ক্লাসে ঢুকে আমাকে দেখেই হৈ চৈ করে উঠলো ফারজানা, স্বাতী আর চিত্রা। তিনজনই আজ এক সাথে এসেছে।
“ওয়াও নয়ন, তোকে তো দেখতে একেবারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লাগছে।”
“ফাজলামি করবি না স্বাতী, চড় খাবি।”
পিঠ থেকে ব্যাগ রাখতে না রাখতেই মন্তব্য করতে শুরু করেছে শয়তানগুলো। ফারজানা আরেক কাঠি সরেস। বললো, “একেবারে আফতাব স্যারের ছাট দিয়েছিস দেখছি। দি নিউ সূর্যমামা সেলুনে গিয়েছিলি নাকি?”

রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তুলনা তবু সহ্য হয়, কিন্তু আফতাব স্যারের সাথে তুলনা? আমি কি তাঁর মতো মাথায় বাটি বসিয়ে চুল কাটিয়েছি নাকি?
“উঁকুন হয়েছিল বুঝি নয়ন? একেবারে বেলমাথা করে ফেললে ভালো করতি।” চিত্রাও যোগ দিয়েছে এবার।

আমি চোখ গরম করে তাকালাম চিত্রার দিকে। তারা আমার এরকম রাগী রাগী চোখে তাকানোর নাম দিয়েছে অগ্নিদৃষ্টি। অন্যসময় এই অগ্নিদৃষ্টি কাজ করলেও আজ কোন কাজ হলো না। তারা হাসতে হাসতে আমার চুল সম্পর্কে মন্তব্য করছে তো করছেই।

মনে হচ্ছে আম্মুর ওপর রাগ করাটা আমার উচিত হয়নি। আম্মু শুধু বলেছিল নিজের চুল নিজে সামলাতে না পারলে কেটে ফেলো। আমারও রাগ উঠে গেলো দুম করে। এখন সেই রাগের খেসারত তো দিতেই হবে। বন্ধুদের হাসি-ঠাট্টা সহ্য করতে হবে। এখন ক্লাসের কাজকর্ম শুরু হয়ে গেলে বাঁচি।

ক্লাসের দেয়ালে লাগানো ঘড়ির দিকে তাকালাম। আটটা বাজতে এখনো ছয় মিনিট বাকি। মনে হচ্ছে আস্তে চলছে ঘড়িটা। জানি ঘড়ি ঠিকই চলছে কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আস্তে চলছে, কারণ আমি মনে মনে চাচ্ছি ক্লাস শুরু হয়ে যাক। এটার নাম আপেক্ষিকতা। আফতাব স্যার আমাদের সাথে আপেক্ষিকতা সম্পর্কে গল্প করেছিলেন একদিন। যেমন পরীক্ষার সময় মনে হয় ঘড়ি দ্রুত চলছে।

অ্যাসেম্বলির ঘন্টা বাজলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে অ্যাসেম্বলি হবে। এখন আমরা ক্লাসেই অ্যাসেম্বলি করি। আগে অ্যাসেম্বলির জন্য তিনতলা থেকে নিচে নেমে মাঠে জমায়েত হতে হতো। তারপর অ্যাসেম্বলি শেষে আবার তিনতলায় উঠে এসে ক্লাসে আসতে আসতে অনেক পরিশ্রান্ত হয়ে যেতাম। এখন আমরা যার যার ক্লাসেই নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাই। তাতে অনেক সুবিধা হয়েছে। গ্রীষ্মকালে রোদে দাঁড়াতে হয় না, বৃষ্টি হলে অ্যাসেম্বলি বাতিল করতে হয় না। আর সবচেয়ে বড় যে সুবিধাটা হয়েছে তা হলো ভোলানাথ স্যারের ধমক খেতে হয় না।

আমাদের ক্রীড়াশিক্ষক ভোলানাথ স্যার একজন মূর্তিমান আতঙ্ক। কথায় কথায় দাঁতমুখ খিচিয়ে এমন ধমক দেন যে মাথা ঘুরে যায়। অ্যাসেম্বলি চলাকালীন ফিসফিস করে কথা বললেও কীভাবে যেন শুনে ফেলেন তিনি। স্বাতী বলে ভোলানাথ স্যারের কান নাকি হাতির কানের মতো। না, হাতির কানের মতো বড় বড় কান নয়; হাতির কান যেরকম অনেক মৃদু শব্দও শুনতে পায়, সেরকম শুনতে পারা অর্থে হাতির কান। সাধারণ মানুষ যে শব্দ শুনতে পায় তার সর্বনিম্ন কম্পাঙ্ক হলো ২০ হার্টজ, আর সর্বোচ্চ কম্পাঙ্ক হলো ২০ হাজার হার্টজ। মানুষ ২০ হার্টজের কম কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায় না, আবার ২০ হাজার হার্টজের বেশি কম্পাঙ্কের শব্দও শুনতে পায় না। হাতি কিন্তু ১০ হার্টজের শব্দও শুনতে পায়। সেই হিসেবে স্বাতী ভোলানাথ স্যারের কানকে হাতির কানের সাথে তুলনা করেছে।

