হয়ে গেছেন অন্যভাবে।

নিজের মৃত্যুর একদিন আগেই লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকাণ্ড, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারী লাঞ্ছনা ও ছাত্র ইউনিয়নসহ কয়েকটি সংগঠনের কর্মসূচিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে লিখেছিলেন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। তিনি লিখেছিলেন, “অভিজিৎ রায়কে যখন খুন করা হয়, অদূরেই পুলিশ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছিল। খুনিরা নিশ্চিন্তে খুন করে চলে গেল। পরে পুলিশ বলে তাদের নাকি দায়িত্বে অবহেলা ছিল না। বড় জানতে ইচ্ছে করে তাদের দায়িত্বটা আসলে কি! ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে যখন খুন করে খুনিরা পালিয়ে যাচ্ছিল তখনও কিন্তু পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু পুলিশের কপাল খারাপ, তারা বলতে পারলো না— এক্ষেত্রেও তাদের কোনো দায়িত্বে অবহেলা ছিল না। কারণ, লাবণ্য নামের তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানবিক মানুষ খুনিদের ধরে ফেলেন। খুনিদের শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেন”। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে ৫ মে তিনি লিখেছিলেন, “মনে হচ্ছে আল-কায়েদার সাথে আইএসের মাঠ দখলের লড়াই খুব শীঘ্রই। কেন জানি মনে হচ্ছে, এটা বাংলাদেশ ইস্যুতেই ঘটবে।…”

অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর, অনন্ত বিজয় হত্যার প্রতিবাদে আমাদের ডকুমেন্টারি নির্মাণের যে আন্দোলন, তাতে নিলয় ছিল আমাদের সহযোদ্ধা। নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের সঙ্গে নিলয়ের ভাল বন্ধুত্ব ছিল। ওর মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার প্রতিবাদে রোজার ১৫/২০ দিন আগে শাহবাগে একটি সমাবেশে অংশ নিয়ে ফেরার পথে নিলয়কে গুলিস্তান পর্যন্ত অনুসরণ করা হয়। এ বিষয়টি জানিয়ে ১৫ মে ২০১৫ ফেসবুকে এক পোস্টে নিলয় লিখেছিলো, সে খিঁলগাও থানায় জিডি করতে গেলেও পুলিশ তা নেয়নি। ওই পোস্টে নিলয় লেখে, ‘গতকাল ঘটনাস্থলের আওতায় থাকা একটি থানায় গেলে তারা জিডি নিল না, তারা বললো আমাদের থানার অধীনে না, এটা অমুক থানার অধীনে পড়েছে ওখানে যেয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান।’

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ২৭ বছর বয়সী ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ব্লগে লিখতো নিলয় নীল নামে। কিছুদিন ধরে হুমকি পাওয়ার কারণে ফেসবুক থেকে নিজের সব ছবি সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি ঠিকানার জায়গায় বাংলাদেশের বদলে লিখেছিলো ভারতের কলকাতার নাম।

৭ আগস্ট ২০১৫

বাড়িতে প্রবেশ করে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে। বিবিসিসহ বিদেশি এবং দেশি গণমাধ্যমগুলোতে সেদিন নিলের যে ছবিগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল তার প্রায় সবগুলোই ছিল ‘লিলিপুটরা বড় হবে’ প্রদর্শনীতে সংগীতা ঘোষের ক্যামেরায় তোলা ছবি।

‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ ডকুমেন্টারি টিমের আরও একজন সদস্যকে আমরা হারালাম। যার নাম থাকার কথা ছিল ছবির ক্রেডিট লাইনে সে ছবির বিষয়বস্তু হয়ে জায়গা করে নিল ছবির মাঝে- অভিজিৎ, বাবু, অনন্তর পরেই!

‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ গ্রুপে আমার একটি পোস্টের কমেন্টে রনদিপম বসু লিখলেন, ‘অভিজিৎ রায়ের প্রকাশক শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুলের সাক্ষাৎকার নেবেন কিনা ভেবে দেখতে পারেন। তিনি কিন্তু সেদিন হাসপাতালে সক্রিয়ভাবে ছিলেন। একজন মাত্র ব্যক্তি যাঁর সাথে বন্যা আপা মুমূর্ষু অবস্থাতেই জড়িয়ে ধরে কিছু কথা বলেছিলেন বলে শুনেছি। তাঁর সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন তিনি আগ্রহী কিনা।’ আমরা জানালাম, অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল এবং ফয়সাল আরেফিন দীপন আমাদের সাক্ষাৎকারের তালিকায় আছেন।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির ২৬ থেকে আগস্টের ৭ পর্যন্ত প্রায় ৫ মাসের ব্যবধানে ৪টি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডে আমাদের নির্মাণ কার্যক্রম কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। টিমের সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক- এরপরে কে? অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশকগণের সাথে তাই সাক্ষাৎকারের জন্য যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। দু’ মাস পরেই ঘটলো একই দিনে প্রায় একই সময়ে দু’ জায়গায় আক্রমণের ঘটনা!

৩১ অক্টোবর

বিকেলে জাগৃতি প্রকাশনার সত্ত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনকে তাঁর কার্যালয়েই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিনে শুদ্ধস্বরের সত্ত্বাধিকারী আহমেদুর রশিদ টুটুলকেও তাঁর কার্যালয়ে হামলা করা হলে গুরুতর আহত অবস্থায় টুটুল ও তাঁর দুই বন্ধু লেখক রণদীপম বসু, কবি তারেক রহিমকে উদ্ধার করা হয়।

যখন দেখলাম, অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করার ‘অপরাধেও’ খুন করা হচ্ছে তখন আমার টিমের সাহসী যোদ্ধারাও নিরব হয়ে গেল। শ্যুটিং বন্ধ হয়ে গেল। তাই বলে কাজ বন্ধ হল না। আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে স্টক ফুটেজ সংগ্রহ শুরু করলাম। ওই পর্যন্ত দেশে ঘটে যাওয়া জঙ্গিবাদী ঘটনাগুলোর ভিডিও ফুটেজ আমরা সংগ্রহ শুরু করলাম। ১লা বৈশাখে বোমা হামলা, কবি শামসুর রাহমানের বাসায় হামলা, তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সিনেমা হল, গ্রামীণ মেলা, যাত্রা, সার্কাস, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ৬৩ জেলায় বোমা হামলা, হেফাজতের তাণ্ডব, হুমায়ূন আজাদ, রাজীব, অভিজিৎ, বাবু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ভিডিও ফুটেজ আমাদের সংগ্রহে চলে এলো। চলতে থাকল শ্যুটিংবিহীন ‘ফিল্ম উইদাউট ফিল্ম’ যুদ্ধ।

২৬ জানুয়ারি ২০১৬

‘লিলিপুটরা বড় হবে’-র সেই শিক্ষকের সংলাপ; অজয় স্যার আমাদের বললেন, ‘কেউ তো কিছুই করছে না; তোমাদের ডকুমেন্টারিটা অন্তত শেষ করো’।

স্যারের কথা আমাদের আলোড়িত করলো। আমরা যেনও ‘রি-চার্জড’ হয়ে গেলাম। নতুন উদ্যমে শুরু হল কাজ। আমরা লক্ষ্য স্থির করে ফেললাম- ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, অভিজিৎ রায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতেই এই ছবির ‘প্রিমিয়ার শো’ করব; করতেই হবে।

৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ একই দিনে শাহরিয়ার কবির এবং ফটোগ্রাফার জীবন আহমেদের সাক্ষাৎকার শ্যুট করলাম।
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ বইমেলায় শ্যুট করতে যাওয়ার পথে ঢাকার কলেজ গেটে আমার ক্যানন মার্ক টু ক্যমেরা, ৫টা লেন্স, শটগান মাইক্রোফোন, জুম রেকর্ডার এবং অন্যান্য এক্সেসরিজসহ ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেল। মোহাম্মদপুর থানার জিডি-তে আশানুরূপ ফলাফল না পেয়ে ডিএমপি-র পুলিশ কমিশনার বরাবর একটা চিঠি দেই। চিঠির অনুলিপি পাঠাই ডিবি-র মিডিয়া উয়িংস এবং মোহাম্মদপুর থানায়। জবি-র ফিল্ম এন্ড মিডিয়া ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান জুনায়েদ হালিম তাঁর বন্ধু মোহাম্মদপুর জোনের ডিসিকে জানিয়েছেন। আমার বড় ভাই আহমেদ ফিরোজ তাঁর বন্ধু প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি-কে জানিয়েছেন… ব্লা ব্লা ব্লা… এরপরেও আমার ক্যামেরা সেটআপ উদ্ধার হল না!

