১. বৃত্তের ধ্রুবক

গণিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা বলা হয়ে থাকে ‘পাই’কে। বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের সাথে একটি অনুপাত থেকে ‘পাই’য়ের ধারণা আমরা পাই। জ্যামিতিতে বিভিন্ন আকৃতির যেসব বস্তু আমরা কল্পনা করতে পারি, তার মধ্যে বৃত্তের গঠনকে অত্যন্ত নিঁখুত ধরা হয় দীর্ঘদিন ধরে। এবং ‘পাই’ সেই অমূলদ সংখ্যাটি, যেটা বৃত্ত সংক্রান্ত যেকোনো জ্যামিতির হিসাব নিকাশের জন্যে অপরিহার্য। তাই ‘পাই’ নিয়ে গণিতজ্ঞদের চুলচেরা বিশ্লেষণের শেষ নেই। তবে Bob Palais নামে একজন গণিতবিদ “Pi is Wrong” নামে একটা নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। আমরা এই লেখার মাধ্যমে তার ধারণাকে পর্যালোচনা করব।

১.১ অস্বচ্ছ প্রস্তাবনা

‘পাই’ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা রয়েছে, তা পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে ‘পাই’কে সঠিকভাবে অনুধাবণ করতে হবে। ‘পাই’ সম্পর্কিত সর্বজনগৃহীত সংজ্ঞা হচ্ছ, ‘পাই’ বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত।

π = C/D = 3.14159265…… ( C=বৃত্তের পরিধি, D=বৃত্তের ব্যাস )

‘পাই’ এর অনেক চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একে বেশি পরিমাণে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। যেমন: পাই সংখ্যাটি অমূলদ। অর্থাৎ একে দুটি সংখ্যার ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা যায় না। এবং এটা একটা তুরীয় সংখ্যা (Transcendental Number)। যেসকল সংখ্যাকে কোনো বহুপদী সমীকরণের চলকসমূহের (variable) মূল (root) হিসেবে প্রকাশ করা যায় না, সেটাই তুরীয় সংখ্যা। এরকম অনেক গাণিতিক বিশেষত্ব নিয়ে ‘পাই’ সংখ্যাটি বিশেষভাবে আলোচিত।

আসলে ‘পাই’ সংখ্যাটি যে ভুল- ব্যাপারটি আদৌ এমন নয়। কিন্তু সত্যটি হল, ‘পাই’ সংখ্যাটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত নয়। তাই যখন আমরা বলি, ‘পাই ভুল’, তার অর্থ এই যে, বৃত্তের একটি ধ্রুবক হিসেবে ‘পাই’ সংখ্যাটি কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। আরো স্পষ্ট করতে বলতে গেলে, বৃত্ত হচ্ছে অসংখ্য বিন্দুর সমষ্টি, যে বিন্দুগুলো অপর একটি নির্দিষ্ট বিন্দু (বৃত্তের কেন্দ্র) হতে সর্বদা সমদূরবর্তী। এই ‘সমদূরত্ব’টিই হলো ঐ বৃত্তের ব্যাসার্ধকে নির্দেশ করে। বলে রাখা প্রয়োজন, ব্যাস হলো বৃত্তের পরিধির উপরিস্থ যেকোনো দু’টি বিপরীত বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব। অন্যদিকে ব্যাসার্ধ হলো, বৃত্তের কেন্দ্র এবং পরিধির উপরিস্থ যেকোনো বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব। এখন নিচের চিত্রটা থেকে দেখা যায়, ব্যাসকে ধ্রুবক রেখে অসংখ্য আকৃতি গঠন করা সম্ভব। কিন্তু ব্যাসার্ধকে ধ্রুবক রাখলে কেবল একটি আকৃতি আসে। ফলে, এটি অনেক বেশি গঠনমূলক বৃত্তের ধ্রুবক তৈরি করে।

