কৈশোরে গ্রামের রাস্তা দিয়ে কোথায় যাওয়ার সময় কোথাও কোথাও দেখতাম, কয়েকজন লোক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রিক্সা ও পথচারীদের থামিয়ে চাঁদা চাইছে নির্মাণাধীন আল্লার গৃহের(মসজিদ) জন্য। আমরা আল্লার জন্য একটা ঘর বানাইতেসি আল্লার রহমতে। সাধ্যমত কিছু দিয়া যান। দুনিয়ায় ও আখিরাতে অনেক নেকি অনেক সওয়াব পাইবেন। অধিকাংশ মানুষই কিছু না কিছু দিতো। অনেক হতদরিদ্রকে দেখেছি, পকেট থেকে চাল কেনার টাকাটা বের করে হাসতে হাসতে আল্লার ঘর বানানোর জন্য দিয়ে দিয়েছে। অতঃপর বাড়িতে গিয়ে উপোস করেছে নিশ্চয় (রিজিকের মালিক রাজ্জাক)। যারা চাঁদা দিতে চাইতো না তাদের চাঁদা সংগ্রহকারীরা নানাভাবে ভর্ৎসনা করতো। চারপাশের লোকজনকে শুনিয়ে, চাঁদা না দিতে চাওয়া মানুষটির দিকে আঙুল দিয়ে বলতো, এই যে, দ্যাখো দ্যাখো, এই লোক বোধ হয় মরবে না। আল্লার ঘরের জন্য টাকা দিতেছে না। ও মিয়া, তুমি কি মরবা না? মরলে আল্লার কাছে কী জবাব দিবা?

যারা টাকাপয়সা সোনারূপা আল্লার পথে ব্যয় না করে, তাদের জন্য আছে কঠোর আযাব

আমার কাছে তো টাকা থাকতো না। আমি দিতে পারতাম না। খুব খারাপ লাগতো আমার নিজের জন্য ও অন্য যারা চাঁদা দেয় না তাদের জন্য। আল্লার কাছে আমরা কী জবাব দেবো? ক্ষণিকের দুনিয়াতে কয়েক বেলা না খেয়ে থাকলাম বা মরেই গেলাম না খেয়ে। তাতে কী? কিন্তু তাই বলে কি আল্লার জন্য টাকা দেবো না? আল্লাকে টাকা না দিয়ে কি একবেলা ভাত খাওয়া বড় হয়ে গেল? বড় মনোবেদনায় ভুগতাম এবং এ-বিষয়ে দার্শনিক চিন্তাভাবনায় নিমগ্ন থাকতাম গভীরভাবে।

মেট্রিক পরীক্ষার হলে যাতায়াতের পথে কয়েকটা মসজিদ পড়তো। মসজিদের কাছ দিয়ে যাবার সময় আমি মনে মনে সমস্ত দোয়াদরুদের বারংবার খতম দিতে শুরু করতাম, সর্বমোট যে দুই-তিনটা জানি আরকি। হে আল্লা, আজকের পরীক্ষায় অমাকে অনেক নাম্বার পাইয়ে দিয়ো। জীবনে আমাকে ব্যারিস্টার বানায়ে দিয়ো, মেজিস্ট্রেট বানায়ে দিয়ো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানায়ে দিয়ো, বড় পুলিস অফিসার বানায়ে দিয়ো। এইরকম আরো অনেককিছু বানায়ে দিয়ো। কিন্তু অমুক তমুক সমুক যারা আমার জন্য মনে বিদ্বেষ পোষণ করে তাদের ভালভাবে ফেল করায়ে দিয়ো। এবং জীবনে তাদের চাষাভুষো বানায়ে দিয়ো।

