গত ১৫ই আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানীর এক বৃষ্টি ভেজা দিন। প্রকৃতিও কি কাঁদে? হয়তো কাঁদে। তাই বাঙ্গালীর ব্যথিত হৃদয়ের সাথে সাথে প্রকৃতিও সেদিন একাত্ম হয়েছিলো আমাদের সাথে। বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণ সভার আয়োজন করেছে স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাস । অবশ্য প্রায় জন্ম নিতে চলেছে এখানকার বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোক্তা বৃন্দও একটি পৃথক আলোচনা ও স্মরণ সভার আয়োজন করেছেন। অনেকটা প্রাণের দায় এবং দূতাবাসের উদ্যমী কর্মকর্তা বৃন্দের আহবানে আমিও উপস্থিত হই । সদা তৎপর মাননীয় রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান মহোদয় আমাদের পাশেই। তাঁর উদ্যোগী কর্ম কাণ্ড সে আর এক উপাখ্যান! দূতাবাসে তিনি এদিন আপাত: ছোট্ট পরিসরে ‘বঙ্গবন্ধু স্মারক গ্রন্থাগারে’র দ্বার উন্মোচন করেছেন। আমরা যারা নানা কাজে সেখানে যাই, কর্মব্যস্ত দূতাবাসে অতিবাহিত কিছুসময়ের সজ্ঞান ব্যবহার আমাদের নিজেদের শেকড় সন্ধানে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। শুনে এলাম তাঁর উদ্যোগেই আমার নিকটস্থ শহর আনসানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার অমর শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে! ক্ষণিকের জন্যে মনে হল একা তো নই, আমাদের চার পাশে অগণিত প্রাণ আলো জ্বেলে আছে! অপেক্ষার রাত কি তবে শেষ হবে…? সেই সন্ধ্যায় দুটি স্মরণানুষ্ঠানে, বিশেষ করে দূতাবাসের আয়োজনে যে কথাগুলো নির্ধারিত সময়ে বলেছিলাম ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’কে কেন্দ্রকরে, তার সার সংক্ষেপই এখানে প্রবন্ধাকারে পুণঃস্থাপিত হল।

একজন মানুষ, সতন্ত্র জাতি প্রতিষ্ঠার নেতা কিংবা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কেমন ছিলেন আমাদের জাতির জনক? আলোচনার শুরুতেই আসলে যেটা প্রাসঙ্গিক, তা হল এই দুটো বিষয় সম্পর্কে সম্যক আলোকপাত করা – বঙ্গবন্ধুর ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠা; রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সফলতা এবং ব্যর্থতা। একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে অতো বড় মাপের একজন মানুষকে বিবেচনা করা সত্যিই অসাধ্য এবং সে জন্যে বিনয়ের সাথে আমি আমার সীমাবদ্ধতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থী। যতটুকু সম্ভব আমি আমার অনুভব এখানে তুলে ধরবো এবং যথাসম্ভব স্বল্পপরিসরে একটি উপক্রমণিকায় পৌঁছুতে চেষ্টা করবো।

বঙ্গবন্ধুর ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠা: যেহেতু একটা নির্ধারিত বইকে কেন্দ্র করে এ আলোচনার প্রসঙ্গ, সেহেতু বইটি সম্পর্কে একটা ছোট্ট ভূমিকা এখানে প্রাসঙ্গিক। আজকে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ই মে হলদেটে মৃতবৎ বাংলাদেশে ফিরে আসেন এক বৈরী পরিবেশে এক পশলা আশীর্বাদের মতোই। এর পরে ঐ একই বছরের ১২ই জুন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটা তৎকালীন সাত্তার সরকার বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার কাছে অফিসিয়ালি হস্তান্তর করেন। ইতোমধ্যে অতি স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের অনেক ইতিহাস ঐ ৩২ নম্বর থেকে হারিয়ে গেছে কিংবা ধ্বংস করা হয়েছে সেটা অনুমেয়। তার পরেও যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেখান থেকেই এ জাতির নবদ্যোম যাত্রা শুরু। আশায় বুক বেঁধে জাতির অপেক্ষা, তদুপরি আমার মনে আছে সেই সময়ের বিরূপ রাজনৈতিক ও সামগ্রিক ভয়ার্ত অন্তঃ-রাষ্ট্রীয় পরিবেশের কথা এবং এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অবয়বে বাংলাদেশের পথচলার কথা। ইতিহাস বিকৃতির পত্তন এবং সর্বোপরি জাতিকে পুরানো পরিত্যক্ত পথে ঠেলে নিয়ে যাবার সর্বনাশা প্রয়াস। রাস টেনে ধরার পরেও সেই যাত্রা পুরোপুরি স্তব্ধ করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ থেকেই স্পষ্ট হয় যে, কি ভয়ানক এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে পতনোন্মুখ ছিল বাংলাদেশ। শ্লথ হয়ে এলেও যার মোমেন্টাম এখনো বিদ্যমান।

