বছরে বেশ কয়েকবার আমরা নাটক মঞ্চস্থ করতাম, আমাদের এলাকায়। অবশ্যই আলোচনা, গণসঙ্গীত পরিবেশন করা হত নাটক মঞ্চায়নের আগে। আশপাশের শ্রমিক, রিক্সা চালক, নিম্নবিত্তরা’ই ছিল মূলত আমাদের দর্শক-শ্রোতা। স্কুলের ছাত্ররাও আসত, তবে সংখ্যায় কম। এর মধ্যে মাদ্রাসার দু’জন ছাত্রকে পেয়েছিলাম। তারা প্রায় নিয়মিত আসাতে মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল। কেমন মায়া হল আমার। নিজে আগ বাড়িয়েই কথা বলেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন লাগে আমাদের অনুষ্ঠান। ভাললাগা ব্যক্ত করেই বলেছিল, “ইচ্ছা করে আমরাও অভিনয় করি”। আমিও আগ্রহভরে বললাম, “অবশ্যই করবে”। উত্তর এলো “না, আমরা অভিনয় করতে পারব না। অভিনয় করলে, হুজুর আমাগোরে মাদ্রাসা থাইক্যা বাইর কইরা দিবে”। সেদিন আমি খুব অসহায় বোধ করেছিলাম। মনে দাগ কেটেছিল বলে ঘটনাটি আজও মনে রয়ে গেছে।

এই ঘটনাটি কি একজন স্কুল ছাত্রের বেলায় ঘটবে? এখনকার কথা জানি না, সেই ৮৮-৮৯’এর দিকের কথা বলছি। উত্তর হবে, না। মাদ্রাসার ছাত্রদের নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই। তাদের নিজস্ব মতামতেরও কোন মূল্য নেই। প্রতিষ্ঠান যেভাবে চালাবে, তারা সেভাবেই চলবে, চলতে বাধ্য।

স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন (ছাত্র ধর্ষিত হয়েছে , এখনও কানে আসেনি) ছাত্রী লাঞ্চিত হলে, বা ধর্ষিত হলে সাধারণতঃ যেভাবে ছাত্রদের মধ্যে বিক্ষোভ সঞ্চারিত হয়, মাদ্রাসায় ছাত্র (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) বা ছাত্রী ধর্ষিত হলে সেরকম কোন বিক্ষোভ দৃষ্টিগোচর হয় না। তার মানে এই নয়, তাদের মধ্যে ক্ষোভ অনুভূত হয় না, হয়। কিন্তু এই নিয়ে বিক্ষোভ করার সাধ্যি তাদের নেই।

বলতে চাচ্ছি, মাদ্রাসা ছাত্রদের হাত পা বাঁধা। উপরের হুকুম মেনে চলাই তাদের ভাগ্য। আর এদের ভাগ্য নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছে একদল ধর্ম্মব্যবসায়ী। মাদ্রাসা ছাত্রদের সমাবেশ ঘটিয়ে, সরকারে কাছে নানা দাবীনামা পেশ করে, তারা হাতিয়ে নিচ্ছে নানা সুযোগ সুবিধা (শুনেছি, এর মধ্যে রেলের জম্নিও রয়েছে)। নিজেদের ছেলেমেয়েদের নামীদামী স্কুলে পড়াচ্ছে। আর ওদিকে, এদেরকে আশ্রয় করে, শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছেমত ইস্যু উৎপাদন করে, জনগণকে বিভ্রান্ত করার খেলায় মেতেছে। আমরা দেখেছি ব্লগার হত্যা হয়, বিচার হয় না। আমরা দেখেছি, ইসলাম অবমাননার নাম করে, হিন্দুর বাড়িঘরে হামলা করা হয়, আগুন দেয়া হয়। অনুসন্ধানে অপরাধী হিসাবে বেরিয়ে আসে মুসলমানের নাম। বিচার হয় না। অথচ শিক্ষক শ্যামল কান্তি’কে জেলে পাঠানো হয়। তাকে কানে ধরিয়ে উঠবস করিয়ে আইনভঙ্গকারী, শাসকগোষ্ঠীর অংশ ওসমান পরিবারের বিচার হয় না। রাব্বীর ছেলে খুন হয়, কি এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে আসামী হয়ে যান পিতা রাব্বী নিজেই।

তালিকা দীর্ঘ হবে, তাই বিরতি। মূল কথাটা হল, সরকার চাইলে, এগুলোর সমাধান করে দিতে পারত বহু আগেই। কিন্তু করা হবে না। তাহলে ইস্যু উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।

উৎপাদিত ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করার জন্য এখন রয়েছে হেফাজত নামক ধর্ম্ম ব্যবসায়ী সংগঠন। আগেও ছিল ভিন্ন ভিন্ন নামে। সমাজের সচেতন অংশ সে-সব ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন। সরকারও এটাই চায়। একটার পর একটা ইস্যুতে লেজেগোবরে হয়ে থাকুক আমজনতা।

আমরা কী করতে পারি?