পরীক্ষার আগে কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন আমাকে দশ-বিশ টাকা করে দিয়েছিল। সে টাকার সমস্তই আমি আল্লাকে দান করে দিয়েছিলাম। শুধু মনের কামনাবাসনার কথা আল্লাকে জানালে তো হবে না। তা পূরণের জন্য তার উদ্দেশ্যে তারই শেখানো পর্যাপ্ত তোষামোদবাক্য ও শব্দ পাঠও যথেষ্ঠ নয়। কিছু টাকাপয়সাও তো দেওয়া চাই ঘুষ হিসেবে! পরীক্ষা দিতে যাবার সময় আমি প্রতিদিন মনেপ্রাণে আল্লার দরবারে নিজের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল ও অন্যান্যদের ততোধিক সর্বনাশ কামনা করতে করতে আল্লার ঘরের দানবাক্সে কোনোদিন জলজ্যান্ত একটাকা, কোনোদিন দুইটাকা, কোনোদিন পাঁচটাকা, এমন কি কোনোদিন গোটা দশটাকার নোট পর্যন্ত দিয়ে দিতাম। শৈশব-কৈশোরের দশটাকা মানে তো দশকোটি টাকা। আমার টাকা দিয়ে আল্লা কোটিপতি হয়ে গেল। আহা! সেইসব টাকাগুলি আল্লাকে না দিয়ে যদি নিজে জমায়ে রাখতাম, ব্যাংকে ফিক্সট ডিপোজিট করতাম তাহলে আজ আমি কোটিপতি হতাম। আমার দানের টাকা আল্লা খেয়ে নিলো ঠিকই, তার বাসস্থান বানায়ে নিলো ঠিকই আমার টাকায়। কিন্তু তার কাছে চাওয়া আমার কোনো মনোবাঞ্ছা পূরণ করলো না। আমার সব টাকা আমি সুদসহ ফেরত চাই তার কাছে। ফেরত না দিলে ধোঁকাবাজ, বেঈমানতার উপরে লানৎ।

এখানে অনেক বাঙালি গ্রোসারি দোকান ও রেস্টুরেন্টের কাউন্টারে ‘মসজিদের দান বাক্সো’ লেখা ছোট্ট একটা বাক্সো দেখতে পাওয়া যায়। ওসকল দোকানে গেলে দেখা যায়, অনেক কাস্টমারই তাদের বাণিজ্য শেষে দান বাক্সে কিছু টাকাপয়সা ভরে দিয়ে বিশ্ববিজেতা বীরের দৃষ্টিতে চারপাশের মানুষের দিকে বারকয়েক করুণার দৃকপাত করছে। তার মানে হচ্ছে, আমি করে ফেললাম একটা মহান কাজ আর তুমি বা তোমরা পারলে না; ধিক ও করুণা তোমাদের।

আমার এক বন্ধুর গ্রোসারি দোকান ছিল কয়েক বছর আগে। একদিন তার পরিচিত এক লোক তার দোকানে একটি দান বাক্সো বসিয়ে দিয়ে গেলো এই বলে, আল্লার ঘরের জন্য একটা দান বাক্সো তোমার দোকানে বসায়ে দিয়ে গেলাম, দোস্ত। অনেক সওয়াব হাসিল হবে এতে। যারা দান করবে তারা তো সওয়াব পাবেই, তোমার দোকানে যে এটা বসালাম, তুমিও অনেক সওয়াব পাবা কিন্তু। আর আমি যে বসালাম আমিতো পাবোই পাবো। এর সাথে আরো যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সংশ্লিষ্ট থাকবে তারা সবাইই পাবে অশেষ নেকি। তোমার ব্যবসারও উন্নতি হবে আল্লার রহমতে। প্রতিদিন একবার এসে সে লোক আমার বন্ধুর দোকান থেকে দান বাক্সো খুলে আল্লার জন্য মানুষের দেওয়া দানের টাকা সংগ্রহ করতো। আমার বন্ধুকে বলতো, দোস্ত, তুমি কিন্তু সব কাস্টমারকে দান বাক্সে টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করবা, স্মরণ করায়ে দিবা। অনেক অনেক নেকি পাবা এজন্য কিন্তু। আমার বন্ধুটি অবিশ্বাসী। তবে সামাজিক কারণে তেমন স্পস্টভাবে তা প্রকাশ করতে ভয় পায়। দান বাক্সো সংক্রান্ত ব্যাপারে সে নির্লিপ্ত থাকে। বাক্সোটি তার দোকান থেকে সরাতে বললে তার ব্যবসা লাটে উঠবে। এটা জানলে কোনো মোসলমান তার দোকানে আর আসবে না। তাকে ওরা ঘৃণাও করবে — এই ভয়ে সে চুপ হয়ে থাকে। বন্ধুর অনেক নেকি হাসিল হয়েছিল। আরে সে নেকির বদৌলতে তার ব্যবসা লাটে ওঠে, দোকান বন্ধ হয়ে যায়।

এখানে কোনো বাঙালি মোসুলমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আমি কখনো দেখিনি কোনো বাংলা স্কুল, গানের স্কুল, ছবি আঁকার স্কুল, প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনুদান সংগ্রহের প্রয়াস। দেখিনি পৃথিবীর অগণিত গৃহহীন মানুষের কারো জন্য গৃহ নির্মাণের জন্য টাকা সংগ্রহ করার প্রয়াস।