বইটির ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু তনয়া আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “তিনি (বঙ্গবন্ধু) পর্যবেক্ষণ করেছেন সবই, সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই সংগ্রাম, অধ্যবসায় ও আত্মত্যাগের মহিমা থেকে যে সত্য জানা যাবে তা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। ইতিহাস বিকৃতির কবলে পড়ে যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন তাদের সত্য ইতিহাস জানার সুযোগ করে দেবে। গবেষক ও ইতিহাসবিদদের কাছে এ গ্রন্থ মূল্যবান তথ্য ও সত্য তুলে ধরবে।“

উপরোক্ত ভাষ্যে দ্বিমতের কোন জায়গা নেই এবং শুধু তাই নয় বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে নির্বীর্য ও মেধার আকাল দেখা দিয়েছে তার প্রেক্ষাপট সনাক্তেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ভূমিকা রাখবে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ অর্জনে আজকের প্রকৌশলগত বৈশ্বিক অর্থনীতির নিরিখে নিরপেক্ষ অথচ সর্বত্র অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে গঠনমূলক রূপরেখা প্রণয়নে।
বইটি আমি আগেও দু-একবার পড়েছিলাম এবং সেদিনের আলোচনাকে কেন্দ্র করে সামান্য কিছু অংশে মনোনিবেশের প্রয়াস ছিল। তার প্রেক্ষিতেই আমার কথাগুলো বলার চেষ্টা আমি করবো। আমার মনে আছে প্রথমবার যখন বইটি পড়ি তখন চোখের কোন ভিজে থাকতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুভব এখানে যথার্থ একজন পারিবারিক সদস্য হিসেবে, অথচ তা যখন পরিবারের গণ্ডি ছাপিয়ে সমাজের প্রান্তিক মনে রেখাপাত করে তখন যথার্থ ভাবেই অনুভব করা উচিৎ যে কত বড় সর্বনাশ সেদিন হয়েছিলো। ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার অব্যবহিত পরে যখন বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লিখা সেই খাতা চারটি এলো বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে, তখনকার মানসিক অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন এভাবে, “ খাতাগুলো হাতে পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এই হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোটবোন শেখ রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি; তারপরই এই প্রাপ্তি। মনে হল যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি। আমার যে এখনো দেশের মানুষের জন্য- সেই মানুষ, যারা আমার পিতার ভাষায় বাংলার ‘দুঃখী মানুষ’,- সেই দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ বাকী, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাকী, সেই বার্তাই যেন আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন। যখন খাতাগুলোর পাতা উলটচ্ছিলাম আর হাতের লেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আব্বা আমাকে যেন বলছেন, ‘ভয় নেই মা, আমি আছি, তুই এগিয়ে যা, সাহস রাখ।‘ আমার মনে হচ্ছিলো, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক অভয় বাণী এসে পৌঁছাল আমার কাছে। এতো দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝে যেন আলোর দিশা পেলাম।“

দ্বিতীয়বার যখন পড়েছি তখন বিস্মিত হয়েছি আমাদের আজকের অধঃপতন মনে করে। এই অধঃপতন মনো-জাগতিক চেতনার কেন্দ্রে। আর মানসিক হলেও তা প্রকারান্তরে প্রভাব বিস্তার করে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আধুনিক মনষ্কতায়। যার ফলাফল আমরা আজ চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছি আমাদের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি স্তরেই। এ সবই যে একটি চক্রান্তের ফল তা যে কোন মানুষই একবার নিরাসক্ত মনে ভাবলেই বুঝতে পারবেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠার পেছনে যে সব গুণাবলী নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে সেসবের প্রধান কয়েকটিকে আমি ক্রমান্বয়ে বলার চেষ্টা করবো। সেসব গুণাবলীকে আমি তাঁর প্রস্ফুটিত জীবনের সাথে সাথে তিনটি স্তরে ভাগ করে নেবো।