ভোলানাথ স্যার শুধু ধমক দিয়ে ঘটনা শেষ করে দিলে কোন অসুবিধে ছিল না। কিন্তু স্যার অদ্ভুত অদ্ভুত কায়দায় শাস্তি দেন। স্কুলে শারীরিক শাস্তি দেয়া এখন নিষেধ সেটা আমরা যেমন জানি ভোলানাথ স্যারও জানেন। কিন্তু তিনি শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক। সুতরাং তিনি শারীরিক শিক্ষা দেয়ার নামে শাস্তি দেন। এই তো সেদিন কলেজের দুই ভাইয়াকে এমন শাস্তি দিলেন যে আমরা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সেদিন অ্যাসেম্বলি শেষ করে আমরা তিনতলায় উঠে ক্লাসে ঢুকতে যাবো এমন সময় দেখলাম অর্ক, আবদুর রহিম, রবিন, সুব্রত সবাই আমাদের ক্লাসের সামনের বারান্দায় জড়ো হয়ে রেলিং-এ ভর দিয়ে নিচে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম দেখার জন্য।

দেখলাম মাঠের মাঝখানে ভোলানাথ স্যার দাঁড়িয়ে আছেন, আর কলেজের দুই ভাইয়া একজন আরেকজনকে কাঁধে নিয়ে মাঠে দৌড়াচ্ছে। এক চক্কর দিয়ে আসার পর ভোলানাথ স্যার আবার নির্দেশ দিলেন। এবার কাঁধের ভাইয়া কাঁধ থেকে নেমে অন্য ভাইয়াকে কাঁধে তুলে দৌড়াতে শুরু করলো। হাতে ইট নিয়ে দৌড়াতে বলাটা শাস্তি জানি। দুটো ইটের ভর ধরো ৫ কেজি। আর এখানে একজন মানুষকে কাঁধে নিয়ে দৌড়ানো। প্রায় দশ গুণ বেশি শাস্তি!

আফতাব স্যারকে আসতে দেখে সুব্রত হাতে স্কেল নিয়ে আমাদের প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে ক্লাসে ঢোকালো। কয়েক সেকেন্ড পরেই আফতাব স্যারকে দেখা গেলো। তিনি ক্লাসে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলেন না। ঘুরে গিয়ে রেলিং-এর কাছ থেকে নিচের দিকে তাকালেন। তারপর দ্রুত চলে গেলেন।

আমরা আবার বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। সুব্রত বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার বাধা আমাদের কৌতূহলের কাছে কিছুই না। এমনিতেই সে আমার নাম প্রতিদিন কয়েকবার করে লেখে তার নালিশের খাতায়। সবিতা ম্যাডাম যখন ক্লাসটিচার ছিলেন, খুব ধমক দিতেন। প্রায়ই বলতেন, “তোমার অভিভাবকের কাছে চিঠি পাঠানো হবে।” আফতাব স্যার ক্লাসটিচার হবার পর আমরা দেখলাম শাস্তি নামক একটা ব্যাপার যে পৃথিবীতে আছে এবং তা যে শিক্ষকরা ইচ্ছে করলেই শিক্ষার্থীর ওপর প্রয়োগ করতে পারেন সে ব্যাপারে কোন জ্ঞানই নেই আফতাব স্যারের। বেতের ভয় দেখিয়ে আমাদের দিয়ে যে কাজ কখনো করানো যেতো না, আফতাব স্যার হা হা করে হেসে হেসেই সেই কাজ আমাদের দিয়ে করিয়ে নেন। অর্থাৎ আমাদের মনকে ক্লাসে বেঁধে রাখেন। কিন্তু আফতাব স্যার ছাড়াও আমাদের আরো নয়জন টিচার আছেন। সুব্রত চাইলে তার নালিশের খাতা অন্য টিচারকেও দেখাতে পারে।

তো যাই হোক। আমরা দেখলাম আফতাব স্যার মাঠে গিয়ে ভোলানাথ স্যারের সাথে কথা বলছেন। আফতাব স্যারের কথা আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু ভোলানাথ স্যারের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। ভোলানাথ স্যার যেন আফতাব স্যারকেও ধমক দিচ্ছেন, “আমার কাজ আমাকে করতে দিন। আমি জানি আমার কী করা উচিত, কী উচিত নয়। আমি তাদের শারীরিক শাস্তি দিচ্ছি না, শারীরিক শিক্ষা দিচ্ছি।” আমার রাগ হচ্ছিল খুব। কেন আফতাব স্যার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধমক খেলেন ভোলানাথ স্যারের?

“অ্যাই কী হচ্ছে এখানে! ক্লাসে ঢোক সবাই।” হালিমা ম্যাডামের ‘হালুম’ শুনে আমরা দৌড়ে ক্লাসে ঢুকে গিয়েছিলাম। হালিমা ম্যাডামের ধমককে আমরা বলি ‘হালুম’। বাঘের মতো হুংকার দিতে পারেন তিনি।

একটু পরেই আফতাব স্যার ক্লাসে এসে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গি করে তাঁর আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছো তোমরা সবাই?” আমার অনেকদিন মনে হয়েছে স্যারকে ধরে কোন ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে যাই। এমন লাল লাল দাঁত বের করে হাসতে একটুও কি লজ্জা করতে নেই?