মোসলমানেরা রোজার মাসে ফিতরা ও যাকাত দেয়। সামর্থবান মোসলমানদের উপর যা ফরজ। কিন্তু তা শুধু মোসলমানদেরকে। এখানকার সামর্থবান মোসলমানেরাও দেশে দরিদ্র মোসলমান আত্মীয়দের জন্য যাকাত ফিতরার টাকা পাঠায়। কিন্তু কখনো কোনো মোসলমান কোনো অমুসলমান মানুষকে সাহায্য করে না। কারণ তা তাদের শান্তির ইসলাম ধর্মে হারাম।

এখানকার অনেক বাঙালি মোসলমান দেশে নিজের এলাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা বানায় অনেক টাকা খরচ করে। এধরনের মানুষেরাও স্কু্‌ল, গানের স্কুল, হসপিটাল, গৃহহীনের জন্য গৃহ, পাবলিক টয়লেট এসবের কোনো প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে না। এখানে বাঙালি মোসলমানদের হাতে একটু টাকা হলেই মসজিদ-মাদ্রাসা বানায় এখানে বা দেশে। বিভিন্ন দেশ হতে আগত মোসলমানদের অবদানে এখন এসব কাফের দেশের মোড়ে মোড়ে আল্লার ঘরের ভিড়। অগণিত আল্লার ভিড়। এখানকার সরকারও আল্লার ঘর বানায়ে আল্লার সংখ্যা বৃদ্ধি করার অনুমতি ও অনুদান দিয়ে ইহলোক ও পরলোকের নেকি হাসিল করে নেয়। নেকির তো দরকার আছে। সরকার কি মরবে না? তখন আল্লার কাছে কী জবাব দেবে? সভ্য দেশগুলিতে আশ্রিত ও প্রশ্রিত ইসলামী সন্ত্রাসে নিরীহ জনতা নিধনযজ্ঞ চলতে থাকলে তার দায় তবে কার?

বাংলাদেশে আগে প্রতিটি অঞ্চলে এলাকার মসজিদের জন্য চাঁদা চাওয়া হতো। কেউ চাঁদা না দিতে চাইলে তাকে নানানভাবে ভর্ৎসনা করা হতো, লজ্জায় ফেলে দেওয়া হতো। এখন চাঁদা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। চাঁদা দিতেই হবে। না দিয়ে বাঁচা যাবে না। কয়েকজন নাস্তিক বন্ধুকে জানি, যারা এই ইসলামী চাঁদাবাজি সন্ত্রাসের শিকার। ওদের কাছ থেকে মসজিদের চাঁদা নিয়ে যায় এলাকার সাচ্চা মোসলমান চাঁদাবাজ বাহিনি। ওদের আমি বলি, কেন তোমরা বলো না, তোমরা মোসলমান নও, মসজিদে যাও না; কাজেই চাঁদা তোমরা দেবে না। ওরা বলে, সাথে সাথে হত্যা করবে তাহলে। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? এমন ইসলামী সাচ্চা সন্ত্রাসের মধ্যে? হ্যাঁ, এভাবেই মানুষকে বেঁচে থাকতে হয় মোসলমান দেশে।

ছোটবেলায় যখন উত্তরাধিকারসূত্রে অন্ধবিশ্বাসী ছিলাম তখন মনে হতো, আল্লা নামের কোনো রূপকথার চরিত্র হচ্ছে সর্বশক্তিমান। তার কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। সে খুব ভালো মানুষ। তার গৃহ নির্মাণের জন্য আমাদের দান করা দায়িত্ব।

ইসলাম ধর্ম ও মোসলমানদের মতে, আল্লা এই ব্রহ্মাণ্ডের তৈরিকারক ও মালিক। তাহলে তার ঘর বানানোর জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা আদায় করে কেন ওরা? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে বানাতে পারে সে নিজের জন্য একটা ঘর কেন বানাতে পারে না? এই অবস্থা দেখে ত মনে হয়, ওর চেয়ে অনাথ, ভিখারি আর কেউ নেই এই ব্রহ্মাণ্ডে। দেড় হাজার বছর ধরে এই ভিক্ষুকের জন্য কয়টা গৃহ বানিয়েছে মোসলমানেরা চাঁদাবাজি, জবরদখল ও ভিক্ষা করে? এই এক লোক কিংবা বস্তু কিংবা অবস্তুর কয়টা ঘর দরকার? এক প্রাণি বা অপ্রাণি বা কিছুই না’র জন্য ঘর বানাতে আর কত বছর ভিক্ষাবৃত্তি করা দরকার তার সন্ত্রাসবাহিনির? কেমন অশেষ নিরলস নির্লজ্জ সে নিজে ও তার সন্ত্রাসী ভিক্ষুকবাহিনি?