ক. প্রাক যৌবনকাল: পারিবারিক শিক্ষা, দৃঢ় প্রত্যয়, ভালবাসা, ঔদার্য, পরোপকার, সমাজ হিতৈষী, বিনয়, নিঃসংকোচ চিত্ত, কর্মদক্ষতা ও উদারতা।
খ. যৌবন কাল: সাংগঠনিক দক্ষতা, অধিনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস, তেজোদ্দীপ্ততা, আপোষহীনতা, জাতীয়তা-বোধ, দুঃসাহসিকতা, সংস্কৃতি সচেতনতা, মঙ্গল-চিন্তা, নেতৃত্ব এবং করনীয় নির্ধারণে দক্ষতা।
গ. পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক মানস কাল: মানবতা-বোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থা, অধিকার সচেতনতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, পরিবর্তিত সুষ্ঠ রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি আস্থা কিংবা সদ্যজাত আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, জাতীয়তা এবং সংস্কৃতিকে ধারণ, সংকটকালে সদৃঢ় স্থিরতা, আকর্ষণীয় রাজনৈতিক চরিত্র, সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতা, যুক্তিবাদ ও ঘটনার সঠিক মূল্যায়নে সক্ষমতা, প্রত্যাশিত ফলাফলের তাৎক্ষনিক যথাযথ বিকল্প নির্ধারণে সক্ষমতা।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে স্তরে স্তরে ক্রম-বিকাশমান এবং সুস্পষ্ট স্তরেই এর সব ক’টির স্পর্শ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর কিশোর বেলাকে এভাবে লিখলেন তাঁর আত্মজীবনীতে,
“আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতাম। আমার দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমার আব্বা মাঝে-মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন। কারণ ছোট শহর, নালিশ হতো; আমার আব্বাকে আমি খুব ভয় করতাম। আর একজন ভদ্রলোককে ভয় করতাম, তিনি আব্দুল হাকিম মিয়া। তিনি আমার আব্বার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে চাকরি করতেন, আমাকে কোথাও দেখলেই আব্বাকে বলে দিতেন, অথবা নিজেই ধমকিয়ে দিতেন। যদিও আব্বাকে ফাঁকি দিতে পারতাম, তাঁকে ফাঁকি দিতে পারতাম না। আব্বা থাকতেন শহরের একদিকে, আর তিনি থাকতেন অন্যদিকে। হাকিম সাহেব বেঁচে নাই, তাঁর ছেলেরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বড় চাকরি করেন, আর একজন সিএসপি হয়েছে।“

পরিবার এবং একতাবদ্ধ সমাজের একটা সামগ্রিক প্রভাব এখানে প্রস্ফুটিত। মানুষে মানুষে ভালবাসা এবং পারস্পরিক সামাজিক দায় বিদ্যমান ছিল। যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে জন্ম নেয় বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ, সহনশীলতা এবং পারিবারিক সম্ভ্রম। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে যখন ছোট্ট পরিসরের সমবয়সী সমাজে, তখন দৃঢ়তা, কর্মদক্ষতা, সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, সংকোচহীনতা এবং হিতৈষী মনোভাবের জন্ম হয়। যার প্রতিফলন কিশোর বঙ্গবন্ধুতে সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠে। কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিতে না দিতেই কলেজের গণ্ডিতে যখন, তখন দেশে ভয়াবহ দুর্যোগ। বাঙ্গালী মুসলমানের কথিত অস্তিত্বের তাগিদে পাকিস্তান আন্দোলন। দেশ ভাগের প্রক্রিয়া এবং এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ হিন্দু-মুসলমান হানাহানি। তিনি উপলব্ধি করলেন তৎকালীন মুসলিম লীগ আসলে সামগ্রিক ভাবে প্রান্তিক বাঙ্গালি মুসলমানকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ। তিনি ছাত্র সমাজের সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। গড়লেন মুসলিম ছাত্রলীগ। এ সময়েই তিনি তৎকালীন এতদঅঞ্চলের বলিষ্ঠ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী, শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখদের নজরে আসেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীর অমায়িক ব্যবহার ও সরলতা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি তাঁর ভাব-শিষ্যে পরিণত হন। শুধু তাই নয় সাথে সাথে নিজ এলাকায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কোলকাতার ছাত্রসমাজের মধ্যমণি হয়ে উঠেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী যেমন, তেমন মহাত্মা গান্ধীর যাপিত জীবনও তাঁকে প্রভাবিত করেছিলো ব্যাপক ভাবে। কোলকাতার দাঙ্গাকালে যখন মহাত্মা-জী হাজির হলেন তখন তাঁর কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “ মহাত্মা-জী রবিবারে কারও সাথে কথা বলেন না, বক্তৃতা তো করবেনই না। মনু গান্ধী ও আভা গান্ধী ‘আলহামদু’ সূরা ও ‘কুলহু’ সূরা পড়লেন। তারপরে রাম বন্দনা গান গাইলেন। মহাত্মা-জী লিখে দিলেন, তাঁর বক্তৃতা সেক্রেটারি পড়ে শোনালেন। সত্যই ভদ্রলোক জাদু জানতেন। লোকে চিৎকার করে উঠলো, হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই। সমস্ত আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়ে গেল এক মুহূর্তের মধ্যে।“ কিংবা ধরা যাক আর একটি ঘটনার কথা। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সভা সম্পর্কে যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেটি।

“১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল, সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। নইমুদ্দিনকে কনভেনর করা হল। অলি আহাদ এর সভ্য হতে আপত্তি করল। কারণ সে আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে সে রাজি আছে। আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম এবং বললাম, ‘এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছু আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না।‘ কয়েক মাস হল পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।“

এসব কিছুই তাঁর ধাপে ধাপে পরিণত হবার এক একটি স্তর। তৎকালীন রাজনীতিবিদদের দোদুল্যমানতা, হঠকারিতা, ও পদে পদে আদর্শহীন এবং সাম্প্রদায়িক আসক্তিতে, কোটারী স্বার্থের তাগিদে নিজেদের জড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এসব ক্ষেত্রে ছিলেন ভীষণ ভাবে সতর্ক। এরকম অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ক্ষিপ্রতার সাথে সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করতেন না। তাই তিনি বলেছেন, “আমি চিন্তাভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।“ একই সাথে এ এক সুচিন্তা প্রসূত সজ্ঞান স্বীকারোক্তিও বটে, যা তাঁর স্বরূপ।