আমরা অবশ্যই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করব, কিন্তু এখানে থেমে গেলেই সমস্যা, যেটা শাসকগোষ্ঠী মনেপ্রাণে চায়। নানা ঘটনায় জনমনে সঞ্চারিত ক্ষোভকে কি ভাবে শাসকগোষ্ঠীর দুর্গাভিমুখে আঘাত হানার লক্ষ্যে পরিচালিত করা যায়, এই নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে খুব করে ভাবা দরকার।

জনগণের স্বার্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় সফল; অগ্রসর চিন্তক বলে পরিচিত একদল কলাম লেখক, ফেইসবুকার, সমাজকর্ম্মী, ইত্যাদি; সরকারের পক্ষে যোগ দিয়েছে বাড়তি উপদ্রব হিসাবে। তারা হেফাজতের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী উপাদান আবিষ্কার করে চলেছেন।

হেফাজতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা’টা কি? হাইকোর্টের সামনে বিদেশী মূর্তি (মূর্ত্তি)? একটি বিবৃতিতে আহমদ শফী বলেছে, “আমরা বারে বারে বলেছি, ইসলামে ইনসাফ বা ন্যায়ের ধারণা একটি মৌলিক ধারণা বা গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এমনকি ইনসাফ কায়েম ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্য। সেই ন্যায়ের বা ইনসাফের কোনও প্রতীকায়ন যদি গ্রিক ঐতিহ্য থেকে ধার করা হয়, তবে প্রকারান্তরে এটাই ধরে নেওয়া হয় যে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যে ও ধর্মে ন্যায়ের কোনও ধারণা বা অবস্থান ছিল না। এটা ঔপনিবেশিক ভাবাদর্শ।” বিস্তারিত এখানে দেখুন: ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনে মর্মাহত আহমদ শফী, বাস্তবতা বোঝার অনুরোধ সরকারকে।

কথা হল, এই ন্যায় বা ইনসাফ অথবা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা কোথায় থাকে, যখন ট্যাংরাটিলা’য় গ্যাস পুড়ে, কিন্তু ক্ষতিপূরণ মেলে না। কোথায় থাকে, যখন সুন্দরবন বিনাশকে সামনে রেখে কয়লাভিত্তিক কারখানার জন্য ভারতীয় পূঁজির ভাগাড় হয়ে উঠে? কোথায় থাকে ইনসাফ যখন বাঁশখালীতে লাশ পড়ে? তবুও চায়নার কয়লাভিত্তিক কারখানার কাজ এগিয়ে চলে। কোথায় থাকে রূপপুরে পারমাণবিক কারখানা বসানোর আয়োজন, রাশিয়ার পূঁজির ভাগাড়?

গার্মেন্টেসে শ্রমিক মরে, মুজুরী পায় না। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি পাচার হয়ে যায়। এদের ইনসাফের নাড়াচাড়া নেই। এ কেবল নড়ে উঠে, অনুভূতি গনগনে হয়ে উঠে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হয়ে উঠে, একটা মূর্তি দেখে। কত হাস্যকর হলে, এরকম কথা বলে পার পাওয়া যায়? আরও হাস্যকর হল, এদের পেছনে বুদ্ধির রসদের যোগানদার হিসাবে হাজির হয়ে যায় একদল বুদ্ধিজীবী।

একটি মাত্র মূর্তি ভাঙ্গার প্রশ্নে যেভাবে , শিল্প, আগ্রাসন, উপনিবেশ, প্রতিকায়ন’এর প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি, তার সিকিভাগ যদি জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে হত, দেশটা আর যাই হোক, বিদেশী শক্তিগুলোর ভাগাড়ে পরিণত হত না।

তো এই ধর্ম্মব্যবসায়ীদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রগতিশীলতার মুখোশ পরিহিত, সমাজে অগ্রসর চিন্তক বলে পরিচিত বুদ্ধি-ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচিত করব কেমন করে? যেহেতু এদের পেছনে রয়েছে আবার অনেক সাধারণ মানুষ, তাদের মধ্যে অনেক আন্তরিক মানুষও রয়েছেন যারা সমাজকে পুরুষ-প্রকৃতির বসবাসের উপযোগী দেখতে চান। তাই এ নিয়েও আমাদের ভাবা দরকার।

এদের সখ্য-তালিকা থেকে বিদায় করে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? কি করা যায়, কেমন করে, এই নব্য দানবদের একঘরে করা যায়, জানার আগ্রহ থেকেই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ।