২০১৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম সার্ধশতবার্ষিকী পড়েছিল। সেই থেকে তাঁকে নিয়ে দেশের চার দিকে নানা রকম সভাসমিতি আলোচনা ও চর্চা হচ্ছে। মিছিল পদযাত্রা করে বিবেকানন্দের স্মরণ যজ্ঞ চলছে, তাঁকে তুলে ধরার হাজার রকম আয়োজন হয়ে চলেছে। রাজ্য সরকার পশ্চিম বঙ্গে তাঁর জন্মদিবসকে (১২ জানুয়ারি) ছুটির দিন বলে ঘোষণা করেছেন। সাধারণত আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ বিবেকানন্দকে দেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করেন। সেখানে তাঁর কাজ কর্ম চিন্তাভাবনা সবই ভালো, শ্রেষ্ঠ, এবং দেশের পক্ষে মঙ্গলময়। তিনি যা কিছু ভেবেছেন, করেছেন, সবই দেশের দশের ভালোর জন্য করেছেন, তিনি এই দেশের মাটি চিনতেন। তাঁর প্রদর্শিত পথই দেশের জন্য সর্বাঙ্গীন উন্নতির পথ। ইদানীং মার্ক্সবাদী বলে পরিচিত একদলও তাঁকে নিয়ে বেশ মাতামাতি করছেন। তাঁরা ভাবছেন, বিবেকানন্দের কিছু মর্মভেদী বাক্য উদ্ধৃতি দিয়ে দক্ষিণপন্থীদের, বিজেপি-আরএসএস প্রমুখর প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করবেন! পাশাপাশি কিছু চিন্তাশীল মানুষ আবার সেই মার্ক্সবাদী ও যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের নামেই ইংরেজ আমলের প্রথম ভাগে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় মুৎসুদ্দি বানিয়াদের দালালি ও তোষামুদির মাপকাঠিতে সমকালীন অন্যান্য মনীষীদের মতো তাঁরও যাবতীয় কার্যকলাপকে বুঝতে এবং প্রায় এক পংক্তিতে রেখে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন।

আমার মতে, এই সমস্ত পদ্ধতিই আদতে ভুল। কেন না, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে তিনি সেই সময়ের ও সমাজের একটা বিশেষ ধরনের ঘটনাক্রমের সৃষ্টি, আবার তিনি নিজেও এক বিশেষ রকমের প্রবল শক্তিশালী ঘটনাস্রোতের স্রষ্টা। এই দেশের জনমানসে তিনি তার জোরে একটি স্থায়ী আসন দখল করে নিতে পেরেছেন। তাঁর সেই কর্মকাণ্ড অবশ্যই বিস্ময়কর; তাই বলে তা বিচারের ঊর্ধ্বে নয়। তার সমকালীন সামাজিক-ঐতিহাসিক উৎস যেমন আমাদের খুঁজতে হবে, তার ভবিষ্যত বৈচারিক ফলাফল নিয়েও আমাদের মাথা ঘামাতে হবে।

স্ব-বিরোধিতার প্রেক্ষাপট

স্বল্পায়ু এই মানুষটিকে আমাদের বুঝতে হবে তাঁর ঝোড়ো কর্মময় জীবনের আলোকে। প্রথমে সারা ভারতে ভ্রমণ, তারপর দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, কখনও আমেরিকা, কখনও ইওরোপ। সেখান থেকে ভারতবর্ষে সতীর্থ ও শিষ্যবৃন্দের উদ্দেশে লেখা একের পর এক চিঠি, সেই চিঠির মাধ্যমে দেশের মঠ এবং মিশনের কাজকর্ম পরিচালনা, নানা সভাসমিতিতে ভাষণ — এর মধ্য দিয়ে আমরা একজন অতি শক্তিশালী ও প্রতিভাবান সংগঠক মানুষের পরিচয় পাই। আবার, একই সঙ্গে তাঁর চিন্তার উৎস ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সচেতন থাকলে একটি অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ে। সেটা হল, বিভিন্ন সময়ে তিনি একই বিষয়ে অনায়াসে পরস্পর বিরোধী মতামত দিয়ে যেতে পারেন। তিনি একবার নারী প্রসঙ্গে বলেন যে, আমেরিকার স্বাধীনচেতা মেয়েদের মত ভারতীয় মেয়েদেরও ঘরের চার দেওয়ালের আগল ভেঙে চক্ষুলজ্জার খোলস ভেঙে বাইরের জগতে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে পড়তে হবে। আবার আর এক জায়গায় বলে বসেন, সীতা সাবিত্রী দময়ন্তীর মতো লজ্জাশীলা পতিব্রতা নারীই ভারতীয় নারীত্বের আদর্শ হওয়া উচিত। এক জায়গায় তিনি হয়ত কঠোর ভাষায় জাতিভেদপ্রথার তীব্র নিন্দা করেন, ছুঁৎমার্গের বিরুদ্ধে কামান দাগেন। প্রায় সেই সময়েই আবার আর এক জায়গায় গিয়ে জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। একে এক বৈজ্ঞানিক সামাজিক বিন্যাস হিসাবে তুলে ধরেন। কখনও বলেছেন, ইসলাম ধর্ম তরবারি ও রক্তপাতের জোরেই সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছে, আবার অন্যত্র বলতে পারেন, তরবারির জোর নয়, সর্বজনীন সাম্যের আবেদনই ইসলাম প্রসারের পেছনে বড় কারণ। একজন সাধারণ মানুষকে এভাবে দু জায়গায় দুরকম কথা বলতে শুনলে স্বভাবতই তাকে আমাদের ভণ্ড অথবা মতিভ্রংশ বলে মনে হবে। কিন্তু সেই সরল যুক্তিতে এই সব মতবাদিক স্ববিরোধিতাকে বিবেকানন্দেরও ভণ্ডামি বা পাগলামি বলে মনে করলে সেটা ভুল হবে। এর আসল রহস্য আমাদের অনায়ত্ত থেকে যাবে।