তার পরদিন মাঠে অ্যাসেম্বলি করতে গিয়ে খেয়াল করলাম ভোলানাথ স্যার যেন একটু চুপচাপ হয়ে গেছেন। অ্যাসেম্বলির পর প্রিন্সিপাল স্যার মাইক্রোফোনে ঘোষণা দিলেন, “আগামীকাল হইতে শিক্ষার্থীদের সার্বিক সুবিধার নিমিত্তে যার যার শ্রেণিকক্ষেই শ্রেণিশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রাতঃকালীন সমাবেশ অনুষ্ঠিত হইবে।” আমাদের স্কুলের বিজ্ঞপ্তিগুলো সাধুভাষায় লেখা হয়। শুনতে মজাই লাগে।

তখন থেকে আমাদের অ্যাসেম্বলি ক্লাসেই হয়। আমাদের বেশ সুবিধাই হয় তাতে। অর্করা বলে আমরা এই সুবিধা নাকি পেয়েছি আফতাব স্যারের জন্য। আফতাব স্যার নাকি ভোলানাথ স্যারের সাথে ঘটনার পর প্রিন্সিপালকে বুঝিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কিন্তু সেরকম কিছু মনে হয় না। আফতাব স্যারকে ভোলানাথ স্যার যেভাবে ধমক দিলেন, আফতাব স্যার পারবেন সেরকম ধমক দিতে? আমাদেরকেই ধমক দিতে পারেন না তিনি। পারেন তো কেবল যুক্তি দেখাতে আর হা হা করে হাসতে। অর্করা আফতাব স্যারকে নিয়ে আসলেই বেশি মাতামাতি করে। স্যারকে সূর্যমামা বলে ডাকে। ছেলেরা তো বটেই, আমাদের ফারজানা ও চিত্রাও মাঝে মাঝে সূর্যমামা সূর্যমামা করে। আফতাব স্যারকে আমার কখনোই সূর্যমামা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে না। এরকম উস্কোখুস্কো মানুষ কিনা হবে আমার মামা! আমার মায়ের কি ভাইয়ের অভাব হয়েছে?

অ্যাসেম্বলির ঘন্টা বাজার একশ দশ থেকে একশ বিশ সেকেন্ডের মধ্যে ক্লাসে আসেন আফতাব স্যার। আমরা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে হিসেব করে বের করেছি ক্লাসে আসতে কোন টিচারের কতক্ষণ সময় লাগে। ঘন্টা বাজার সাথে সাথে স্টপওয়াচ অন করে টিচার ক্লাসে আসার সাথে সাথে স্টপওয়াচ অফ করেছি। এভাবে পর পর দুই সপ্তাহ অর্থাৎ দশদিন পর্যবেক্ষণ করেছি। তারপর গড় সময় বের করেছি। এখন আমাদের ক্লাসের দশজন টিচারের প্রত্যেকের ক্লাসে আসতে কতক্ষণ সময় লাগে আমরা জানি। আমাদের ক্লাসরুম থেকে টিচারদের অফিসরুম পর্যন্ত দূরত্ব মেপে আমরা টিচারদের গতিবেগও হিসেব করে নিয়েছি। আফতাব স্যারের প্রভাবে আমাদের ভেতর বৈজ্ঞানিক সত্ত্বা জাগতে শুরু করেছে। আমাদের কথাবার্তায় এখন অনেক বেশি যুক্তি থাকে।

ঘন্টা বেজে গেছে। আজ বৃহস্পতিবার। আফতাব স্যার আসবেন থার্ড পিরিয়ডে। রবি থেকে বুধবার এই চারদিন আফতাব স্যার আসেন ফার্স্টপিরিয়ডে। অ্যাসেম্বলিও তিনি করান। আজ ফার্স্ট পিরিয়ড হালিমা ম্যাডামের। তিনিই অ্যাসেম্বলি করাবেন। হালিমা ম্যাডামের ক্লাসে আসতে গড় সময় লাগে চার মিনিট তের সেকেন্ড। তার মানে আরো সাড়ে তিন মিনিট পর তিনি আসবেন।

হালিমা ম্যাডাম আমাদের অংকের ম্যাডাম। ভীষণ কড়া। ক্লাস সিক্সে বিজ্ঞান পড়াতেন। তখন বিজ্ঞান বইয়ের দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনসহ সবকিছু মুখস্থ করতে হতো। নইলে ‘এবং’ এর জায়গায় ‘ও’ লিখলেও নম্বর কাটতেন তিনি। অর্ক এ নিয়ে যতবারই ম্যাডামের সাথে কথা বলতে গেছে ততবারই ধমক খেয়েছে। অর্ক জানে অনেক, পড়েও অনেক। কিন্তু পরীক্ষায় খুব বেশি নম্বর পায় না।

এবছর বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন আফতাব স্যার। বিজ্ঞান আমরা পড়ে ফেলেছি অনেক। কিন্তু পরীক্ষা কী রকম হবে কেউ জানে না। কারণ আফতাব স্যার বলেন, “শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাস করার জন্য পড়লে শিখবে না কিছুই। শেখার জন্যে পড়ো, দেখবে পরীক্ষায় এমনিতেই ভালো করছো।”

সুব্রত খাতা বের করে দেখছে আজ জাতীয় সঙ্গীত গাইবার পালা কাদের। আফতাব স্যার আমাদের ক্লাসকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন জাতীয় সঙ্গীত গাইবার সুবিধার জন্য। প্রত্যেক গ্রুপ সপ্তাহে একদিন জাতীয় সঙ্গীত গায়। যারা ভালো গাইতে পারে তাদেরকে স্যার পাঁচ গ্রুপের মধ্যে এমনভাবে ভাগ করে দিয়েছেন যেন কোন দলেই শিল্পীসংকট না থাকে।

আজ যারা জাতীয় সঙ্গীত গাইবে তারা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ অর্কদের দল। অর্কের সাথে চোখাচোখি হতেই সে বললো, “তোকে তো জন ডাল্টনের মতো লাগছে নয়ন।”
“কী বললি?”
“জন ডাল্টন। ইংরেজ বিজ্ঞানী। ডাল্টনের পরমাণুবাদ…”
“জন ডাল্টন কে আমি জানি অর্ক। পড়ালেখা শুধু তুই করিস না, আমরাও কিছু কিছু করি। কিন্তু ডাল্টনের সাথে আমার কী সম্পর্ক?”
“ডাল্টনের ছবির সাথে মিলিয়ে দেখিস। হাহা”
হাসছে শয়তানটা। জন ডালটনের সাথে আমার চশমাটা ছাড়া আর কোনকিছুরই মিল নেই। আর শয়তানটা আমাকে জন ডাল্টন ডাকছে! ইচ্ছে করছে একটা মারামারি লাগিয়ে দিই। কিন্তু কিছু করার আগেই হালিমা ম্যাডাম ঢুকলেন ক্লাসে।