যেহেতু বৃত্তের ব্যাসার্ধ এর ব্যাসের দ্বিগুণ, তাই নতুন এই ধ্রুবকটি হবে ‘পাই’য়ের দ্বিগুণ। ‘পাই’য়ের মতো এটিও তুরীয় এবং অমূলদ সংখ্যা হবে। খেয়াল করলে দেখা যায় গণিত, পদার্থবিদ্যার অনেক সূত্রে 2π ব্যবহার করা হয়। “Pi is Wrong” নিবন্ধে লেখক বৃত্তের ধ্রুবকের জন্যে ব্যাসার্ধ সংক্রান্ত সংজ্ঞাটিই অধিক গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। তিনি একে বৃত্তের ‘এক চক্র’ (one turn) বলে পরিচিত করেছেন। এবং চিহ্ন হিসেবে τ (tau) ‘কে বেছে নিয়েছেন।

τ = C/r = 6.283185307179586… (C= বৃত্তের পরিধি, r=বৃত্তের ব্যাসার্ধ)

১.২ ‘পাই (π)’য়ের জনপ্রিয়তা

বৃত্তের ধ্রুবক হিসেবে যে ‘টাউ (τ)’য়ের ব্যবহারই স্বাভাবিক হতে পারত, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে আমরা দেখে নিতে পারি- আমাদের মাঝে ‘পাই’ কতটা জনপ্রিয়। প্রথমেই আমাদের এই সত্যটা স্বীকার করে নিতে হবে যে, প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে আমাদের মাঝে ‘পাই’ এর জনপ্রিয়তা একটা অন্ধ বিশ্বাসের মাধ্যমে বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘পাই’ এর গুণাবলি নিয়ে উচ্চপ্রশংসা করে বিভিন্ন বইও লেখা হয়েছে। এমনকি ‘পাই’য়ের জন্যে অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ঈশ্বরের মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা। যেমন: ২০১০ সালে গুগল ‘পাই’ দিবসকে উদযাপন করেছে, তাদের লোগো পরিবর্তনের মাধ্যমে।

কিছু কিছু ‘পাই’ প্রেমী মানুষ ‘পাই’য়ের মান শতক বা হাজার ঘর পর্যন্ত মুখস্ত করে ফেলে ! তাই সত্যি কথা বলতে, ‘টাউ’কে ‘পাই’য়ের মতো একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হবে। যদিও আমরা ‘টাউ’ ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বেশি যৌক্তিক পক্ষে অবস্থান করি।

২. ‘টাউ’ সংখ্যাটি কী?

উপরের ১.১ অংশে আমরা দেখেছি ‘টাউ’ (τ) কে 2π হিসেবে লেখা যায়। গণিতের বিভিন্ন সূত্রে আমরা এই 2π কে দেখতে পাই। যেমন:

১ম সূত্রে পোলার স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় একটি স্থানের সমাকলন (integration) করার সময় আমরা শূন্য ( 0 ) থেকে 2π ব্যবধানের মান বের করি।

২য় সূত্রটি পরিমিত বিন্যাস সম্পর্কিত। একে Gaussian Distribution-ও বলা হয়। ‘পরিমিত বিন্যাস’ ব্যাপারটি একটা সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে। যেমন: বাংলাদেশের একজন পুরুষকে যদি দৈবচয়নে নির্বাচন করা হয়, তাহলে তার উচ্চতা ৫ ফুট থেকে ৫.৫ ফুটের মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা কত ? এই সম্ভাবনা বের করার জন্য যে সূত্র, সেক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই 2π কে।

৩য় সূত্রটি ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম-এর। বিভিন্ন ধরণের তরঙ্গের কম্পাঙ্ক, অনুপাত ইত্যাদি বের করার জন্যে সূত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সূত্রেও 2π রয়েছে।

৪র্থ’টি গণিতবিদ অগাস্টিন লুইস কচির বিখ্যাত একটি সূত্র। জটিল সংখ্যা (complex number) ’কে ব্যবহার করে যে ফাংশন তৈরি করা হয়, তার সমাকলন করার জন্যে এই সূত্রটি ব্যবহৃত হয়। স্বাভাবিকভাবেই এখানেও 2π দেখা যাচ্ছে।

৫ নং এ এককের n তম বর্গমূল বের করার জন্যে e এর পাওয়ার হিসেবে 2π ব্যবহার করা হয়েছে।