কেন, ধাপে ধাপে বুঝিয়ে বলছি।

আসলে বিবেকানন্দের ভূমিকায় এই পৌনঃপুনিক স্ব-বিরোধী মতামতের ঐতিহাসিক উৎস খুঁজতে হবে সমকালীন ভারতবর্ষেই, যেখানে তখন ধীরে ধীরে এক নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা এবং ইংরাজিতে বহু দেশি সংবাদপত্র, গড়ে উঠছে আধুনিক নাট্যশালা, মঞ্চস্থ হচ্ছে একের পর এক দেশীয় নাটক। তার মধ্য দিয়ে দুর্বলভাবে হলেও বিরোধিতা করা হচ্ছে কিছু কিছু ধর্মীয় আচার বিচার কুসংস্কারের। যুক্তিবাদের উদয় হচ্ছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বাধীন মত প্রকাশ ও ব্যক্তিসত্তার বিকাশের আকাঙ্ক্ষা সমাজের আনাচে কানাচে ব্যক্ত হচ্ছে। বাবুবিলাস বাঈনাচ বা খেমটা-খেউড়ের পাশাপাশি, আসলে তাকে ধীরে ধীরে মধ্য মঞ্চ থেকে হঠিয়ে দিয়ে, নতুন ধরনের এক আধুনিক রুচি সম্পন্ন উন্নততর শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত নাটক সৃষ্টির পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়েছে। শক্তি ও ঋজুতায় তুলনামূলক হ্রস্বতা সত্ত্বেও এই সব লক্ষণ নিঃসন্দেহে ইতালির রেনেশাঁসের একেবারে ধ্রুপদী কার্বন কপি, যদিও হয়ত তার তৃতীয় কপি।

এই নবজাগরণেরই একজন কুশীলব বিদ্যাসাগর। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের আন্দোলন আপাত দৃষ্টিতে ভারতীয় সমাজের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ, হিন্দু উচ্চবর্ণের, ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র সীমিত ছিল। কারণ, বিধবা বিবাহের এই প্রশ্ন ইতিহাসের আঙিনায় বৌদ্ধ ধর্মে আড়াই হাজার বছর, খ্রিস্ট ধর্মে দু হাজার বছর এবং ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে দেড় হাজার বছর আগেই সমাধান হয়ে গিয়েছিল। তাঁর আর দুটো অ্যাজেন্ডা — বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহরূপী দুই চরম কুপ্রথার নিবর্তন — শুধু তাঁর জীবদ্দশায় নয়, বহুকাল পরেও কার্যকর হয়নি। তথাপি বিদ্যাসাগরের আন্দোলন ছিল আসলে, মর্মবস্তুতে, এক মতাদর্শগত অচলায়তনের বিরুদ্ধে লড়াই। এক নতুন ভিন্নতর জীবন দর্শনের উচ্চারণ। যা অনেক ঘাত প্রতিঘাত সত্ত্বেও শেষ অবধি এই দেশে, অন্তত এই বঙ্গভূমিতে, রয়ে গেল।

এই অচলায়তনের বিরুদ্ধে একটু দুর্বলভাবে হলেও আরও আগে থেকেই সংগঠিতভাবে মাথা তুলেছিল ব্রাহ্ম সমাজের বৌদ্ধিক আন্দোলন। যা ভাঙতে চেয়েছিল অসংখ্য দেবদেবী আর বীভৎস আচারবিচার বিধিনিষেধের কঠিন কারাগার। শ্রুতি-স্মৃতির শূন্যগর্ভ মায়াজাল। একেই তো সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্স তাঁর পূর্বসূরি হেগেলের অনুসরণে বলেছিলেন হাজার হাজার বছরের এশিয়াটিক অচলয়াতন। আর এই অচলয়াতন একটু একটু করে অন্য দিক থেকেও ভাঙতে শুরু করেছিল ইংরেজ বণিকের পণ্য সংগ্রহ ও বিক্রির বাস্তব ঔপনিবেশিক অর্থনীতির অমোঘ নিয়মেই। হাজার হাজার মাইল রেল পথের প্রচলন যার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষের এই সনাতনী কূপবদ্ধতাকে ভাঙার ক্ষেত্রে ইতিহাসের এক অসচেতন হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।

তবে অনেকেই যেটা লক্ষ করেন না, মার্ক্স কিন্তু আরও একটা জিনিস দেখালেন। খুব মূল্যবান কথা। এ পর্যন্ত হিন্দুস্থানের উপর দিয়ে শক হুন মোগলদের যেসব মতাদর্শগত আঘাত এসে পড়েছে হিন্দু রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ তাকে শেষ অবধি সামলাতে পেরেছে। আত্মরক্ষায় সফল হয়েছে। এমনকি অনেক কিছু অভিঘাত প্রায় হজম করে ফেলেছে। কেন না, তার সবই ছিল উভয় তরফে দুই সামন্তবাদী সংস্কৃতির সমানে সমানে টক্কর। একথার একটা প্রমাণ এই যে, সুদীর্ঘ সাতশ বছরের একটানা মুসলিম শাসনকালেও হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবনে এবং সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির দাপট কিন্তু এতটুকু কমেনি। কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শোষণ শাসনের প্রয়োজনেই ইউরোপ থেকে যে নতুন রাজনীতি অর্থনীতি বয়ে নিয়ে এল তার সাথেই এল — না, খ্রিস্টধর্মের পতাকার কথা বলছি না, সে এলেও তার অভিঘাত ছিল নগণ্য। তারা নিয়ে এল, অনেকটা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই — ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্ট বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ বাহিত এক আধুনিক উচ্চতর সাংস্কৃতিক গণতান্ত্রিক মানবতাবাদী ভাববিপ্লব, যাকে আর কেবলমাত্র পুরনো সামন্তী ভাবাদর্শের জোরে, হিন্দুধর্মের সনাতন শাস্ত্রবাক্যের ব্রহ্মতেজে, ব্রাহ্মণ্যবাদের অষ্টপদী শুণ্ড-জালিকায় ধরে বেঁধে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না।

বিবেকানন্দের কৃতিত্ব এই যে তিনিও তাঁর মতো করে এটা বুঝতে পেরেছিলেন। একথার সত্যতা বুঝতে হলে একটা ঘটনা মনে রাখতে হবে। তাঁর সামান্য আগে থেকে শুরু করে পরে আরও একদল ছিলেনবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভূদেব মুখোপধ্যায় শশধর তর্কচূড়ামণি বসন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ — যাঁদের উচ্চারিত গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী রক্ষণশীল মতামতের সাথে বিবেকানন্দের প্রচারিত ভাবধারার বিরাট কোনো মৌলিক পার্থক্য ছিল না। তাঁরা কিন্তু কেউই সেদিনকার বা পরবর্তী কালের বঙ্গীয় সমাজমানসে ততটা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেননি। ধর্ম বিষয়ক ধ্যানধারণার জন্য নয়, বাংলা ভাষার আধুনিক কথাসাহিত্যের স্রষ্টা হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্রের নাম লোকে আজও জানে, বাকিদের নাম বা মতবাদের কথা আজকের যুগের মানুষ বেমালুম ভুলে গেছে। স্কুল কলেজের পাঠ্য বইয়ের বাইরে তাঁদের আজ আর অস্তিত্ব নেই। অথচ বিবেকানন্দ সাধারণ মানুষের গহীন অন্তরে একটা বেশ দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারলেন।

কেন?