আর্থিক এবং মানসিকভাবে তৈরি হওয়া এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এলেন টিমের সদস্যরা। নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে ভাড়া করা ক্যামেরায় শুরু হল শ্যুটিং। এই কঠিন সময়ে রঞ্জন বর্মণ, দেওয়ানজী বাসব এবং সৈয়দ জামালের সহযোগিতা না পেলে কাজটা যথাসময়ে শেষ করা দুস্কর হয়ে পড়তো। আমাদের ইউনিটের সবার মনের মধ্যে তখন অজয় স্যারের সেই কথার প্রতিধ্বনি হতে থাকল… ‘কেউ তো কিছুই করছে না; তোমাদের ডকুমেন্টারিটা অন্তত শেষ করো’।

দেশের বাইরে থেকে অনেক ব্যস্ততার মাঝেও শ্যুটিংয়ে অংশ নিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন ওমর ফারুক লুক্স, ফারজানা কবির খান। বন্যাদির অংশটি শ্যুট করে দিয়ে আমাদের ঋণে আবদ্ধ করেছেন নাস্তিকের ধর্মকথা। আর যার কথা বিশেষভাবে বলা দরকার তিনি আরিফুর রহমান। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ছিলেন। ওই সময়ে তাঁর সাথে আমার দুইবার মিটিং হয়েছিল। ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পরেও তিনি সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে নির্মাণের ব্যাপারে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। ছবিটির ইংলিশ ভার্সনের বব চার্চিলের কণ্ঠের ধারাবিবরণীটি ধারণ করেছেন তিনি। বিবিসি ইউকে, ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ওপরে করা একটা নিউজ রিলের জন্য আমাদের কাছ থেকে কিছু ফুটেজ কিনতে চেয়েছিল; এর মধ্যস্থতা করেছিলেন আরিফুর ভাই। বিবিসি ইউকে-র কাছে ফুটেজ বিক্রি করতে পারলে ওই অর্থে ফিকশন পার্ট শ্যুট করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কিন্তু বাস্তবতার কারণেই ডকু-ফিকশন বাদ দিয়ে শুধুই ডকুমেন্টারি করতে হয়েছে।
অবশেষে আমরা যথাসময়ে ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’-র উদ্বোধনী প্রদর্শনীর আয়োজন করলাম।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি খুন করা হয়েছিলো অভিজিৎ রায়কে। একই বছর অভিজিৎ রায়ের বই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ প্রকাশের অপরাধে খুন করা হয় ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। সেই দীপন কর্নারকেই আমরা বেছে নিলাম ভেন্যু হিসেবে। জটিলতা সৃষ্টি করলো প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সংবাদের ভুল তথ্য। সংবাদে লেখা হয়েছিল এই প্রদর্শনীর আয়োজক জাগৃতি প্রকাশন। এই সংবাদ দেখে জাগৃতি প্রকাশন-এর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ও লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক আজিজ সুপার মার্কেটের সমিতিকে শো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে বলেন। সমিতি ছবির শো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে যোগাযোগ করে শাহবাগ থানার সাথে। শাহ্‌বাগ থানার ওসি শো বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। আমাদের সবার দৃঢ়তার কারণে অবশেষে আমরা ২৬ ফেব্রুয়ারিতেই ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’-র প্রিমিয়ার শো করতে সক্ষম হই। পুত্রের হত্যাকাণ্ড নিয়ে চলচ্চিত্র উদ্বোধন করেন বাবা। কী যে হৃদয় বিদারক ছিল সেই দৃশ্য!

