বাংলাদেশের অনেক বাঙালি বিদেশে থাকেন। পরবাসী বাঙালির বেশির ভাগ মানুষই তীব্রভাবে অভাব বোধ করেন বাঙালি সংস্কৃতি ও দেশ। বিদেশে আবার নতুন প্রজন্মও জন্ম নিচ্ছে; বড় হচ্ছে। সংস্কৃতি ভাবনায় প্রবাসীদের অবস্থানটা কি?
অন্যান্য অনেক অনেক জাতির মানুষের মত বাঙালিকেও এক এক সময়ে বিদেশী দখলদার শাসকদের তুষ্ট রাখতে হয়েছে। অনেক সময়েই তাদের ভাষায় কথা বলতে হয়েছে নানা বিজাতীয় শব্দে। আবার তাদের হুকুম করা নিয়ম মেনে চলতেও বাধ্য হতে হয়েছে। নিত্যদিনের চলনে বলনে স্বাভাবিক আচরণকে বদলাতে হয়েছে অনেকটা। যতদিন বিদেশী শাসকরা শোষণ করেছে দেশ; ততদিন চলেছে এসব। দেশ স্বাধীন হবার একটু আগে পরে অন্য জাতির ভাষা ব্যবহারে বাধ্যবধকতা না থাকলেও শাসকের তুষ্টির কাজ কিন্তু করতেই হয়েছে নাগরিকদের। যে জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনাচরণ অনেকটা এক রকমের তারাই সমষ্টিগত ভাবে একটি জাতি। কিন্তু একটি জাতির প্রায় অনেক কিছু এক রকমের হলেও তাদের দেশ যে একটাই তেমন তো আর নয়। এটা সত্যি যে বাঙালি জাতির ব্যাপক অংশ বাস করে বাংলাদেশে, অন্য অংশটি আজকের ভারতের পশ্চিম বঙ্গে। একটি জাতির একাংশের উপর দিয়ে রাজনৈতিক দাগ টেনে দিয়ে জাতি ভাগ করেই তৈরী হয় প্রতিবেশীর দেশ। এতে জাতি ভাগ হয়না, ভাগ হয় জমি। জাতি একই থেকে যায় যদিও তাঁর উপর প্রভাব পড়ে স্বদেশের নিয়ম কানুন ও সেই দেশ চেতনার। সুতরাং বদলায় শাসক, বদলায় দেশের সীমানা কিন্তু খুব একটা আকাশ পাতাল বদলায় না যা, তা হলো সে জাতির সংস্কৃতি। আর তা যদি খুব বেশি বদলায় তা হলে ধরে নিতে হবে সেই জাতি বিভ্রান্ত হচ্ছে, বিপদে থাকছে। সে জন্যই নিত্যদিনের জীবন চেতনায়; তা যাপনে উদযাপনে আর চর্চায় বেছে নিতে হয় ভালোগুলো। খারাপগুলো নয়। নিজ সংস্কৃতির প্রতি অচেতন থাকলে, অযত্ন অবহেলা করলে অনাকাঙ্খিত খারাপ উপাদানের অনুপ্রবেশকে না ঠেকালে, নিয়ন্ত্রণে না রাখলে, জাত্যাভিমান না থাকলে সেগুলো জাতির মন্দ করবে। দেশ ও জাতির ভালো দেশের মানুষকেই করতে হবে।
প্রবাসী বাঙালি; বাংলাদেশী যারা বাঙালি জীবনধারাকে এই দূরদেশে টিকিয়ে রাখছেন তাদের ত্যাগ ও প্রচেষ্টা বেশ অনেকটা তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার মতই। বিদেশে বাঙালির অনেক বাঙালিপনা থাকলেও বাঙালির দেশটা কিন্তু এখানে নেই। বিদেশের সংস্কৃতির অর্থাৎ এখানকার জীবনাচরণ, নিয়ম; ভাষা এসব বজায় রেখে বাঙালি হয়ে থাকা প্রচন্ড কঠিন কাজ। পরবাসী একেই তো শেকড় হারা, তার ওপর প্রবাসী প্রজন্ম; সব নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার অন্তর্বর্তীকালীন এই যে সংগ্রাম; এ বড়ই কঠিন কাজ। বাংলার সেই আপনা থেকে পাওয়া মাটির গন্ধ, মেঘ বৃষ্টি জল, কদমফুল, কিংবা রসের পিঠে, রোদ পোহানো শীতের সকাল, অলস দুপুর কিংবা বসন্ত কোকিল, সুবিশাল মেলা, ছোট বড় উৎসব, পার্বণ ইত্যাদি বিনেই অনেকটা চালাতে হয় পরবাসের বাঙালিপনা। বাঙালি সংস্কৃতির প্রবল চর্চা ছাড়া অন্য কোন উপায়ই নেই তা ধরে রাখবার।
এ দূর পরবাসে যখনই দেখি নিবেদিতপ্রাণ ক’জন বাঙালি নতুন পুরোনো সবাইকে নিয়ে একসাথে হয়ে বাঙালির অনুষ্ঠান করছে তখন মন ভরে যায় আনন্দে। গান হচ্ছে, নাচ হচ্ছে; বই উৎসব, লেখকদের মেলা, হচ্ছে আরো নানান আচার অনুষ্ঠান। আজই হয়তো দেখবো বাংলার ঋতুগুলো নিয়ে একটি অপূর্ব উপস্থাপনা।