তার কারণ, সনাতন হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি যে রাস্তা নিলেন, এঁদের সকলের থেকে সেটা বেশ একটু ভিন্ন রকম। তিনি অন্যদের মতো সরাসরি আধুনিকতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার বা বর্জন না করে তার টুকরো টুকরো কিছু উপাদান গ্রহণ করার পথেই পা ফেললেন। গণশিক্ষা চাই, সাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রচার চাই। শুধু ধর্ম চর্চা নয়, তার সাথে জনসেবা করতে হবে। খালি পেটে ধর্ম হয় না। শিব জ্ঞানে জীব সেবা। “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর . . .”, ইত্যাদি। তার জোরেই তিনি অবক্ষয়িত হরপ্পা-দশাপ্রাপ্ত হিন্দুধর্মকে শক্তি জুগিয়ে আরও কিছুদিন অন্তত তার আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। এখানেই বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক ভূমিকা, এখানেই তাঁর চিন্তার সীমাবদ্ধতা, আবার এখানেই তাঁর চিন্তাধারায় ও বক্তব্যে প্রকট স্ববিরোধিতার উৎস নিহিত। তিনি মেলাতে গিয়েছিলেন এমন দুটো জিনিসকে যারা কখনই মিলতে পারে না।

না, এ তাঁর কোনো অসঙ্গতি নয়। দুর্বলতা নয়। সীমাবদ্ধতাও নয়। এ তাঁর রণকৌশল। তিনি জেনেশুনে ভেবেচিন্তেই এই পদ্ধতির ব্যবহার করে গেছেন। ভণ্ডামি করে নয়, মিথ্যাচারের অর্থে নয়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে হিন্দুধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার তাগিদে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত জোর গলায় হিন্দু সমাজের সর্বোচ্চ (আসলে সর্বনিম্ন) স্তরের কুসংস্কার কুপ্রথাকেও সমর্থন করেছেন। সতীদাহ প্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের মতো প্রথাকেও ভালো বলেছেন। আবার, দেশের ভেতরে হিন্দুধর্ম-আশ্রিত অন্ধ ভক্তদের কাছে সমান উচ্চস্বরে সমস্ত কুপ্রথা কু-আচারের নিন্দা করেছেন! মিথ্যাচার বা ভণ্ডামি হলে উল্টোটাই করার কথা। সস্তার জনপ্রিয়তা অর্জন করার লোভে তা তিনি করেননি। তাঁর এই দুরকম বক্তব্যই প্রচারিত হয়েছে। প্রচার যাতে হয়, তিনি সেই দিকেও নজর রেখেছেন। উদ্দেশ্য, যার যাতে সন্তুষ্টি সে যেন তা বেছে নিতে পারে।

আবার, প্রচলিত ধর্মীয় আচরণ ও পদ্ধতির বিরোধিতার কারণেই তিনি বৃহত্তর হিন্দুমানসে এমন সাড়া জাগাতে পারলেন। এতদিনকার ধর্মীয় অন্ধতা বা কুসংস্কারও তাঁর নতুন ব্যাখ্যায় আবার এক রকম যুক্তিগ্রাহ্যতা ফিরে পেল। জাতিভেদ পেল এক কষ্টকল্পিত সমাজবৈজ্ঞানিক সমর্থন। বৈধব্যপালনকে তিনি দিলেন এক দেবীসুলভ চিত্রকল্প। রামকৃষ্ণ আন্দোলনেও তিনি নতুন ধারা প্রবর্তন করলেন। রামকৃষ্ণর প্রকল্পিত ধর্মচিন্তায় সমাজ সেবা বা জনমুখী কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কালীঘাটের পুরনো মন্দিরের পাশে দক্ষিণেশ্বরের নতুন মন্দিরেরও খানিকটা প্রচার হোক, আর সেখানকার পূজক ঠাকুর হিসাবে তাঁরও সমাজে কিছুটা নামডাক হোক — এই ছিল তাঁর আন্তরিক মনোবাসনা। কাঙালিভোজন বা ভিখারিদের মধ্যে বস্ত্রদান — এসব তাঁর কর্মসূচি ছিল না। এর সবই ছিল রাণি রাসমণি এবং তাঁর জামাই মথুরা মোহন বাবাজীবনের জমিদারি পরিকল্পনার অঙ্গ। মন্দির প্রচারের স্বার্থে।

বিবেকানন্দের অন্যান্য গুরুভাইদেরও সার্বক্ষণিক সাধন ভজন পূজা আরাধনা — এর বেশি আর কিছু করার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা ছিল না। সেই যুবক দলের নেতা হিসাবে নরেন্দ্রনাথ কিন্তু এত অল্পে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি চাইলেন বড় কিছু করতে। এমন একটা কিছু, যা এর আগে কেউ করেনি শুধু নয়, ভাবেওনি। এইভাবে অচিরেই তাঁর মাথার মধ্যে খ্রিস্টীয় উদাহরণ দেখে দেখে হিন্দু ধর্মীয় মঠ বা মিশনের চিন্তা এসে গেল।