একই দিনে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে চলচ্চিত্রটির একটি মুক্ত প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দাউদ হায়দার এবং তসলিমা নাসরিনের সাক্ষাৎকার থাকায় তারা প্রদর্শনীটি স্থগিত করে।

এর পরের শো-টা আমরা করি ওয়াশিকুর বাবুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখে ২৫ মার্চ ২০১৬, সন্ধ্যা ৭.৩০টায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সেমিনার কক্ষে। এই শো-এর সপ্তাহ দুয়েক পর থেকেই আমরা আবার দেখতে শুরু করলাম আগের ঘটনাগুলোর মত একই কায়দায় হত্যাকাণ্ড।

৬ এপ্রিল ২০১৬

বুধবার রাত ৯টার দিকে সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর পর মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ(২৬) কে, যিনি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনলাইনে লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন।

সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল, মঙ্গলবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেন সামাদ। সেখানে তিনি লেখেন, ‘সরকার, এবার একটু নড়েচড়ে বসো বাবা। দেশের যা অবস্থা, আইনশৃঙ্খলার যা অবনতি, তাতে গদিতে বেশিদিন থাকা সম্ভব হবে না। জনরোষ বলে একটা কথা আছে। এটার চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে না চাইলে এক্ষুনি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। নতুবা দিন ফুরিয়ে আসবে খুব দ্রুত।’

২ এপ্রিল নাজিমুদ্দিন সামাদ লেখেন, ‘আওয়ামী ওলামা লীগ আর বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দুই বিপরীত মেরুর দুই বাসিন্দা। ওলামা লীগ কখনোই বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান চায়নি এবং চাইবে না।’

২৪ এপ্রিল ২০১৬

নিজের বাসার কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী(৫৮) কে হত্যা করা হয়। সারাদেশে ব্লগার হত্যার আঘাতের ধরণের সাথে রেজাউল করিম হত্যার মিল রয়েছে বলে জানিয়েছে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার।

২৬ এপ্রিল ২০১৬

রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে দুজনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ২ জন। নিহতরা হলেন- জুলহাস মান্নান এবং তার বন্ধু তনয় মজুমদার। জুলহাস মান্নান লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে ‘রূপবান’ নামে সাময়িকীর সম্পাদনার পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডিতে কাজ করতেন।

একমাসে ৪ খুন। এই পরিস্থিতিতে দেশে শো করা আমরা স্থগিত করে দেই।

২৪ মে ২০১৬ কোলকাতা থেকে মুক্তমনা বন্ধু অরিন্দম মুন্সি আমাদের সাথে যোগাযোগ করে জানালেন, কলকাতায় আমাদের সমমনা বন্ধুরা ছবিটি দেখতে চায়। আমরা রাজি হলাম। ‘বাংলাদেশ: আক্রান্ত মানবতা, আক্রান্ত মুক্তচিন্তা’ শিরোনামে আমরা একটি সচেতন প্রয়াসের ব্যানারে ৯ জুলাই ২০১৬ বিকেল ৫টায় ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট লাইব্রেরি হলে শো-এর আয়োজন করা হল। আমাদের কোর টিমকে আমন্ত্রণ জানানো হল। আমরা যখন আমাদের টিম সদস্যদের ভিসা সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত তখনই এক রাতে ঘটলো বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটি।

২০১৫ সালের শুরু থেকে দেড় বছর ধরে লেখক, শিক্ষক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ভিন্নমতের অনুসারী ও বিদেশিদের ওপর একের পর এক উগ্রপন্থি হামলা যখন বাংলাদেশের মানুষকে শঙ্কিত করে তুলেছিল, তখনই ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে সুরক্ষিত বলে পরিচিত গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় পাঁচ তরুণের জঙ্গি হামলা জাতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দেয়।

হামলার রাতেই জঙ্গিদের সঙ্গে গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন। ১ জুলাই রাতেই জঙ্গিরা ২০ জনকে হত্যা করে যাদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন বিদেশি নাগরিক। এদের মধ্যে ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানি ও ১ জন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। এছাড়া দু’জন বাংলাদেশী, ১ জন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান।

পরের দিন সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে ছয় জন নিহত হয়। আইএস এর পক্ষ থেকে এদের মধ্যে পাঁচজনকে তাদের ‘সৈনিক’ বলে দাবি করে, হামলার দায় নেয় তারা।