রাজনৈতিক বলয়ের বাইরেও সাধারণ্যেও তাঁর কাজ ও মানুষের কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা যেন এক সহজাত প্রবৃত্তি। কিশোর বেলাতে যেমন হিন্দু মহাসভার সুরেণ ব্যনার্জীর বাড়ি থেকে বন্ধু মালেক কে উদ্ধার করে নিয়ে আসার ঘটনা কিংবা দাওয়ালদের উপড়ে আইন করে নাজিমুদ্দিন সরকারের লোকজনদের নির্যাতনের প্রতিবাদ, কিংবা গোপালগঞ্জে সফর করতে আসা নাজিমুদ্দিন কে উপঢৌকন হিসেবে দেবার জন্যে সরকারী আমলাদের জোর করে কর আদায়ের প্রতিবাদ অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে তাঁর ছাত্রত্ত্ব হারানো, এরকম সহস্র ঘটনার ইতিহাস আছে তাঁর সমগ্র জীবনে। আছে জেল জীবনের বর্ণাঢ্য ঘটনা। আর এসবই তাঁকে সাধারণ মানুষের অন্তর আলয়ে একটা জায়গা করে দিয়েছিল। কষ্টে থাকা, নির্যাতনের শিকার মানুষেরা একটা ভরসার জায়গা পেয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর ছায়ায়। আর এভাবেই তিনি পরিণত হয়েছেন শেখ মুজিব থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’তে।

পরিণত রাজনৈতিক জীবনের কিছু ঘটনা আমাকে স্পর্শ করেছে, বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জে এসেছেন নির্বাচনের কাজে। সেই সময় তিনি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি প্রায় খালি হাতে নির্বাচনের ময়দানে। সেসময়ের ঘটনা, তাঁর নিজের ভাষাতেই চলুন শুনি-, “আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, “বাবা আমার এই কুঁড়ে ঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।“ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।“ আমার চোখে পানি এলো। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, “তোমার দোয়া আমার জন্যে যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।“ টাকা সে নিলো না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, “গরিবের দোয়া তোমার জন্যে আছে বাবা।“ নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, ‘মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।‘”

তিনি নিজেই তার পরেই বলেছেন, “এ রকম আরও অনেক ঘটনা ছিল।“ তিনি জেলে বসে চন্দ্র ঘোষের কথা বলেছেন, এ সময় তাঁকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এই চন্দ্র ঘোষ ফরিদপুরেরই লোক যাঁকে বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই চিনতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ”চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সমাজকর্মী। জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মতো একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটি ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে একজন সরকারী কর্মচারী অতি উৎসাহ দেখাবার জন্যে সরকারকে মিথ্যা খবর দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করায় এবং তাঁর শাস্তি হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী সাহেব গোপালগঞ্জে এসে ১৯৪৮ সালে সেই কর্মচারীকে বলেছিলেন, চন্দ্র ঘোষের মতো মানুষকে গ্রেফতার করে ও মিথ্যা মামলা দিয়ে পাকিস্তানের বদনামই করা হচ্ছে।“

এভাবেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যেমন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পরিপক্বতা আসে ঠিক তেমনি একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-চেতনার অভ্যুদয় হয়। তিনি ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেন সমস্ত মানুষের নেতা। শুধু তাই নয় এমনকি পশ্চিমেও তাঁর সুখ্যাতির কমতি ছিল না। সেই জন্যেই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনশত আসনের ২৯১টি আসনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি হয়েছিলো, ধর্মের নামে রাজনৈতিক বজ্জাতি এই বাংলাদেশের মানুষ বরদাস্ত করে না। মুসলিম লীগ এই নির্বাচনে ধর্মের তাস পিটিয়েছিল ব্যাপক হারে। বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
“এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে ‘ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ শ্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙ্গালী মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না এ ধারনা অনেকেরই হয়েছিলো। জনসাধারণ চায় শোষনহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।“

এই ভাবেই সেই দিনের কিশোর দুরন্ত মুজিব হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের জন্মদাতা জাতির পিতা। হয়ে উঠলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। সুপ্রাচীন ও কালের সুদীর্ঘ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এটাই বাঙ্গালী জাতির জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। আর এর রূপকার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁরই একক অঙ্গুলি হেলনে সেদিন গোটা জাতি উঠেছে এবং বসেছে। সে জায়গা, সে বিশ্বাস, সে নির্ভরতার আসনটি তিনি নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক বিপদসংকুল পথে চলতে চলতে। তিনি যেন রাজনীতির কবি ছিলেন। বাস্তবের রবীন্দ্র লালিত্য আর মাটির গন্ধ মাখানো আব্বাস উদ্দীনের সাথে কথোপকথনের বর্ণনায় সেই সত্যের আলো আরও প্রদীপ্ত হয়ে উঠে।