নিবেদিতার শাস্তি

অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মে সন্ন্যাসীর যে শাস্ত্র-নির্দিষ্ট সনাতন চেহারা, তারও বহু চিরাচরিত ‘প্রোটোকল’ বিবেকানন্দ ভেঙে দিলেন। সন্ন্যাস নিলেন, বিরজা হোমও করলেন, আবার সাংসারিক জীবনের সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক বজায় রেখে দিলেন। ভোজন-ব্যসনেও তিনি যেন ঢাকঢোল পিটিয়েই সাধারণ গেরস্থ ভোগী জীবনের সমস্ত উপসর্গ রক্ষা করে চললেন। এইভাবে বহু বিষয়ে প্রচলিত হিন্দু ঐতিহ্যকে কার্যক্ষেত্রে অবগ্রামিত করার ব্যাপারটা সনাতন মতাবলম্বী সতীর্থরা পছন্দ না করলেও তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ও দেশ-বিদেশ থেকে অর্থসংগ্রহের ক্ষমতার জন্য সেই মুহূর্তে কেউ কিছু বলতে বা করতে সাহস পাননি। কিন্তু সেই অপছন্দ প্রকাশ পেল বিবেকানন্দ অল্প বয়সে মারা যাওয়ার পরে পরেই। বিবেকানন্দের এই হিন্দু-শোধনবাদ তার গুরুভাইদের কাছে এতটাই পরিত্যজ্য ছিল যে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা ভগিনি নিবেদিতাকে চিঠি লিখলেন, চোদ্দ দিনের মধ্যেই তিনি যেন খবরের কাগজে ঘোষণা করে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্গে সমস্ত সংস্রব পরিত্যাগ করেন, অন্যথায় তাঁকে প্রকাশ্যভাবে বহিষ্কার করা হবে। প্রখর আত্মসম্মান জ্ঞানসম্পন্ন নারী নিবেদিতা অতঃপর দেরি না করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে মিশনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ ঘোষণা করলেন। হয়ত তাঁর মনে মনে আশা ছিল, এর ফলে অন্তত বিবেকানন্দের গুরুভাইদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য বজায় থাকবে। তাঁর সে আশা কিন্তু পূর্ণ হল না। বিবেকানন্দের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সেদিন তাঁর শ্রেষ্ঠ শিষ্যা আর তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তির মধ্যে তাঁরই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের উদ্যোগে বিচ্ছেদ ঘটে গেল। স্বামীজির “অপরাধ”-এর শাস্তি ভোগ করতে হল নিরীহ নিবেদিতাকে।

এর পেছনে অবশ্য আরও একটা, সম্ভবত আরও বড় কারণ ছিল। স্বামীজির জীবদ্দশাতেই নিবেদিতা ধীরে ধীরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছিলেন। বিবেকানন্দের অনেক উদ্দীপ্ত ভাষণেই দেশ নিয়ে স্বদেশ নিয়ে জ্বালাময়ী অনেক কথা ছিল। বিবেকানন্দের কাছে সেই দেশ ছিল দুহাজার বছর আগেকার প্রাচীন ভারত। যে কালে আসলে দেশের কোনো ধারণাই মানুষের মনে গড়ে ওঠেনি। নিবেদিতার তা নয়। আয়ার্ল্যান্ডের মানুষ হিসাবে তাঁর কাছে দেশপ্রেমের উপলব্ধি ছিল বর্তমান দেশ ভিত্তিক ধারণা। ঔপনিবেশিক পরাধীন ভারতের জন্য উদ্বেগ। বিবেকানন্দের এতে আপত্তি থাকলেও তিনি সরাসরি বাধা দেননি। বা, বলা ভালো, বিচক্ষণতাবোধেই বাধা দিতে চেষ্টাও করেননি। মিশনের বাকি সদস্যের কাছে মঠ ও মিশন শুধু মাত্র ধর্ম চর্চার জায়গা। সেখানে ব্রিটিশ শাসকের চোখে তাঁরা অপ্রিয় হতে চাইবেন কেন?

আজ অনেকে কল্পনাও করতে পারবেন না, সেই ১৯০২ থেকে ১৯১১ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত কী দুঃসহ আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে জীবন কাটিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। শায়া ব্লাউজ সেলাই করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করেছেন এবং বাগবাজারে স্ব-স্থাপিত মেয়েদের স্কুলের খরচ চালিয়ে গেছেন এই বিদেশিনী নারী। কোথাও কারোর কাছে অভিযোগ জানাননি, হাতও পাতেননি। আবার অভিমান নিয়ে স্বদেশেও ফিরে যাননি। এমনকি, বেঁচে থাকা কালীন তো নয়ই, মৃত্যুর সাত বছর পর অবধি তাঁর স্কুলের দায়িত্ব পর্যন্ত মিশন নেয়নি। অনাহারে অপুষ্টিতে কঠিন পরিশ্রমে তিনি শেষ কালে কালান্তক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলেন। কিন্তু মিশন তাঁর চিকিৎসা বা শুশ্রূষারও কোনো ব্যবস্থা করেনি। এই অবস্থার তাঁর শারীরিক অসুস্থতার খবর পেয়ে ব্রাহ্ম মতাবলম্বী জগদীশ চন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসু তাঁকে দার্জিলিঙের বাড়িতে নিয়ে যান এবং মৃত্যুর আগে কিছুটা সেবাযত্নের ব্যবস্থা করেছিলেন। তারও অনেক পরে ১৯২৪ সালে অভেদানন্দ দার্জিলিঙে বেড়াতে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে দেখতে পান, সেখানে নিবেদিতার কবরের উপরে কোনো স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত বসানো হয়নি। তিনি তখন স্বীয় উদ্যোগে সেই অবহেলিত সমাধির উপরে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেন। এসব কৃষ্ণ-খবর বর্তমান রামকৃষ্ণ মিশনের প্রকাশিত বিভিন্ন বইপত্রে বা নিবেদিতার জীবনী গ্রন্থে কেউ দেখতে পাবেন না। অধুনা দুষ্প্রাপ্য গিরিজা শঙ্কর রায়চৌধুরির “নিবেদিতা ও বাংলায় বিপ্লববাদ” গ্রন্থে এবং স্বামী অভেদানন্দের আত্মস্মৃতিতে এই তথ্যগুলি আলাদা আলাদাভাবে ধরা আছে।