এর সাত দিনের মাথায় ৭ জুলাই ২০১৬ রোজার ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের কাছাকাছি একটি পুলিশ চেকপোস্টে আবারও জঙ্গি হামলা হয়। বোমায় নিহত হন দুই পুলিশ সদস্য, বাড়িতে গুলি ঢুকে প্রাণ হারান এক গৃহবধূ। পুলিশের গুলিতে এক জঙ্গিও সেদিন নিহত হয়, গ্রেপ্তার হয় কয়েকজন।

এর পরদিন ৮ জুলাই ২০১৬ ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’-র কোর টিম সদস্যরা কোলকাতায় পৌঁছে যাই। ৯ জুলাই ২০১৬ অনুষ্ঠানের ভেন্যুতে গিয়ে উপচে পড়া দর্শক দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। ওপার বাংলায় আমাদের এত সমমনা বন্ধু দেখে আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত দর্শকদের অনেকেই তাদের নিজ নিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে ছবিটির শো করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমরা যেহেতু কাজটা কমার্শিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করিনি তাই তখনই শো করার অনুমতিসহ প্রদর্শন উপযোগী সফট কপি দিয়ে আসি। এর একদিন পর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র সাংবাদিক ঋজু বসু আমাদের কোর টিমের সাক্ষাৎকার নেন। ১৩ জুলাই ২০১৬ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র সম্পাদকীয় পাতায় ‘ক্যামেরা হাতে কলকাতায় ও-পার বাংলার গেরিলারা’ শিরোনামে এই নিউজটা প্রকাশ পেলে ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ দেখার ব্যাপারে দর্শকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ( http://www.anandabazar.com/bangladesh-news/a-new-bangladeshi-short-documentary-razors-edge-express-lights-on-unstable-bangladesh-bng-dgtl-1.433672 ) বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ছবিটি প্রদর্শন করার আগ্রহ জানিয়ে আমাদের সাথে বিভিন্ন জন নানাভাবে যোগাযোগ করতে থাকে।


দেশে ফিরে আসার পর ‘ইন্ডিয়া টুডে’-র সাংবাদিক রোমিতা দত্ত টেলিফোনে আমাদের সাক্ষাৎকার নেন। লেখাটি প্রকাশ পায় ১৬ আগস্ট ২০১৬-র ‘ইন্ডিয়া টুডে’-তে ‘ডেড ব্লগারস সোসাইটি’ শিরোনামে। ( http://indiatoday.intoday.in/story/dead-bloggers-society/1/737370.html ) শিরোনাম দেখেই আমরা নস্টালজিক হয়ে পড়ি। ফিরে যাই ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ থেকে ধারাবাহিকভাবে আমাদের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই দুর্যোগের দিনগুলোতে।

ব্লগারদের প্রতি সরকারের নিষ্ক্রিয় মনোভাবের কারণে তারা যে এক ধরণের মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সেটি সরকার অনুধাবন করতে পারেনি। যদি পারতো তাহলে দেড় বছরের ব্যবধানে এতগুলো হত্যাকাণ্ড হতো না। এখানে যে সংগঠনগুলো সংগঠিত হচ্ছিল তাদের উপর সরকার খবরদারি করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু গুলশান হামলার পর খুব বড় করে আমরা সচেতনতা দেখলাম। হলি আর্টিজানে যে হামলা হয় এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টুইন টাওয়ার হামলার মতো। যেভাবে টুইন টাওয়ার হামলা আমেরিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, হলি আর্টিজান হামলাও আমাদের দেশের জন্য একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। একসঙ্গে এতজন বিদেশি এর আগে বাংলাদেশের কোথাও মারা যায়নি। তারপর দেখলাম অনেক জঙ্গি ধরা পড়ল, মারা গেল, পুলিশ তাদের আস্তানাগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হল।

কিন্তু অবাক বিস্ময়ে আমরা এও দেখতে পাচ্ছি হুমায়ূন আজাদ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, সোশ্যাল এক্টিভিস্ট হত্যাকাণ্ডের একটিরও সুষ্ঠু বিচার হয়নি।
এই বিচারহীনতা আমাদের কী বার্তা দেয়?

(রাকিবুল হাসান, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৭)