সবশেষে, গণিতের একটা অসাধারণ সূত্র রেইম্যান-জেটা ফাংশন। বাস্তব অথবা জটিল সংখ্যা ব্যবহার করে একটি অসীম ধারা তৈরি করা হয়েছে, যা রেইম্যান-জেটা ফাংশন নামে পরিচিত। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এখানেও 2π ব্যবহার করা হয়েছে।

[রেইম্যান-জেটা ফাংশনটি 2n এর পরিবর্তে -১ ব্যবহার করলে যে ধারাটি পাওয়া যায়, সেটি হল ১+২+৩+৪+৫…∞ , অর্থাৎ সমস্ত স্বাভাবিক সংখ্যার যোগফল। সূত্রের ফলাফল হিসেবে মানটি আসে -১/১২ । মজার ব্যাপার হলো, ভারতীয় গণিতবিদ রামানুজন আরেকটি ভিন্ন উপায়ে খুব সহজেই এই একই মান বের করেন। আগ্রহীরা উইকিপিডিয়াতে দেখতে পারেন।]

এখন কেউ কেউ ভাবতে পারেন উপরের এই সূত্রগুলো আমরা বেছে-বেছে নিয়েছি, যেখানে 2π -ই রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি আপনার গণিত অথবা পদার্থবিদ্যার বইটা খুলে দেখেন, তাহলে দেখবেন সেখানে অসংখ্য সূত্র রয়েছে, যেগুলোতে 2π ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এই রহস্যের সমাধান করতে আমাদেরকে বৃত্তের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিশদ ধারণা লাভ করতে হবে। যদিও কমবেশি সবারই বৃত্তের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে, তারপরও ‘টাউ’ সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারনা পেতে আমাদেরকে বৃত্তের উপর একবার নতুন করে চোখ বুলিয়ে নিতেই হবে।

২. ১ বৃত্ত এবং কোণ

বৃত্ত এবং কোণের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। নিচের ছবিতে একই কেন্দ্র বিশিষ্ট দু’টি ভিন্ন ব্যাসার্ধের বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। যাদের পরিধি থেকে ভিন্ন দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট দু’টি অংশ বা ‘চাপ’ (arc lengths) কেটে নিলেও তাদের মধ্যবর্তী কোণের পরিমাণ (θ) একই থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, বৃত্তের ‘চাপ’ পরিমাপ করার সময় ব্যাসার্ধ এবং কোণ পরস্পর স্বাধীনভাবে আচরণ করে। তবে যখন আমরা শুধুমাত্র একটা বৃত্ত নিয়ে বিভিন্ন পরিমাপ করতে চাই, তখন ব্যাসার্ধটি অবশ্যই অপরিবর্তনীয় থাকে। এবং ঐ বৃত্তের দু’টি ব্যাসার্ধের মধ্যবর্তী অংশকে পরিমাপ করার জন্যেই আমরা ‘কোণ’ মেপে থাকি।

সম্ভবত কোণ পরিমাপের সবচেয়ে প্রাথমিক পদ্ধতি হলো ‘ডিগ্রি’। এটা বৃত্তকে ৩৬০ ভাগে ভাগ করে। নিচের ছবিতে ত্রিকোণমিতিতে ব্যবহৃত কিছু প্রচলিত কোণের পরিমাপ দেখানো হল-

কোণ পরিমাপের আরেকটি মৌলিক পদ্ধতি হল, কোনো বৃত্তের চাপের দৈর্ঘ্যের সাথে ঐ বৃত্তের ব্যাসার্ধের অনুপাত বের করা। একে রেডিয়ান পদ্ধতি বলা হয়। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বৃত্তের চাপ এবং ব্যাসার্ধ পরস্পরের সামাণুপাতিক। এবং সেখানে ধ্রুবক হলো ‘কোণ’। এখানে খেয়াল রাখতে হবে, যেহেতু ‘চাপ’ এবং ব্যাসার্ধ উভয়ের দৈর্ঘ্যের এককই সমান, তাই এর কোনো একক নেই। রেডিয়ান কোণের ব্যবহার গণিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করা সমাকলন বা ব্যবকলন করার সময় যে কোণের হিসাব করা হয়, সেগুলো সবই রেডিয়ান কোণ। যেমন: sinθ কে যদি θ এর সাপেক্ষে ব্যবকলন (differentiation) করা হয়, তাহলে আমরা cosθ পাই। এখানে θ দ্বারা রেডিয়ান কোণই নির্দেশ করা হয়েছে। এবং এই ব্যবকলন শুধুমাত্র রেডিয়ান কোণের জন্যেই সঠিক হবে।