এক-পা আগে আর দুই-পা পিছনে

আজ একথা সকলেই জানেন, বাংলার রেনেশাঁসের দুটি ধারা ছিল। একটা ছিল ভক্তিবাদী ধারা, আর একটা ছিল যুক্তিবাদী ধারা। রাম মোহন রবীন্দ্রনাথ হয়ে ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বে বা বঙ্কিম চন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিভাত ছিল আপসমুখী ধারা, যা আধুনিক গণতান্ত্রিক মানবতাবাদী চিন্তাধারা গ্রহণ করেও তার সাথে প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য বৈদিক-ঔপনিষদিক ও পৌরাণিক ঐতিহ্যকে মেলাতে চেয়েছিল। যাঁরা মনে করতেন, ইওরোপের তথাকথিত জড়বাদী সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের তলায় আজ চাপা পড়ে গেলেও আমাদের প্রাচীন আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির স্থান অনেক উঁচুতে। আধুনিকতায় অবগাহন করতে গিয়ে সেই গৌরবময় ঐতিহ্যকে ভুলে গেলে বা ছেড়া দিলে চলবে না। পক্ষান্তরে, লালন ফকির থেকে শুরু করে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর অক্ষয় কুমার দত্ত মাইকেল মধুসূদন দত্ত শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রেমচন্দ রোকেয়া সাখাওয়াত হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম কাজী আব্দুল ওদুদ প্রমুখর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল রেনেশাঁসের আর একটি উপশাখা, যার মধ্যে ছিল নানা মাত্রার যুক্তিবাদী চিন্তাস্রোত, যা প্রাচীন ঐতিহ্যকে সরাসরি বা পরোক্ষে অগ্রাহ্য করে আধুনিক জীবন ও মূল্যবোধকে বরণ করতে চেয়েছিল।

বিস্ময়ের সঙ্গে আজ লক্ষ করছি, অনেকেরই দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না যে সমাজতাত্ত্বিক লক্ষণ বিচারে বিবেকানন্দ এই দুই ধারার কোনোটাতেই পড়েন না। তাঁর চিন্তা ও কর্মের অভিমুখ হচ্ছে রেনেশাঁসের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। এমনকি, রামমোহন বা রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ধর্ম বা ঐতিহ্যের সাথে আপস থাকলেও তার প্রকৃত গতিমুখ হচ্ছে ধর্মীয় বৃত্ত থেকে আধুনিকতার বৃহত্তর আলোকিত পথে বেরিয়ে আসার দিকে। আর বিবেকানন্দের চিন্তাধারাতে আধুনিক মানসভুবনের অনেক ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি থাকলেও তার ঈপ্সিত গতিমুখ হচ্ছে নবজাগ্রত সংস্কৃতিক্ষেত্র থেকে সংকীর্ণ হিন্দু ধর্মীয় বৃত্তের মধ্যে আরও বেশি করে ঢুকে পড়া। সামনের দিকে নয়, পেছনের দিকে এগিয়ে চলা।

এই সূক্ষ্মবিচারের নিরিখে তাই বিদ্বান ইতিহাসবিদ প্রয়াত তপন রায়চৌধুরীর সাথে দ্বিমত ব্যক্ত করে আমি সবিনয়ে বলতে চাই, আর-এস-এস নয়, বামপন্থীরাই বরং বিবেকানন্দকে মাঝে মাঝে দক্ষিণপন্থী শিবির থেকে হাইজ্যাক করে তুলে এনে তাঁদের সমর্থনে ব্যবহার করার প্রয়াস পান। এ কথা ঠিক, তাঁর রচনায় উগ্র মুসলিম-বিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িক হিংসার সামান্যতম অবকাশও নেই। সেটুকু হয়ত আর-এস-এস-এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতেই পারে। কিন্তু তখনও এটা ভুলে গেলে চলবে না, যে মৌল বিশ্বাস-পৃক্ত মানসিকতা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষের আঁতুরঘর বা আশ্রয়স্থল, তার মোহজাল কেটে বেরিয়ে আসার মতো কোনো যুক্তি-বুদ্ধিগত দিশাও তাতে খোঁজ করে পাওয়া যাবে না। বরং আমি তপনবাবুকে বা তাঁর সঙ্গে সহমতাবলম্বীদেরকে লক্ষ করতে অনুরোধ জানাই, আর-এস-এস-পন্থীরা কেন কখনও রামমোহন বা রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের বৈদান্তিক-ঔপনিষদিক ধর্মবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও হাইজ্যাক করার চেষ্টা করে না; অগ্রাহ্য বা তাচ্ছিল্য করারই চেষ্টা করে থাকে। তারা নিশ্চয়ই ভালো করেই বোঝে, কোন ধরনের ধর্মবিশ্বাস তাদের হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের নরমেধযজ্ঞে কাজে দেবে, আর কোনটা দিয়ে তাদের কাজ একেবারেই হবে না।

আসল কথা হল, রামমোহন বা রবীন্দ্রনাথের ধর্মভিত্তিক চিন্তাভাবনা আমাদের আধুনিক যুক্তিবোধ বা সামাজিক ঐহিকতাকে ততটা পীড়িত করে না যতটা বিবেকানন্দের চিন্তার মাধ্যমে ঘটে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ-কল্পনাও বিবেকানন্দের হিন্দুভারত কল্পনা থেকে সম্পূর্ণতই ভিন্ন। বিবেকানন্দের মৃত্যুর সামান্য পরে ১৯০৯ সালে লেখা তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে যখন দেখি গোরা তার কঠোর হিন্দুত্ববাদী চেতনা থেকে অবশেষে এক ধর্মীয় লেবেল-মুক্ত ভারতীয় চেতনায় উত্তীর্ণ হয়, তখন সন্দেহ হয়, রবি ঠাকুর বুঝি আমাদের সাবধান করে দিলেন, দেশভক্তির কোন রাস্তাটা নিতে হবে। শরৎচন্দ্র তাঁর শেষপ্রশ্ন উপন্যাসে ত্যাগধর্ম চর্চার এক আশ্রমের কাহিনি ফেঁদে এবং তাকে নিয়ে কমলের মুখ দিয়ে নানা রকম সমালোচনা করিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাবকে আরও সম্প্রসারিত করে দিয়েছিলেন।

পক্ষান্তরে, বিবেকানন্দ শুধু ক্রম-অবক্ষীয়মান প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাননি, একই সাথে সেই যুগধর্ম-বিরোধী কর্মসূচি রূপায়নের স্বার্থে তিনি চিন্তা যুক্তি ও দর্শনের ক্ষেত্রে এমন অনেক গোঁজামিল ও পরস্পর বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের চিন্তায় মননে যুক্তিবৃত্তিতে এবং সংস্কৃতিতে একেবারে মজ্জাগত হয়ে গেছে।
তবে সেটা ভালো করে বোঝার জন্য আর একটি এযাবত অনালোচিত প্রসঙ্গ এখানে আমাদের তুলতে হবে।