বৃহস্পতিবার থার্ড পিরিয়ড আর ফোর্থ পিরিয়ডে আফতাব স্যার আসেন। এই আশি মিনিট সময়ের জন্য আমরা সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকি। এই দুই পিরিয়ড আমাদের বিবিধ ক্লাস। সবিতা ম্যাডাম যখন ক্লাসটিচার ছিলেন তখন আমরা গান গাইতাম এই সময়। আর ম্যাডাম মোবাইল ফোনে গেম খেলতেন বা ফেসবুক করতেন। আফতাব স্যার ক্লাসটিচার হয়ে আসার পর থেকে আমাদের অনেককিছুই বদলে গেছে। আমরা বিভিন্ন রকমের বৈজ্ঞানিক পড়াশোনা, কাজকর্ম করতে শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আমরা সূর্য ও পৃথিবী সম্পর্কে যে অনেক পড়াশোনা করেছি তা তোমাদের বলেছি আগে। আজকালের মধ্যেই আমরা নতুন কোন প্রজেক্ট শুরু করবো।

সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হবার দেড় মিনিটের মধ্যেই আফতাব স্যারকে দেখা গেলো ক্লাসের দরজায়। ঢলঢলে অ্যাপ্রোনটা যে ময়লা হয়ে গেছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই স্যারের। কুচকানো যে শার্টটা পরে আছেন সেটা গত রবিবার থেকে দেখছি স্যারের গায়ে। একটা শার্ট এই গরমে সারা সপ্তাহধরে কীভাবে পরেন কে জানে। ক্লাসে এসে প্রতিদিনই স্যার একটা বাক্য দিয়ে শুরু করেন, “কেমন আছো তোমরা সবাই?” আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
“আমরা ভালো আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন স্যার?” আমরা সমস্বরে বলি। স্যার লাল দাঁত দেখিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন, “আমার সাথে যাকে দেখছো সে তোমাদের নতুন বন্ধু।”

আমরা হা হা করে হেসে উঠি। মনে করি এটা স্যারের কোন নতুন বৈজ্ঞানিক খবর। প্রতি বৃহস্পতিবার ক্লাসে এসে স্যার আমাদের কয়েকটি নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গল্প করেন। আমরা ভাবলাম আজ সেরকম কোন অদৃশ্য মানব জাতীয় কিছুর গল্প করবেন।
“আপনার সাথে তো কেউ নেই স্যার।” আবদুর রহিমের গলা।
আবদুর রহিম আর কোন টিচারের ক্লাসে কথা বলে না। আফতাব স্যারের ক্লাসে তাকে খুব সক্রিয় দেখা যায়। আফতাব স্যারের ‘সূর্যমামা’ নামটি নাকি আবদুর রহিমের দেয়া।

স্যার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর সাথে কেউ নেই। একটু এগিয়ে দরজার কাছে গিয়ে ডাক দিলেন, “ইলোরা ইসলাম, এসো, ভেতরে এসো।”

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ব্যাগি জিন্‌স আর লাল টি-শার্ট পরা পুতুলের মতো একটা মেয়ে ক্লাসে এসে ঢুকলো।
“ও তোমাদের ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়েছে। তোমরা তাকে বন্ধু করে নাও।”

ইলোরা ইসলামকে দেখেই আমি খুশি হয়ে গেলাম। তার চুলও আমার চুলের মতো ছোট। ক্লাসে এখন আর আমি একাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা জন ডাল্টন নই।

ফারজানা ফিস ফিস করে বললো, “কী রে নয়ন, তুই জানতি নাকি যে সে আসবে আজ?”
“না, কিছুই জানতাম না। এটা কাক ডাকিল, তাল পড়িল।”
“মানে?”
“কাকতালীয়।”

ইলোরা ইসলাম ক্লাসে ঢুকে স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। স্যার বললেন, “তোমরা ইলোরা ইসলামকে স্বাগতম জানাও।”
আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম, “হ্যালো ইলোরা ইসলাম।”
ইলোরা ইসলাম তার ডানহাতটা সামান্য উঁচু করে বললো, “হাই, মাই নেম ইজ লুনা ফর মাই ফ্রেন্ডস।”

লুনার ইংরেজি উচ্চারণ একেবারে বিদেশীদের মতো। সে কি বাংলা জানে? নাকি ইংলিশ মিডিয়াম থেকে এসেছে? কৌতূহল হচ্ছে অনেক।
“লুনা ইজ এ বিউটিফুল নেইম, দি নেইম অব আওয়ার মুন।” আফতাব স্যার হঠাৎ ইংরজিতে বলে উঠলেন। আফতাব স্যারের ইংরেজি উচ্চারণ বাংলা উচ্চারণের চেয়েও খারাপ। এরকম ইংরেজি শুনলে আসমানি ম্যাডাম ক্লাস থেকে বের করে দেবেন। আসমানি ম্যাডাম আমাদের ইংরেজি প্রথম পত্র পড়ান। চলেন দীপিকা পাডুকোনের মতো, বলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো।
“ফারজানা আক্তার, ইলোরা ইসলামকে বসাও তোমাদের পাশে।” আফতাব স্যার ক্লাসের কাউকে ডাকনামে ডাকেন না। লুনাকেও লুনা বলে ডাকবেন না কখনো।