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর সফলতা এবং ব্যর্থতা: যেহেতু আলোচনাটি একটি বইকে কেন্দ্র করে এবং সেটি বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠবার সময়ের ব্যাপ্তির আগের ইতিহাস, তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্যক এখতিয়ার বহির্ভূত বলে এক রকম সামগ্রিকতায় তার উপস্থাপন বিবেচনা করা যায়। নানান মতে বিভক্ত শিশু বাংলাদেশের জন্ম অব্যবহিত পরের ঘটনাবলী এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের দিন গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে, আগামীতেও হবে। কেননা তিনি যে ইতিহাস রেখে গেছেন এবং যা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছেন, সেই প্রাপ্তির যথাযথ মর্যাদা, এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং আধুনিক রূপ দিতে হলে নিরন্তর গবেষণা আর তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যুগ যুগ ধরে চলতে হবেই। তবুও আমার মনে হয় এ যাবত কালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যতো মত-অভিমত সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে আর কাউকে, কোন নেতা কিংবা জাতির পিতাকে নিয়ে তা হয় নি। আগেই উল্লেখ করেছি, আমার কাছে যেটা মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর জীবনের সব চেয়ে বড় সাফল্য যে, তিনি বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্ব-বুকে বাঙালী জাতির আপন আলোয় স্বনিয়ন্ত্রানাধিকার প্রতিষ্ঠার সফল আর্কিটেক্ট। বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট ও বিকল্পহীন উপলব্ধি, তাঁর দৃঢ়তা ও দৃপ্ত ঘোষণা, সুচারু পরিকল্পনা, পরিকল্পনা মাফিক ধারাবাহিক কর্মসূচী, তাঁর লড়াই সংগ্রামের স্তরে স্তরে প্রথিত সংকল্পের বাস্তবায়ন, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা, সবশেষে দেশ ও জাতির জন্যে তার চূড়ান্ত আত্মদানের মাধ্যমেই বাঙালি জাতির নতুন সৌকর্যে একটি সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হয়েছে। এ লালিত স্বপ্নের পরিস্ফুটনের ইঙ্গিত মিলে সেই ১৯৫৫ সালের ২৫শে আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর কথায়। তিনি বলেছিলেন, ”স্যর, আপনি দেখবেন ওরা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবী জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তন কে মেনে নেবেন কিনা। এক ইউনিটের প্রশ্নটা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আপনারা এই প্রশ্নটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কি হবে? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্নটারই বা কি সমাধান ? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধেই বা কি ভাবছেন? পূর্ব বাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্ন গুলোর সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাব তারা যেন আমাদের জনগণের ‘রেফারেন্ডাম’ অথবা গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন।“

১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। এসময় তিনি বলেন,
“একসময় এদেশর বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। …একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সাথে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। …জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি –আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ হইবে। “ এই ছিলেন বাংলার সাথে একাকার হওয়া আমাদের বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ এবং এর আপামর জনমানুষের কাছে নেতা হিসেবে এই বঙ্গবন্ধুর কোন বিকল্প তখন ছিল না। তিনি নেতা হয়ে নেতাও গড়েছেন! তাঁর পারিষদবর্গের মাঝে অগণিত নেতাদের মাঝে অন্তত: ৭৫ এর নৃশংস জেল হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া চার জাতীয় নেতার নাম সবিশেষ উল্লেখ যোগ্য। তাঁরাও সমহীমায় আলোকিত ছিলেন নিজ নিজ বলয়ে।

এভাবেই রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর গুরুজন, পূর্বসূরি ও সহযাত্রী আছেন অনেক শ্রদ্ধেয় নেতা। কিন্তু দ্বিতীয় কারো ভূমিকা বঙ্গবন্ধুর এই আনুপূর্বিক ভূমিকার সঙ্গে তুলনীয় নয়। কারোও দ্বারাই সেটা কোন ভাবেই সম্ভবপর ছিল না। ইতিহাসের পাঠ পরিক্রমায় যদি যান দেখবেন, তাঁর নিরন্তর আত্ম অনুশীলন একটি জাতির মুক্তি ও ভিত রচনায় এক একটি প্রস্তর খণ্ডকে তিনি কতোটা সুনিপুণ ভাবে গেঁথে তুলেছেন। তার অনুশীলনে ও চর্চায় ভ্রান্তি যে ছিল না, তা নয়, কিন্তু সে ভ্রান্তির সংশোধকও ছিলেন তিনি নিজেই। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, রাজনৈতিকভাবে তিনি এই উপমহাদেশের প্রতিটি স্বতন্ত্র জাতি-গোষ্ঠীর জন্যে আলাদা শাসন, বাঙালি সহ উপমহাদেশের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর জন্যে আলাদা শাসন অঞ্চল বা রাজ্য মিলে স্বাধীন অথচ স্বতন্ত্র ভূমির স্বপ্ন দেখেছিলেন। এমনকি এ উপমহাদেশীয় স্তরেই সব জাতিসত্তার সু-সমন্বিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বা রাজ্য মিলে একটি অভিন্ন রাষ্ট্রকাঠামো তার প্রত্যাশিত ছিল। দেশভাগের আগে থেকেই বাঙালি তথা প্রতিটি পৃথক জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক এই বাস্তবাশ্রয়ী রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রায়োগিক প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর তাবৎ কর্মকাণ্ডে। এটাই তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এবং প্রজ্ঞার প্রতীক। গন-মানুষের ঐক্য যে একটা জাতি গঠনের ভিত্তি তা তিনি জানতেন। তাই যে কোন ধরনের সম্প্রদায়-গত বৈপরীত্যকে তিনি দূরে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৫ সালের ২১শে অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করেন তিনি।