সংগঠন-মনস্কতা

উনিশ ও বিশ শতকের ইতিহাস পাঠে আমরা দেখতে পাই, তৎকালীন ভারতের নানা রকম সামাজিক কার্যক্রমে রক্ষণশীলরা নিজেদের যেভাবে বেশ খানিকটা সংগঠিত করতে পেরেছিলেন, প্রগতিশীল শক্তির প্রতিনিধিরা তা একেবারেই পারেননি। বিবেকানন্দ দর্শনের দিক দিয়ে গোড়ায় খুব দৃঢ়চিত্ত আস্তিক ছিলেন না। তিনি যৌবনপ্রারম্ভে ডেভিড হিউম, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রভৃতিদের সংশয়বাদী চিন্তায় (agnosticism) মূলত আপ্লুত ছিলেন। তখন অবধি তাঁর যা বৌদ্ধিক বিকাশ বা অভিমুখ, তাতে তাঁর রামকৃষ্ণ শিবিরের চাইতে রেনেশাঁস শিবিরের দিকেই ঝুলটা বেশি হওয়ার কথা ছিল। অথচ তৎকালীন প্রগতিশীল আন্দোলনের ধারাকে যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, বিদ্যাসাগর রাজেন্দ্রলাল মিত্র অক্ষয় দত্ত প্রমুখ, কিংবা তাঁর সহপাঠী ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, তাঁরা কেউ তাঁকে তাঁদের শিবিরে যুক্তিতর্ক এবং/অথবা স্নেহ-প্রীতি দিয়ে আকৃষ্ট করে টেনে নিয়ে যেতে পারলেন না। এমনকি তার কোনো চেষ্টা পর্যন্ত করলেন না। তার বদলে বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন স্কুলে চাকরি নিয়ে তিনি পড়াতে এসে এক মাস বাদেই শিক্ষাদানে অবহেলার অভিযোগে বরখাস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীও তাঁদের পরিচালনাধীন একটি ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ে শূন্য পদ থাকা সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান রামকৃষ্ণ-সাহচর্যের কারণে তাঁকে চাকরি দিতে রাজি হননি।

ঠিক এই জায়গাতে রামকৃষ্ণের যত মত তত পথের আসল মর্মার্থটি আমাদের বুঝতে হবে। লক্ষ্য তাঁর সীমিত ও নির্দিষ্ট। কিন্তু কাকে কীভাবে কাছে টানবেন তা নিয়ে তাঁর নির্দিষ্ট কোনো পন্থা নেই। ব্যক্তি বিশেষের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে যেমন যেমন নমনীয়তা ও সহনশীলতা দেখালে কাজ হবে, তিনি সেইভাবে এগিয়েছেন। তা না হলে তাঁর পক্ষে যে বহু মানুষকে তাঁর দিকে জয় করে আনা সম্ভব হত না, রামকৃষ্ণ সেটা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই কেশব সেনের মত পণ্ডিত আবার গিরীশ ঘোষের মত মদ্যপ অথচ প্রতিভাবান নাট্যকার, কাউকেই ধরে ফেলতে রামকৃষ্ণের অসুবিধা হয়নি। শিক্ষিত যুবক নরেনের সংশয়বাদকে, তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বকে, তাঁর গ্রাম্য বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে যে কাটাতে পারবেন না তা তিনি বুঝে ফেলেছিলেন। তাই তিনি নরেনকে গানের মধ্য দিয়েই কাছে টেনে নিয়েছিলেন, এখনকার ভাষায় ‘রিক্রুট’ করেছিলেন। আশা করব, শব্দটাকে কেউ খারাপ অর্থে নেবেন না। রামকৃষ্ণের সাংগঠনিক দক্ষতাকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেবার জন্যই ভালো অর্থে নিতে হবে।

পাশাপাশি আমরা দেখি, বিদ্যাসাগর বা অন্যান্য প্রগতিপন্থীরা কিন্তু সেভাবে তাঁদের মতাদর্শে সেদিনকার সমাজ থেকে সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতিমান কাউকে নিজেদের উদ্যোগে রিক্রুট করতে পারেননি। তাঁর নিজস্ব বিচারের প্রসারের খাতিরেই যদি বিদ্যাসাগর সেদিন অক্ষয় দত্ত মধুসূদন রাজেন্দ্রলাল মিত্র ইত্যাদিদের নিয়ে একটা সমিতি জাতীয় কিছু গড়ে তুলতে চেষ্টা করতেন, মতবাদিক পত্রিকা চালাতেন, এবং/অথবা একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেন, তাঁর চিন্তাধারা সমাজে একটা স্থায়ী জায়গা পেয়ে যেত। যে কাজ রামমোহন রায় করেছিলেন।করেছিলেন। তাঁর আত্মীয় সভা, ব্রাহ্ম সমাজ, ইত্যাদি সংগঠন এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে বাংলা ও ইংরাজিতে প্রকাশিত একাধিক পত্রপত্রিকা বহু মানুষকে ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখার স্থায়ী ব্যবস্থা করেছিল। যার সূত্র ধরে আমরা রবি ঠাকুর বা প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতো একাধিক মনীষাকে পেয়েছিলাম। কিন্তু বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীরা সবাই যে যাঁর মতো একা একা থেকে গেলেন। বিদ্যাসাগর যে ছাত্রদের শিক্ষা প্রদানে কোনো রকম অযত্ন অবহেলা সহ্য করতেন না, সেটা জেনেও এবং তাঁর সেই আবেগকে যথোচিত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেও আমি বলতে চাই, নরেনকে স্কুল থেকে একবারে তাড়িয়ে দেবার আগে তিনি যদি তাকে কাছে ডেকে এনে জিগ্যেস করতেন, সে কী চায়, কেন সে পড়ানোতে মন দিতে পারছে না, তাতে কোথাও কোনো ক্ষতি হত না; বরং হয়ত এদেশের ইতিহাস আজ অন্য রকম ভাবে লেখা হতে পারত। শিবনাথ শাস্ত্রীর উদ্দেশেও আমাদের এই একই আক্ষেপ না জানিয়ে পারছি না। আসলে এইভাবে তাঁরা কেউ ভাবেনইনি।