ক্লাসে প্রতি বেঞ্চে পাঁচজন করে বসার নিয়ম। কিন্তু আমাদের বেঞ্চে আমি, ফারজানা, চিত্রা আর স্বাতী ছাড়া আর কেউ বসে না। আমরা এত বেশি কথা বলি আর এত বেশি নড়াচড়া করি যে কেউই আমাদের পাশে বসে আরাম পায় না। দেখি লুনা কতদিন বসতে পারে।

বৃহস্পতিবারের বিবিধ ক্লাসে একটা বিবিধ প্রশ্নোত্তরের আসর থাকে। আমরা আফতাব স্যারকে যা খুশি প্রশ্ন করি, আর স্যার উত্তর দেন। এতে নাকি গঠনমূলক চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ে। স্যার বলেন, “প্রশ্ন করতে শিখতে হবে। যেকোনো নতুন কিছু জানার, নতুন কিছু আবিষ্কারের মূল চাবি হলো প্রশ্ন করা। রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছেন জ্ঞান অর্জন করার পর মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়।”

আমরা হেসে উঠি স্যারের কথায়। অর্ক বলে, “তাহলে তো স্যার খুবই সমস্যা। জ্ঞান হবার পরই যদি অজ্ঞান হয়ে যাই তাহলে তো সাথে ডাক্তার রাখতে হবে।”
“এই অজ্ঞান সেই অজ্ঞান নয়। তিনি আসলে বলেছেন, after knowing something, we become ignorant again। মনে করো তুমি জানতে চাচ্ছো একটা ইট ভাঙলে কী পাওয়া যাবে। ইটের গুড়ো। সেটা ভাঙলে কী? এভাবে ধরো ইটের অণু। তারপর সেই অণু ভাঙলে বিভিন্ন পরমাণু। সেই পরমাণু ভাঙলে ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াস ভাঙলে প্রোটন ও নিউট্রন। প্রোটন ভাঙলে কোয়ার্ক। কোয়ার্ক ভাঙলে কী? আমরা জানি না। এই যে না-জানার স্তরে পৌঁছানো এটাই হলো অজ্ঞান হওয়ার স্তর। আমরা যদি সব জেনে বসে থাকি তাহলে তো কোন কৌতূহল থাকবে না। আর কৌতূহ্ল না থাকলে কোন আবিষ্কারও হবে না।”

প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালনার দায়িত্ব একেক সপ্তাহে একেক জনের হাতে দিয়েছেন স্যার। আমাদের ক্লাসের সবাইকেই স্যার কোন না কোন দায়িত্ব দিয়েছেন এবং সেই কারণে আমরা সবাই ক্লাসে নিজেদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। আজকের প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালনার দায়িত্ব বিশাখার। নিয়ম হলো যারা যারা প্রশ্ন করবে তারা হাত ওঠাবে। আর পরিচালক একজন একজন করে সুযোগ দেবে। একই প্রশ্ন কেউ দুবার করতে পারবে না।

আজ আমরা অনেকেই আগে থেকে হাত উঠিয়ে বসে আছি প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতেই। দেখলাম আফতাব স্যারও হাত উঠিয়েছেন। বিশাখা স্যারকে বলার সুযোগ দিল।
“ইলোরা ইসলাম যেহেতু ক্লাসে আজ নতুন এসেছে এবং তোমাদেরও অনেক কৌতূহল হচ্ছে তার ব্যাপারে জানার, তাই আমার প্রস্তাব হলো আজকের প্রশ্নোত্তর পর্বে তোমরা ইলোরা ইসলামকে প্রশ্ন করবে এবং সে তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে।”
তারপর দশ মিনিট ধরে আমরা অনেকেই লুনাকে প্রশ্ন করলাম, লুনা উত্তর দিলো।
“তুমি আগে কোন্‌ স্কুলে ছিলে লুনা?”
“আই ওয়াজ ইন চায়না ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, বেইজিং”
“তুমি কি বাংলা বলতে পারো না?”
“কম কম স্পিক করতে পারি। সাম ওয়ার্ডের বাংলা এখনো জানি না। বাট আন্ডারস্ট্যান্ড করতে পারি।”
লুনার কথা শুনে আমরা বেশ মজা পাচ্ছিলাম।
“তুমি কি চায়নিজ ভাষা স্পিক করতে পারো?” মনে হলো ধ্রুব ভ্যাঙাচ্ছে লুনাকে। কিন্তু লুনা বুঝতে পারলো না। সাবলিলভাবেই উত্তর দিলো, “ইয়েস, আমি চায়নিক ভাষায় স্পিক করতে পারি।”

আমরা জেনে গেলাম লুনা সম্পর্কে অনেককিছু। লুনার বাবার কাজের সূত্রে লুনারা চীনে ছিল এতদিন। সম্প্রতি দেশে ফিরেছে। লুনাকে আমাদের বেশ ভালো লেগে গেলো। খুবই নিচুস্বরে কথা বলে সে, কিন্তু প্রত্যেকটি শব্দ খুব স্পষ্ট। আমাদের মতো হা হা করে হাসে না সে, কিন্তু মুখটা গম্ভীর করেও রাখে না। মনে হচ্ছে লুনার সাথে আমাদের বেশ বন্ধুত্ব হবে।

প্রশ্নোত্তর পর্বের পর শুরু হয় আমাদের বিজ্ঞানের আসর। আফতাব স্যার বললেন, “লুনা কিসের নাম তোমরা জানো?”
“ইলোরা ইসলামের নাম স্যার।” ভাস্করের কথায় আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। রাজু উৎসাহিত হয়ে বললো, “লুনা আমার খালার নাম স্যার।”
“মানুষের নামের কথা বলছি না। মানুষ ছাড়া আর কিসের নাম লুনা তোমরা জানো?”