বরাবর তিনি নিজেকে ঘোষণা করেছেন আপাদমস্তক এক অবিসম্বাদিত বাঙালি হিসেবে। তাই বাঙালিও তাকে স্বতঃস্ফূর্ত অভিধায় গ্রহণ করেছে জাতির জনক রূপে। বাংলা, বাংলাদেশ ও বাঙালিত্বে যার বিন্দুমাত্র কোন সংশয় ছিল না। বঙ্গবন্ধু, তিনি নিজেও তাঁর সামষ্টিক সুকৃতি সম্পর্কে ছিলেন নিঃসংশয়। সাধারনতঃ প্রতিটি গৃহীত প্রস্তাবনার উল্টো-পিঠে একটি বিকল্প কিংবা প্রতি সিদ্ধান্ত উপস্থিত থাকে। এটাই মননে আধুনিক অগ্রযাত্রার দ্বান্দ্বিক দর্শন। এর বাস্তবায়ন শুধু মাত্র সম্ভব সহিষ্ণু অবাধ গণতান্ত্রিকতায়, সদাচারে আসক্ত মানসিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সহমর্মীতায়। যাতে তিনি আগে থেকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন নিজের সাথেই। তাঁর রাজনৈতিক গৃহীত সিদ্ধান্তে ও তৎপরতায় সেটাই বিশেষ ভাবে ছিল লক্ষণীয়।

১৯৬৬ সালের লাহোরে ঘোষিত তাঁর ৬-দফা দাবী বস্তুত: পরিণত হয় বাংলাদেশের মুক্তি সনদে এবং এর সাথে ১৯৬৯ সালে ছাত্র-সমাজের ১১-দফা যেন মিলে মিশে গোটাটাই তখন পাকিস্তানকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশ হয়ে যায় এদেশের জনমনে! তারপরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, আমাদের আবহমান কালের সংস্কৃতিকে গলা টিপে হত্যা করার নীল নকশা, সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’ হয়ে একাত্তরের ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বাঙ্গালী জাতির বিজয় ভাগ্যের চাকা এসে এক অসম লড়াইয়ের পূর্ণ-শ্বাস নিতে ক্ষণিকের জন্যে দাঁড়ায়। জনতার বঙ্গোপসাগর সেদিন আক্ষরিক অর্থেই বাংলা আর বাঙ্গালী জাতিকে চিরকালের জন্যে প্রতিষ্ঠিত করে সমহীমায়। আর সে মহিমার নাম ‘বঙ্গবন্ধু’ তথা ‘বাংলাদেশ’, অবিচ্ছেদ্য দুটি সত্ত্বা। ঠিক এই খানে এসেই একটা প্রশ্ন বরাবর আমাকে উৎপাত করেছে। আর তা হল এই ‘বাংলাদেশ’কে হত্যা করার জন্যে ১৯৭৫ সালের ঠিক এই দিনটি অর্থাৎ ১৫ই আগস্টকে কেন বেছে নেয়া হল? ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস, যারা বাংলাদেশ চায়নি, যারা মানতে পারেনি বাঙ্গালীর স্বাধীন সত্ত্বাকে, যারা পরিচ্ছন্ন ইতিহাসের পাতায় পরাজিত, একি তবে তাদের প্রতিশোধ? আর কারা ছিল তবে নেপথ্যে? রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস নতুন নয়, তবে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস সম্ভবত: এক একক ও বিরল দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে সম্ভবত: এই ঘটনাটিই একমাত্র ব্যতিক্রম এবং এর পরম্পরাও বিরল। আইন করে ঘাতকদের দায়মুক্তির পথ করে দেওয়া হয়েছিলো, তাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত সহ নানা কাজে নিয়োগ দেয়াও হয়েছিলো! যারা দিয়েছিলেন এবং যেসব দেশ ঐ সব খুনীচক্রকে স্ব স্ব দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে গ্রহণ করেছিলো তারা কেউই প্রশ্নাতীত নয় কখনোই।

সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে এসেই রাষ্ট্র-নায়কোচিত বলিষ্ঠতায় একদিকে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বস্তুগত সম্পদ ও স্থাপনা সমূহের পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ, যুদ্ধোত্তর দেশে সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলার সোপান নির্মাণ ও দুবৃত্তায়ন রোধ, অরাজকতার গ্রীবা চেপে ধরা, ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর মতো জরুরী বিষয়গুলোই তিনি জরুরী ভিত্তিতে নিয়েছিলেন। পাশাপাশি বিশ্বের স্বাধীন রাষ্ট্র সমূহের স্বীকৃতি আদায় ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ ও তাতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে যুক্ত থাকার প্রক্রিয়া এ সবই যথাযথ সুচিন্তা প্রসূত এবং সুদূরপ্রসারী দূরদর্শী সিদ্ধান্ত-তো বটেই অধিকন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিসত্তার অগ্রযাত্রার প্রথম অথচ অবশ্যগ্রহনীয় পদক্ষেপ। আমি বিস্ময়ে অভিভূত হই যখন দেখি সদ্য স্বাধীন দেশের লিখিত সংবিধান এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করেন ১৯৭২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর এবং কার্যকর করেন ১৬ই ডিসেম্বর দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে। এরকম ঐতিহাসিক অর্জন বিশ্বের আর একটি দেশের ক্ষেত্রে আছে বলে আমার জানা নেই। এ সময়ের আর একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও সুকীর্তি হল সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সমূহের কাতারে নিয়ে আসা। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির অধীনে নিয়ে দেশকে পুনর্গঠনের পথে এগিয়ে নেওয়া।

আর তাঁর সব চেয়ে বড় ব্যর্থতা হল, তাঁর দায়িত্বের সবটুকু শেষ করতে না পারা। এ দায় যদিও তাঁর পুরোটাই নয়, বরং পিতৃ-হন্তারক এ জাতির উপড়েও সমান ভাবে বর্তায়। যার জন্যে এ জাতির ভালে চিরস্থায়ী ভাবে লেগে গিয়েছে পিতৃহত্যার অমোচনীয় কলঙ্ক। তিনি সচেতন ভাবে বলেছিলেন, “বাংলাদেশ যেমন লক্ষ লক্ষ শহীদের জন্ম দিয়েছে, তেমনি বেঈমানও রয়েছে। এখানে রাজাকার আলবদরও রয়েছে, এরা যড়যন্ত্র করছে। এসব পরগাছার শিকড় তুলে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে।“ তিনি অতি বিপ্লবীদের বিষয়েও সতর্ক করেছেন।

তাঁর ব্যর্থতা হ’লো, তিনি ছিলেন অত্যন্ত হৃদয়বান মানুষ। মানবিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে তিনি অবশ্যই ছিলেন না। ছিলেন না কোন ঐশী শক্তির আঁধার, নিতান্তই এক সাদামাটা আটপৌরে নিখাদ বাঙ্গালি মানস। কোনও বাঙালির অস্ত্র তাঁর বক্ষ-ভেদ করবে এটা ছিল তাঁর কল্পনার অতীত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি। ঘোরতর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্যও ছিল তাঁর বুক-উজাড় করা ভালোবাসা। আগেও যেমন, তেমন পরেও। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকারবৃত্তির কারণে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, খুলনার আবদুস সবুর খান কারাগারে থাকলেও বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে খাবার যেত ঠিকই। বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেতে সমস্যা হয়নি রাজনৈতিকভাবে বিরোধী আত্মগোপনে থাকা মোহাম্মদ তোয়াহার পক্ষেও । মাঝে মাঝেই আমরা বলি, নীতির প্রশ্নে আওয়ামী-লীগ কখনোই আপোষ না করলেও রাজনৈতিক পশ্চাদপসরন ঘটাতে বাধ্য হয়েছে বহুবার। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় স্বাধীনতা পূর্বকালে নীতি ও রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামীলীগকে পেছনে হাটতে হয়নি কখনোই। সে দৃঢ়তা আর দূরদর্শীতা ‘নেতা’ বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরি-কাঠামোতে লড়াইয়ের নতুন বলয়ে বিশ্ব-যাত্রার ছন্দে পা মেলাবার নেতৃত্বে ‘রাষ্ট্রপতি’ বঙ্গবন্ধুকে এগিয়ে যেতে বহুবারই পিছু হটতে কিংবা বিকল্প পথের আশ্রয় নিতে হয়েছে। তড়িঘড়ি করে এ সময়ে ওআইসি-র সদস্যপদ লাভের চেষ্টাও আমার কাছে আপাতত আত্মঘাতী বলেই বিবেচিত। যেখানে ষড়যন্ত্র ডানা মেলবার অবকাশ পেয়েছিলো বলে আমি মনে করি। সে সব ঘটনা বাহুল্য বোধের পঙ্কিলতার সাথে সমালোচকদের কলমের অক্ষর-স্রোতে সতত: দৃশ্যমান হলেও আস্থার জায়গাটা কখনোই টলেনি।