সাধারণত, ত্রিকোণমিতিতে কোণের হিসাব করার জন্যে রেডিয়ান কোণই ব্যবহার করা হয়। আমরা উচ্চমাধ্যমিকে ত্রিকোণমিতির যে বিশেষ কোণগুলোর (30, 45, 60, 90…) মান মনে রাখার চেষ্টা করতাম, সেগুলো আসলে ‘পাই-রেডিয়ান’ সিস্টেমে লেখা ছিল।


চিত্র- i

এখন আমরা সেই ‘পাই-রেডিয়ান’ সিস্টেমের একটা অন্যরূপ দেখাতে পারি। যেখানে আমাদের পরিচিত কোণগুলোকে লেখা হবে একটা বৃত্তের বিভিন্ন ভগ্নাংশরূপে। আর এই পদ্ধতি আমাদেরকে রেডিয়ান কোণ পরিমাপের সংজ্ঞাকে নতুনভাবে যাচাই করতে সাহায্য করবে। এখানে আমরা বৃত্তের চাপের (s) পরিবর্তে পুরো বৃত্তের পরিধির (C) ভগ্নাংশ (f)-কে লিখতে পারি। তাহলে, s=fC :

θ = s/r = fC/r = f (C/r) ≡ fτ

খেয়াল করলে দেখা যায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে ‘টাও (τ)’ চলে এসেছে। যদি সত্যিকার অর্থেই আপনার ‘পাই’ এর প্রতি একটা অন্ধবিশ্বাস থেকে থাকে, তাহলে আমার আশঙ্কা- উপরের এই চিত্র এবং সমীকরণ আপনার সেই বিশ্বাসের মূলে একটা চিড় ধরাতে পেরেছে !


চিত্র-ii

যদিও ‘টাও’ এর পক্ষে অনেক যুক্তিই রয়েছে, কিন্তু উপরের ছবিটা বোধহয় সবচেয়ে মারত্মক যুক্তি। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি Bob Palais এর সেই ‘এক চক্র’ এর বাস্তব রূপ। যার সংজ্ঞাটা এখন সহজেই করা যাবে: ‘টাও’ হল রেডিয়ান পদ্ধতিতে বৃত্তের এক চক্র পরিমাপের একটি একক। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ‘টাও’কে মুখস্ত করার কিছু নেই। বৃত্তের বারো চক্রের একভাগ হলো τ/১২, আট চক্রের একভাগ হলো τ/৮ । তাই ‘টাও’ এর ব্যবহার আমাদেরকে বৃত্তের কোণ-ব্যাসার্ধ সম্পর্কে একটা বাস্তব ধারনা তৈরি করতে অত্যন্ত সহায়ক এবং হিসাবের নিকাশের জন্যেও সহায়ক। যেমন: τ/১২ কেবলমাত্র একটা সংখ্যাকে নির্দেশ করে-

বারো চক্রের একভাগ = τ/ ১২ ≈ ৬.২৮৩১৮৫…/১২ = ০.৫২৩৫৯৮৮…

সবশেষে আমরা আরেকবার, চিত্র-i এবং চিত্র-ii থেকে দেখে নিতে পারি যে, ২π ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঝামেলাটা আসলে কোথায়। যদিও বৃত্তের এক চক্র ১τ মানে কিন্তু ২π –ই। তাই সংখ্যাগত দিক থেকে এই দুটি জিনিস এক হলেও, বাস্তবসম্মত চিন্তা করার ক্ষেত্রে ‘পাই’ এবং ‘টাও’ এর মধ্যে রয়েছে বিস্তার ফারাক।

[আর্টিকেলটা The Tau Manifesto এর ভাবানুবাদে লিখিত]