মানুষ ছাড়া আর কিসের নাম? পশুপাখির নাম লুনা রাখে বলে তো শুনিনি। আমার খালা থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে নাকি একটা অ্যাক্টিভিটি পার্ক আছে – লুনা পার্ক। স্যার কি সেটার কথা বলছেন?
“লুনা ইজ দি নেম অব আওয়ার মুন।” পাশ থেকে ফিসফিস করে বললো লুনা। মনে পড়লো স্যার কিছুক্ষণ আগেই বলেছিলেন সেকথা। লুনা আমাদের চাঁদের নাম।
“হ্যাঁ, আমাদের চাঁদের নাম লুনা। প্রাচীন রোমানরা চাঁদকে দেবী মনে করে নাম দিয়েছিল লুনা। আসলে আমাদের চাঁদের নির্দিষ্ট কোন নাম নেই। চাঁদ, চন্দ্র, মুন, লুনা, ডায়ানা, এরকম আরো অনেক নামে ডাকা হয় আমাদের চাঁদকে। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মোট চাঁদের সংখ্যা ১৮১। এটা বর্তমানের হিসেব। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। এই চাঁদগুলো সব আমাদের চাঁদের পরে আবিষ্কৃত হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ কোটি বছর ধরে এই চাঁদ দেখে আসছে বলে আমাদের পৃথিবীর চাঁদের কোন আসল নাম নেই। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন নাম আছে আমাদের চাঁদের।”
আমরা বুঝতে পারছিলাম সূর্য ও পৃথিবীর পর এবার আমরা চাঁদ সম্পর্কে কাজ করতে যাচ্ছি।
“আমরা কি স্যার প্রজেক্ট লুনা শুরু করতে যাচ্ছি?”
“হ্যাঁ। শুরু করে দাও। তার আগে দেখা যাক চাঁদ সম্পর্কে আমরা কে কী জানি। কে শুরু করবে? ব্যাক বেঞ্চ থেকে শুরু করো। আবদুর রহিম।”
“স্যার চাঁদ আমাদের মামা। আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা।”
সারা ক্লাস হা হা করে হাসতে শুরু করলো। ফারজানা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো, “আবদুর রহিম তো তোর ডায়লগ ঝেড়ে দিলো।”
মনে পড়লো সূর্য সম্পর্কে স্যারকে বলেছিলাম, “সূর্য আমাদের পরম আত্মীয়, আমরা তাকে মামা বলে ডাকি।”
“কোন কোন সংস্কৃতিতে চাঁদ কিন্তু মহিলা। যেমন লুনা। তাকে কি মামা বলে ডাকা যাবে?”
“তখন তাকে খালা বলে ডাকতে হবে স্যার। লুনা খালা।”
আবার হাসছে সবাই। স্যারও হাসতে হাসতে বললেন, “তোমরা কিন্তু ইলোরা ইসলামকে আবার লুনা খালা বলে ডাকতে শুরু করো না।”
আমি নিশ্চিত যে ক্লাসের অনেকেই এখন সুযোগ পেলেই লুনাকে ‘লুনা খালা’ বলে ক্ষ্যাপাবে। কিন্তু মনে হয় না লুনা ক্ষ্যাপবে তাতে। সে এমনিতেই স্যারের কথায় বেশ মজা পাচ্ছে। ফিসফিস করে বললো, “আই লাইক দিস ক্লাস। সো ফানি।”
“তোমরা তো সবাই চাঁদ দেখেছো। আমাদের পৃথিবীর আকাশে যে দুটো উজ্জ্বল থালা দেখা যায় – তার একটি হলো সূর্য, অন্যটি চাঁদ। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় ছাড়া সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো যায় না। কিন্তু চাঁদের দিকে আমরা সবসময়েই তাকাতে পারি।”
“চন্দ্রগ্রহণের সময়ও তাকাতে পারি?”
“হ্যাঁ, চন্দ্রগ্রহণের সময় তো আরো বেশি করে তাকাতে পারি। চাঁদ নিয়ে আমাদের অনেক সংস্কার আছে এখনো। আমরা যত বেশি জানবো তত বেশি সংস্কারমুক্ত হতে পারবো। তোমরা চাঁদ সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করে দাও। লাইব্রেরিতে অনেক বই আছে। লাইব্রেরির কম্পিউটারে ইন্টারনেট আছে। ইন্টারনেট থেকে অনেক ছবি ও তথ্য পাবে। তিন-চারজন মিলে এক একটা গ্রুপ করে নাও। আর কাজে লেগে পড়ো। তার আগে আমাদের একটা কাজ করতে হবে। এবছর মানে ২০১৬ সালটা আমাদের জন্য একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। এবছর নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখ চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসবে। ফলে পৃথিবী থেকে সেদিন চাঁদকে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় দেখা যাবে। ৬৮ বছর আগে ১৯৪৮ সালের ২৬ জানুয়ারি চাঁদ এরকম কাছে এসেছিল। এবছর ১৪ নভেম্বরের পর এরকম কাছে আসবে আবার ২০৩৪ সালের ২৫ নভেম্বর। ততদিনে তোমরা কত বড় হয়ে যাবে, কত দূরে চলে যাবে। তাই আমি চাই তোমাদের সবাইকে নিয়ে এবছর কাছে আসা চাঁদ দেখতে।”
“সুপারমুন স্যার।” অর্ক মন্তব্য করে।
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছো সুপারমুন। সুপারমুন আসলে প্রতিবছরই দেখা যায় তিন-চারবার। কিন্তু আমি যে চাঁদের কথা বলছি সেটা হবে সুপারসুপারমুন। অনেক বছর পরপর দেখা যায়।”
“আমরা কি স্যার খালি চোখে দেখবো নাকি দূরবীণ দিয়ে দেখবো?”
“খালি চোখে তো আমরা চাঁদ সবসময়েই দেখি। আমি চেষ্টা করছি একটা দূরবীণ জোগাড় করতে। আমাদের হাতে অনেক সময় আছে। আশা করি ততদিনে জোগাড় হয়ে যাবে। অন্যান্য ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও দেখবে। তাই তোমরা সবাই যেন দূরবীণে চোখ রাখার সুযোগ পাও সেজন্য একটা কমিটি গঠন করা দরকার।”
“চাঁদ দেখা কমিটি স্যার?”
“অনেকটা সেরকম। কিন্তু চাঁদ দেখা কমিটি বলা যাবে না। কারণ চাঁদ দেখা কমিটির সুনির্দিষ্ট কাজ থাকে।”
“ঈদের চাঁদ দেখে।”
“আমাদের কমিটির একটা অন্যরকম নাম দেয়া দরকার। তোমাদের মতামত শোনা যাক এ ব্যাপারে।”
আমরা বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করতে শুরু করলাম।
“মুন সাইটিং কমিটি”
“মুন সিইং কমিটি”
“দি নিউ মুন সোসাইটি”
“চাঁদ দি মুন”
“লুনা খালা পরিষদ”
কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না। আমি বললাম, “স্যার চন্দ্রদর্শন পরিষদ রাখলে কেমন হয়?”

দেখলাম সবাই সমর্থন করলো আমাকে। অর্ক সাধারণত আমার সাথে একমত হয় না কোনদিন। দেখলাম সেও সমর্থন করলো আমার প্রস্তাব। আফতাব স্যার বললেন, “চন্দ্রদর্শন – খুবই সুন্দর শব্দ। তবে আমরা তো শুধু দর্শন করবো না, আমরা আরো ভালোভাবে দেখবো টেলিস্কোপ দিয়ে। তাই চন্দ্রদর্শনের বদলে চন্দ্রবীক্ষণ হলে আরো অর্থবহ হয়। চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদ। তোমরা কী বলো?”

আমরা সবাই চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদের পক্ষে রায় দিলাম। সুপারসুপারমুন দেখার জন্য চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদ গঠিত হলো। কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ছয় জনের একটা টিম গঠিত হলো। সেই টিমে সুব্রত, অর্ক আর রবিনকে রাখা হলো ছেলেদের প্রতিনিধি হিসেবে। আর মেয়েদের প্রতিনিধি হিসেবে রাখা হলো আমাকে, ফারজানাকে আর লুনাকে।

লুনা মনে হয় ব্যাপারটা শুরুতে বুঝতে পারেনি। যখন বললাম, “তোমাকে চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদের প্রতিনিধি করা হলো ” সে আপত্তি জানালো। বললো, “আই কান্ট বি আ রিপ্রেজেন্টেটিভ অব ইওর চান্ড্রোবিক্ষণ পারিষাড”।
“হোয়াই?” ইংরেজি মনে হয় ছোয়াঁছে ভাষা। লুনার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার মুখ থেকেও ইংরেজি বেরিয়ে আসছে।
“আই অ্যাম সেলিনোফোবিক।”
“কী?”
“আমার সেলিনোফোবিয়া আছে।”
সেলিনোফোবিয়া! লুনার কথা শুনে আমি ফারজানার মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম সেও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার মানে সেও জানে না সেলিনোফোবিয়া শব্দের অর্থ।

আফতাব স্যার আমাদের কথা শুনতে পেয়েছেন। দেখলাম স্যার সিরিয়াস চোখে তাকিয়ে আছেন লুনার দিকে। লুনাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি নিশ্চিত যে তোমার সেলিনোফোবিয়া আছে?”
“নট শিওর স্যার। বাট আমি থিংক করি।”

লুনার মুখে হাসি দেখে আমরাও হাসলাম। আমরা সেলিনোফোবিয়া শব্দের অর্থ জানি না বুঝতে পেরে স্যার বললেন, “ক্লাসে লুনা ছাড়া আর কেউ জানো সেলিনোফোবিয়া (selenophobia) শব্দের অর্থ কী?”

কেউ কিছু বলছে না। ভাস্কর বললো, “সেল ফোন ফোবিয়া। মানে মোবাইল ফোন ভয় পায়।”
হাসির কথায় হা হা করে হাসা আমাদের অভ্যেস। লুনা হাসে নিঃশব্দে। ফারজানা বললো, “সেলিনা ম্যাডামকে ভয় পায়।”
সারা ক্লাস হা হা করে হেসে উঠলো আবার। হাসারই কথা। কারণ সেলিনা ম্যাডামকে স্কুলের কেউই ভয় পায় না। সেলিনা ম্যাডাম ক্লাস টুতে আমাদের ক্লাসটিচার ছিলেন। খুব সুন্দর গল্প বলতেন। আমরা সেলিনা ম্যাডামকে ভালোবাসি সবাই, কিন্তু ভয় পাই না কেউই।
আফতাব স্যার বললেন, “তোমার কথা কিছুটা ঠিক। সেলিনা ম্যাডামকে ভয় পায় না, সেলিনি ম্যাডামকে ভয় পায়। সেলিনি হলো গ্রিকদের চাঁদের দেবী। রোমানদের যেমন লুনা, তেমনি গ্রিকদের সেলিনি।”