রামকৃষ্ণের এই সংগঠন নির্মাণের ধারাকে বিবেকানন্দও একভাবে গ্রহণ রক্ষা ও সম্প্রসারণ করেছিলেন। প্রচার যাই হয়ে থাকুক না কেন, নানা তথ্য সূত্রে আমরা এখন জানি, ১৮৯৩ সালের শিকাগো ধর্ম মহাসভায় বিবেকানন্দের বাচন-সাফল্য বিরাট কিছু ছিল না। তাঁর তুলনায় সেদিন অনেক বেশি মঞ্চসফল্ হয়েছিলেন ভারত থেকে প্রেরিত অন্য দুজন প্রতিনিধি, প্রতাপ মজুমদার এবং ধর্মপাল। অথচ আজ কজন মানুষ তাঁদের নাম স্মরণ করতে পারে? তাঁদের আমরা আজ মনে করতে পারি শুধুমাত্র বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়েই। অতবড় মহাদেশ তুল্য দেশে একেবারে একা ঘুরে ঘুরে তিনি নিজের দিকে আমেরিকাবাসীর নজর আকর্ষণ করতে গিয়ে যেটুকু সফল হয়েছিলেন তাকে ধরে রাখতে এবং বাড়িয়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। বেশ কিছু সমর্থক জোগাড় করে ফেললেন। কয়েকটি শহরে সংগঠন গড়ে তুললেন। কিছুদিন কষ্ট করে থাকার পর লোকজন টাকাপয়সা সবই জুটিয়ে ফেললেন। আর ভেবে দেখুন, বয়স তখন তাঁর কত? সবে মাত্র তিরিশ পেরিয়েছে।

তাঁর আরও একটা কৃতিত্ব উল্লেখনীয়। তিনি জানতেন, সনাতন হিন্দু ধর্মে নতুন রিক্রুটমেন্টের কোনো জায়গা নেই। কারণ, হিন্দু ধর্মে রয়েছে জাতপাতের অলঙ্ঘ্য উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ। বিদেশের কাউকে বেদান্ত এবং সর্বব্রহ্মতত্ত্ব বুঝিয়ে তারপর তো আর বলা যায় না, “তুমি ভাই আমার ধর্মমতে ম্লেচ্ছ, তাই আমার ধর্মে এসে আপাতত শূদ্র থেকে কাজ শুরু কর, তারপর এক সময় হয়ত তোমাকে ব্রাহ্মণত্বে প্রোমোশন দেওয়া হবে।” তিনি নিজেও তো দত্ত বংশজাত, জাতে কায়স্থ। তিনিই বা শ্রুতি স্মৃতি অনুযায়ী ধর্মগুরু হবেন কীভাবে? বিবেকানন্দ এই সব সমস্যার সমাধানকল্পে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের মাধ্যমে রিক্রুটমেন্টের এই এলিয়েন (বিজাতীয়) সংস্কৃতি হিন্দু ধর্মে ঢুকিয়ে দিলেন। এই পথেই তিনি হিন্দু ধর্মকে এক অন্য ধারায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আচার-সর্বস্বতার বাইরে এনে বৌদ্ধ বা খ্রিস্ট ধর্মের মতো এক মিশনারি ধর্মে পরিণত করেছিলেন। বেদ-উপনিষদ-গীতা-চণ্ডী মনু-পরাশর জ্ঞানযোগ-পূজাপাঠ-পশুবলি সবই রইল। নিরাকার নির্গুণ নির্বিকল্প ব্রহ্ম এবং মুণ্ডমালিনী করাল দ্রংষ্ট্রাবিকশিত সাক্ষাৎ মা কালী পাশাপাশি রইল। ব্রাহ্মণ পুরোহিতটুকু শুধু বাদ গেল। হিন্দু ধর্ম তাঁর হাত ধরে হয়ে উঠল ব্রাহ্মণ-বর্জিত এক নব্য-ব্রাহ্মণ্যবাদ। এও তাঁর এক বড় সাফল্য বৈকি।

হিন্দু গণচিত্তে তাঁর চিন্তা ও কর্মের প্রভাবও এই কারণেই অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর হতে পেরেছিল।

কদাচ রাজনীতি নয়

আগেও একবার বলেছি, হিন্দু ধর্মের এই সমাজমুখীকরণের কার্যক্রমে অনেক সময় তাঁকে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের সুরে আবেগময় উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করতে হয়েছে। সেটা মিথ্যা নয়, ভণ্ডামিও নয়। আর দেশের আপামর জনসাধারণকে যে তিনি ভালোবাসতেন সেও মিথ্যা নয়। কিন্তু সেই মৌল ধর্মীয় কার্যক্রমের কারণেই তাঁর বাকি সামাজিক কর্মকাণ্ডে বাস্তব রাজনৈতিক আদর্শগত অর্থে (ব্রিটিশ বিরোধী) জাতীয়তাবাদী উপাদান বিশেষ জায়গা পায়নি। কেন না, সেই দেশ অনেক আগেকার এক রোমান্টিক স্বপ্নের দেশ। সীতা সাবিত্রী দময়ন্তীর যুগের দেশ! শ্রুতি স্মৃতি পুরাণের কালের দেশ। যা আসলে আধুনিক অর্থে কোনো দেশই নয়। বসতি মাত্র। বড় জোর জনপদ। ছোট ছোট নগর।

তাই স্বভাবতই, দেশ নিয়ে তাঁরই উচ্ছ্বাসপূর্ণ অগ্নিস্রাবী কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে যখন নিবেদিতা বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে উত্তরোত্তর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছিলেন, তাকে কিন্তু তিনি ভালো চোখে দেখেননি। মাঝে মাঝেই তাঁকে বলেছেন, ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে যে কোনো একটা বেছে নিতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সমগ্র ইতিহাসে রামকৃষ্ণ মিশনের কোনো রকম ইতিবাচক ভূমিকা বা অংশগ্রহণ নেই। এটা কোনো অভিযোগ হিসাবে বলছি না। নিছক ঘটনার বিবৃতি হিসাবে রাখছি। যেমন একালে, তেমনই সেকালেও বেশিরভাগ মানুষই রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকতেন। শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয় নিয়েই আত্মসংবরণ করতেন। সুতরাং মিশনের সন্ন্যাসীরাও যে রাজনীতি থেকে দূরে বসে বিশুদ্ধ ধর্ম চর্চার পথ বেছে নিয়েছিলেন, এটা তো আর তাঁদের কোনো দোষের ব্যাপার নয়। কিন্তু আজ যদি কেউ দাবি করেন, বিবেকানন্দর চিন্তা স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক ছিল, তিনি দেশমুক্তিভাবনার প্রধান উদ্গাতা ছিলেন, তখন এই তথ্যটি তার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে যাবে। নিবেদিতাকেও রামকৃষ্ণ মিশন বর্জন করেছিল এই দেশপ্রেমের প্রশ্নেই।