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে বসন্ত বা স্প্রিং, গ্রীষ্ম অর্থাৎ সামার, হেমন্ত মানে ব্রিটিশদের অটাম আর আমেরিকায় ফল, ও শীত অর্থাৎ উইন্টার এই চারটি প্রধান ঋতু মানলেও বাঙালির ঋতূ ছয়টি। আর গ্রীষ্মকাল মানেই সেই গাছপাকা ফল অর্থাৎ বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাস, বর্ষাকাল তো নামেই বলে দেয় ঝড় বৃষ্টির আষাঢ়-শ্রাবণ, শরৎকাল হলো ভাদ্র-আশ্বিন; জল থৈ থৈ; বন্যা, হেমন্তকাল হয় কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণে; ধান কাটার সময়, পিঠে পুলির কাল মানেই শীতকাল; পৌষ- মাঘ; কোকিল ডাকা বসন্ত; ফাল্গুন- চৈত্র।
অথচ এত আনন্দের বৈচিত্রের আড়ালেও মন কাঁদে শঙ্কায়। ঋতুগুলোর সময় প্রভাব ব্যাপ্তি কিছুই আর আগের মত নেই। পৃথিবী গ্রহের জলবায়ূ আবহাওয়ার হচ্ছে অতি দ্রুত পরিবর্তন। এর খারাপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও। বাংলাতে। জলবায়ু পরিবর্তন অনেকগুলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। যেমন পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া ও বহির্জগতের প্রভাব; মানে সৌর বিকিরণের মাত্রা, পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক-পরিবর্তন কিংবা সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান। মানুষের সৃষ্ট গ্রীন হাউজ গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। এতদিনে অনেক মানুষ জেনে গেছে যে পৃথিবী জুড়ে জলবায়ূর আচরণের অস্হিরতা সহ মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অন্যান্য আরো কিছু কারনে ক্রমশ: উষ্ণ হয়ে উঠছে আমাদের এই প্রিয় বাসগ্রহ। পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ খুব দ্রুত গতিতে গলে যাচ্ছে, এমন গতিতে যা খুব নিকট অতীতে ঘটেনি। এর ফলে সমুদ্র উঁচু হয়ে যাচ্ছে। পানিতে তলিয়ে যেতে চলেছে নিচু অর্থাৎ সমুদ্রের বা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব উঁচু নয় এমন সব দেশের অনেক অঞ্চল। প্রথমেই বিপদে পড়বে এই অঞ্চলের দেশগুলো। বেদনাদায়ক ও বাস্তব হলেও এটা সত্যি যে বাংলাদেশ প্রথম ধাক্কায় পড়া দেশগুলোর মধ্যে প্রধান একটা দেশ। বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশকে রীতিমত একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করছে এখন। অথচ চীন, আমেরিকা, ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপানসহ অনেক দেশই নেতিবাচক এই দ্রুত পরিবর্তনের জন্য দায়ী।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাটা এত বড় যে এর ক্ষতিকর প্রভাব বিলম্বিত করতে এবং মহা সঙ্কটে পড়া এই প্রাকৃতিক পরিবেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সমন্বিত পদক্ষেপ নিতেই হবে। এই সঙ্কটের খুব নিকট ভবিষ্যতের শিকার বাংলার মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে, জনমত গড়তে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। এটি পৃথিবী গ্রহের সব মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট। এ সঙ্কট আমাদের প্রতিনিয়ত জীবনাচরণের অন্তর্গত; তা’ই এটি আমাদের সাংস্কৃতিক সঙ্কটও বটে।
(বার্ন্সডেল থিয়েটার, হলিউড, ইউ.এস.এ, জুলাই ১৫, ২০১৭, অভিষেক অনুষ্ঠান, ক্রান্তি)
অনেক ভাল পোষ্ট।
ধন্যবাদ আপনাকে।