প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করতো যে সেলিনির ভাই হচ্ছে সূর্যের দেবতা হেলিওস। হেলিওস দিনের বেলায় আকাশে থাকে। সন্ধ্যা হলে সেলিনি যায় আকাশে। ভোরের একটা দেবীও আছে গ্রিকদের। তার নাম ইওস। ইওস হলো সেলিনির বোন। পৃথিবীর অনেক সংস্কৃতিতেই চাঁদ ও সূর্যকে ভাইবোন কল্পনা করা হয়। আমরা অবশ্য চাঁদকে মামা ডাকি, আবার সূর্যকেও মামা ডাকি – তাতে মনে হয় চাঁদ ও সূর্য ভাই-ভাই আমাদের সংস্কৃতিতে।

লুনা চাঁদ ভয় পায় শুনে খুব অবাক হয়েছি। চাঁদকে কেমন ভয় পায় জানা দরকার। চাঁদ নাকি চাঁদের আলো? এমন সুন্দর চাঁদের আলো কেউ ভয় পায় এটা কল্পনাও করতে পারছি না।

আফতাব স্যার বলছেন, “ভয়কে এড়িয়ে চললে ভয় বাড়ে। ভয়কে জয় করার প্রধান উপায় হলো ভয়ের মুখোমুখি হওয়া। চাঁদ সম্পর্কে যতই জানবে, দেখবে চাঁদ একটি বড়সড় গোলাকার পাথর ছাড়া আর কোন কিছুই নয়। এই পাথরটি মহাকর্ষ বলের টানে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে অবিরত।”
“স্যার, চাঁদে কি মানুষের মুখ দেখা যায়?”
“চাঁদ সম্পর্কে অনেক কাল্পনিক কাহিনি আছে পৃথিবীজুড়ে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মানুষ কত কিছু ভেবেছে। কেউ ভেবেছে চাঁদে এক বুড়ি বসে বসে চরকা কাটছে। কেউ কেউ ভেবেছে চাঁদে খরগোশ আছে। আমাদের দেশে সম্প্রতি কেউ কেউ বলেছে চাঁদে যুদ্ধাপরাধীর মুখ দেখা গেছে।”
আমরা সবাই হা হা করে হেসে উঠলাম।
“চন্দ্রানন শব্দের অর্থ জানো?”
“চাঁদের মত মুখ স্যার। সুন্দর অর্থ ব্যবহৃত হয়।”
“অথচ তোমরা দেখবে চাঁদে কী পরিমাণ ধুলোর স্তর জমে আছে। আর কী বিরাট বিরাট গর্ত, উঁচুনিচু পাথরের পাহাড়। এসব যখন নিজের চোখে দেখবে তখন আর চন্দ্রানন শব্দটাই ব্যবহার করতে ইচ্ছে করবে না।”

আমরা হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে চাঁদ সম্পর্কে অনেক আলোচনা করলাম। স্যার আমাদের তিন সপ্তাহ সময় দিয়েছেন চাঁদ সম্পর্কে পড়াশোনা করে চাঁদের উৎপত্তি, বিবর্তন, চাঁদের গঠন, পৃথিবীর ওপর চাঁদের প্রভাব, মানুষ কীভাবে চাঁদে গেলো এরকম সব দরকারি তথ্য জেনে নেবার জন্য। চাঁদ দেখতেই হবে এমন কোন নিয়ম থাকবে না এই শর্তে লুনা রাজি হয়েছে চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদের প্রতিনিধি হতে। পরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা চাঁদ সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে ফেললাম।

লুনার সাথে আমাদের ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ক্লাসের সবার সাথেই তার ভাব। সে খুব দ্রুত বাংলা শব্দ শিখে নিচ্ছে। এখন ধরতে গেলে সে একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে পুরো বাক্য বলতে পারে। ক্লাসের কেউ তাকে ‘লুনা খালা’ ডাকলেও সে রাগ করে না। এমন ভাবে তাকায় যেন সে আসলেই তার খালা। আমরা তার কাছ থেকে চায়নিজ ভাষা শেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনো ‘নি হাউ’ মানে ‘হ্যালো’ আর ‘শেই শেই’ মানে ‘থ্যাংক ইউ’ – এর বেশি এগোতে পারিনি। ক্লাসের পর সময় পেলেই আমরা লাইব্রেরিতে চলে যাই। লাইব্রেরিতে চাঁদ সম্পর্কে অনেক সুন্দর সুন্দর বই আছে, তবে বেশিরভাগই ইংরেজিতে। তাতে আমাদের তেমন কোন অসুবিধা হয় না। লুনা ভালো ইংরেজি জানে। তাছাড়া তার একটা ইলেকট্রনিক ডিকশনারি আছে যেখানে ইংরেজি থেকে ইংরেজি, ইংরেজি থেকে বাংলা, বাংলা থেকে ইংরেজি – সব রকমের শব্দার্থ পাওয়া যায় বেশ দ্রুত। পড়তে পড়তে আমরা শুধু বিজ্ঞান নয়, অনেক ইংরেজি শব্দও শিখে ফেলছি।

চাঁদ সম্পর্কে আমরা কী কী জানলাম এবার বলি তোমাদের।

####
বাকিটা “চাঁদের নাম লুনা” বইতে আছে। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে বইটি। প্রকাশক: মীরা প্রকাশন। বইমেলায় স্টল নম্বর ৪৪৪ ও ৪৪৫।