একথা ঠিক, তাঁর প্রবল উদ্দীপনাময় ভাষায় দেশকে ভালোবাসার কথায়, দেশের নিরন্ন বুভুক্ষু মানুষকে সেবা করার হৃদয়স্পর্শী আবেদনে সেই সময় এদেশের যুবকরা ব্যাপকভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সুভাষ বসুর মতো মানুষও হয়েছেন। কিন্তু সে তাঁদের নিজস্ব ব্যাপার। তাঁদের একটা প্রেরণার উৎস দরকার ছিল। সব মানুষেরই সমাজপ্রগতির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এরকম একটা আদর্শ ও চরিত্রের প্রাথমিক প্রেরণা-বিন্দুর প্রয়োজন হয়। হাতের সামনে আঁকড়ে ধরার মতো বাস্তব অনুপ্রেরণা না পেলে কাছাকাছি যা পাওয়া যায় তাকেই মানুষ মাথায় তুলে নেয়। নিজে যা চায়, পুরোটা দেখতে পাক বা না পাক, কিছু পেলেই মানুষ তার সেই প্রেরণা-উৎসের উপর নিজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যগুলিকে কল্পনায় আরোপ করে ফেলে। যা সে পেয়েছে বলে ভাবছে, তা যে তারই জমা দেওয়া সম্পদ ফিরে পাওয়া তা সে সচেতন মনে বুঝতে পারে না। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে সাম্প্রতিক কালে খ্রিস্টীয় ও ইসলামিক লিবারেশন থিওলজির ক্রমবর্ধমান প্রণোদন ভূমিকা এখানে স্মর্তব্য। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও সম্ভবত এই ঘটনাই ঘটেছিল।

যেমন দেখতে পাই আরও কিছু প্রেরণা-বিন্দু নির্মাণে। মহাভারত কাহিনির মূল আখ্যান রাজ্য ভাগ নিয়ে দুই জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যেকার রক্তক্ষয়ী লড়াই। তারই এক পক্ষকে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, নির্লজ্জ হত্যা-প্ররোচনাদায়ী ভাষণ সম্বলিত শ্রীমদ্ভগবত-গীতা হয়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলনের ন্যায়যুদ্ধের এক নৈতিক প্রেরণা গ্রন্থ। আবার সেই একই গীতায় বাংলার বিপ্লবীরা পান সশস্ত্র যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রেরণা, আর মোহনদাস গান্ধী দেখতে পান তাঁর প্রকল্পিত অহিংস যুদ্ধের নির্মল নির্দেশ। গীতাপাঠে এই দুটো জিনিস সত্যিই এক সঙ্গে দেখা যেতে পারে কিনা, তা নিয়ে আমাদের কারোর মনে লেশমাত্র সন্দেহ দেখা দেয় না। আমরা একই সঙ্গে বিদ্যাসাগর এবং বিবেকানন্দকে মহান সমাজ সংস্কারক এবং শিক্ষা সংস্কারক বলে ভাবতে পারি। আমরা গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর মিশনের নাম করে বেদান্ত ধর্ম প্রচারের স্বার্থে সামাজিকভাবে সংগৃহীত অর্থে আপন ঘর সংসার প্রতিপালনে, গার্হস্থ্য মামলার ব্যয় নির্বাহে, খরচ করার মধ্যে কোনো নীতিগত বৈসাদৃশ্য বা আদর্শচ্যুতি দেখি না। আমাদের মনে কখনও প্রশ্ন জাগে না, আমেরিকা ইংলন্ডের নারীরা যদি বিবেকানন্দ কথিত ও মহিমান্বিত আদর্শ মেনে সীতা সাবিত্রীর মতো লজ্জাশীলা গৃহবদ্ধ পর্দানশিন হতেন, তাহলে বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ মিশন গড়ে তোলার মিশন সফল হতে পারত কিনা। মিস মার্গারেট নোবলের কোনোদিন নিবেদিতা হয়ে ওঠা সম্ভব হত কিনা।

কিংবা, আমরা কেউ যখন কলকাতা থেকে বিমানে ভ্রমণ করে সেলফোন হাতে তিরুপতির মন্দিরে গিয়ে মামলা জিতিয়ে দেবার জন্য পুজো দিই, প্রার্থনা করি, তার মধ্যেও কোনো মতিভ্রম লক্ষ করি না। আমাদের ইসরোর বড় বড় বিজ্ঞানীরা অনায়াসে মহাকাশে রকেট নিক্ষেপনের আগে দুহাতের আঙুল ভর্তি লাল সবুজ সাদা পাথরসহ আংটি পরে বালাজি ভেঙ্কটেশের দরবারে বাতাসা বা ইডলি মানত করে আসতে পারেন। ভারতের বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষের মননচর্চায় এরকম যে হাজার একটা অসঙ্গতি পীড়াহীনভাবে সহাবস্থান করতে পারে তার পেছনেও আছে — আরও অন্যান্য কারণের পাশাপাশি — স্বামী বিবেকানন্দর চিন্তার অনভিপ্রেত সর্বাত্মক প্রভাব। অসংখ্য স্ববিরোধ চরিত্রে আচরণে পুষে রাখতে আমরা বাঙালিরা, এবং ভারতীয়রাও, কখনও একটুও অস্বস্তি বোধ বা বিবেক দংশন অনুভব করি না। আমাদের জীবনে নীতি-অনীতির বৈপরীত্য পরম নিশ্চিন্তে বাসা বেঁধে থাকে।

শিক্ষা

তথাপি আমি বলতে চাই, বিবেকানন্দের জীবন থেকেও আমাদের যুক্তিবাদীদের, বস্তুবাদীদের, বেশ কিছু শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু সেটা তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারা বা বাচনিক যুক্তিকলা নয়। নিতে হবে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, মানসিক দুঃসাহস, লক্ষ্যের একাগ্রতা, সাংগঠনিক কুশলতা ও বড় ও কঠিন কাজে নেতৃত্বদানের নৈপুণ্য। নিতে হবে তাঁর অননুকরণীয় কথ্য ও লিখিত গদ্য ভাষার সুকল্লোল নির্ঝর। দেশের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকিয়ে বারংবার নিরুপায় আক্ষেপে আজ মনে হয়, সেদিন যদি বিদ্যাসাগরের ভাবধারা আর বিবেকানন্দের সংগঠনবুদ্ধির মেলবন্ধন হত . . . ! Ж