দেশ বিভাগের পর পর মিল্লাত প্রেস বিক্রি সংক্রান্ত জটিলতায় যে হাশিম সাহেবের সাথে তাঁর বিতর্ক হল, উত্তেজনা হল, তার প্রেক্ষিতেই আবার বলছেন, “তাঁর সাথে ভিন্নমত হতে পারি, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে যে রাজনীতির শিক্ষা পেয়েছি, সেটা তো ভোলা কষ্টকর। আমার যদি কোন ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি, তা স্বীকার করতে আমার কোনদিন কষ্ট হয় নাই। ভুল হলে সংশোধন করে নেব, ভুল তো মানুষেরই হয়ে থাকে। আমার নিজেরও একটা দোষ ছিল, আমি হঠাৎ রাগ করে ফেলতাম। তবে রাগ আমার বেশী সময় থাকতো না।“ তথাপি এই মানুষটিকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে যে প্রতিহিংসার রাজনীতির সূত্রপাত হয় তার রাস টেনে ধরার ক্ষমতা বোধ করি আমাদের এখনও নেই, আর সহসা হবারও নয়। রাজনীতিতে উদারতা ও কঠোরতার যে সমন্বয় দরকার বঙ্গবন্ধু তা করেননি। তিনি ছিলেন কেবলই উদার, মানবিক এবং সংবেদনশীল।
সমালোচকেরা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের সমালোচনা করেন। সে সংগঠন কখনোই আলোর মুখ দেখেই নি। অথচ সাংগঠনিক প্রকৃয়াকালে এদেশের রাজনীতিবিদ সহ সমাজের প্রত্যেকটা স্তরের মানুষের ভেতরে আশার সঞ্চার করেছিলো, কথিত আছে যে, এর উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং উৎপাদনে গতিশীলতার সৃষ্টি করা, যা অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে বিদীর্ণ করে স্বনির্ভর জাতি-গঠনের মন্ত্র হিসেবে হয়তো আবির্ভূত হবে! সে বিষয়ে প্রণীত সংশ্লিষ্ট আইনের কল্যাণ-অকল্যাণের প্রশ্ন এখন অতীত, কিন্তু তখন বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশের যে পতন ত্বরান্বিত হয়েছিলো সে বিষয়ে আমার এবং আমাদের সমমনাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। আজও আমরা পতনোন্মুখ এবং এখনও শিক্ষায়, চেতনায়, মননে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে ও জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে এক মৃতবৎ জাতি, যা শুরুতেই বলেছিলাম। আর এ আক্ষেপ হয়তো আমাদের চিরকালের জন্যে অবধারিত হয়ে রইলো।

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমাদের নীতি পরিষ্কার। এর মধ্যে কোন কিন্তু নাই। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলই সুপ্রিম বডি। আপনাদের সিদ্ধান্ত সরকারকে মানতে হবে। এটা আওয়ামী লীগের সরকার। সরকারের আওয়ামী লীগ নয়। আমার অনুরোধ, নির্দেশ, আবেদন– কাজ করতে হবে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে হবে। ক্ষমতা দখলের জন্য আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করেনি। তাই সবাইকে লোভের ঊর্ধ্বে, স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।“ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা সবাই কি লোভের ঊর্ধ্বে, স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন আজ? আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, মানুষ কি সরকার এবং আওয়ামী লীগকে আলাদা করে চিনতে পারছে? ইতিহাস সৃষ্টিকারী আওয়ামী-লীগ ও সরকার কি আজ একাকার হয়ে নেই? সরকার হতে আলাদা রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যে দলীয় অস্তিত্বের নমুনা কি দেখা যায়? শুধুমাত্র ‘বঙ্গবন্ধু’ নাম উচ্চারণে এবং এ নিয়ে আস্ফালনের মধ্যে দিয়ে বস্তুত: কিছু আসে যায় না, যদি না তাঁকে কিংবা তাঁর মহত্তম রাজনৈতিক দর্শনের আলোতে নিজের ভিত রচনা করা না যায়। নিজ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করা না যায় তাঁর ‘বাংলার গরীব মেহনতি মানুষ’ গুলোকে, তবে দেশের আইন-কানুন, মূলনীতি, সুশাসন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য-নীতি, শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ কিকরে পরিকল্পিত পথের অগ্রযাত্রায় আলোর দেখা পাবে? বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ছিল ত্যাগ ও তপস্যার। পাকিস্তানের কারাগারে তিনি এবং বাইরে তাঁর পরিবার কি কঠিন সময় কাটিয়েছেন, তার কয়েক ছত্র তার মুখ থেকেই শোনা যাক, “কে বুঝবে আমাদের মতো রাজনৈতিক বন্দিদের বুকের ব্যথা। আমার ছেলেমেয়েদের তো থাকা-খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। এমন অনেক লোক আছে যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দীর স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে করুণ কাহিনী কল্পনা করতেও ভয় হয়।“

তাহলে? তাহলে পারলেন না কেন আর একটু শক্ত হতে? আর একটু কঠোরতা কি বেশী হতো? এ জাতি তো বেঁচে যেতো, পোহাতে হতো না আজকের মতো জীবন্মৃত দিনাতিপাতের কাল!